(ফরহাদ নাইয়া’র ‘ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি’র বিপরীতমুখী পাঠ)
মেহেরাব ইফতি
লেখক ফরহাদ
নাইয়া তাঁর ‘ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি’ প্রবন্ধের পয়লাতেই সিভিল সোসাইটির
বাঙলায়ন বা সংজ্ঞায়নের তালাশে নিযুক্ত আছিলেন অথবা কোশেশ করতেছিলেন নয়া কোনো ভাষার
বোধগম্যতা দিয়া বুঝাইবার লাগি কি জিনিস এই সিভিল সোসাইটি; আমরা সেই দিকে যাইব না। আমরা এই
প্রত্যয় লইয়া অযথা হাঙ্গামা না করিয়া দেখব যে সিভিল সোসাইটি নামক ট্যাবলেটখানার গুণ ও নির্গুণ
কি কি। ফরহাদ নাইয়া গুণ
দেখাইতে গিয়া বলেন যে, আগেকার সিভিল সোসাইটির সাথে বর্তমান সিভিল সোসাইটির পার্থক্য এই জায়গায় যে, “ঐ সিভিল সোসাইটির আকাঙ্ক্ষা ছিলো
সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে রাষ্ট্র কাঠামোকে মজবুত করা”
সুতরাং, আমরা আগেকার সিভিল সোসাইটির অতি-অল্প পয়লা গুন বা নির্গুণ দেখিতে
পাইতেছি। আগেকার সিভিল সোসাইটি আছিল সাম্রাজ্যবাদী। লেখক আগেকার সিভিল সোসাইটির লগে
বর্তমানের সিভিল সোসাইটির পার্থক্য বলেন এইভাবে যে,
‘...যা আজকের
দুনিয়ার সিভিল সোসাইটির বিপরীত’। কিন্তু এই জায়গায় আমরা অমত করিব। আমরা মহাত্মা কার্ল মার্ক্সকে অ-শরীরে হাজির
করে দেখতে পাই ভিন্ন চিত্র। কার্ল মার্ক্স রাষ্ট্র আর সিভিল সোসাইটি, উভয়কেই বলতেছেন, ‘পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী তাঁবেদার’। সুতরাং, আমরা বুঝতে
পারি, বর্তমান সিভিল সোসাইটিও পূর্বেকার সিভিল সোসাইটির মতোই সাম্রাজ্যবাদকে তোয়াজ
করিয়া চলেন এবং কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদ ফ্রন্টের স্বার্থরক্ষার তাঁবেদারি করিয়াই
চলিতেছেন।
মহাজন গ্রামসির কথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্র
যখনই ভুল করে তখনই সিভিল সোসাইটি গা ঝাড়া দিয়া নিজের আকৃতি (দুর্গসম)
জানান দেয়।
মহাজন গ্রামসি তাই বলতেছেন, রাষ্ট্র দুর্গের বাইরের একখান পরিখা বিশেষের
বেশি কিছু নহে। আর সিভিল সোসাইটি হইল সেই শক্তপোক্ত দুর্গ। কিন্তু, প্রাসঙ্গিকভাবেই মহাজন গ্রামসির লগে
দ্বিমত করিতে হয়। কেননা পরিখা যদি রাষ্ট্র হইয়া থাকে তবে যে কোনো ভাবেই সিভিল সোসাইটি
দুর্গ নয়; তাঁরা হইতে পারেন পরিখার ঠ্যাং-ভাঙ্গা সৈনিক মাত্র। অতএব আমার মত,
রাষ্ট্র কখনোই
দুর্গের মত পোক্ত সিভিল সোসাইটি তাঁর রাষ্ট্র-যন্ত্রের ভেতরে পাইলিং করতে দিবে না
যদিও বা এটা স্রেফ পাহারাদার পরিখাও হইয়া থাকে। পক্ষে সাফাই গাইতেছে ক্যারদার্সের কথা, “দুর্বল ও খোঁড়া
রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে যে সিভিল সোসাইটি তার চেয়ে খোঁড়া আর কোনো জিনিস থাকতে
পারে না।” সুতরাং, সিভিল সোসাইটি যদি টিলাসমান দুর্গ
তুলিয়াও থাকে রাষ্ট্র গড়িয়াছে পাহাড় সমান প্রাসাদ;
এমনটা বিবেচনা
করা ছাড়া আমার কল্পনা করতে কষ্ট হয়।
সিভিল সোসাইটির আরো কয়েকপ্রস্থ গুণ
লেখক তাঁর আলোচনাতে দেখাইয়াছেন, যেমনঃ রাষ্ট্র (রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান) বহির্ভূত, দল বহির্ভূত, বাজার
ব্যবস্থার বহির্ভূত। কিন্তু, আমরা দেখি যে কোনো না কোনো ভাবে
বর্তমান সিভিল সোসাইটি এই সবগুলা বহির্ভূত বিষয়ের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখিয়া আঁতাত
গড়িয়া তুলিয়াছেন। টোটালিটারিয়ান
রাষ্ট্রের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সিভিল সোসাইটিও সেই ক্ষমতার নিপীড়নের লেজে
থাকেন। গ্রামসি যে পাল্টা আধিপত্যের দোয়া আমাদের কানে কানে শুধাইলেন, যেভাবে
সর্বহারারা পাল্টা শক্তির আধিপত্য দিয়া শাসনযন্ত্রে পৌঁছাইবে সেখানে সেই
সর্বহারাদের পাশে ভাই হিসাবে যেই সিভিল সোসাইটিরে পাওয়ার কথা,
তাঁরা আজ
রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঁথার তলায় গা দিয়া বইসা জিরাইতেছেন। মহাত্মা কার্ল মার্ক্স যে ‘রাষ্ট্রের
বাইরের সবকিছু সিভিল সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত’-এই কথা বললেন সেই সিবিল সোসাইটি নিজের
অন্তর কোন অন্তরে অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন তাহার খবর কে লইবে!
সিভিল সোসাইটির গর্ভে জন্ম নেওয়া নয়া
সন্তান ‘ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি’র দিকে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব যে
সামাজিক পুঁজিরে কেন্দ্রে রাইখা ও তার সাথের আরো কতকগুলি একইরূপী বৈশিষ্ট্যের উপর
ভিত্তি করে এই সোসাইটি গড়ে উঠেছে। লেখক সামাজিক পুঁজি কি পদ সেটার ব্যাখ্যাও
দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সামাজিক পুঁজি হচ্ছে ব্যক্তির সাথে
ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের পারস্পারিক সম্পর্ক আন্তঃসম্পর্ক’। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সামাজিক
পুঁজির যে সমরূপ গুনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠেছে সেটা “সমরূপ”; “অপররূপ” নয়। কেননা, সমাজবিজ্ঞানী
বর্দুর দেওয়া ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগের শক্তিশালী অবস্থান বিষয় হিসাবে উল্লেখ পায়
(১) সাংস্কৃতিক
কাঠামোবদ্ধ পরিচয় (২) সামাজিক স্বীকৃতি। আপনারা দেখেন, এইগুলা ‘সমরূপে’
অর্জন করা তো
সম্ভব হইবে কিন্তু ‘অপররূপে’
ব্যক্তি চাই কি সিভিল সোসাইটি হোক কিংবা ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটিতে-
কোনো জায়গাতেই তিনি ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন
ক্রিয়াকর্ম, ভিন্ন আদর্শ, ভিন্ন দর্শন লইয়া এগুলা কামাইতে
পারবেন না।
তারপরও লেখক ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটির ইন্ডিভিজ্যুয়াল ব্যক্তির দিকে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়া দেখতে সক্ষম হন। লেখক বলেন, ‘ইন্ডিভিজুয়াল নিজেই এখানে অনেক প্রভাবশালী হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। ইন্ডিভিজুয়াল তার পোস্ট কমেন্ট, রিপ্লের মাধ্যমে কোন আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় কোন বিষয়কে সামনে আনলে সেটিকে ঘিরে প্রচুর আলোচনা সমালোচনা হয়ে থাকে’। আমি লেখকের সাথে একমত যে, ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটিতে ইন্ডিভিজ্যুয়ালের যে একক ক্ষমতা তাঁর সে পূর্ণ ব্যবহার করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে লেখক ‘রামপাল’, ‘নো-ভ্যাট’, ‘শিশু রাজন হত্যা’র কথা উল্লেখ করেন। বোধকরি মহান দার্শনিক এরিস্টটল এমন ‘ব্যক্তি সত্তার মুক্তি’র কথাই বলিয়াছিলেন।
লেখক নানা তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটাইয়া দেখাইতেছেন ‘অনলাইন
চ্যাটরুম’ ব্যক্তির ফেস-টু-ফেস ডিসকাসন বা আলোচনা থেকে অনেক বেশি
ক্রিয়াশীল। রুশ ভাষা-দার্শনিক ভি. এন. ভলোসিনভ্ বলেন যে, ‘যে সব চিহ্নের সমগ্রকে ভাষা বলা যাবে, সেই সব চিহ্নের হাজিরা ছাড়া মতাদর্শের উৎপাদন সম্ভব নয়।’ আমি চ্যাটরুমের সমস্যা হিসাবে এটারে নোকতা ধরে আগাতে চাই। আমি বলতে চাই, চ্যাটরুম ক্রিয়াশীল-ইহা লেখক বস্তুত
সকল তথ্য দিয়াই প্রমান করিয়াছেন কিন্তু এর ‘ভাষিক কার্যকারীতা’ নিয়া লেখক কিছু
বলেন নাই। অনলাইন চ্যাটরুমে যে ডিসকাসন হয় তার ইন্টার-টেক্সটের কাছে বিপরীতজন কতটুকু পৌঁছাইতে পারেন তা গভীর আলোচনা যোগ্য। ‘মতাদর্শ উৎপাদন’ যদি ভাষার চিহ্ন দ্বারাই হাজির করতে হয় তাহলে সেই ভাষার ইন্টার-টেক্সটের কাছে সাবজেক্ট অথবা অবজেক্ট বেশিরভাগ সময়ই অনলাইন চ্যাটরুমে পৌঁছাইতে পারেন না। আর যদি ভাষিক পন্থায় সে মতাদর্শের কথা বোধগম্যরূপে সাবজেক্ট বা অবজেক্ট’র কাছে না পৌঁছায় তাহলে ‘ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি’র জন্য ইহা ভয়ানক বিপদ হইয়া উঠিবে।
আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে,
ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটির সীমানা আমরা কি করিয়া পরিমাপ করিব? এই সীমানা
নির্ণয় না করিলে লেখকের কথা মোতাবেক, ‘এখানে অনেক বেশি হুজুগে এবং
অগুরুত্বপূর্ণ হালকা মতামত দেয়ার প্রবণতা থাকলেও সে আলোচনায় আমরা যাব না’- কিন্তু
ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটির সীমানা নির্বাচনে আমাদের সে আলোচনা
আরো বেশি দরকারী কেননা পরবর্তীতে লেখক নিজেই বলেন,
‘...এখানকার সবচেয়ে
বড় সুবিধেটা হচ্ছে প্রত্যেক ইন্ডিভিজুয়াল-ই আওয়াজ তুলতে পারে’; আমার লেখকের
কাছে সবিনয় নিবেদন, এই প্রত্যেক ইন্ডিভিজ্যুয়াল-ই কি আলাদা-আলাদা রূপে ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটিতে
জায়গা পাইবে? আরো প্রশ্ন রাখি যে, যেহেতু ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি যে
কোনো সময়ে যে কোনো প্রান্তে তড়িৎ গতিতে তথ্য আদান-প্রদান করে এবং এর মাধ্যমেই দ্রুত
সিদ্ধান্ত নেয় সুতরাং এতে করে কি ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটির সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ
সময়ই প্রতিক্রিয়াশীলতার জালে জড়ায়ে যাইতে পারে না, এবং সেইসব সিদ্ধান্ত কি বেশিরভাগ সময়-ই ‘ফ্যালাসি’ কিংবা ‘থট-এরর’ এর পথে নিয়া
যাইতে পারে না?
এইসব থেকে পরিত্রান পাইবার জন্য ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি কি কি ব্যবস্থা নিবে তার উপরেই পরবর্তী সময়ের ‘আধুনিক ভার্চুয়াল সিভিল সোসাইটি’র গড় আয়ু নির্ভর করতেছে। আমীন।
২য় বর্ষ ।। ২য় সংখ্যা ।। বৈশাখ
১২২৪ ।।
আরজঃ রাষ্ট্রের এই
সংখ্যাটি পড়তে ‘রাষ্ট্র’ নামের উপর ক্লিক মারেন।
--------------------------------------------------------------------------------
লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com
--------------------------------------------------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন