চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

একটি প্রকৃত না-গল্প


একটি প্রকৃত না-গল্প
মীর হাবীব আল মানজুর

আমার উচ্চতায়, আমারই অপব্যবহারে ক্লান্তির অমোঘ মেঘরেখা আমার অন্তঃকরণে ছায়া ফেলে ছুটে চলে বারবার; তারপর আরও একটি শ্রান্তির গুমোট আভাসে তার ইঙ্গিতময় রহস্য-ব্যাকুলতা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, তার উৎপত্তিস্থল সম্বন্ধে আমার জ্ঞান বিতাড়িত হয় অভিশপ্ত সন্ত্রাসের মতো। 
আরও একটি দিকভ্রান্ত গল্পের দিক ছায়া ফেলবার উদ্দেশ্যে আমার নিরুদ্দিষ্ট খোঁজাখুঁজি প্রদোষকালীন রাগের মতো একটা ছেনালি রঙিনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার অবকাশ খুঁজে তারপর বসে পড়ে; আরেকটু অবকাশে আলস্যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করতে থাকে। বিলোড়নের সমস্ত সৌজন্য মাঠে মারা পড়ে। আমি একটি গল্পের প্লট কিংবা সাজানো মাঠের জন্য দৌড়ঝাঁপ নয়, খানিকটা গা ছেড়ে গুল্ম- কাঁটাবিহীন পথের প্রতি দৃষ্টি দিই... 
আমার পাঠ সর্বাগ্রে এসে দাঁড়ায় আমারই সমুখে: মানবপাঠও একই কাতারের বোধ হতে থাকে।

আমি এক রিকশাওয়ালার আরামে বসে পা-দোলানো দেখতে দেখতে তাঁর মানসিকতা বা পরিবারের কথা বিবেচনা করতে থাকি। হাল-অবস্থায় তাঁর মনোক্রিয়া কী প্রকারে হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না, এটা বুঝতে পারি। কারণ, এ শ্রেণির কাছাকাছি যাবার সুযোগ, তাদের পাশে বসে দু’কথা বলবার সুযোগ, পারিবারিক অবস্থাদির কথা জানবার সুযোগ হয়নি। তাঁর সঙ্গে আমার মূল সম্পর্ক যাত্রী রিকশা চালকের সম্পর্ক। কখনো কোনো প্রগলভ বা বলতে আগ্রহী রিকশাওয়ালার রিকশায় চাপলেও তাতে আর কদ্দূর জানা যায়!

প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান/ধারণা খুব স্বল্প। এতে কেউ খুব আগ্রহীও হয় না যেচে। তাহলে শুধু কি প্রান্তিক মানুষ নিয়েই গল্প লিখতে হবে? ওদের জীবন ছাড়া মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন, সুখে-দুঃখে অভিন্ন মানব-সংসার মানব-জীবনে কি নেই? থোড়া, নিজেদের জীবনের অনুদ্ঘাটিত পর্দার কয়টি স্তর আমি ভেদ করেছি? এ নির্জ্ঞানতা আমার কোনো গল্প আজোবধি প্রসবিত না হবার বড় কারণ।

*****

আমার মনে পড়ে, আহমদ ছফার ‘নিহত নক্ষত্র’  গল্পের প্রধান চরিত্র মুনতাসীরের কথা। তাঁর সতীর্থ এক জ্বালাময়ী(!) লেখা— যা নিয়ে কলেজে তুমুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিলো—তা নিয়ে এলে মুনতাসীর ওই গোড়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে লেখার নঞর্থকতা বুঝিয়ে দেয়। তাতে অবশ্য ব্যর্থতা-বিপাকে খানিকটা ফাঁপরে পড়ে আমাদের চিরায়ত অভ্যাসমতো বেশ রেগে যায় মুনতাসীরের সতীর্থ।

শহীদুল জহির সাক্ষাৎকারে এ কথা স্পষ্ট করেছেন, গল্পের জন্য যে এলাকাস্থলে ঘটনা এগোবে,  সেখানে গিয়ে টুকিটাকি নোট নিতেন। মানুষকে নিবিড়তরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। আমি ভাবি, জহির তো একা মানুষ ছিলেন;—এ গল্পের সরঞ্জাম খুঁজতে গিয়ে নিজে কতগুলো গল্পে জড়াতেন! তাঁর অনুভূতির রঙ কেমন আলাদা হতো! গা-শিরশিরে একটা ভাবও হয়তো তৈরি হতো।

আমি ভাবি গল্পকারদের কথা। শুধু গল্পকারদের কথা বলে বোধ হয় বোঝাতে পারছি না;—আমি শিল্পের কারিগরের কথা ভাবি, তাদের পরিস্থিতি-অনুভব-সময়চক্র আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের ব্যক্তিক যে আপাত কুলীনতা-অকুলীনতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার কথা ভাবি। খুব সরলভাবেই তাদের বৈষয়িকতা এসে পড়ে এখানে; বৈষয়িকতা বেঁচে থাকবার প্রধানতম অনুষঙ্গ, বেঁচে থাকাটাই তো শিল্পের অঙ্কুরোদগম ঘটায়, তাই বেঁচে থাকার বিচিত্রতার প্রাসঙ্গিকতাও প্রাসঙ্গিক।

আমাদের যারা নতুন গল্প লিখছেন, কত মানুষই তো গল্প লেখে,  চৌদ্দ-পনেরোর নওল কিশোর থেকে আমাদের আশি বছর বয়সী খ্যাতিমান গল্পকারেরা, এদের কত ক’টা গল্প হয়? ক’জনে কল্পনা আর অভিজ্ঞতার মিশেলে সপ্রাণ শব্দের বুনটে আমাদের মৌলিক উপরসে বাধিত করেছেন, করছেন? আমার নিজেকে নিয়ে বড় সন্দেহ। নিজের সীমাবদ্ধতার সীমায়ন জানি বলে কিংবা সাথর্ক কিছু শিল্পোত্তীর্ণ কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকার ভয়েই আমার গল্প লেখা হয় না।

সাইয়েদ আতীকুল্লাহর মস্ত বাড়ি ছিলো, খুব টিপটপ থাকতেন; তা দেখে রফিক আজাদরা হাঁ হয়ে ভাবতেন—এ বেটা গল্প লেখে! শহীদুল জহির সচিব ছিলেন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহও সম্ভবত।

গুণ যখন গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসেন তৃষ্ণতা নিয়ে কবিতার প্রতি, দীনতায় তাঁর জুড়ি মেলাও ভার ছিলো। খেয়ে-দেয়ে অর্থ-কড়ি না থাকায় ঝেড়ে দৌড় দিয়েছেন বেশ ক’বার হোটেল থেকে। ষাটের কণ্ঠস্বর পত্রিকা বা পত্রিকা-সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের কথা বলি যদি,  তাহলে তাদের কীইবা ছিলো আর্থিকতা!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কলেজ-অধ্যাপনার টাকা আর সাইকেলে ঘুরে-ঘুরে বিজ্ঞাপনের চাঁদা দিয়ে একটি পত্রিকা-সৃষ্টিতে কী যুদ্ধটাই না করতে হয়েছে কণ্ঠস্বর- গোষ্ঠীর! অই যে শান্ত-মিষ্ট-নিঃসঙ্গ আবুল হাসান— তাঁর এই ঢাকায় থাকবার কী গতি ছিলো! আর তাঁর কিছুকাল বড় আল মাহমুদের! মধুদার আলাদা একটা খাতাই ছিলো শিল্পের লোকদের বাকিতে খাওয়া-খাবার লিখে রাখবার জন্যে, সে খাতায় শুধু বাকিই জমতো, সে বাকি কখনো পরিশোধ হতো না। মধুদা মহানুভব ছিলেন,  স্নেহশীল ছিলেন।

একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেতে হয় প্রত্যেক শিল্পীকে, আমরা বুঝতে পারি। কারো আর্থিক, কারো মানসিক প্রচন্ড বিক্ষুদ্ধতার মধ্য দিয়ে দিন-গুজরান করতে হয়। একজন সমস্যাকাতরতাহীন ব্যক্তি বা সত্তা এ বিক্ষুদ্ধতার অর্থই বোঝে না, বোঝে না মানুষ কত ধরনের জটিলতায় ভোগে। মহাত্মা গাজ্জালি পর্যন্ত জীবনভর এই অস্থিরতা বা ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে গেছেন।

কত গল্পে নিজেদেরই আঁটকা পড়তে হয় শিল্পীদের এবং তার মধ্য দিয়েই এগোয় জীবন। গল্প তো এ জীবনেরই ভাঙা আখ্যান, অথবা ভাঙা-ভাঙা গল্প;—আমি সে জীবনের কথাই ভাবতে বেশি ভালোবাসি। তা নিয়েই আমার কল্পনার আলিঙ্গন রাঙা হয়ে ওঠে। তাই আমার আর গল্প লেখা হয়ে ওঠে না।

*****

আমাদের যারা নতুন গল্প লিখছেন, কত মানুষই তো গল্প লেখে,  চৌদ্দ-পনেরোর নওল কিশোর থেকে আমাদের আশি বছর বয়সী খ্যাতিমান গল্পকারেরা, এদের কত ক’টা গল্প হয়? ক’জনে কল্পনা আর অভিজ্ঞতার মিশেলে সপ্রাণ শব্দের বুনটে আমাদের মৌলিক উপরসে বাধিত করেছেন, করছেন? আমার নিজেকে নিয়ে বড় সন্দেহ। নিজের সীমাবদ্ধতার সীমায়ন জানি বলে কিংবা সাথর্ক কিছু শিল্পোত্তীর্ণ কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকার ভয়েই আমার গল্প লেখা হয় না।

পুরনোতে আমার কোনো আগ্রহ নেই। পুরনো উপমা গা-গুলোনো, পুরনো শব্দ বিবমেষু, পুরনো চিত্রকল্পে নতুন কোনো ছবি আসে না মস্তিষ্কে। কাহিনীর রহস্যময়তা, তার বাঁক-ফেরানো, সঠিক প্রবাহের মতো এঁকেবেঁকে চলা, ক্লাইম্যাক্স-আন্টি ক্লাইম্যাক্সের কথা নাইবা বললাম। ডিটেইলসে কাজ কী পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ! এ ছাড়া আরও কত দিক নিয়ে আলোচনা করা যায়! সেগুলোর কথা কোবিদগণ জানাবেন নাহয়।

কিন্তু তাহলে আমরা নতুন কই পাবো! আমাদের পূর্বে এত-এত শিল্পীগণ এসেছেন, তাঁরাই তো সব এঁকে গেছেন, লিখে গেছেন। এই যে, আমিই যে এমন বকছি, আমারই-বা কয়টা শব্দ নতুন, কয়টা বাক্য অসাধারণ সৌকর্যের নবীনত্ব নিয়ে আছে, পূর্বেকার বক্তাদের বক্তব্য থেকে আমারটায় কদ্দূর মৌলিক তফাত! আমার গল্প লেখায় এ-ও এক বড় ও মৌলিক বাধা।

*****

আমি সবসময় একধরনের কল্পনা, একধরনের ভাবময় অভিলাষ, একধরনের মানসিক দ্বন্দ্বদীর্ণ প্রেক্ষিতে অবস্থান করতে থাকি। এগুলো যখন বেশি হিংস্র হয়ে যায় বালিশে মাথা গুঁজবার পরও, তখন এই চিন্তা মোচনের জন্য উপস্থিত বিষয় দেখতে থাকি, তা নিয়েই চিন্তা করতে সংলিপ্ত হই। অধিকাংশ সময় চোখ বন্ধ হয়ে আসবার পূর্ব পর্যন্ত চোখের সামনে সাদা কাগজে কালো অক্ষরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখি, বুঝতে পারি আর না পারি।

কল্পনা ব্যাপারটা আনন্দময় সুখী মানুষের জন্য, এষণা যাদের নেই, তাদের জন্য। শিল্পের মানুষেরা কল্পনার মাঝের অসংলগ্নতার বেপরোয়া ধারা বুঝবেন। কী বেগবান অনিষ্ট অন্বেষ তাঁদের!

এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে, আগুপিছু এত চিন্তা করে, পজেটিভিটির নেগেটিভিটি আর নেগেটিভিটির পজিটিভিটি বুঝে কোনো গল্প লেখার মতো স্পর্ধার অনুমোদন আমার ঔচিত্যবোধি আমাকে দেয় না।

*****

একটা কবিতা-গান অথবা গদ্যের মনঃপূত কোনো পঙ্ক্তি কীভাবে যেন ইঁদুরের কলের মতো ধরে ফেলে করোটি। তারপর নিজ থেকে তাতে পানি সেঁচে। আর সে মুহূর্তে পূর্বে না-বোঝা কোনো মর্ম এত নিগূঢ়ভাবে মর্মায়ন হয়, উদ্বেলে-আপ্লুততায় নেচে উঠতে ইচ্ছে করে! এখন একটা পঙ্ক্তি নিয়ে ঘুরছি করোটিতে—অঞ্জন দত্তের গানের কয়েকটা শব্দ— ‘বেলা বোস, তুমি শুনছো কি?’

বেলা বোস কী শুনবে? কেন শুনবে?  সে কে?  তাঁর সঙ্গে কি আমার কোনো নৈকট্য আছে—সুজন-পরিজনের? অথবা এমন অদ্ভুত আবদার কেন আমি শূন্যের কাছে, বাতাসের কাছে করেই যাচ্ছি? বাতাসের সঙ্গে রাস্তায় একা হাঁটবার কালে বয়সের স্ব-আবেগে যে শিহরণ আমাকে প্রতিমুহূর্ত বেগবান করে, কুদে-নেচে তার সঙ্গে অন্বয় সৃষ্টি করে একজাতীয় মন্দ্রন-অযোগ্য আলোময় সুশীলতা, তা প্রতিবার ‘বেলা বোস, তুমি শুনছো কি?’-র সঙ্গে হেলানো লতার হাওয়ায় সাঁতরাবার মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে।

আমার গল্প শেষের দিকে।

***** 

প্রত্যেক গল্পকার চান—অন্তত আমাদের বাংলাদেশি গল্পকাররা—তাঁর গল্পের একটা স্মাশিং ফিনিশিং হোক। আমার মাথায়ও এ ধরনের একটা বিধুর-বিধুর সমাপ্তি টানবার ইচ্ছে হচ্ছে। কারণ, ক’দিন আগে আমার ভ্রমণ এমন স্থলে হয়েছে, যেখানে গেলেই আমি একধরনের অবশসর্বস্ব বিহ্বলতায় আক্রান্ত হই;—তা আমার পুরনো (আবারো পুরনো!) স্মৃতির আবছায়া—ঝিরঝিরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি-প্রামাণ্য; অথবা সে জায়গার পরিবেশ-প্রতিবেশ, একটা রেললাইন, অল্প কিছু গাছ ঘোরগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে একটা মেঘমেদুর আবহাওয়ায় থিরথির কাঁপতে-কাঁপতে শহুরে এক বালককে আকাশপাতাল ভাবনায় ফেলে নিজেকে যাচাই করবার এক দুর্লঙ্ঘনীয় গিরিতে ফেলে দেবার জন্যই বোধ করি। 

এ গল্পটা লিখতে-লিখতে আমার আরও শত গল্প, হাজারও চিত্রকল্প, অসংখ্য অদ্ভুতুড়ে কাহিনী আর ভাবাবেশের অজস্র দৃশ্যচিত্র সতীব্র উদ্ভাবকতায় হাতকে থামিয়ে দিচ্ছে বারবার। এ গল্পের শেষ বাক্যটাও এসে পড়েছে আমার অন্তঃপুরে। মনে পড়ছে, এ গল্পটা লিখতে-লিখতে, ইন্তেকালের আগের দিন, আইসিউতে, বারো দিনের অজ্ঞান আব্বুর চোয়াল নাড়িয়ে ওঠা দেখে, মাকে আমার নিশ্চিন্ত-নির্ভরতার পরম আশ্বাস- আম্মু, আব্বু ভালো হয়ে যাবে...

লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই