চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

সমবৃত্ত


সমবৃত্ত
নূরকামরুননাহার

দশ বছরে ঢাকাটা বদলে গেছে তার গ্রামের মতই। গ্রামের আকাবাঁকা নদীটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। তাতের কলগুলো আর চলে না। ধানি জমিতে উঠছে বসত ঘর। তিন ফসলী জমি নেই বললেই চলে। জমির মাঝখানে ছোট ছোট বেড়ার ঘর। রাত ভর ঘটর ঘটর চলে স্যালো ইঞ্জিন। জমির জমিতে দোলে ইরি ধানের শীষ। নদীতে নৌকা আর চলে না। এপাড় ওপাড়ও কেউ হয় না। মাছও নেই । কেউ এখন আর মাছ ধরে না। বিলে দু একটা আর বর্ষাকালে নদীতে দুএকটা মাছ মিলে। মানুষের কাজ নেই। হতশ্রী, হাহাকার আর অভাবের চেহারায়  ফিসফিস করা দুঃখগুলো গুটি বসন্তের দাগের মত স্পষ্ট হয়ে উঠলেও গ্রামের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। নতুন সড়ক হয়েছে। চলে গেছে থানাসদর। সড়ক ধরে রিক্সা চলে। এ গ্রাম ওগ্রামেও চলে। পল্লী বিদুৎ এসেছে। ঘরে ঘরে টিভি, বাজে রেডিও, ক্যাসেট। কারো কারো বাড়িতে আছে ফ্রিজ। মানুষের কাছে টাকা এখন কলাপাতা। ঘরে ঘরে মানুষ বিদেশ গেছে। টাকা আসে। টাকায় বাড়িতে দালান উঠে। পকেটে যাদের টাকা তারা আর হাটে না, রিক্সা দিয়ে চলাচল করে। বাছা জিনিসে রসনা মেটায়। চলে মেহমানদারী। বাজারে দুধ, মাছ, মাংস কেনা হয়। চাহিদা বাড়ে। ক্ষেতে, ঘরে গতর খাটানোর মানুষ কই। মানুষ নাই, সব সাহেব। ঠাট বাড়ে। দুধ -মাছ-মাংস বাড়ে না। চাহিদা বাড়ে। বাজারে আগুন লাগে। বিদেশ থেকে পয়সা আসে। গায়ে লাগে না। পকেটওয়ালা পকেট থেকে পয়সা ফেলে। টাকা চিবিয়ে খায়। হা-ভাতের ঘরে ভাতের কদর আরো বাড়ে। ভেতরে ঢুকে যাওয়া চাপায় দাঁত ভাসিয়ে হাভাতের দল হাসিমুখে যে কাজই করতে চাক না কেন, ঠিক মতো কাজ মেলে না, কাজ পেলেও তাতে বাঁচা যায় না, পেটে টান ধরেই থাকে। 

হাবিউল্লার অবশ্য কাজের একেবারে আকাল ছিল না। সড়ক ধরে সে রিক্সা চালায়। যদিও আজকাল রিক্সা চালিয়ে আর টেকা যায় না তবু কনু মেম্বারের বাড়ির এককোণে ভাঙ্গা ঘরে তার দিন চলছিলো। চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে পাতে কোন রকম ভাতও উঠছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো বউ রুফিয়া। গত এক বছর ধরেই বউটার অসুখ। ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসে। খেতে পারে না। শরীর শুকিয়ে হাড্ডি হয়ে গেছে। সংসারের কাজ তবু দেখতে হয়। সারাদিন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাজ করে। রান্না করে খাওয়ায়। পাশের গ্রামের স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সে দেখানো হয়েছে কয়েকবার। কী সব ঔষধ দেয়। খেলে জ্বরটা একটু কম থাকে। দুদিন পরে আবার আগের মতোই। বউটার জন্য বুকটা জ্বলে। বউটা তার সংসারে রাতদিন খাটে। হাবিউল্লার জন্য জানটা দেয়।

কিন্তু বউটার কোন ভালো চিকিৎসা করাতে পারছে না। গত মাসে জ্বরটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়েছিলো। এ কিস্তি উপজেলা সদরের ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছে সাথে সাথে এটাও বলেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার আর ঢাকায় নিয়ে গেলে ভালো হয়।
সংসার যে রকম চলে সে রকমে রুফিয়াকে ডাক্তার দেখানোর চিন্তা চৈত্র মাসে নদীতে পানি আসার মতো মিথ্যা ভরসা। কিন্তু বউটার দিকে আর তাকানো যায় না। যেন আগুনে পোড়া কয়লা।
রুফিয়া তবু বলে- থাক। চিন্তা কইরেন না সাইরা যাইবো ।
এই সাইরা যাইবো শুনতে শুনতে একবছর। কিন্তু সারে না। শরীরটা আরো শুকায়, গায়ের চামড়া হাড্ডিতে মিশে। তাই এবার ভাবে ঢাকার কথা। ঢাকায় গেলে তার ডবল আয় হবে। টাকা জমিয়ে তখন রুফিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসবে, ডাক্তার দেখাবে। তারপর ভালো হলে থাকবে, সুবিধা না হলে ফিরে আসবে গ্রামে।

সন্ধ্যাটা রাতের দিকে এগোয়। অন্ধকার জেকে বসে। রিক্সার নিয়ে যেখানে দাড়ানো হাবিউল্লা সেখানে আলো আধারী, নির্জনতা। সোডিয়াম লাইটগুলোর লালচে আলোয় জমাট ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো গাছ। বাতাসে সে অন্ধকার ছায়া কাঁপে শব্দ করে ঝরে পড়ে কয়েকটা পাতা। বাতাসে সামান্য হীম। 

ঢাকায় রিক্সা চালানোর বিষয়টা তার জন্য নতুন না। নদীতে যখন নৌকা চলে তখন সে ছিলো মাঝি। নদী শুকায় হাবিউল্লার বুক শুকায়। কাজ নাই। আসে ঢাকায়। বৈঠার হাতে তুলে রিক্সার হ্যান্ডেল। সে বছর দশেক আগের কথা। গ্রামের সড়ক তখনও পাকা হয়নি। সদর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেনি। মাঝখানে মাঝখানে সড়ক যেমন ভাঙ্গা ছিলো তেমনি একটানা সড়কও ছিলনা। এ গ্রাম ও গ্রামে সড়ক দিয়ে যাওয়ার উপায় ছিলো না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হতো। তবে ভালোভাবে সড়কের কাজ শুরু হয়েছিল। ঢাকায় বেশিদিন থাকেনি সে। শহর তার ভালো লাগে না। কেমন আউলাচক্করি লাগে। তবে শহরে রিক্সা চালানোর শিক্ষাটা তার ভালোই কাজে লেগেছে। গ্রামেই ফিরে সড়ক ধরে রিক্সা চালানো শুরু করে।

এখন এই দুর্যোগ তাকে আবার ঢাকায় এনেছে। দশ বছর পরের ঢাকা দেখে হাবিউল্লার নিশ্বাস আঁটকে আসে। শহরে মানুষ যে আগেও দেখেছে। কিন্তু এখন যেন তা ভার নত কাউনের শীষের মত। অগণিত, অজস্র। এত মানুষ,এত গাড়ী ,ধূলা, অজস্র বাতির চমকানো আলো, তার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। সে চোখে কোন কিছু ঠাহরই করতে পারে না। উপরে তাকালে বিল্ডিং আর বিল্ডিং, এত উঁচু যে, ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে হয়। নিচে মানুষ আর গাড়ী। সব আবার কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন। ছুটাছুটা, ছেঁড়াছেঁড়া, বিচ্ছিন্ন। কোন কিছুর সাথে কোনটার মিল নেই। শরহটাকে তার গ্রামের কানু পাগলার মতো লাগে। আলুথালু আউলা বাউলা। আবার মনে হয় ছোবল দেয়া বিষধর সাপ। যে কোন সময় বিষ ঢেলে দেবে। তবে দেখে হাবিউল্লা রিক্সা ভাড়া অনেক বেড়েছে। রিক্সা ঠিক মতো চালাতে পারলে ভালোই কামাই হবে কিন্তু রিক্সাতো চলেই না। এখানে রিক্সা চলে তার বউ রুফিয়ার মত কোনরকম ঠেলে ঠেলে, শ্বাস টেনে। মানুষ-গাড়ী-রিক্সা একসাথে জট বেধে থাকে। তারপর সবগুলো  গুতোগুতি করে, আগায় না। হাবিউল্লা শুনেছিলো শহরে খুব ভীড় কিন্তু তার মানে যে এই তা বুঝেনি। এই দশদিনে হাবিউল্লার কাছে পুরো শহরটাকে মনে হয়েছে একটা ইঁদুরের কল কোথাও ঢুকলেই আঁটকে থাকা। বের হওয়া যায় না।

খুব সকালে শহরটা একটু শান্ত থাকে। মানুষগুলো তখন ঘুমায়। তবে তাও বেশি সময় না। সূর্যটা রাস্তায় তাপ দেয় কী দেয় না মানুষ ছোটে। তারপর শুরু হয় সেই যুদ্ধ। খুব সকালেই তার রিক্সা নিয়ে বের হবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি, দুচোখ কেমন আঠার মতো লেগে ছিলো। চোখ ডলে রিক্সা নিয়ে বের হতে হতে পিঠে পিঠে সূর্যটা লেগে যায়। হালকা তাপে আর বাতাসে তার ভালোই লাগে। কয়েকটা মাস তাকে কাটাতে হবে রুফিয়ার জন্য। প্যাডেল চালাতে হবে সকাল থেকে বিকাল, বিকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত। থামলে হবে না। এ কদিনে বুঝেছে হাবিউল্লা অসময়ে একটু বেশি পাওয়া যায়। খুব সকালের আর রাতের খেপে তাই তার আগ্রহ। তবে সে এখনও ভাড়া ঠিক করে চাইতে জানে না। প্যাসেঞ্জারের ঠেকা বুঝে আদায় করতেও জানে না। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে লজ্জা হয়। সব জায়গার ভাড়া জানেও না। যাত্রীর বিবেকের উপরই আস্থা রাখে। বিবেক আবার সব সময় তাকে জেতায় না। কঠিন ভাবে প্রতারিত করে।

দু একটা করে পেডেল মেরে সামনের রাস্তায় এসে নি:শ্বাস নেয় হাবিউল্লা। সকালের খেপ না পেলেও তার বনি ভালো হয়েছে। রিক্সায় এমুহূর্তে বসে আছে একজন সাহেব। কোথায় যাবে এখনও বলেনি কিন্তু দেখেই বোঝা যায় লোকটার দিল আছে। ভাড়া টাড়া কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কোথায় যাবে জানে না হাবিউল্লার। এ শহরের মাথামুন্ডু সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তবে দশবছর আগের অভিজ্ঞতা তাকে কিছু আলো দেয়। সে আলোতে যে বিভিন্ন জায়গার নাম আবার স্মরণে আনতে পারে। কিন্তু জায়গাটায় যাবে ঠিক কোন রাস্তা ধরে তা সবসময় বুঝে উঠে না। এক টানে তাই সে ছুটতে পারে না, যাত্রীর সাহায্য নেয়। তার রিক্সায় যে যাত্রী বসে আছে যে মনে হয় ঠিক রিক্সার যাত্রী না গাড়ীর লোক। চেহারা সুরত তাই বলে। হাতে সুন্দর একটা বাক্স। চেহারাটা চকচকে, দামী স্যুট, এই সকালেও চোখে সানগ্লাস। বসে আছে বাবুর মতো। মুখে শুধু বলেছে যাও। কিন্তু কোনদিকে যাবে হাবিল্লা বুঝে না। যাও যখন নিশ্চয় সামনের দিকে।
কিছুক্ষণ রিক্সা চালিয়ে পেছন ফেরে হাবিউল্লা -স্যারে যাইবেন কই।
যাব কয়েক জায়গায়। আগে ইসলামপুর চলো। শাহাজাদপুর থেকে ইসলামপুরের দুরত্ব আন্দাজ করতে কষ্ট হয়। তবে সে জায়গাটার নাম জানে। আগের বার সে খেপ নিয়ে গিয়েছেও। দুরত্ব ও ভাড়া আন্দাজ না এলেও সে বুঝে জায়গাটা বেশ দুরের।
রাস্তাটা একটু কইয়্যা দিয়েন।
নতুন রিক্সা চালাও।
না রিক্সা চালাই দশবছর।
ঢাকা শহর নতুন আইসো?
আগে একবার আইছিলাম। এহন আইছি আজগা দশদিন।
ঠিক আছে যাও। রাস্তা চিনিয়ে দেব।
ভাড়াটা আফনেই ইনসাফ কইর‌্যা দিয়েন।
যাও যাও তোমাকে পুষিয়ে দেব।

হাবিউল্লা রিক্সার পেডেল ঘোরায়। সকালের সূর্য উঠে। এই শহরটার আসলেই কোন আগামাথা নেই। কার্তিকের শেষ তারপরও পিঠ পোড়ে। গা বেয়ে ঘাম ঝরে। ঘাম মুছে আবার পা চালায়। যাত্রী লোকটা ভালো নরম স্বরে রাস্তা চেনায়। ইসলামপুর পৌঁছে রিক্সায় বসে থাকে হাবিউল্লা। প্রায় ঘন্টা কাটিয়ে এসে আবার রিক্সায় উঠে যাত্রী। তার লুঙ্গির খুচিতে মাত্র দশটা টাকা আছে। পেটটা খিদায় চরচর করে। ভাড়াটা পেলে কিছু দেয়া যেত এই হাবিয়া দোজখে। ইসলামপুর থেকে রিক্সা চলে আবার কাকরাইলে। তারপর মলিবাগ তারপর মতিঝিল। এখন সূর্যটা মাথার কাছ থেকে হেলে পড়ছে। পেটটা আর কোনভাবেই মানছে না রাগী পাড়ের মত অবাধ্যতা খেলা করছে। মতিঝিল জায়গাটা ভালোভাবেই চেনে হাবিউল্লা। তবে এখানেও এখন চকচকে বড় বড় দালান হয়েছে। উঁচু একটা বিল্ডিং। তার সামনেই নামে তার বনির যাত্রী।
এবার সে পাবে। টাকা পাবার আশায় তার পেটটা আর একবার খিদের জানান দেয়।
তুমি একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।
স্যার তাড়াতাড়ি আইয়েন।

রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হাবিউল্লা। আধ ঘন্টা কেটে যায়। না দেখা নেই। এমন একটা বড় চকচকে বিল্ডিং এর ভেতরে সে কোথায় ঢুকবে। আর কিভাবেই বা ঢুকবে।  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার শরীরটা ভেঙ্গে আনে। পেট প্রবল ভাবে মোচড় দেয়। শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। হতাশ হয়ে রিক্সার পা দানিতে বসে পড়ে হাবিউল্লা। তার সারাদিনের কামাই শেষ। জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। এমন একটা শহরে তার কান্না কে দেখবে। এখানে কি আর রুফিয়া আছে। তার কান্নায় ব্যাকুল হয়ে উঠবে। আস্তে আস্তে রিক্সার প্যাডেলে আবার পা রাখে হাবিউল্লা। সামনের বাক নেয়া রাস্তায় কোনায় রিক্সা রেখে। দুইটা রুটি আর এক চাকা আখের গুড় খায়। তারপর ঢকঢক করে খায় পানি। প্যাসেঞ্জার উঠায় সে। সায়দাবাদ।

প্যাসেঞ্জারের দিকে বারবার তাকায় হাবিউল্লা। সে তাকে প্রতারণা করবে না তো। মানুষরে আর বিশ্বাস হয় না। না, তার লুঙ্গির খুঁচে পঁচিশ টাকা জমা হয়। মালিক কে জমা দিবে কি? সারাদিনের জমা ১২০ টাকা। এখন মাত্র ২০ টাকা। বাকি সময়টা টানলে হয়ত হবে। কিন্তু রাতের খাবার। পেটটা তার এখনও চো চো করছে। এত খিদের দুইটা রুটি পেটের তলায় পড়ে আছে।
আরো দুই খেপের পর তার হাতে এখন ষাট টাকা।
রিক্সা নিয়ে বেলার দিকে তাকায়। বিকেল হয়ে গেছে। কার্তিকের বিকেল এখনি শেষ হয়ে যাবে। তার  রিক্সায় সামনে একটা যুবতী মেয়ে। চেহারায় অভাবের ছাপ।
মেয়েটা বলে- যাইবেন শাহবাগ?

শাহবাগ চেনে হাবিউল্লা। চেনে ইউনিভার্সিটিও। কিন্তু তার বুকটা কাঁপে। এই মেয়ে ভাড়া দিবে তো। দিবে না কেন! সব কি আর ঐ সাহেব! গার্মেন্টেসের মেয়েরা কি রিক্সায় উঠে না! তবে মেয়েটাকে তার কেমন লাগে। চেহারায় মেঘ।! চোখে বিভ্রান্তি। কথার মধ্যে লুকানো ভাব। শাহবাগ বলেছে ঠিকই কিন্তু মনে হয় কোথায় যাবে যেন ঠিক মতো জানে না। অস্পষ্ট কথাবার্তা। হাবিউল্লা একবার ভাবে না করে। তারপর আবার কি মনে হয়।
ভাড়াটা ঠিক করে বলে সে- চল্লিশ টাকা।
মেয়েটা মাথা নাড়ে।

সন্ধ্যা নেমে গেছে। সোডিয়াম লাইট গুলো জ্বলে উঠেছে। শিশু একাডেমী পার হয়ে দোয়েল চত্তর ফেলে সামানের দিকে রিক্সায় এগোতেই মেয়েটা বলে- ইটটু রাহেন এই হানে।
বুকটা আবার ধক করে। আবার কি তার খাটনি মাইর যাইবো।
এইখানে রিক্সা কই রাখবো। রাহন যাইতোনা।
ইটটু থামান। কাম আছে। সময় লাগবো না।
খুব অনিচ্ছা নিয়ে রিক্সাটা থামায় হাবিউল্লা -তাড়াতাড়ি আইয়েন। 
সন্ধ্যার অন্ধকার মেয়েটা উদ্যানের ভেতর অদৃশ্য হয়।
হাবিউল্লা নিজেকেই নিজে বলে- আজগ্যা কুফা লাগছে।
সন্ধ্যাটা রাতের দিকে এগোয়। অন্ধকার জেকে বসে। রিক্সার নিয়ে যেখানে দাড়ানো হাবিউল্লা সেখানে আলো আধারী, নির্জনতা। সোডিয়াম লাইটগুলোর লালচে আলোয় জমাট ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো গাছ। বাতাসে সে অন্ধকার ছায়া কাঁপে শব্দ করে ঝরে পড়ে কয়েকটা পাতা। বাতাসে সামান্য হীম।
হাবিউল্লা দাড়িয়ে থাকে।প্রায় বিশ মিনিট। বুঝেনা কি করবে। থাকবে না যাবে।
এ জায়গায় শহরের ন্য জাগার তুলনায় যানবাহনের ভীড় কম। নিঃশব্দে তাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ, টুংটাং শব্দ তুলে চলমান রিক্সা আর দানবের চোখের মতো আলো জ্বালিয়ে সাই সাই করে গাড়ি। বেকুবের মতো সে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

আস্তে আস্তে বলে- হারামজাদী গেলগা নাকি?
নিজেকেই সে আবার বলে- শুয়রনী, আইতো না।
না, অন্ধকার গায়ে মেয়েটা ফিরে। আলো-আঁধারে হাবিউল্লার দিকে তাকায়। জায়গাটা ফাঁকা।
গাছের নিচের জমাট অন্ধকারে দিকে চেয়ে বলে- আমি ভাড়া দিতারমু না।
হাবিউল্লার কন্ঠটা একমুহূর্তে খেই হারায় কর্কশ স্বরে বলে- তয় ফুডানি কইর‌্যা রিক্সায় উঠছিলি ক্যান।
শইলডা ভালা না। কালকাও খাই নাই। আজগ্যা সারাদিন কিচ্ছু খাই নাই। ভাবছিলাম কাম কইরা দুইডা টেহা পাইলে তোমার ভাড়াও দিমু। নিজেও খামু। কাম করনের মানুষ পাইতাছি না।
হাবিউল্লা কথাগুলো ভালো করে শুনে কী শুনে না এক প্রকার চিৎকার করে বলে- টেহা না দিয়া এক পাও যাইতারতি না।
আমি টেকা দিতে পারমু না। টেকার বদলা তুমি আমারে কাম কইর‌্যা যাও।
হাবিউল্লা এবার দিকবিদ্বিক জ্ঞান শূন্য হয়ে মেয়েটার হাত ধরে টান দিয়ে ঝাঁকি মেরে বলে- খানকীয়ে কয় কি। তাইরে আমি লাগাই! ঘরে আমার মাগী আছে না!
মেয়েটার শরীরে হাত পড়লে রাগটা হঠাৎ কেমন পানি হয়ে আসে হাবিউল্লার। শরীরটা গরম। ঠিক রুফিয়ার মতো।
তর নাম কি?
হালিমা।
আধো আধো আলোয় হাবিউল্লা ভালো করে তাকায় হালিমার দিকে। সাধারণ একটা মুখ। অনিশ্চয়তা আর কষ্টের ছাপ আঁকা। রুক্ষ চুলগুলো মাথা আর কপাল ছাড়িয়ে। ছাপা শাড়িতে ঢেকে রাখা ঐ শরীর বিধ্বস্ত, চুপসানো। জ্বরের তাপে মুখটা লাল। ঠিক রুফিয়ার মতো যুদ্ধক্লান্ত, ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া।

তর এই জ্বর কতদিন ধইরা।
মাঝে মাঝেই আহে যায়।

লুঙ্গির খুচি থেকে খুলে বিশটা টাকা দেয় হাবিউল্লা- নে মাগী ধর কিছু কিনন্যা খাইস। আর উঠ তোরে রাইখ্যা আহি।


লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই