চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আমি পাঠক বলছি (৬)




[“আমি পাঠক বলছি” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে আমার পড়া বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। আমি সর্বভুক পাঠক। যা পাই তাই গিলি। আমার কাছে মূল বিষয়- একটি বই সুখপাঠ্য কী-না। সুখপাঠ্য হলে লেখক আস্তিক না নাস্তিক, মোল্লা না ব্রাহ্মন, দেশি না বিদেশি, নতুন না পুরাতন, লেখায় গভীরতা আছে কী নেই এসব বাছবিচার এ যাই না। লেখাটা পড়ে ফেলি। কখনো কখনো মতামত ও দেয়ার চেষ্টা করি। পাঠক হিসেবে আমার এই কখনো কখনো দেয়া বক্তব্য হয়ত লেখকের/লেখকগোষ্ঠীর মনঃপূত না-ও হতে পারে কেননা লেখার বিচারিক ক্ষমতা কখনোই একজন পাঠক আর লেখকের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। দৃষ্টিভঙ্গীও সমান হয় না। তবু পাঠক হিসেবে ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ থাকায় কলম হাতে নেয়ার দুঃসাহস করলাম। আশা করছি, লেখকগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আমার এই দুঃসাহস!]



পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ওবায়েদ হকের ‘জলেশ্বরী’। আখতার মাহমুদ

ট্রেন ভ্রমণে বই পড়ার নেশা জেগে ওঠা বা ট্রেনে বইপড়াটা আনন্দদায়ক কেন সে উত্তর ঠিক জানা নেই। অথবা এমনও হতে পারে সবখানে প্রশ্ন অনর্থক এবং অপ্রয়োজনীয়। অদ্ভুতও। কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলেই হয়তো তেড়ে এসে বলবে- আঁতেল কোনহানকার। বই পড়বি পড়। পইড়া ফাও সময় নষ্ট করবি কর। আাজাইরা প্যাঁচাল ক্যান?
এসব নানাদিক বিবেচনায় প্রশ্নটা আপাতত তুলে রাখি। কোনো এক তুমুল সিরিয়াস ঝগড়ামুখর আলোচনার মাঝখানে, নিরীহ প্রশ্নটা টুপ করে ফেলে দেব। এতে করে হয়তো কোথাও যুদ্ধ থেমে যাবে না। শিশুরা বেঁচে যাবে না যুদ্ধ ও ধর্ষণ থেকে। ঘটার মত এতটুকুই ঘটবে হয়তো যে আচমকা ঝগড়াটে কেউ খেই হারিয়ে ফেলবে। ঝগড়া থেমে যাবে, অন্তত কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও। 

সে-যাক, গেল সপ্তায় এক ট্রেন ভ্রমণের দিনে জলেশ্বরী মেলে ধরি মুখের ওপর। বই পড়ার আগে সাধারণত লেখককে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিই আমি। বলি- দেখো বাছাধন, আমি সহজে মুগ্ধ হবার মানুষ না। তোমার ক্ষমতা থাকলে করো দেখি মুগ্ধ। তোমার ভক্ত বানাও দেখি তো কত জোর তোমার কলমের! এটা করি আসলে পাঠক কল্যাণ সমিতির  সভাপতি, প্রচার সম্পাদক এবং একমাত্র সদস্য হিসেবে। গুণী লেখকরা যখন প্রায়শই পাঠককে বাতিল করেন, পাঠকের বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং যখন কেউ বলেই ফেলেন উগ্র লেখক বোদ্ধা মননে- আমি পাঠকের জন্য লিখি না।…. তখন, পাঠক হিসেবে পাঠক সমাজের দায়িত্ব একাই তুলে নিই কাঁধে। স্রেফ এটা প্রতিষ্ঠা করতেই যে, আমরা পাঠকরা ছাড়া আপনি লেখক মহাশয়, স্রেফ খালি একটা কলসি এবং বাজেন বেশি।

ওবায়েদ হক, আমাকে হতাশ করে মুগ্ধ করে ফেলেন। পড়তে পড়তে বিরক্ত হই, ধ্যাত্তেরি। এত মুগ্ধতা আসে কোত্থেকে? যাচ্ছি চট্টগ্রাম, কিন্তু বইয়ের ভেতর ডুবে থেকে মনে হয় আমার যাত্রাও সেই জলেশ্বরী তথা জলছরির দিকেই। ভুলে যাই, অফিসের মারাত্মক কাজের চাপ মাথায়, চট্টগ্রাম গিয়েই আবার রাতে বা তার পরদিন সকালে ফিরতে হতে পারে যদি অফিসের বস ছোট্ট একটা কল করে দেন। মাত্র দশ সেকেন্ডে আমার তিনদিনের আনন্দভ্রমণ মাটি হয়ে যাবে যদি বস কর্পোরেট কণ্ঠে বলে বসেন- কাল অফিসে থাকবা।
যাত্রাটা শুধু চট্টগ্রাম গিয়েই ঠেকবে না। একদম রাঙামাটি পর্যন্ত যাব। গ্রামের বাড়িতে… গ্রামও না ঠিক, মফস্বল বলা চলে ওটাকে। কিন্তু কেউই মফস্বলের বাড়ি বলে না, বলে গ্রামের বাড়ি! শুনতেও মিঠে লাগে। আহ, গ্রামের বাড়ি কতদিন পর! মামা হয়েছি, এই সুসংবাদ পাওয়া হয়েছে আরো মাস ‍দুয়েক আগে, কিন্তু টাকা-পয়সা আর সময়ের মধ্যবিত্ত সংকট মিলিয়ে ভাগিনাকে দেখতে যাবার সুযোগ মিলল কেবল মাত্র। এই সুযোগেই জলেশ্বরী আমার হাতে আর আমি অফিসের চাপ, গ্রামের বাড়ি যাবার ফিনফিনে আনন্দ সব ভুলে মুগ্ধ পড়ে যেতে থাকি এবং বিরক্তও হই লেখককে চেপে ধরার শক্ত কোনো কারণ না পেয়ে।

কাজলের যাত্রা, আমি বলবো এক মহাকাব্যিক যাত্রা নানান উপলব্দির ভেতর দিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্য এই বইটির- এটি গ্রামকে তুলে আনে, এটি যেমন ঠিক তেমনই। এমন এক গ্রাম যে গ্রামকে কল্পনা করাই শক্ত হয়ে দাঁড়ায় আমার মত শহুরে মুরগির পক্ষে। অথচ কী জ্বলজ্বলে বাস্তব গ্রাম তুলে আনেন তিনি। চরাচর ভেসে যাওয়া, গ্রামকে গ্রাম বর্ষা-বন্যার জলে আঁটকে পড়া থাকা মানুষেরা, তাদের জীবন… জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি- সবকিছুই তীব্র হয়ে ফোটে জলেশ্বরী উপন্যাসে। পাশাপাশি বেশ মমতায়ও ফোটে। নানান কুসংস্কার, নানান ভ্রান্তি, লোভ-লালসা, হিংস্রতা সবকিছুকেই দারুণ মমতায় এঁকেছেন ওবায়েদ হক। সমালোচনাও করেছেন গল্পের ভেতর দিয়ে, গল্পের চরিত্রগুলোর নানান বর্ণিল উপস্থাপনায়। ধর্মে-ধর্মে রেষারেষি, ক্ষমতাবান পক্ষের দুর্বলের ওপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়া, শুয়োরের মত বাপ কর্তৃক মেয়েকে ধর্ষণ... ইত্যাদি নানান সমালোচনা রয়েছে, কুসংস্কারের কথাতো একবার বলেছিই। আর রয়েছে অভাব! উৎকট দানব সদৃশ অভাব। উপন্যাসে দেখতে পাই এই দানব খেয়ে নিচ্ছে নৈতিকতা-প্রেম-মমতা। তবে ওবায়েদ হকের গ্রামের শত দোষ এবং গ্রামীণ চিত্রপট এঁকে ফেলার মধ্যে মমতা আছে। এ-কাজ সকলে পারবেন না। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রামীণ প্লট প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় শাহাদুজ্জামানের কয়েকটি গল্প- ‘নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডে’, ‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’, ‘ঘাসের উপর সবুজ বাতাস’, ‘মৌলিক’ ইত্যাদির কথা। এসব গল্পে লেখকের গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষের চিত্র বর্ণনে মমতা অনুপস্থিত। একইভাবে মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তেও আমি মমতার ঘ্রাণ পাই না। টের পাই কেবল অনুক্ত তীব্র এক সমালোচনা। লেখক হিসেবে একরকম এলিটিজমের ঘ্রাণ মানিক, শাহাদুজ্জামানে এবং বর্তমানে আরো অনেকের লেখায় আমি পাই যা বেশ অপছন্দ করি। অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে। আমি আমার উপলব্দির কথাটা বললাম কেবল। বর্তমানে অনেকের মধ্যে লেখায় মিশে যাওয়ার ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে লেখকীয় আভিজাত্য ধরে রাখার প্রবল চেষ্টা, লেখক হিসেবে নিজেকে মহৎ ভাবা , মানুষের আত্মস্বীকৃত ত্রাতা হয়ে ওঠার চেষ্টা দেখে মৃদু অর্ধচন্দ্র হাসি প্রায়শই মুখে ঝুলিয়ে রাখি। ভাবি- এরা লেখক হতে চাইছে কেন? এদের হওয়া উচিত কট্টর, ‍কৃপণ, করুণ সুশীল মহাজন। দামি সাদা পাঞ্জাবীর ওপরে কাশ্মীরী শাল চাপিয়ে, কড়া ইস্ত্রি করা লুঙ্গির কুঁচিগুলো টিকিয়ে রেখে কাদার মধ্যে হেঁটে যাবেন দামি জুতো পায়ে রেখে, কাদায় জুতো সমেত আঁটকে যাবেন এরা তবু লেখকীয় আভিজাত্যবোধ মাথায় চড়ে থাকে বলে জুতোটা বগলতলায় নিয়ে, লুঙ্গি মালকোচা মেরে, দামি শাল ছুড়ে ফেলে কাদা মাড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে যাওয়া শিখবেন না।

তাপসী চরিত্রটার বিকাশ বা উপস্থাপন যদি লক্ষ্য করি আমরা তবে দেখব, আসলে চরিত্রটা না থাকলে আসল গল্পের কোনো ক্ষতিই হতো না। তবে অনেকক্ষেত্রেই মূল চরিত্রের (কাজলের) ভাবনা ফোটাতে তাপসীর চরিত্রটা কাজে এসেছে। কিন্তু সেটা অন্য চরিত্র দিয়েও করা যেত। জলছরির যাত্রাপথে অনেকের সাথেই দেখা হয় কাজলের। কিন্তু লেখক প্রবল করে তোলেন তাপসী চরিত্রটিকেই। পক্ষপাতিত্ব? আমি বলব আসলে পাঠকের সহানুভূতিকে চাঙা রাখার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল এটি। এটি রোমান্টিসিজম।

গ্রামের মানুষের প্রতি অমন মায়া টের পেয়েছি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘ঢোড়াইচরিত মানস’ ইত্যাদিতে কেননা এসব রচনায় আমার মনে হয়েছে অকারণ আভিজাত্যবোধকে সযত্নে পাশ কাটিয়েছেন লেখকেরা। জলেশ্বরীর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। লেখক কাজলকে গ্রামীণ জীবনে যেভাবে মিশিয়ে ফেলেন, তা প্রশংসনীয়। এমনকি এটাকে আরোপিতও মনে হয়  না। স্বাভাবিক, সহজাতই মনে হয়। আমরা দেখি- আমেরিকা ফেরত উচ্চবিত্ত জীবনে অভ্যস্ত এক যুবক কী দারুণভাবে মিশে যাচ্ছে বেদেনিদের সাথে, মাঝিদের সাথে, তাপসীর সাথে, আসাদ পাগলার সাথেও। এই ‘জলেশ্বরী’তে লেখক যে মায়ার চাষ করেন সেটাই হয়তো আমাকে মুগ্ধ করে। নইলে কাহিনী মসৃণ স্নিগ্ধ এগিয়ে গেলেও, একটা চমকের অপেক্ষায় পড়ে গেলেও মুগ্ধতা সকল লেখা পাঠে আসে না। জলছরির দিকে যাত্রায় ক্রমেই আপনি ঢুকে পড়বেন এক অদ্ভুত জগতে। যে জগত আজো অস্তিত্বশীল, বেশ তীব্রভাবেই। তবে আমরা টিভির সামনে বসেই কেবল ঝকঝকে আলোতে সেসব দেখি, বিশেষ করে বন্যায়-বর্ষায়। ভাবালু হয়ে মাঝে মাঝে হয়তো ত্রাণ সংগ্রহের তহবিলে শ’পাঁচেক বিকাশ করে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরি-ফিরি। আঁধারে, সেসব জগতে দাঁড়িয়ে দেখার সৌভাগ্য এবং সাহস আমাদের সকলের হয় না। সে ভয়ানক বাস্তব চিত্র কতটা ভয়ানক, কতটা তীব্র আবার কতটা মায়াময় তার সামনে ওবায়েদ হক আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। এবং আমরা বিস্ময়ে দেখি- ওভাবেও মানুষ বাঁচে, ভালবাসে এবং ঘৃণা করে। ওখানেও মানুষকে তাড়িত করে ক্ষুধা-লোভ এবং সাম্প্রদায়িকতা। এ সবকিছুই সহজাত। লেখক আমাদের দুটো পিঠই দেখান- সাম্প্রদায়িকতা থাকলেও অসাম্প্রদায়িক মানুষেরাও থাকে। হিংস্র মানুষেরা থাকলে দয়ালু মানুষ গুলোও থাকে।

‘জলেশ্বরী’ পড়তে পড়তে কিন্তু একেবারে ভুলি না যে আমি পাঠক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও একমাত্র সদস্য। ফলে আমার কেবলই মুগ্ধ হওয়া চলে না। পাঠক সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে লেখককে কিছু প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। তাই কিছু প্রশ্নের বাণ সাজাই, লেখককে ছুঁড়ে দিতে।

একজন লেখকের কি দায়িত্ব কেবলই পাঠককে মুগ্ধ করে যাওয়া বা এমন কিছু লিখে যাওয়া যা পাঠককে কেবলই মুগ্ধ করবে? পাঠককে ভাবালু ভাললাগা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনাও কি লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? লেখকের কী উচিত নয়, পাঠককে নির্মমভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া এক সিদ্ধান্তের দোলাচলের মাঝখানে? নিরাপদ বিনোদন হাজারো-লক্ষ লেখক দিয়ে গেছেন পাঠককে, এর থেকে বেরিয়ে আসা উচিত নয় লেখকের? এমনতর মোহময়, মুগ্ধতাছড়ানো উপন্যাসও হাজারে হাজারে, নতুন কিছু কই? নতুন ভাব কই? নতুন লেখার ধরণ কই? ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কই? জলেশ্বরী উপন্যাসে এমন কী নতুনত্ব আছে যা আগে কেউ লিখে যান নি? তবে কি এটা নতুন করে আবার রেডিও-টেলিভিশন আবিষ্কারের মত হয়ে দাঁড়াল না? মানুষ নতুন মনে করে চমকে উঠে বলবে- ওহ, দারুণতো! কিন্তু গভীর উপলব্ধিতে যারা ভাববেন তারা বলবেনই- এ-আর নতুন কী? এইসব সরল মোহময় গল্পগুলো কি আসলে সাহিত্যের গলার কাঁটা নয়? পাঠকের সামনে নতুন নতুন মোড়কে সেই পুরোনো দিনের গান নয়? এসব নিয়ে কি লেখক কখনো ভেবেছেন? নাকি লেখকের, লেখকদের এসব ভাবার দায় বা সময় নেই?

নানা কথায়, বারবার ভুলে যাচ্ছি একটা কথা বলতে যে, জলেশ্বরী উপন্যাসের মূল প্লটটা দাঁড়িয়ে আছে কিছু দৃষ্টিকটু কো-ইনসিডেন্টের ভিতের ওপর। এছাড়াও উপন্যাসের অলঙ্করণে বা সাজগোজে যা-ই বলি না কেন, তাপসী চরিত্রটির আমদানি ওভাবে গাছের ওপরে নাটকীয়ভাবে না করলেও চলতো। বড় বেশি সিনেমাটিক মনে হয়েছে। কো-ইনসিডেন্টতো বটেই। আচ্ছা, ওখানে তাপসীর জায়গায় একটা কিশোর থাকলে কী ক্ষতি হতো? গল্পের প্লটের তো কোনো ক্ষতি হতো না। একটি স্নিগ্ধ লাবণ্যময়ী আবার একই সঙ্গে বিদ্রোহী নারী চরিত্র লেখার চার্ম বাড়ায়? পাঠককে বেশি নাড়া দেয়? ‘নারী’ কি পাঠকের মনোযোগ শিথিল মানবিক করে তোলার যন্ত্র? যে বিদ্রোহী আকর্ষণীয় নারী, যার সেবা করার মানসিকতাও থাকবে আবার সাপের মতো ফণা তুলতেও যে দ্বিধা করবে না?... লেখক কী তবে পাঠকের সহানুভূতি আদায়েই তাপসী চরিত্রটিকে ঠেসে ঢুকিয়েছেন গল্পে? তা-ও আবার অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে গাছের আগায় তার সাথে প্রথম সাক্ষাত মেলে পাঠকের! তাও আবার জনমানবহীন এক দ্বীপসম জেগে থাকা চর বা ওরকম কিছু একটাতে। এটা ঠিক লেখকের দোষ কী না সেটা বিস্তর আলাপের বিষয়। মার্কেজও এ কাজ করেছেন। তার ‘আমি শুধু ফোন করতে এসেছিলাম’ গল্পটির কথা ধরা যাক। এই গল্পটিতে একজন সুন্দরী তরুণীকে ব্যবহার করেছেন তিনি পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া দিতে। অনেকেই বলে থাকেন এটি একটি বিখ্যাত গল্প। কিন্তু আমি দেখি এই গল্প মারা যায়- যদি সুন্দরী তরুণীর বদলে একজন কুৎসিত তরুণী থাকে বা একজন পুরুষ দ্বারা সুন্দরী তরুণীকে প্রতিস্থাপন করা হয়। যে গল্প দুর্বল হয়ে পড়ে নারীর বদলে পুরুষ চরিত্র ব্যবহারে বা সুন্দরী তরুণীর বদলে কুৎসিত তরুণীর জীবন বয়ানে, সে গল্প কী আদৌ গল্প? না। সেসব গল্প নয়। যেসব লেখক নারী চরিত্রকে পুঁজি করেন, পাঠককে আবেগ তাড়িত করতে সেসব গল্প দুর্বল। সেসব লেখা দুর্বল। এবার যে-ই একাজ করুক সেই দুর্বল লেখক আমার চোখে। এমনকি যদি আমি নিজেও কখনো করি একাজ, আমিও দুর্বল লেখক। একাজ করলে মানুষের আবেগকে পুঁজি করা ব্যতীত আমার লেখার ভেতরে প্রয়োজনীয় মশলা নেই। আমি বাতিল। আমি ফালতু।

তাপসী চরিত্রটার বিকাশ বা উপস্থাপন যদি লক্ষ্য করি আমরা তবে দেখব, চরিত্রটা না থাকলে আসল গল্পের কোনো ক্ষতিই হতো না। তবে অনেকক্ষেত্রেই মূল চরিত্রের (কাজলের) ভাবনা ফোটাতে তাপসীর চরিত্রটা কাজে এসেছে। কিন্তু সেটা অন্য চরিত্র দিয়েও করা যেত। জলছরির যাত্রাপথে অনেকের সাথেই দেখা হয় কাজলের। কিন্তু লেখক প্রবল করে তোলেন তাপসী চরিত্রটিকেই। পক্ষপাতিত্ব? আমি বলব আসলে পাঠকের সহানুভূতিকে চাঙা রাখার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল এটি। এটি রোমান্টিসিজম। নইলে, শেষতক কাজলের সাথে আসাদ পাগলা থাকতে পারতো। মাঝিদের দুজনের একজন বা দুজনই থাকতে পারত। কিন্তু ওবায়েদ হক গল্পটা শেষ করেন তাপসীর হাত কাজলের হাতে তুলে দিয়েই……. যদিও শেষটা নিখুঁত এবং এরচেয়ে সুন্দর শেষ আর হয় না। কিন্তু তবুও আমি লেখকের দিকে আঙুল তুলবোই- তাপসীর বদলে আসাদ পাগলা কেন নয়? শেষ দৃশ্যে আসাদ পাগলার জায়গা হলো না কেন? বা মতিন চোরার? বা লিয়াকত-বজলুদের কেউ?

বলছিলাম, কো-ইনসিডেন্টের কথা। নিতাই মাস্টারের সাথে দেখা হয় কাজলের। আবার মাস্টারের লক্ষীর সাথেও কাজলের দেখা হয়ে যায় যেখানে তাদের নিজেদের ভেতরই  দেখা হয় না দীর্ঘদিন। কাজলকে যখন টাকার লোভে পানির ধারে ফেলে রেখে চলে যাওয়া হয় তখন পানিতে ডুবে সে মরে না। বেদেনির নৌকা কাছে এলে তাপসি-কাজল দুজনেই ঝড়ের তোড়ে কাহিল হয়ে গাছ থেকে খসে পড়ে পানিতে। এমনকি, সেই বেদেনির নৌকাও জলছরিরই পথ খুঁজছে! যে মতিন চোরাকে কাজল বাঁচায়, সেই মতিন চোরার সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যায় ডাকাতের পাল্লায় পড়ার পর, মতিন তাকে বাঁচায় পাল্টা, অন্তত কিছু সময় পাইয়ে দেয় তাকে। অন্যদিকে ডাকাত সর্দার বেশ ভদ্রলোকের মত, সিনেমার ভিলেনদের মত আলাপ-সালাপ করে এমনকি যে ইব্রাহীম গাজীকে খুঁজতে কাজলের মহাকব্যিক যাত্রা তাকেও নিমেষে চিনে ফেলে ডাকাত সর্দার। এমনকি ইব্রাহীম গাজীর হাতে লেখা চিঠিও ডাকাত সর্দার স্মৃতি স্বরূপ রেখে দিয়েছে বিশ-পঁচিশ বছর যাবত!!!…. যে চিঠি আবার… থাক, পাঠের আমেজটা নষ্ট না করি অন্য পাঠকদের।

পাঠক কল্যাণ সমিতির সদস্য হিসেবে এতগুলো কো-ইনসিডেন্স মানতে পারি না। যদিও গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে এসব কো-ইনসিডেন্টের ওপর। এসবই গল্পটার ভিত্তি। তবে ওবায়েদ হকের এসব চেতন-অবচেতন কো-ইনসিডেন্টের প্রয়োগ গল্পকে আঘাত করে না। গল্পটা মসৃণ বয়ে যায় শেষতক। বেখাপ্পা লাগে না, লেখনির গুণে। যে কারণে, ওবায়েদ হকের জলেশ্বরী পড়ে এক আরাম পাওয়া যেতে পারে। একটা অদ্ভুত আবেশে কিছু সময়ের জন্যে পালানো যেতে পারে কর্কশ মুহূর্তগুলো থেকে। পাঠক কল্যাণ সমিতির সভাপতি কাম সদস্য হিসেবে কোনো বইয়ে-ই এই পলায়নপরতার আরাম সমর্থন করি না; কিন্তু সকল পাঠক এই আরাম, এই পলায়নপরতার স্বস্তি ছেড়ে দিতে নিশ্চয়ই রাজি নয়, তাই না? এবং কেউ এই স্বস্তি, পলায়নপরতা ছেড়ে দিতে রাজি না হলে তাকে পাঠক হিসেবে বাতিল করাও আহাম্মকি। নয় কী?

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই