চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

দেবাশিস ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার


দেবাশিস ভট্টাচার্য ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। জন্ম ১ মার্চ ১৯৫৬। পেশা- মিডিয়া জনসংযোগ ও মানব সম্পদ বিশেষজ্ঞ। প্রথম প্রকাশিত বই প্রেম অন্ধকারে (কবিতার বই), কলকাতা বইমেলা, ২০১৬, ডিসেম্বর। প্রথম উপন্যাস চির প্রবাস (২০১৭)। শখ- লেখা, পড়া, গান শোনা, দেশ ও মানুষ দেখে বেড়ানো। চিলেকোঠা সাহিত্যের পক্ষ থেকে অনলাইনে  তাঁর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আখতার মাহমুদ।

আখতার মাহমুদঃ কেমন আছেন?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ ভাল আছি ভাই। 

আখতার মাহমুদঃ বই প্রকাশের তারিখ বিবেচনায় নিলে লেখালেখির শুরুটা অনেক দেরিতে আপনার। প্রথম বই বেরিয়েছে প্রায় ষাট বছর বয়সে। হুট করেই লেখালেখিতে ঢুকে পড়া? না দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল? লেখালেখি শুরুর ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতে চাইছি আসলে।

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ আমি কিশোর ও যুবা বয়সে কবিতা লিখতাম। দেশ ও কৃত্তিবাসে নিয়মিত লিখেছি। আনন্দ বাজার পত্রিকায় গ্রন্থ সমালোচনা টেলিগ্রাফে সঙ্গীত আলোচনা ইত্যাদি করতাম। তখন ও পরবর্তী কালে আমি সাংবাদিকতা জাতীয় রচনাও অনেক লিখেছি, ইংরিজি বাংলা দুই ভাষায়। বিবিসির জন্য রেডিও সাংবাদিকতাও করেছি কিছুকাল। আসলে নিজেকে খুঁজে পেতে কিছু সময় লেগে গেছে, একটা পুরো পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সৃষ্টিশীল রচনায় ফিরে আসব এটা স্থির ছিল। বয়স এখানে গৌণ যেহেতু মনের বয়স বাড়ে না। সে প্রস্তুত না হলে প্রকাশিত হয়ে লাভ নেই। 

আখতার মাহমুদঃ কেমন বিষয় পছন্দ লেখালেখিতে আপনার? আপনার প্রথম উপন্যাস, চিরপ্রবাস পড়ে আমার মনে হয়েছে গল্পের প্রতিটা মানুষ আলাদা অথচ কী দারুণ এক আত্মীয়তায় তারা সবাই এক! প্রত্যেকেরই আলাদা গল্প রয়েছে আবার সবার গল্প একত্রে মিলেমিশে এক ধ্রুব জীবন গল্প উঠে আসে সামনে। উপন্যাসের প্রায় প্রতিটা চরিত্রকে কোনো না কোনোভাবে বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন দেখতে পাই। বিষণ্নতা- কাছের মানুষটির দুঃখে, কাছের মানুষটির কাছে না থাকার দুঃখে, কাছের মানুষটি হারানোর দুঃখে। জীবন এলোমেলো হয়ে যাবার দুঃখেও বিষণ্ন হতে দেখি কাউকে কাউকে। উপন্যাসের শেষটা যদিও বিষণ্ন ছিল না, কিন্তু আর সব পাঠকের কাছে প্রথম উপন্যাস নিয়ে কেমন মন্তব্য পেয়েছেন?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ চির প্রবাস ভাল সাড়া পেয়েছে। প্রকাশক- ধানসিঁড়ি, নবীন কিন্তু অত্যন্ত গুনমান সচেতন। কিন্তু সঠিক বিপণন, যা হলে একটা বই বহু সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছায় তা করা যায় নি। তুমি নিজে সাহিত্য সেবক তুমি জান এইসব সমস্যা থাবে কিন্তু আমাদের এগুলি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। চির প্রবাস আমাদের প্রতিদিনের চেনা জগত ও চরিত্রদের মধ্যে একটা অচেনা বিস্ময় আবিষ্কার করে যা পাঠকদের আঘাত করেছে। তাছাড়া শান্তিনিকেতনের কাহিনী হিসেবেও একটা আকর্ষণ তো আছেই। 

আখতার মাহমুদঃ কর্পোরেট চাকুরি করে লেখালেখি কী কঠিন, না বরং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার আলোকে সহজ?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ সময়ের দিক দিয়ে কঠিন। কিন্তু মানুষ প্রেমে পড়লে প্রেম করার সময় ঠিকই বের করে নেয়। তাছাড়া আমি ‘চির প্রবাস’ লিখেছি প্রবাসে দিল্লীর পাশে নয়ডা শহরে। পরিবার থেকে দূরে। ঐ একাকীত্বটা হয়তো দরকার ছিল। 

আখতার মাহমুদঃ সাহিত্য আসলে আমাদের কী দেয়? কী আশা করতে পারি আমরা সাহিত্যের কাছে? কেন সাহিত্য চর্চা করছেন?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দ। 

আখতার মাহমুদঃ প্রায়শই শুনি, বর্তমানে বাংলায় আন্তর্জাতিকমানের সাহিত্যিক নেই। কিন্তু আমার বক্তব্য, বাংলাভাষার প্রকাশকরা কী আন্তর্জাতিক মানের? তাদের সম্পাদনা? লেখককে প্রদত্ত সম্মানী? এমনকি বাংলাভাষার প্রকাশকেরা বইয়ের প্রচারণায় শহর এবং বইমেলার গন্ডীই পেরুতে পারেন না, আন্তর্জাতিক হবেন সে আশা দুরাশা। একইসাথে লেখকের জন্যে উপযুক্ত সম্মানের পরিবেশ তৈরী না করে আন্তর্জাতিকমানের লেখক পাওয়ার আশা করাটাই মস্ত ভুল- এটা আমার মত, আপনার বক্তব্য কী এ বিষয়ে?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ তোমার বক্তব্য অত্যন্ত সঠিক। পরিবেশ না রচনা করলে সামগ্রিক উন্নতি হওয়া শক্ত। অথচ ভালবাসা গভীর হলে এই ক্ষুদ্র গণ্ডীতেই অমরত্বের স্বাদ মেলে। বাংলা ভাষার লেখকরা প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আরও অনেকে পাননি এইমাত্র তফাত। আমি মনে করি বিপণন বা বিক্রয়মূল্য দেখে সাহিত্যের বিচার চলে না। কোনও শিল্পেরই চলে না। তবে সমাজের উচিত সাহিত্য শিল্প সেবীদের খেয়াল রাখা। নাহলে মস্ত অবিচার হয়। অনেক সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্টও হয়। 

‘তসলিমা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আমায় বললেন, আপনি কি যা তা লিখেছেন আমার বিষয়ে।’

আখতার মাহমুদঃ আপনার দৃষ্টিতে কে এগিয়ে যাচ্ছে আসলে- প্রিন্ট মিডিয়া না অনলাইন মিডিয়া? এ-দুটোকে আলাদা মনে হয় আপনার, না এদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখতে পান কোথাও?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ না কোনও সংঘর্ষ নেই। ডিজিটাল বিশ্বে এ বইকে অস্বীকার বা অবহেলা করা মূর্খতা। আবার এ-ও ঠিক যে ভারত বা বাংলাদেশে আরও বহুকাল ছাপা বই রাজত্ব করবে কারণ ডিজিটাল ডিভাইড বা বিভাজন। সুদূর পল্লীগ্রামে পৌঁছতে হলে ছাপার নৌকোয় পাড়ি দেয়া ছাড়া উপায় কি? 

আখতার মাহমুদঃ বাংলায় কার লেখা ভাল লাগে আপনার? কথাসাহিত্য ও কবিতা আলাদা করে বলুন।

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ তালিকা সুদীর্ঘ করতে চাই না, বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথের নাম ইচ্ছে করেই করব না, কথা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণ শীর্ষেন্দু হুমায়ুন আহমেদ কবিতায় জীবনানন্দ সুধীন দত্ত অমিয় চক্রবর্তী শক্তি মন্দাক্রান্তা জয়ের কিছু কিছু। দেবারতি মিত্র মনীন্দ্র গুপ্ত উল্লেখযোগ্য, এই কবি দম্পতিকে আমি আমার সাম্প্রতিক কবিতার বই " যাই" উৎসর্গ করেছি। দেবারতিদি আমায় কিশোর বয়স থেকে চেনেন। স্নেহ করেন। চির প্রবাস পড়ে উনি ভীষণ খুশি হয়েছেন এটা আমার গর্বের। বলা হয় নি মননে বুদ্ধদেব বসু শিবনারায়ণ রায় সুধীন্দ্রনাথ নীরদ চন্দ্র চৌধুরী কবিতা ও কোনও কোনও গদ্যে সুনীল। ব্যক্তিগতভাবে সুনীল ও শক্তির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের আন্তরিক স্নেহ ও সক্রিয় উৎসাহ দানের কারণে। কবিতায় সুভাষ মুখপাধ্যায়ের নামও করা উচিত। ভাল কথা, তসলিমা অনেক দারুণ কবিতা লিখেছেন, তাঁর কিছু আত্মকথা দুর্দান্ত তাঁর রচনার গতি ও কবিত্বের আমি অনুরাগী। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে নিজের কবিতা একান্তে পাঠ করে শুনিয়েছেন, কবিতা ও জীবন নিয়ে আড্ডা দিয়েছি আমরা, কিন্তু আমার একটি অনলাইন প্রকাশিত নিবন্ধে সেই যে তিনি আমার উপর চটে গেলেন তাঁর আর কোনও ক্ষমা পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা হাস্যকর। কিন্তু বাস্তব। আমি নিবন্ধে লিখেছিলাম যে তিনি ক্ষমতাশালী লেখিকা কিন্তু তাঁর নিরন্তর বিদেশ ভ্রমণ ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি নিয়ে ভাষণ দেয়া এক জিনিশ আর সত্যিকার অনাহার অশিক্ষার সঙ্গে সামাজিক লড়াই করা আরেক জিনিস। এই সমালোচনায় তসলিমা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আমায় বললেন, আপনি কি যা তা লিখেছেন আমার বিষয়ে।

আখতার মাহমুদঃ এই উপমহাদেশে ধর্ম একটা বেশ প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়। সাহিত্যে এর প্রয়োগ কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ আমি ধর্ম বিষয়টি ব্যক্তিগত বলে মনে করি। সাহিত্যে তার ভূমিকা থাকতেই পারে। কিন্তু তখন সেটি ধর্ম থাকে না। জিরাফ হয়ে যায়। অর্থাৎ তার আবেদন সাহিত্যিক হয়। তবে সাহিত্য যেহেতু মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনের উৎপাদন সুতরাং তাতে শিল্পীর ধ্যান ধারনা বিশ্বাস অবিশ্বাসের ছাপ থাকতে বাধ্য। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রেমাস্পদ বিধাতাকে নিয়ে গান লিখেছেন আমি নাস্তিক হলেও তাতে কোনও সমস্যা চোখে পড়ে না কারণ গানের আর্তি অতি মধুর। হুমায়ুন আহমেদ ঘোর নাস্তিক হয়েও হাসন রাজার মরমী গানে বিভোর হন, আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার গুরুত্ব তাঁর ঈশ্বর অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত মার্ক্সবাদী বামপন্থী রাজনীতি করতেন কিন্তু তাঁদের বেশ কিছু পংক্তি আমাদের চোখ নয় মন প্রাণও ঝলসে দেয়।

আখতার মাহমুদঃ লেখালেখি নিয়ে কী কী পরিকল্পনা আছে আপনার?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ একটি বড় উপন্যাস লিখছি একটি বিশেষ নারীকে নিয়ে, যে আইকনিক, একটা বিশেষ সময় বা সর্বকালের স্ত্রীজাতির প্রতিভূ, উপন্যাসের মধ্যে তিন যুগ ও প্রজন্ম ধরা আছে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতকের শেষ, অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনা আছে, দুই তৃতীয়াংশ লিখেছি মাত্র, কিন্তু ভালবেসে লিখছি, দেখি কি দাঁড়ায়। 

আখতার মাহমুদঃ লেখক হিসেবে কতদূর যেতে চান?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ যতদূর নিজের ভিতর পথ পাই। 

আখতার মাহমুদঃ এবারে বইমেলায় বই বেরুচ্ছে আপনার?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ কবিতার বই "যাই" এটি "প্রেম অন্ধকারে" মানে প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেক পরিণত। আরেকটি রহস্য গল্প সঙ্কলন "পর্দার ওপারে" কিন্তু মুশকিল হল এটি তারাই পড়তে পারবে যারা ভয় পেতে ভয় পায় না এবং রাত বারোটার পরে পড়াশোনায় অভ্যস্ত। এই গল্পের চরিত্রগুলি বারোটার আগে পাঠকের সামনে আসবেই না। 

আখতার মাহমুদঃ ‘পর্দার ওপারে’ এর রহস্য গল্পের আড়ালে কী কোনো চিরন্তন মেসেজ আছে?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ না না এগুলো একটু অন্যরকম মজা, মেসেজ টেসেজ না খোঁজাই ভাল। 

আখতার মাহমুদঃ দুই বাংলাতেই মিলবে আপনার বইগুলো?

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ আমার প্রকাশক ধানসিঁড়ি বিপণন দেখছে, বাংলাদেশের দোকানে আসার কথা তো বটেই। এখুনি স্পষ্ট খবর দিতে পারছি না ভাই দুঃখিত। 

আখতার মাহমুদঃ নতুন বইয়ের জন্যে শুভকামনা।

দেবাশিস ভট্টাচার্যঃ তোমাকেও ধন্যবাদ, শুভ কামনা, অফলাইনে আমাদের আড্ডা চলবে।

লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই