চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

হনন


হনন
নাঈমা পারভীন অনামিকা

স্কয়ার হসপিটালের একটি সুশীতল কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।  মাত্র কয়েক মিনিট আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। আকাশী এপ্রোন পড়া দুজন বয়স্ক নার্স খুব যত্ন করে লাইফ সাপোর্ট খুলে নিচ্ছেন। স্বচ্ছ দরজার এপাশ থেকে তাকিয়ে আছি অনুভূতিহীন আমি। কেমন অচেনা লাগছে চেহারাটা।  আচ্ছা,  মানুষ মরে গেলে কি চেহারা পালটে যায়!  অদ্ভুত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ টা। চোখের পাশটা কালচে, মুখটা ঈষৎ হা হয়ে আছে।  আমার বোধহয় চিৎকার করে কাঁদা উচিৎ।  কিন্তু কান্না পাচ্ছেনা একটুও।  হাসপাতাল  কর্মচারীর  দু'এক জন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।  আড়ষ্ট পায়ে এগুলাম সামনের দিকে।  হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বারান্দায়। ঝুঁকে তাকালাম, এখান থেকে রাস্তার মানুষগুলো কেমন পিঁপড়ের মত দেখা যায়। চোখ সরিয়ে নিলাম,  খবর দেয়া হয়েছে আমার একমাত্র ছেলে আর আত্মীয়স্বজনদের। এখন আমার কি করনীয় ঠিক বুঝতে পারছিনা। বারান্দায় রাখা গাঢ় সবুজ রঙের চেয়ারটায় বসলাম। এত ক্লান্ত লাগছে আমার!  টানা সতের দিন খুব ধকল গেছে শরীরে,  হাসপাতাল- বাসা এই করে করে একটু ভালভাবে দাঁড়ানোর সুযোগও হয়নি। রাজ্যের ক্লান্তি নেমে আসছে শরীরে। মনে মনে লজ্জিত হলাম আমি।  স্বামীর মৃত্যুর শোক ছাপিয়ে ঘুম জড়িয়ে আসছে আমার চোখ জুড়ে, ভেঙে আসছে শরীর। আমার শোকাচ্ছন্ন হওয়া উচিৎ।  স্বাভাবিকতা সেটাই বলে। মৃত মানুষটার মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম একবার,  পারছিনা।  কি আশ্চর্য!  আমার চোখে ভাসছে  সাতাশ বছরের উচ্ছল যুবক খালিদ। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্যাকব্রাশ চুল, স্মিত হাসির ছেলেটিকে। ওর পুরো নাম  ওয়াসিত বিন খালিদ। যে হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে ঘুরে বেড়াত ইউনিভার্সিটির চত্বর। হৈ চৈ আর আড্ডবাজিতে কাটিয়ে দিত অনেকটা সময়। চোখ বন্ধ করলাম আমি। চলে গেলাম ২৮ বছর আগের সেই অসাধারণ দিন গুলোতে।  আজও কত স্পষ্ট  জীবন্ত সময়গুলো........।

ভার্সিটির প্রথম দিকের সময়গুলো অন্যরকম সুন্দর ছিল। অরুনিমার সাথে পরিচয় হয়েছিল শুরুর দিকেই। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। বেশ অনেকটা দিন আমি আর অরুই ছিলাম খুব ভাল বন্ধু। তারপর বন্ধুর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের দুজনের ভালবাসা আন্তরিকতায় তার প্রভাব পড়েনি একটু ও। দুজন ছিলাম একদম বিপরীত স্বভাবের। আমি খুব চঞ্চল,  দুষ্ট, সারাক্ষণ বকবক করতাম। আর অরুণিমা শান্ত, ধীরস্থির। খুব কম কথা বলত, আমার বেশিরভাগ কথারই জবাব দিত না,  শুনত চুপচাপ আর মাঝেমাঝে হাসত। আমি সেই হাসিতে আঁটকে গেলাম। কি যে পছন্দ করতাম এই শান্ত মেয়েটাকে!  লেখাপড়ায় বরাবরই মনোযোগী ছিল অরু। লাইব্রেরীতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা খেটেখুটে নোট তৈরী করত।  আর সেই সময়টা আমি কাটাতাম কেন্টিনে কিংবা দারুণ আড্ডায়।  আমাদের সাবজেক্ট এক ছিল, তাই পরীক্ষার আগে আগে ওর সব নোট ফটোকপি করে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়ে যাওয়া ছিল আমার  প্রতিবারের নিয়ম।  এ-নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুযোগ দেখিনি কখনো অরুর চোখে। প্রতিটা পরীক্ষার গন্ডি পার হয়ে যেতাম আমি এমন করেই। 

তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলে এসেছে ঠিক এমন একটা সময় অরু পরপর দুদিন ভার্সিটি এলো না। দারুণ অস্থিরতায় পড়লাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক খুঁজে টুজে বাসা বের করে ফেলব।  ক্লাস করলাম না।  ভার্সিটি গেটে দাঁড়িয়ে রিক্সা খুজছি,  হাতে কাগজে লেখা অরুর বাসার ঠিকানা।  ওর এলাকারই একটা মেয়ের কাছ থেকে জোগাড় করা।  হাত তুলে রিক্সা ডাকতেই চোখে পড়ল অরু হেঁটে আসছে। কাছাকাছি হতেই অতি পরিচিত হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল মুখে। হঠাৎ আমার এমন রাগ হল!  উলটো দিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করলাম, অরু দৌড়ে হাত ধরল আমার, বলল --- "প্লিজ  মিথিল কথা শোন! আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই এই দুদিন আসিনি। আমি বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকালাম।  গাল দুটো লালচে, দৃষ্টি মাটির দিকে। নিমিষেই রাগ উধাও হল, আমি জড়িয়ে ধরলাম ওকে। 

"কাল সন্ধ্যায় ওরা আংটি পড়াতে আসবে, তুই কিন্তু সকালেই চলে আসবি!" মৃদু স্বরে  বলছিল অরু। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে, এই দুদিনে যেন আরও সুন্দর হয়ে গেছে মেয়েটা!

সকাল বেলা না হলেও আমি পৌঁছে গেলাম দুপুরের পরপরই। ব্যস্ত হয়ে গেলাম বিয়ে বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে। অরুকে সাজানো টুকু ছাড়া আর সব আয়োজন শেষ হল সন্ধ্যার আগেই। কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না ব্যস্ততায়। খোঁপায় ফুল পড়াতে পড়াতে বললাম --- "তোর বর কী করে রে? "  অরু উত্তর দিলনা,   মৃদু হাসল।  রক্তিম আভায় জড়ানো অরুকে দেবীর মত লাগছিল, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না আমি।  

বর পক্ষ এসেছিল সাড়ে ছ'টার দিকে।  অরুকে আংটি পড়ানো হল,  একে একে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা, আতিথেয়তা সম্পন্ন হবার পর  রাত সাড়ে নটার দিকে আমি বিদায় নিলাম।  বাড়ী ফেরার পথ টুকু অদ্ভুত ঘোরে কাটল। প্রচণ্ড মাইগ্রেনের ব্যাথায় আচ্ছন্ন ছিলাম পুরো সময় টুকু। আকাশ ভেঙে কী যে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন! রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছিল, বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছিলাম একদম। গলির মুখটায় এসে অটোরিকশাটা আচমকা থেমে গেলো, প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। 

"আফা!  গাড়ী আর যাইতোনা।  গলির ভিতর গেলে ইঞ্জিন ডুইবা যাইব। আফনে এইখানে নাইমা যান।" 

পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম,  গলিতে প্রায় হাঁটু সমান পানি। কথা না বাড়িয়ে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম।  রাস্তার নোংরা কাদা পানি,  মাথার উপর বৃষ্টি,  আর অসহ্য মাথা ব্যথা নিয়ে অনেক কষ্ট করে যখন বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছলাম,  আমার শরীর মন দুই-ই অসাড়। শরীরের তাপমাত্রায় দ্রুত পরিবর্তন আসছিল বুঝতে পারছিলাম।  খুব কষ্ট করে দুটো প্যারাসিটামল পেটে চালান করে দিলাম। প্রবল ক্লান্তিতে আমার শরীর আচ্ছন্ন হচ্ছিল ক্রমশ। ঘুমিয়ে পড়লাম একসময়। প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। দেয়াল ঘড়িতে তখন দুটো পঁয়ত্রিশ। উঠে বসলাম,  বসে থাকতে পারছিলাম না, শরীর কাঁপছিল। শরীরের প্রচণ্ড উত্তাপে আমি দিশেহারা প্রায়। অনেক কষ্ট করে গ্লাস টা হাতে নিয়ে তৃষার্তের মত পানি খেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী করব, ভাবলাম মাকে ডাকি। শরীর জুড়ে প্রচণ্ড ব্যথা, দেয়াল ধরে এগুচ্ছিলাম, হাঁটতেই পারছিলাম না। কোনমতে মায়ের ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়েছি, তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। 

তার পরের দিন গুলো কেটেছিল ঘোরে। যতবার চোখ খুলেছি, মাকে দেখেছি উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। দিন রাতের কোন বোধ ছিল না আমার। সাত দিনের মাথায় উঠে একটু বসতে পারলাম। আমাদের হাউজ ফিজিসিয়ান আবিদ আংকেল মাথায় হাত রাখলেন। "ভাল লাগছে আজ? বাড়ীর সবাইকে তো আতংকে ফেলে দিয়েছিলে!  কি জ্বরটাই না বাধালে!" 

হাসলাম আমি। শরীর ভীষণ দুর্বল,  মুখে তেতো ভাব ছড়িয়ে আছে। মায়ের দিকে তাকালাম --- "আজ কত তারিখ মা?"

"২৯ মে।  কেন?" 

আমি মনেমনে হিসেব করে নিলাম,  সাত টা দিন পার হয়ে গেছে। ৯ জুন  থার্ড ইয়ার ফাইনাল। কালই একবার ভার্সিটি যেতে হবে। অরুর মুখটা মনে পড়ল। 

মা যেন বুঝতে পারলেন  বিষয়টা।  "অরু এসেছিল। তুই তো তখন খুব অসুস্থ।  জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে ঘুমোচ্ছিলি। মাথার কাছে বসে ছিল অনেকক্ষন।  আমি বলেছিলাম  'ওকে ডাকি।'  ডাকতে দিল না তোকে।  বিয়ের কার্ড টা দিয়ে মন খারাপ করে চলে গেল।  ১জুন  বিয়ে। এখন তো সুস্থ হয়েছিস প্রায়। যেতে পারবি নিশ্চই।  মেয়েটা খুশী হবে।  একটা ফোন করে দিস বিকেলে।"

সেদিন ছিল ৪ জুন। পুরানো অশথ গাছের বেদীটা খুব প্রিয় জায়গা ছিল একসময়।  সারাক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে হত, সেদিন বিরক্ত লাগছিল। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে একই ভাবে বসেছিলাম।  চোখে রোদ এসে পড়ছিল, তাও নড়ছিলাম না আমি। হঠ্যাৎ নিজের নামটা শুনে চমকে পেছন ফিরলাম, অরু ছুটে আসছে।  

"তুই কেমন আছিস? আমি কতবার ফোন করলাম,  রিসিভ করলি না!  সবাই জিজ্ঞেস করছিল তোর কথা। আমার কী যে খারাপ লাগছিল!  আমার বিয়েতে তুই থাকবি না,  মানতেই পারছিলাম না। একবার ভেবেছিলাম তোর বাড়ী যাই, কিন্তু সময়ই বের করতে পারলাম না। এখন ভাল লাগছে শরীর? "

অরু জড়িয়ে ধরেছিল আমায়,  সে আলিঙ্গনে যে কত আন্তরিকতা!  কিন্তু আমায় স্পর্শ করল না। আমার হাতদুটো তাকে জড়ালো না পর্যন্ত!  

অরু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল --- "কী হয়েছে তোর? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?" 

আমি আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে দিলাম তাকে।  ভাল লাগছিল না আমার। সত্যি বলতে বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমার এই পরিবর্তন চোখ এড়ালো না অরুর। কিছুটা দিশেহারা ছিল ও। অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিল। আমার একটু ও মায়া হল না। গভীর মনোযোগে আমি একটু দূরে বসা বাচ্চাটার মালা গাথা দেখতে লাগলাম।

আমার এই হঠ্যাত নির্লিপ্ততায় সাময়িক খেই হারালেও হাল ছাড়লো না সে।  খপ করে হাত ধরল--- "চল, তুই আজ বাসায় যাবি আমার!  নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি গতকাল। গুছিয়ে উঠতে পারিনি এখনো।" 

প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও  অরু একরকম জোর করে নিয়ে গেল ওর নতুন সংসারে। যে মেয়েটা প্রায় কথাই বলত না,  সারাক্ষণ বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিল আমার। এত্ত বিরক্ত লাগছিল! গল্পের বিষয়বস্তু একটাই,  তার স্বামী।  বিয়ের পরে ওর এই আমূল পরিবর্তনে সাংঘাতিক বিরক্ত হয়েছিলাম।  ছাড়া পেয়েছিলাম বিকেলে।  একরকম জোর করেই চলে আসতে হয়েছিল।  অরু কি যে অনুরোধ করেছিল ওর বর আসা অবধি থাকবার জন্য! 

বাড়ী ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম -- এই অরু কে একদম সহ্য করতে পারছি না আমি। প্রচণ্ড রাগে,  বিরক্তিতে মনটা বিক্ষিপ্ত হচ্ছিল বারবার। শুধু ওকে এড়িয়ে চলব বলে ভার্সিটি গেলাম না পরপর ক'দিন। অরুর প্রতি আমার ভালবাসা,  টান উধাও হল নিমিষেই,  সেখানে বাসা বাধল সীমাহীন বিরক্তি। নিজের এই অদ্ভুত পরিবর্তনে আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম নিজেই। প্রাণপণ চেষ্টা করেছি নিজেকে সংশোধনের,  কাজ হল না।  বরং অনুভূতি তীব্র থেকে  আরও  তীব্রতর  হল। শুধু অরু নয়, আশেপাশের সমস্ত বন্ধন গুলো অসহ্য মনে হতে লাগল প্রতিনিয়ত। সবকিছু বাদ দিয়ে আমার একান্ত প্রিয় জায়গা হল বাড়ীর নির্জন ছাদ। সারাক্ষণ বসে থাকতাম সেখানে। একদিন সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নামছি, আবিদ আংকেলের গলা শুনে দাঁড়ালাম। তার মুখে আমার নাম শুনে বসার ঘরের দিকে এগুলাম, পর্দার আড়াল থেকে মাকেও দেখতে পেলাম। তাদের আলোচনার বিষয় আমি। আমার এভাবে চুপচাপ হয়ে যাওয়া, কারো সাথে যোগাযোগ না রাখা, ভার্সিটি না যাওয়া এসব নিয়ে মা খুবই চিন্তিত। আবিদ আংকেল এসবের যা ব্যাখ্যা দিলেন তা হলো --- শীঘ্র যে অসুস্থতা আমি কাটিয়ে উঠেছি,  তার দারুণ প্রভাব পড়েছে আমার মস্তিষ্কে। অতিরিক্ত শারীরিক উত্তাপ মানুষের মস্তিষ্কে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যে কারনে মেজাজ খিটখিটে হয়,  রাগ বেড়ে যায়, সহ্য ক্ষমতা কমে যায়,  আশেপাশের অতি পরিচিত পরিবেশ ও মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়, অস্বাভাবিকতা আসে আচরনে। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। সময় দিলে আস্তে আস্তে এসব ঠিক হয়ে যাবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হবে হয়ত, আমার এই অদ্ভুত পরিবর্তন গুলো অসুস্থতার পর থেকেই শুরু হয়েছিল।

থার্ড ইয়ার ফাইনাল দিলাম না সেবার। বাবা ছুটি নিলেন অফিস থেকে। নিয়ে গেলেন ছোট ফুপুর ওখানে। সিলেটের চা বাগানে চাকরী করার সুবাদে দারুণ একটা বাংলো ছিল ফুপার।

ওখানে গিয়ে কি যে ভাল লাগল আমার! সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম এদিক ওদিক।  বাবার ছুটি শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমার ফিরতে মন চাইল না একটু ও। বললাম-- "বাবা আমি থাকি আরও কিছুদিন!" বাবা অমত করলেন না,  রেখে এলেন আমায়।  

সে সময় গুলো অসাধারণ ছিল। সারাদিন চা বাগানে হেঁটে বেড়াতে অন্যরকম লাগত। ক্লান্ত লাগলে মাঝেমাঝে বসে পড়তাম ছোট ছোট টিলায়! অনর্গল পাখির কিচিরমিচির ডাকে তন্ময় হয়ে থাকতাম। বাগানের শেষপ্রান্তে ছোট্ট একটা ঝিল ছিল, এত স্বচ্ছ টলটলে পানি! পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ।  শীতল স্পর্শে শিহরিত হতে হতে টের পেতাম,  আমার হারিয়ে যাওয়া আমি ফিরতে চাইছে আমার মাঝে।

ওখান থেকে ফিরেছিলাম প্রায় দুমাস পর। ঢাকায় পা রেখেই ছুটলাম অরুর কাছে।  দীর্ঘদিন পর দুই বন্ধু আবার ফিরে এলাম পুরনো আস্থায়, ভালবাসায়। এরপরের দিন গুলো চমৎকার ছিল।
ভার্সিটি শেষে প্রায়ই চলে যেতাম অরুর বাসায়। খাওয়াদাওয়া শেষে দারুণ আড্ডা হত। ছুটির দিন গুলোয় চলে যেতাম সকালে। অরু, আমি আর ওর বর। কী যে দারুণ সময় কাটতো! বিকেল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে যেত টেরই পেতাম না!  

পড়াশোনায় সিরিয়াস হলাম, নিয়মিত ক্লাস করতাম, লাইব্রেরী ওয়ার্ক করতাম, পাশাপাশি অরু সাহায্য করত সবসময়।  ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার শেষের দিকে অরু অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ করে। সে অসুস্থতা খুশীর ছিল। অরু মা হচ্ছে। কী যে খুশী হয়েছিল খবর টা শুনে ওর বর! আমার সামনেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেল,  অরু লজ্জায় লাল হয়ে মুখ ঢেকেছিল।  ওদের অপার্থিব সুখটুকু দারুণ ভাবে স্পর্শ করেছিল আমায়। ঈর্ষা হচ্ছিল অরুকে। 

সময় তো চলে যায় তার মত করে। আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট হল। অপ্রত্যাশিত ভাল রেজাল্ট হল আমার। আমার চেয়েও বেশী খুশী হল অরু। কী যে আনন্দ তার! দুজন মিলে সেদিন কত প্লান করলাম! 

অরুর শরীরে দ্রুত পরিবর্তন আসছিল। চলা ফেরায় কষ্ট হত। শ্বাসকষ্ট হত প্রায়ই। সাত মাসের পর তার প্রেগনেন্সিতে কিছু জটিলতা দেখা দিল। কেন এই জটিলতা ডাক্তার স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। অরুর বর আরো বড় গাইনোকোলজিস্টের স্মরনাপন্ন হলেন। ডাক্তার অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর যা বললেন--- অরু আর অরুর বরের ব্লাড গ্রুপ এক, অরুর শ্বাসকষ্টের সমস্যা জন্মগত ভাবেই, পাশাপাশি এখন  উচ্চরক্তচাপ এবং প্রি- একলামশিয়া শরীরে জটিলতা তৈরী করেছে। অরুর বর এবং পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়লেন। আট মাস পূর্ণ হবার পর ডাক্তার সিজারিয়ান করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ততদিনে অরুর শরীর ফুলে ফেঁপে বিভৎস অবস্থা।  

হসপিটালে ভর্তি করা হল অরুকে। খালাম্মা আর আমি প্রায় চব্বিশঘণ্টা পালাক্রমে দেখাশোনা করতাম ওর। অরু কান্নাকাটি করত খুব। তিন দিন পরে সিজার হল।  ফুটফুটে একটা বাচ্চা ধবধবে তোয়ালেতে জড়িয়ে নার্স যখন O.T  রুম থেকে বের হল, অন্য সবার কথা জানিনা,  অন্যরকম ভাললাগায় আমার মন ভরে গেল। আমি প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম সদ্য পৃথিবীতে আসা দেব শিশুটির দিকে। অরুর বর চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল বাচ্চাকে,  পরক্ষণেই জানতে চাইল অরুর কথা। নার্স জানালো-- অরু ভাল আছে তবে শ্বাসকষ্ট টা কমেনি, অবজারভেশনে রাখা হয়েছে।  ডাক্তার আশা রাখছেন এটা শীঘ্রই নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে।  I.C.U  তে রাখা অরুর মুখ টা দেখলাম একবার।  অক্সিজেন মাস্ক পড়া,  শ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে।  

অরু এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল ঠিক তার দুদিন পর, অপ্রত্যাশিত ভাবে।  বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রতিটা মানুষ।  খালিদ মানে অরুর বর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কথা বলত না কারো সাথে। বাচ্চাকেও স্পর্শ করত না।  একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে অরুর বাবা মা পাগল প্রায়। তীব্র শোক কিংবা অভিমান থেকেই হয়ত বাচ্চাকে দূরে সরিয়ে রাখলেন তারাও। বিরাম হীন একটি নিষ্পাপ শিশুর কান্না  যেন আমায় বলত-- সে একটা উষ্ণ বুক চায়। আমি জড়িয়ে নিলাম বুকে উষ্ণতায়, পরম মমতায়। অরুর শোক ছাপিয়েও যে বোধ আমায় অস্থির করল -- তা দায়িত্ব। ওকে আগলে রাখলাম প্রতিটা মূহুর্ত। বাড়ী ছেড়ে পড়ে রইলাম অরুর ফ্লাটে। মা বুঝতেন পরিস্থিতি টা,  মাঝেমাঝে এসে দেখে যেতেন সবাইকে।  বাবাও আসতেন কখনো কখনো। 

সময় অদ্ভুত এক বিষয়,  গভীর থেকে গভীরতর শোকে প্রলেপ পড়ে একসময়। ধীরেধীরে ফিরছিল জীবনের স্বাভাবিকতা। অরুর বর অফিস যাওয়া শুরু করল। আমিও মায়া কাটিয়ে বাচ্চাটিকে দিয়ে এলাম অরুর মায়ের কাছে। ফিরে এলাম বাড়ীতে। কিন্তু একদিন পরই খালিদ চলে এলো বাসায়,  বাচ্চাটাকে সামলাতে পারছেনা কেউ। আমি আবার চলে গেলাম অরুর ফ্লাটে। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল আমার সাথে বাচ্চাটা আসলে। খালাম্মা হাফ ছেড়ে বাচলেন আমাকে দেখে। কোলে নেয়া মাত্র দুটো নিষ্পাপ চোখে যে স্বস্তি দেখেছিলাম,  তা আমি কেন ,  এ পৃথিবীর কারো পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলনা।  বুঝতে পারছিলাম দারুণ ভাবে জড়িয়ে পড়ছি। কিন্তু  কিছু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে বাঁধা যায় না,  আমিও চাইনি নিজেকে কোন নিয়মে বাধতে। তবে প্রবল আপত্তি তুললেন বাবা। তিনি কোনভাবেই চাইলেন না আমি ও-বাড়ীতে থাকি। তার অসন্তোষ ভদ্রতার সীমারেখা পার করে প্রকাশ্যে এলো। সরাসরি  কথা বললেন অরুর বাবা-মা আর খালিদের সাথে। সংগে করে নিয়ে এলেন আমাকে। বাবাকে এর আগে কোন বিষয়ে এত কঠোর হতে দেখিনি আমি।

মায়া কাটাতে পারিনি নিষ্পাপ চোখ দুটোর। মনে পড়ত খুব। গিয়ে দেখে আসতাম মাঝেমাঝে। মাস তিনেক পর অরুর বাসা থেকে খবর দেয়া হল আমাকে, দেখা করলাম। দীর্ঘক্ষণ কথা হল অরুর মা-বাবার সাথে। বাড়ী ফেরার পুরোটা পথ অরুর বাবা-মায়ের কথা গুলো কানে বাজছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি করব।  রাতে খাবার টেবিলে যতোটা সম্ভব গুছিয়ে বাবা আর মাকে সব টা  বললাম,  জানালাম ওদের প্রস্তাব।  বাবা কয়েক মিনিট তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।  সে দৃষ্টিতে বিস্ময় আর তীব্র ক্রোধ দেখেছিলাম। খাবার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন, চলে গেলেন।  মা-ও অনুসরণ করলেন তাকে।  আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। বাবার রেগে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। মেয়ের বিয়ে নিয়ে নিশ্চই তার অন্যরকম স্বপ্ন ছিল। পাশাপাশি সমাজ ও বড় একটা বিষয়।  বুঝতে পারছিলাম আমি।

বাবা-মায়ের প্রচণ্ড আপত্তি উপেক্ষা করে আমি বিয়ে করলাম খালিদ কে। পাকাপাকি ভাবে জড়িয়ে নিলাম অরুর সংসার টাকে। ওর স্বামী,  সন্তান,সংসার সব আমার হল। জীবন যে কত বিচিত্র!

খালিদের সাথে চব্বিশ বছরের সংসার জীবন কাটলো। আমরা বেশ সুখেই কাটিয়েছি। একমাত্র সন্তান নাভিদ  লন্ডনে পড়ছে প্রায় দুবছর। সে সবকিছুই জানে। দেখতে,  মননশীলতায় অরুর মতই হয়েছে।  তাই মা হিসেবে ভালবাসার পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাও দেখতে পাই নাভিদের চোখে সবসময়। আর খালিদ! আমাদের বিয়ের প্রথম বছরটায় অরুর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকলেও পরের সময় গুলোতে তার জগত ছিল আমিময়। নাভিদ আর আমি তার সমস্ত জীবন,  স্বত্তা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছিলাম একটু একটু করে যেখানে অরুর অস্তিত্ব ক্রমশ বিলীন হয়েছিল আপনা আপনি।

কাঁধে স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম, আকাশী এপ্রোন পড়া অল্প বয়সী একজন  মেয়ে খুব নরম গলায় বলল--- "আপনার বোধহয় বিশ্রাম দরকার।" 

অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটি দেখতে অবিকল অরুর মত। হাত ধরলাম আমি, এই প্রথম শব্দ করে কাঁদলাম। মেয়েটি জড়িয়ে ধরল আমায়।  "কিছু কাগজপত্রের ফর্মালিটি আছে, আপনার পক্ষ থেকে কেউ কি আছে?"

"আমার ছেলে আছে,  ও-তো লন্ডনে থাকে।  কাল বিকেল নাগাদ হয়ত পৌঁছে যাবে। " 

কথা বাড়ালো না মেয়েটি, চলে গেল। কাগজপত্রের সমস্ত কাজ শেষ করে, খালিদ কে ফেলে নিচে এলাম। ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে এলাম বনানী।  বহু বছর পর এ বাড়িতে পা রাখলাম। বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। গেট খুলে ধীরে ধীরে চলে এলাম ছাদের চিলেকোঠার ঘরটায়। বাড়ীর আসবাবপত্র আর পুরনো সব জিনিস গুলো এখানে রেখে পুরো বাড়ী ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে। কেয়ারটেকার গফুর কে ডেকে চাবি নিলাম। ঘরে ঢুকতেই ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। সব কিছুতে ধুলোর পুরু আস্তর। একপাশে রাখা ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে আলমারির চাবি নিলাম। এটা আমার আলমারি ছিল। সিন্দুকে রাখা চওড়া খাম টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। কেমন নীরব গা ছমছম নিরবতা ঘরটায়, অস্বস্তি হচ্ছিল। দ্রুত বেড়িয়ে এলাম সেখান থেকে।

খালিদের প্রাণহীন শরীর টা রাখা হয়েছে লাশবাহী এম্বুলেন্সে। বসার ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালে গাড়ীর স্বচ্ছ গ্লাসের ভেতর থেকে মুখ টুকু দেখা যায় স্পষ্ট। কতক্ষণ যে তাকিয়ে আছি মুখটার দিকে! ক্লান্ত লাগছে। দাঁড়ানোর শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ হল,  বসে পড়লাম মেঝেতে। ঘরভর্তি আত্মীয়স্বজন,  কেউ জড়িয়ে ধরছে,  কেউ শান্তনা দিচ্ছে,  এসব অসহ্য লাগছে আমার। কেবল-ই মনে হচ্ছে নাভিদ কখন আসবে!  শুধু ওর জন্যই মানুষ টাকে দাফন দেয়া হচ্ছে না, কত কষ্ট পাচ্ছে! 

নাভিদ এসে পৌঁছল ভোররাতে। স্পর্শ পেতেই বুঝলাম খুব কাছের কাউকে  প্রয়োজন ছিল এতক্ষণ!  তাকে বুকে জড়িয়ে শোকের বাধ ভাঙল আমার।  দুজন হারালাম আমাদের খুব কাছে মানুষটাকে। সে শোক,  সে আবেগে মন্থরতা আসতে পার হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। 

৮:৫০ এর ফ্লাইট ধরে নাভিদ চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মাত্র দুদিন পরে তার ফাইনাল এক্সাম। বাস্তবতা রূঢ় হলেও তাকে মেনে নিতে হয় কখনো কখনো।  বাবার মৃত্যু সংবাদে ছুটে আসা ছেলেটা ফিরে গেল দুদিন পরই। উপায় ছিলনা,  ফিরতেই হল তাকে।  নাভিদকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরলাম। দরজায় পা রেখেই মনে হল ২৯০০ স্কয়ার ফিটের এই বিশাল ফ্লাটটায় আজ থেকে আমি একা, সম্পূর্ণ একা। ভয়ংকর এক হাহাকার গ্রাস করল আমায়।  খুব ধীরে আলমারিটার দরজা খুললাম।  সন্তর্পণে বের করলাম প্রশস্ত খাম টা। পরম মমতায় ছুঁয়ে রাখলাম দীর্ঘসময়। মনে হল ছাব্বিশ বছরের সেই প্রাণবন্ত উচ্ছল খালিদ কে ছুঁয়ে আছি। ১৬ টা চিঠি। কত প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে যে লিখেছিলাম! দেয়াই হয়নি খালিদকে। কতবার চেষ্টা করেছি! কিন্তু বিশ বছরের একজন তরুণীর পক্ষে কাউকে ভালবাসার কথা জানানো তো সহজ নয়! মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র খালিদের মুখোমুখি দাঁড়ানো হয়নি কখনোই,  জানানোই হয়নি কী ভয়ংকর প্রেমে পড়েছিলাম তার!  গালে ছুঁইয়ে আছি চিঠিগুলো, ভিজে যাচ্ছে ক্রমশ।  ভিজে যাক এই ভালবাসায়,  যা কখনো জানতেই পারল না খালিদ।  তবুও অনুযোগ নেই। খালিদ তো আমারই হয়েছিল। অরু বেঁচে থাকলে সেটা সম্ভব ছিল না কখনোই।  অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নেবার সময় অরু চোখ মেলেছিল,  সে চোখে ছিল প্রচণ্ড বিস্ময়,  আতঙ্ক আর বিশ্বাস ভংগের তীব্র বোধ।  আমি তাকিয়ে ছিলাম শরীরটা স্পন্দনহীন হবার আগপর্যন্ত।  মনেমনে বলেছিলাম---- 'ক্ষমা করিস অরু'।

লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই