চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বাংলাদেশি সিনেমায় নারী প্রাসঙ্গিকতা


বাংলাদেশি সিনেমায় নারী প্রাসঙ্গিকতা
সাইফ মাহমুদ

শুরু কথা

বর্তমানে বাংলা সিনেমার অবস্থা নিয়ে লিখতে বসলে অনেক প্রসঙ্গই চলে আসে। স্বাধীনতার পর থেকে যদি আজ অব্দি দেখি তাহলে আমরা ৪৭ বছরে অনেক সিনেমা পেয়েছি। প্রায় চার হাজার হবে এর সংখ্যা। এই চার হাজারে চারশ মানসম্মত হবে কিনা সন্দেহ। কেন?  তাহলে বাকী সিনেমা কী সিনেমা নয়?

আমি আগেও বলেছি সিনেমা আমাদের সমাজ এবং জীবনধারাকে পর্দায় তুলে ধরে। আমাদের জীবন ধারা কেমন এমন প্রশ্ন নিশ্চই করবেন না। কেননা উত্তরের সাথে সিনেমার জীবন ধারা মিলবে না। কেননা জীবন ধারা থেকে বাস্তবসম্মত উপাদান নিয়ে তাতে বিনোদনের উপাদানের মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে পরিচালক সিনেমা বানান। 

প্রায় পঞ্চাশ বছরে আমাদের সিনেমার বাপ দাদারা যে বিকলাঙ্গ সংস্কৃতি বয়ে এনেছেন (!) আমরাও তো এখনো তাই বয়ে যাচ্ছি। যে সকল সিনেমা আজ আমরা দেখছি তার নাচ, গান, হাসি, কান্না আর একশন দৃশ্যের সমন্বয় মোটেও বাঙালি সংস্কৃতির মাঝে পড়ে না।

নায়ক নায়িকা নির্ভর বুর্জোয়া শ্রেণীর এসব সিনেমার কিছু কিছু অসঙ্গতি এতটাই প্রাসঙ্গিক যে না বললেই নয়।

সিনেমায় নায়িকা বা নারী অভিনেত্রীদের সরব উপস্থিতি এর প্রাণ। কিন্তু তাদের আমরা কতটুকু অভিনেত্রী হিসেবে পর্দায় দেখি প্রশ্নের বিষয়। বরং তাদের আমরা নায়িকা হিসেবেই দেখি। আরেকটু খোলাখুলি করে বললে ‘পণ্য'  হিসেবে দেখি। এই একবিংশ শতাব্দী তে এসেও মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা বা আমাদের বাপ দাদাদের কাঁধে চাপা বিকলাঙ্গ সংস্কৃতি আমরা ছাড়তে পারি না। আরো বৃহৎ পরিসরে উত্তরসূরির কাজটা করে যাই।

নারী'র ভূমিকাটা এখানে একজন অভিনেত্রী’র থেকে নয় তার গ্ল্যামার দেখে নির্বাচন করা হয়। তাদের এই ভূমিকাটাই সিনেমায় অভিনেত্রী থেকে পণ্যের কাতারে নিয়ে গেছে। আমরা বাস্তব জীবনে নারীদের যেভাবে দেখে আসছি সিনেমায় নায়িকাদের সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না। তাদের গড় উপস্থাপনটাই কিন্তু চোখের আনন্দ দানের জন্য। না-হলে আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন ঢাকার রাস্তায় মিনিস্কার্ট পরিহিতা কোনো মেয়ে কখনো দেখেছেন?  আমাদের সমাজ এটাকে কীভাবে নেয়? শুধু এই না আরো অনেক কিছু আছে।

হালচালে বাপ দাদার শেখানো বুলি

“খুবই কাম উদ্দীপক, সংক্ষিপ্ত পোষাক পরে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে এক সুন্দরী মেয়ে। পাশেই ছিল কিছু বখাটে ছেলে। মেয়েকে দেখে অসৎ কামনা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে ঝাপিয়ে পড়ল তারা মেয়ের উদ্দেশ্যে। রগরগে দৃশ্য চলছে মেয়েটি নিরুপায় হয়ে “বাঁচাও বাঁচাও” বলে চিৎকার করতে থাকল। পাশ দিয়েই নায়ক যাচ্ছিল। নায়িকার আর্তনাদ শুনে আসমান থেলে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লেন নায়ক। ঢিশুম ঢিশুম করে মেরে তক্তা বানিয়ে দিলেন বখাটেদের। নায়িকা ধন্যবাদ জানায়। তখনই গান আরম্ভ।” হলে থাকা দর্শকেরা উল্লাসে ফাটিয়ে দিচ্ছে সব। এটি বাংলা সিনেমার চিরাচরিত দৃশ্য। আফসোস এতকাল পরেও আমরা এর গণ্ডি পার হতে পারিনি। খুব কম সিনেমাই আছে যেখানে নারীদের গতর বিলানো দৃশ্য বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা গেছে। কেন?

পরিচালকদের যখন জিজ্ঞেস করা হল নারীদের এমন উপস্থাপন তারা কেন করেন  তখন জবাবে বলেন এটা দর্শকদের চাহিদা। তাই তারা চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেন। 

ভেবেছিলাম আঙুল তাক করব ওই সব পরিচালকদের দিকে এখন দেখছি দোষের পাল্লা আমাদের দিকেই ভারী! তারা বলেন দর্শক দেখে। ওই সব সিনেমার দর্শক কারা? সাধারণ লোক। তাহলে ইন্টেলেকচুয়াল (!) লোকেরা কী দেখে? তারাও দেখেন তবে গোপনে। তবে সবাই যে দেখেন তা কিন্তু না। সে যাই হোক, সিনেমায় নারীর এমন উপস্থাপন মোটেও সুস্থ কিছু নয়। অভিনয়ের সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম সিনেমাতেই যখন অভিনয় কে প্রাধান্য না দিয়ে চামড়ার রঙ আর দেহের গঠন ভঙ্গির উপর প্রাধান্য দেয়া তখন আর কিছুই বলার থাকে না। ধনতান্ত্রিক এই দেশে যখন এটাই রীতি হয়ে উঠে তখন সমান অধিকার বলে আর কিছু থাকে না। চিরকাল ধরেই নারীরা পুরুষ শাসিত। ঘরে কিংবা বাইরে। এর প্রভাব যে সিনেমায় পড়বে না তা কী হয়?

আইটেম গানের মধু

সম্প্রতি সিনেমাগুলোতে আইটেম সং নামে একটা গান জুড়ে দেয়া হচ্ছে। আইটেম সং কী এমন প্রশ্ন করে বসা ব্যক্তিকে নিষ্পাপ বলাই যায়। 

কেমন হয় এই আইটেম সং? এর জবাব তো দুই লাইনে লেখা যায় না! অভিনয়, গল্প ইত্যাদি বাদ দিয়ে নির্মাতারা যেখানে আইটেম সং-এ অঢেল টাকা ব্যয় করছেন তাহলে বুঝতেই হবে আপনার তাদের কাছে এর মূল্য কতটুকু। বিশাল সেট, ঝকমকে লাইটিং, শত শত পুরুষের মাঝে অর্ধ নগ্ন আইটেম গার্ল নাচছেন। সেই গানের কথাও বেশ উত্তেজক।

‘এভাবেই মেয়ে পটানোর নামে যে প্রেম আমরা দেখি সেখানে অজান্তেই ইভ টিজিং কে প্রমোট করছি। বাস্তব জীবনে এসব ইভ টিজিং এর কাতারেই পড়ে।’

সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ করা আইটেম সং দেখে তাই বোধ হচ্ছে। লিরিকের বাহার কেমন বলছি।

এসব যৌন আবেদনীয় দৃশ্যায়ন এর বাহার দেখে হলে লোক নিজেকে সামলাতে পারে না। হল থেকে ফিরে আমার এক বন্ধু তাই বলেছিল। দর্শক কী করল জানতে বন্ধু যা বলল তা সেন্সরড। 

গানের কথা কতটা অশ্লীল আর রুচি বিবর্জিত তা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন।
“ গুণ গুণ করে যে ভ্রমর আমার চারিপাশে
সামলে রাখি মনের গার্ডেন ভরা ফাল্গুন মাসে।
নারে নারে না কেউ পিছি ছাড়ে না
আমি কোন গলি যে ধরি”

এটি হিট হওয়া একটি বাংলা আইটেম সং। এরকম শত শত আইটেম সং খোঁজ নিলেই পাবেন । এসব গানের তালে শতাধিক পুরুষের সাথে নাচতে দেখা যায় আইটেম গার্লকে। গানের কোরিওগ্রাফিও যৌন আবেদনময়। অশ্লীল সেসব অঙ্গভঙ্গি তে তারা যখন তাল মেলান তখন নারী আর নারী থাকে না। কেন তারা এইসব গানের তালে নাচেন? দেখা যাচ্ছে যে, আইটেম গার্ল হিসেবে যারা নাচেন সঙ্গে সাপোর্ট ডান্সাররা এরা ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিক অভাবের তাড়নায় জীবিকা নির্বাহ করতে না পারায় এই রঙিন দুনিয়ায় এসেছেন। যমুনা টেলিভিশনে দেখা একটি প্রতিবেদনেও তাই দেখেছিলাম। কিন্তু এই কথাটা এক দশক আগে হলে মানা যেত। বর্তমানে যিনি নায়িকা তিনিই আইটেম গার্লের ভূমিকা চতুরতার সাথে পালন করছেন। অখ্যাত’র তুলনায় বিখ্যাত নায়িকারা যখন আইটেম গানে কোমর বেশি দোলান তখন জিনিসটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ভাবা দরকার। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক আর আইটেম গানে খ্যাতি লাভের মত উপাদান প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। টাকাকড়ির কাছে নৈতিক অবনতি সিনেমায় নতুন কিছু না। দিন শেষে নায়িকা হিসেবেই তাদের আমরা মাথায় তুলে রাখি।

নারী নির্ভর সিনেমা কতটুকু “নারী নির্ভর”

নারী নির্ভর বা নারী চরিত্রকে প্রধান করেও ইদানীং সিনেমা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও নায়িকার দেহ ব্যবহারের সুযোগ ছাড়ছেন না পরিচালকেরা। কিছুদিন আগে মাহিয়া মাহি অভিনীত একটি সিনেমা দেখেছিলাম। নাম “অগ্নি ২”। সেখানে দেখা যায় মাহি বাবা মা হত্যার প্রতিশোধ নেয়। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য খুনিদের দেহ বিলিয়ে দেয়ার মত সুযোগ এনে দেয় আর সেখানে আছে রগরগে দৃশ্য এবং তারপরেই খুন।

প্রশ্নটা হল এক্ষেত্রে যদি মাহির বদলে কোনো নায়ক থাকত? তখন কী উলটো হতো না ব্যাপারটা? হ্যাঁ, তখন নায়ক মাষ্টার প্ল্যান করে সকল খুনিদের মেরে ফেলবে। তাহলে নায়িকা'র ক্ষেত্রে কেন তা হয় নি? এখানে এটা মাথায় রাখতে হবে যে পরিচালক কিন্তু আমাদের জন্য সিনেমা বানান। আমরা অমন জিনিস চাই বলেই ত তারা বানায়।

সমাজের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া

সিনেমায় প্রায়ই দেখা যায় নায়িকাকে পটাতে নায়ক নানা ধরণের কাজ করেন। তার পিছু ঘুরে বেড়ান, তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে বিরক্ত করেন, ফোনে জ্বালাতন করেন। শেষতক নায়িকা বাধ্য হন নায়কের প্রেমে পড়তে। তারপরেই গান। মনোরম দৃশ্যে গান হয়। দেখা যায় গানে একঝাঁক ছেলেমেয়ে তাদের পেছনে নাচছে। দৃশ্যে দৃশ্যে কাপড় বদলে যাচ্ছে। তারপর নায়িকার বাবা বা ভাই আসে। ভাই নায়কের সাথে মারামারি করে তার বোনের পেছনে লাগা ছেলেটির সাথে। কিন্তু হিরোরই জয় হয়। আমরা ত তাই-ই চাই! এভাবেই মেয়ে পটানোর নামে যে প্রেম আমরা দেখি সেখানে অজান্তেই ইভ টিজিং কে প্রমোট করছি। বাস্তব জীবনে এসব ইভ টিজিং এর কাতারেই পড়ে। আমার বোনের সাথে কেউ এসব করলে আমিও বাধা দিব। কিন্তু সিনেমায় গিয়ে যদি আমি ইভটিজার এর পক্ষ নেই সেইটা কতটা বাস্তবতা বিবর্জিত হয় নিজেই ভেবে দেখুন।

শেষ কথা

সবশেষে আমাদের নিজেদের ঠিক হতে হবে। নারীদের শুধু পণ্য না ভেবে “নারী” সম্মানটুকু দিয়ে যদি সিনেমা তৈরি হয় তাহলে এই অনৈতিক, অশ্লীলতার শেষ হতে পারে। আমরা যদি বেঠিক থাকি তাহলেই সমস্যা। আমি কোনো বিশেষ ব্যক্তি নই যে যার কথায় এতকাল ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতি বদলে যাবে। তবু আমাদের ছোট ছোট পরিবর্তন বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারবে।

জয় হোক বাংলা সিনেমার।

১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, সিলেট।

লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই