(“আমি পাঠক বলছি” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে আমার পড়া বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। আমি
সর্বভুক পাঠক। যা পাই তাই গিলি। আমার কাছে মূল বিষয়- একটি বই সুখপাঠ্য কী-না।
সুখপাঠ্য হলে লেখক আস্তিক না নাস্তিক, মোল্লা না
ব্রাহ্মন, দেশি না বিদেশি, নতুন না পুরাতন, লেখায় গভীরতা আছে কী নেই
এসব বাছবিচার এ যাই না। লেখাটা পড়ে ফেলি। কখনো কখনো মতামত ও দেয়ার চেষ্টা করি।
পাঠক হিসেবে আমার এই কখনো কখনো দেয়া বক্তব্য হয়ত লেখকের/লেখকগোষ্ঠীর মনঃপূত না-ও
হতে পারে কেননা লেখার বিচারিক ক্ষমতা কখনোই একজন পাঠক আর লেখকের মধ্যে সমানভাবে থাকে
না। দৃষ্টিভঙ্গীও সমান হয় না। তবু পাঠক হিসেবে ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ থাকায় কলম
হাতে নেয়ার দুঃসাহস করলাম। আশা করছি, লেখকগণ
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আমার এই দুঃসাহস!)
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ আবদুশ
শাকুরের শ্রেষ্ঠ গল্প। আখতার মাহমুদ
ক’দিন আগে ট্রেন ভ্রমণের অবকাশ মিলে যায় হুট
করেই। পাশের খালি সিটে একজোড়া কপোত-কপোতীর জোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কপোতী এসে বসার
আয়োজন করে আর কপোত তীব্র সন্দেহমাখা প্রতিদ্বন্দ্বী চোখে আমাকে দেখে নেয় আপাদমস্তক। মাথার
ক্যাপ খুলে চকচকে টাকখানা
দেখিয়ে সুদর্শন কপোতকে আশ্বস্ত করি- তার সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতার
যোগ্যতা শূন্য! ক্যাপ
মাথায় থাকলে আমাকে কিঞ্চিত তরুণ দেখায় বটে তবে ক্যাপ ছাড়া গল্পটা ভিন্ন। কাজটা করি, মাথা
গরম হয়ে গেছে ট্রেনের ভ্যাপসা গরমে এমন ভাব করে ক্যাপখানা দিয়ে যত্নে চকচকে মাথায় বাতাস করতে করতে। আশ্বস্ত হয়ে কপোত আমার
কাছে মিনিট দুয়েকের জন্যে সিটটা ধার চায় বিনয়ে। উদার বদনে দিয়ে দিই ধার। মধ্যবিত্তের পথে-ঘাটে এইসব উদারতাই বোধহয় শক্তি। না দুর্বলতা?
মিনিট দুয়েকের জায়গায় মিনিট দশেক কেটে যায়, না
কপোত না ট্রেন কেউই নড়ে না। খানিক ইতস্তত করে আবদুশ শাকুরকে ব্যাগমুক্ত করি। তার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ এবারের যাত্রায় সঙ্গী। আবদুশ শাকুরকে এর আগে পড়া হয়নি। ফলে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ি- লেখক সাহেব, আমি
ত্যাদড় পাঠক। আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবেন তো? পারবেন তো সবগুলো গল্প আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিতে? নাকি
একটা দুটো গল্প পড়েই ফের ব্যাগ বন্দী হওয়া আপনার নিয়তি?
যে লেখক পড়ে না সে-কী আসলে লেখক? না
পড়ে লেখক হয় কেউ? কী-করে? কেমন করে? সে
উপায়টা আসলে কী? টাকা? টাকা থাকলেই বই হয়? লেখক
গজায়? অমন গজানো লেখকে কী আসে যায়? তাদের
ময়লার বিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়াটাই কী কাম্য নয়? আনন্দের নয়? স্বস্তির নয়?
কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু না করলে বইটা শুরু করতে
পারছিলাম না। কার না কার সিটে বসেছি, কখন এসে উঠিয়ে দেয় সে আশঙ্কা অস্থির করে রাখে
আর কেন যেন উপলব্দি করি কপোত-কপোতী আসলে
স্বামী-স্ত্রী নয়। দূরত্ব বেশি নয় বলে না তাকিয়েও
দৃষ্টি সীমায় এসে পড়ে- কপোত জড়িয়ে ধরছে কিন্তু কপোতী গায়ে ঢলে পড়ছে না। সহজাত বাঙালি মেয়ের
আড়ষ্টতা আচরণে। যে আড়ষ্টতা আমাকে নিশ্চিত করে
সমস্তটা অধিকার কপোতী এখনো ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু কপোত মাথা মোটা বলে নয় বরং এসব
মুহূর্তে বা সময়ে বা কালে পুরুষের চোখে রঙীন চশমা থাকে বলে বুঝে উঠতে পারছে না
আড়ষ্টতার ব্যাপারটুকু। অথবা কে জানে, টিপিক্যাল অনুসন্ধিৎসু অথবা নাক গলানো বিশ্রী মানসিকতাতেই অপ্রয়োজনীয় এসব ভাবছি। তাদের আচরণ, সম্পর্কের
বিশ্লেষণে আমার কাজ নেই। আমার তো প্রয়োজন ট্রেনটা ছেড়ে যাওয়া, সিটের দখল ফিরে পাওয়া আর আবদুশ শাকুরের পোস্টমর্টেমে নেমে পড়া। তবে আমার সিট খালি হতেই, ট্রেন
ছেড়ে যেতেই আরামদায়ক আলস্যে হেলান দিই সিটে বইপড়া
বাদ দিয়ে।
বেশ সকালে উঠেছি। একটু ঘুমিয়ে না-হয় লেখকের মনের অতলে সতেজ মস্তিষ্কে
ডুব দেয়া যাবে। তাতে করে লেখকের ত্রুটি-সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট ধরা পড়ে যাবে চোখে। আমার
চোখ পাঠকের, রুচি
বিচারকের। আর আমি তো জানিই, পাঠকের
সামনে লেখকের ক্ষমতা খুবই সীমিত। পাঠক চাইলেই মলাট না উল্টে অবজ্ঞা করে যেতে পারে
যে কোনো লেখককে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সারাজীবনও হতে পারে। কী আসে যায়
যদি পাঠক বই-ই না পড়ে? জীবনতো
থেমে থাকে না। তবে কী থেমে থাকে মনন-রুচি? চিন্তাশীলতা? থেমে থাকে কী ভাবনার গন্ডী, সংকীর্ণ
হয় কী দৃষ্টিসীমানা? বোধ? উপলব্ধি? অপাঠে
কী আসে না মানসিক বন্ধ্যাত্ব? অতি আত্মবিশ্বাস? দেমাগ? মিছে
প্রজ্ঞা? আচ্ছা
পাঠকই পড়ে যাবে কেবল? লেখকের
পড়ার দায় নেই? রুচি
ও মনন বিকাশের দায় নেই? যে লেখক পড়ে না সে-কী আসলে লেখক? না
পড়ে লেখক হয় কেউ? কী-করে? কেমন
করে? সে
উপায়টা আসলে কী? টাকা? টাকা
থাকলেই বই হয়? লেখক
গজায়? অমন
গজানো লেখকে কী আসে যায়? তাদের
ময়লার বিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়াটাই কী কাম্য নয়? আনন্দের নয়? স্বস্তির
নয়?
চোখ বন্ধ করতে চেয়েও খুব একটা সুবিধে হয় না।
খুব অল্পসময়েই পরের স্টেশনে ট্রেন থেমে হুড়মুড়িয়ে লোক ওঠে।
আমিও শেষতক তুলে নিই আবদুশ শাকুরের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’। মলাট
খুলি। ‘অসুখ’ গল্পটা শুরু করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই- ভদ্রলোক
রোমান্টিক ছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তার টাকার টানাটানি...
হুট করে কিছু টাকা পেয়ে নিজেকে রাজা-উজির ভেবে আর্থিক দৈন্যতার সংকোচ কাটিয়ে হলেও সন্তানদের নানা
প্রয়োজনে টাকাগুলো একে একে বিলিয়ে দেয়া... এসব রোমান্টিসিজম থেকেই আসে বলে মনে
করি। এইসব তথাকথিত অভাব-অনটনের উল্লেখ সেই আদিকালের। এতে গল্প কোথায়? লেখককে
তাচ্ছিল্য করে সামনে বাড়তেই, ল্যাং মেরে ফেলে দেন লেখক আমাকে। বুঝি- লেখক
মহাশয় আমার চেয়েও ত্যাদড়। আমি হুড়মুড়িয়ে কুপোকাত হয়েই দেখি গল্পটা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। আবিষ্কার
করি কেমন
করে একজন মধ্যবিত্ত পিতা-স্বামীর সীমাবদ্ধতা ঠিক-ঠাক গল্প হয়ে ওঠে। একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পিতা-স্বামীর সংসার
হয়ে ওঠে মিথ। মহাবিস্ময়। আমি মুগ্ধ হই। লেখককে আনমনে দিই এক লম্বা লাল
সালাম।
সমঝদারের মত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পরের গল্পে
(পাপেট) ডুবি, তবে হতাশ হই
এখানে ঠিকঠাক লেখককে রোমান্টিক পেয়ে। একজন কিশোর মায়ের চিকিৎসার স্বার্থে, বোনের
ভাত যোগাড়ের জন্যে মানুষের পকেট কাটতে প্রস্তুত-
এটা আসলে বাস্তবতাবর্জিত। এছাড়াও, আরো অবাস্তববাদী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যখন
গল্পকথক দেখেও না দেখার ভাণ করে। সহানুভূতিতে আক্রান্ত থাকে। এই যে, কিশোরটির
প্রতি গল্পকথকের সহানুভূতি- একে মনে হয়েছে লেখকেরই সহানুভূতি। এই মনে হওয়াটাই
গল্পটাকে মৃত করে তোলে আমার কাছে। আপনি লেখক হয়ে যখন কোনো চরিত্রের প্রতি
সহানুভূতি দেখিয়ে ফেলবেন, পক্ষপাতিত্ব
দেখিয়ে ফেলবেন তখন আপনি আসলে লেখক থাকেন না। নিজেই হয়ে পড়েন লেখার অংশ-চরিত্র। লেখার চরিত্ররা তখন হয়ে ওঠে লেখকের চেয়ে
প্রবল। লেখকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে না তখন চরিত্ররা- এটাই আসলে রোমান্টিসিজম। আপনি অরোমান্টিক
লেখক তখনি হবেন যখন আপনি পুরোটা সময় জুড়ে সচেতন থাকবেন- আপনি একটা গল্প লিখছেন বা
প্রবন্ধ বা অন্যকিছু। আপনার আবেগ শব্দের কারুকার্যে গল্পে ঠেসে-ঠুসে দেয়া বা কোনো চরিত্রের মাধ্যমে নিজের
ইচ্ছে-কামনা-বাসনা ফুটিয়ে তোলা আসলে কাজের বস্তু নয়। আপনার আবেগ অত্যন্ত সস্তা এবং ফালতু বিষয় ঠেকতে পারে
ভাবনা-সচেতন, মননশীল
পাঠকের কাছে। লেখায় অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত
আবেগের প্রকাশ থাকবে না। তবে সত্যিই যদি আপনি রোমান্টিক-ভাবালু দুর্বল লেখক হয়েই
বাঁচতে চান তাহলে লেখায় ঢালাওভাবে আবেগ চলতে পারে।
‘কয়েদি’ গল্পেও লেখক
একই ভুল করেন। রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হন। তা যদি না হতেন তবে কঠোরভাবে রুস্তমকে
বঞ্চিত করতেন। গল্পটায় বেশ মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের ঝলক ছিল। পাঠক রুস্তমের দিকে
ঝুঁকে থাকতে পারে সেটা অস্বাভাবিক নয়।পাঠক
যে কোনো চরিত্রের প্রতিই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু লেখকও কেন অমনটা
হবেন? লেখকতো
পারতেনই রুস্তমকে অতৃপ্ত কামনার হাহাকার উপহার দিতে।
রুস্তমের অনুক্ত হাহাকারে গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারতো সেখানেই, যখন মরিয়ম রুস্তমের কাছে অনুমতি চেয়ে বসে কয়েদি
স্বামীকে নিয়ে দেওয়ালের আড়ালে যেতে। কিন্তু লেখক শব্দের ক্ষমতায় চেয়েছেন রুস্তমকে
সুখি করতে। অথবা এটাও মনস্তাত্ত্বিকভাবে
অস্বাভাবিক নয় যে, নিজের তৈরী একটি নারী চরিত্রের প্রতি
নিজেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সেই দুর্বলতা তিনি ঢেলে দিয়েছেন রুস্তমের চরিত্রে।
তিনি মরিয়ম আর নিজেকে সুখি করতে চেয়েছেন অযথাই। সেটা করতে গিয়ে তিনি আরো প্রায় হাজার দুয়েক বা
তার কিছু বেশি শব্দ যোগ করেছেন যা আসলে চমৎকার গল্পটাকে মেরে ফেলেছে। নইলে এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠতম গল্প হতে পারতো
এটি।
‘এপিটাফ’ গল্পটা বেশ
নাড়া দিয়েছে আমাকে। বিশেষ করে একটি কদপর্দকহীন, আশ্রয়হীন, স্বজন-বান্ধবহীন
মানুষ যখন চায় বা আকাঙক্ষা করে মৃত্যুর পর হলেও যেন
কেউ তাকে স্বীকৃতি দেয়, যেন তার অস্তিত্ত্ব স্বীকার করে, যেন
বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তার সমাধি না হয়- তখন বেশ আলোড়িত হই। লেখককে আপন মনে হতে
থাকে। মানুষের এমনতর জটিল মনস্তত্ত্বকে সরল ভাষায় পাঠকের সামনে এনে দিলে সে লেখককে
আপনতো মনে হতেই হবে!
সবচেয়ে ভাললাগা গল্পটার সাক্ষাত আরো পড়ে ঘটবে
এটা না জেনেই দ্রুত সামনে লাফিয়ে ‘বোধিদ্রুম’ গল্পটা পড়ি এবং বিরক্তিতে শেষ করি। সিনেমাটিক, টিপিক্যাল
একটি গল্প। শেষে আবার দেখা যায় নারী চরিত্রটি
নিজের ভুল বুঝতে পারে, গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যেতে
চায়। যা আরো বেশি টিপিক্যাল করে তোলে গল্পকে। শহরের মানুষ কুটিল আর
গ্রামের মানুষ সরল এটা নিয়ে লক্ষ লক্ষ গল্প লেখা হয়েছে পৃথিবীতে। গ্রামের
মানুষগুলোই কিন্তু একসময় শহরে গিয়ে থিতু হয়ে সরল
থেকে কুটিল হওয়াটা স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে, মেনে নেবে। এছাড়াও গ্রামের মানুষদের জীবন
প্রণালী সরল এবং বৈচিত্রতা কম বলে কুটিলতাও তাদের কম। নইলে শহরের মানুষ যেমন সরল
হতে পারে গ্রামের মানুষও মহা কুটিল হতে পারে। এভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে যে, সরলতা
গ্রাম্য জীবনের অনেক বৈশিষ্ট্যের একটি মাত্র। প্রধানতম বৈশিষ্ট্য নয়। এ যুগে তো নয়-ই। অথচ গল্পে তা-ই দেখানো হয়েছে।
‘পুনর্মূষিকো’ গল্পটাকে
সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছি । এটিকে এই বইয়ের শ্রেষ্ট গল্প বলে মেনে নেয়া যায়। গল্পটার প্রথমে মায়ের সাথে কাল্পনিক কথোপকথনের অতিকথনটা না থাকলে গল্পটা আমার বিবেচনায় নিখুঁত হয়ে উঠতো। অমনতর
কথনের প্রয়োজনই ছিল না। তবে হয়তো পাঠকের আবেগকে উসকে দিতে চেয়েছেন লেখক ওই
অতিকথনের সহায়তায়। অস্বীকার করব না, কোনো পাঠক অশ্রুসজলও হয়ে উঠতে পারে ওই অংশটুকু পড়ে। কিন্তু
পাঠককে আবেক্রান্ত করে তোলার চেষ্টা করাটা কী লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? আমি লেখকদের ওসব আদিখ্যেতায় বিরক্ত হই।
গল্পে এসব আবেগের কচকচানি অসহ্য মনে হয়। তবে সামনে এগোতেই গল্পটা আমাকে পেয়ে বসে।
আচ্ছন্ন করে। আতংকিত হয়ে ভাবতে থাকি- লেখক এই গল্পটাকেও নষ্ট
করে দেবেন না তো? আত্মহত্যা
করে বসবে না তো হতচ্ছাড়া লোকটা? তবেই কিন্তু সব শেষ। লেখককে আমি আবারো
রোমান্টিক বলবো। কেননা আত্মহত্যার ইচ্ছে-মানসিকতা এবং আত্মহত্যা করে ফেলাটা উগ্র
রোমান্টিসিজম থেকে আসে। গল্পের প্রায় শেষে পৌঁছে যখন দেখি তালিব হোসেন রেশন
স্লিপের মেমোটাকে যত্নে ব্যাগে
ভরে রেল লাইন ছেড়ে দৈনন্দিন তীব্র সমস্যায়
জর্জরিত জীবনে ফিরছেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কেননা আমি বিশ্বাস
করি, জীবনের
মুখোমুখি দাঁড়ানো, টিকে
থাকার চেষ্টাটাই আসল গল্প। পালিয়ে বাঁচা নয় বা মরে গিয়ে বাঁচা নয়। গল্পটা সত্যিই অসাধারণ।
এছাড়া গল্পগ্রন্থের ‘ক্ষীয়মাণ’, ‘মোট ব্যাপার’-এসবকে এভারেজ গল্প মনে হয়েছে। আর ‘রচনা’ গল্পটা শেষতক পাঠককে টেনে নিতে সক্ষম বটে তবে
একেও এভারেজ গল্পের দলেই ফেলবো। এসকল গল্প শ্রেষ্ঠ গল্পের সঙ্কলনে না রাখাটাই ভাল ছিল।– এই সিদ্ধান্ত
আমি দিচ্ছি গল্পের বিচারে, লেখকের ভাবপ্রকাশের দক্ষতা
বিচারে নয়।
শেষগল্পটি- ‘ত্যাগ’, বেশ ভাল গল্প। গল্পটা পড়ে বইয়ের মলাট বন্ধ করি
গভীর তৃপ্তিতে। গল্পটি দেয় চাওয়ার চেয়েও কিছু বেশি। নারী লোভী এক পুরুষের অমন কাব্যিক শাস্তিই প্রাপ্য বিবেচনা করি বলেই
হয়তো গল্পটা বেশি ভালো লেগেছে।
আলোচনা শেষ করা উচিত এটা স্বীকার করে যে, শব্দের
খেলায় আবদুশ শাকুর বেশ দক্ষ। এমনকি
আমাদের চেনা-জানা অনেক এভারেজ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের চেয়েও অনেক ওপরে তাকে রাখা
যায়। এমন মহৎ তীক্ষ্নধী লেখক আসলে হাতে গুণে ফেলা যায়। তার লেখার দারুণ ক্ষমতা
তাকে গুরুত্বপূর্ণ লেখক করে তুললেও, কিছু পুরস্কার এনে
দিলেও জীবদ্দশায় তাকে কেন যে জনপ্রিয় বহুল আলোচিত লেখকে পরিণত করেনি সেটা বুঝে
উঠতে পারছি না। আসলে জনপ্রিয়তা হয়তো সবার ব্যাপারে ঠিকঠাক ক্লিক করে না। এর পেছনে
পাঠকের যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা থেকে থাকতে পারে তা হলো- আমরা আম-পাঠকরা
পন্ডিত/প্রজ্ঞাবান লেখক ঠিক পছন্দ করি না। লঘু লেখকদেরই জয়-জয়কার আমাদের পাঠকের
পৃথিবীতে। আমরা সাধারণ মানুষেরা এলিট-উচ্চ মার্গীয় মানুষদের চিন্তায়-দৃষ্টিভঙ্গীতে
নিজেদের সরল ভাবনাগুলোকে ভারাক্রান্ত করি না। আমাদের উচ্চমার্গীয় বিষয় আশয়ে আগ্রহ
যে থাকে না, এটা আসলে মজ্জাগত। সহজাত।
যা-হোক, সামনের
দিনগুলোর কথাতো আমরা জানি না। হয়তো সামনে কখনো, কোনো
একদিন প্রাপ্যটা তিনি পাবেন। তবে তার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ পড়ে মনে হয়েছে তার মনোযোগ গল্পের চেয়ে শব্দের
অলঙ্কারে, হিউমার চর্চায়, রম্য-রসে প্রজ্ঞা ছড়ানোতেই বেশি ছিল। এসবকে ত্রুটি না ভেবে বৈশিষ্ট্য বলেই ধরে নেয়া যায়। কারণ প্রতিজন পাঠকের যেমন থাকে ব্যক্তিগত পছন্দ
ও আগ্রহের ব্যাপার-স্যাপার তেমনি লেখকেরও গল্প বলার ঢঙ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ থাকে। সেটা ভুলে গেলে চলবে কী করে?
--------------------------------------------------------------------------------
লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com
--------------------------------------------------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন