চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

সমুদ্রডাকিনী


সমুদ্রডাকিনী
সাদিয়া সুলতানা

ছোটবেলা থেকে সাইরেন আর মারমেইডের গল্প আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতো। আমার বাবা গ্রিকপুরাণের মায়াবিনী গায়িকা সাইরেন আর মারমেইডের গল্প এমন সুন্দর করে বলতো যে আমি নিজের ভেতরে মৎস্যকন্যা হবার বাসনা ধারণ করতাম। স্বপ্ন দেখতাম, ঊর্দ্ধাংশ মানবী এবং নিম্নাংশ মাছের শরীরের অপরূপা আমি সুদৃশ্য আয়না আর চিরুনি হাতে জনমানবহীন সাইরেনিয়া দ্বীপে বসে গান গাইছি।

কখনো আবার স্বপ্ন দেখতাম; নিশ্চল হয়ে বসে আমি সামনে থাকা বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের তোলপাড় দেখছি আর আমার দীঘল সোনালি চুল পুরো পিঠে ছড়িয়ে পড়ছে, সমুদ্রের নীলাভ ঢেউয়ের সৌন্দর্যও ফিকে হয়ে যাচ্ছে আমার সেই সোনালি চুলের চঞ্চল ঢেউয়ের কাছে। সেই সাথে বাতাসের কম্পন এসে পিছলে যাচ্ছে আমার পিচ্ছিল শরীরে। কী অলৌকিক সুন্দর সে স্বপ্ন! এই স্বপ্নের ঘোর ঘুম ভাঙলেও পিছু ছাড়ে না।

সেই স্বপ্নঘোরে পড়ে আমি মাকে আমার চুল ছাঁটতে দিতাম না। মা বলতো, গরমে ঘামে চুলের গোড়া ভিজে সর্দি জ্বর হবে। আমি মায়ের কথা শুনতাম না। উল্টো আমার কালো চুল কীভাবে সোনালি হবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকতাম। মাসে দু’বার খুব যত্ন করে চুলে মেহেদি বাটা, ডিমের সাদা অংশ, চাপাতার নির্যাস দিতাম। এসব যত্নআত্তিতে চুল লালচে হতো ঠিকই কিন্তু কিছুতেই সোনালি হতো না।

ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমি একবার বায়না ধরলাম, চুলে সোনালি রঙ করবো। কিন্তু মায়ের চোখ রাঙানিতে তা করা সম্ভব হলো না। মা বলতো, কৃত্রিম কিছু শরীরে ছোঁয়ালে সৌন্দর্য বাড়ে না, কমে যায়। আমি নাকি এমনিতেই অনিন্দ্য সুন্দরী। সত্যিই আমি সুন্দরী ছিলাম। সুন্দরের শরীরী সংজ্ঞার জন্য যা যা প্রয়োজন; লাল-সাদা রঙ গোলানো গায়ের বরণ, নিখুঁত মাপের দাঁতের সারি, বাম গালে টোল পড়া হাসি, শরীরের বাঁক, ভারি চোখের পাতা, মখমলী চুলের গোছা সবই আমার ছিল। তাই শুধু মা না, ছোটবেলা থেকে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠীরা মুগ্ধতা বা ঈর্ষার চোখে আমার সেই সৌন্দর্য দেখতো। তবু আমি মায়ের কথা শুনে গাল ফোলাতাম।

মা আমার বায়না আর ছেলেমানুষিতে রাগ ঝেড়ে হাসতে হাসতে আমার চুলে তেল দিয়ে দিতো। সুগন্ধি তেল। সেই তেলের মৌ মৌ সুবাসে চোখ লেগে এসে আমার স্বপ্ন আরও গাঢ় হতো। তখন ঘরে বসেই আমি মৎস্যকন্যা হয়ে সমুদ্রজলে সাঁতরে বেড়াতাম আর চোখ বন্ধ করে মোহবিষ্টের মতো দেখতে পেতাম, আমার অপূর্ব সুন্দর পিচ্ছিল শরীর আর সোনালি চুলে রোদের সোনা আলো পিছলে পড়ছে আর আমি সুরের মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছি সেই গড়িয়ে পড়া আলোতে। আমার সুরেলা কণ্ঠের টানে দিকভ্রান্ত জাহাজের দিশারী পথ ভুলে সাইরেনিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে।

সাইরেন আর মারমেইডের মায়াতে বুঁদ হয়ে এভাবেই নিজেকে আমি মৎস্যকন্যা ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে আমি গান শেখার সময় হারমোনিয়ামের প্রতিটা রিডে দরদ উজার করে দিতাম। রোজ সকালে দারুচিনি ভেজানো কুসুম কুসুম গরমপানি খেয়ে আমি গানের রেওয়াজ করতে বসতাম। আমার রেওয়াজ শুনতে শুনতে বাবা বলতেন, ‘তোর কণ্ঠে সুরের জাদু, একেবারে মায়াবী সুরেলা মৎস্যকন্যার মতো।’

আমার সেই রূপ আর কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে কতজন যে আমাকে প্রেম নিবেদন করতো! কিশোরীকাল থেকে তারুণ্য; নানান বয়সী প্রণয়প্রার্থীদের প্রত্যাখান করতে করতেই আমার চঞ্চল সময় কেটেছে। আর সেই থেকে নিজের অজান্তে কখন যে আমি ভেতরে ভেতরে দুর্মর অহংকারী হয়ে উঠছিলাম; টের পাইনি। নিজের নির্মিত অহংকারের চূড়োয় বসে আমি অন্যান্য প্রণয়াকাঙ্ক্ষীর সাথে সাথে একদিন নয়নকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

নয়নকে যেদিন আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন রাতেই নয়ন উপবন এক্সপ্রেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনের নিচে কাটা পড়া নয়নকে আমাদের ক্লাসের প্রায় সকল ছেলেমেয়েই দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু আমি যাইনি। আমার না যাওয়াকে কেন্দ্র করে পরের দিন ক্যাম্পাসে সবাই নানান রকম ব্যঙ্গবিদ্রুপ করলেও কেউ ঠিক আমার সামনে কিছু বলেনি, শুধু ওদের দৃষ্টির কটাক্ষে আমাকে আহত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নয়নের মৃত্যুর পেছনে কী আমার কোনো ভূমিকা ছিল? এধরনের বোকামানুষি কাজ করার মতো ছেলে যে নয়ন তা কি আমি বুঝতে পেরেছিলাম?

না, অন্তত আমি বুঝতে পারিনি। আর কীভাবে বুঝবো! আমার জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছেলেই উতলা ছিল। অনেকেরই আরাধ্য ছিলাম আমি। আমার সাথে কথা বলতে পেরে প্রায় সব সহপাঠী ছেলেই ধন্য হয়ে যেত। আমি ঠিক বুঝতাম সেসব। উপভোগও করতাম। ওদের কেউ কেউ প্রেম নিবেদন করলে আমি ওদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতাম, সে আমার যোগ্য না। কই, তাদের কেউ তো কখনো আত্মহত্যা করার মতোন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি! তাহলে নয়ন কেন আমার প্রত্যাখানে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করবে! তাছাড়া নিতান্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা ছেলের নানান রকম হতাশা থাকতে পারে, সেসবের খোঁজ-খবরতো আমার জানার কথা না।

তবু বন্ধুরা আমার দিকে আঙুল তুলেছিল। দীর্ঘদিন এ বিষয়টা নিয়ে ওরা কানাকানি করেছিল। নয়নের মতোন মেধাবী ছেলের মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই ওরা সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিল। তবে সত্যি বলছি ডিপার্টমেন্টের বারান্দার এককোণে বই হাতে ঘাড় গুঁজে থাকা নয়নের মারা যাবার খবরটা পেয়ে আমার তেমন কোনো আক্ষেপ হয়নি। বরং ওর মৃত্যুতে আমার ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র অহমিকাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল; আমি বুঝেছিলাম, আমার জন্য ছেলেরা মরতেও পারে। নিজের গুরুত্ব অনুধাবন করে তাই আবার আমি নিজের কাজে মন দিয়েছি।

আমি তখন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে দুবেলা গানের রেওয়াজ করতাম। নয়নের মৃত্যুর চারদিন পরেই প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমি চমৎকার একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করার পর ক্রিমিনোলজি কোর্সের টিচার হায়দার স্যার আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সমঝদারের মতোন বলেছিলেন-‘তুমি তো অপূর্ব গান গাও! মাঝে মাঝে আমাকে গান শোনাবে তো!’ নারীঘেঁষা স্বভাবের কারণে ক্যাম্পাসে স্যারের বদনাম থাকলেও স্যার আমার সাথে যথেষ্ট কোমল ব্যবহার করতেন, আমাকে স্যার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন তার কোর্সে সর্বোচ্চ মার্কস পেতে তিনি আমাকে সহযোগিতা করবেন।

সেদিন আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। কারণ নয়ন না থাকাতে আমি একটু বেকায়দাতে পড়েছিলাম। ক্রিমিনোলজির বেশ কয়েকটা চ্যাপ্টারের নোট তখনো নয়নের কাছ থেকে নেয়া হয়নি। ও না থাকাতে আমার একটা ক্ষতি হয়েছিল বৈকি; আমি একজন নোটদাতাকে হারিয়েছিলাম। এই একটি বিষয় ছাড়া নয়ন চলে যাওয়ায় আমার ভেতরে কোনো শূন্যতা তৈরি হয়নি। তাই একসময় নতুন সব প্রণয়প্রার্থীর ভিড়ে নয়নের মুখটিও ক্রমশ ঝাপসা হয়েও এসেছিল।

যদিও একটা তরতাজা ছাত্রের আত্মহত্যাকে ঘিরে মানুষ দীর্ঘদিন বিচলিত থাকবে সেটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমার ভাবতে অবাক লাগে এত বছর পর আজও কেউ কেউ নয়নের মৃত্যুর সাথে আমার নামটা জুড়ে রাখে। এই তো বছরখানেক আগে তাহেরই এ কাজ করলো।

আমার অফিসেই সেবার তাহেরের সাথে দেখা। ক্যাম্পাস ছাড়ার ষোলো বছর পর। তাহের খুব উন্নতি করেছে। নিজেই কন্সালটেন্সি ফার্ম দিয়েছে। বেশ কয়েকটা নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারও ও। এমডি স্যারের রুমে তাহেরের সাথে দেখা, কী একটা চুক্তিপত্র তৈরি করবে বলে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ তাহের আমাকে বলল, 'নয়নকে মনে আছে তোর? বেচারা নয়ন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে চেয়েছিল। বেঁচে থাকলে নয়ন বি.সি.এস. ক্যাডারই হতো। কিন্তু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মফস্বলী একটা ছেলের বেঁচে থাকার উপজীব্য আর কি’ইবা থাকতে পারে।'

তাহেরের কথা শুনে আমার তীব্রভাবে ফুঁসে ওঠার কথা ছিল। এই সেই তাহের! যে কিনা পি.এইচ.ডি থিসিসের সময় একটা আর্টিকেল পাবলিশের পর তার ৬০% বিদেশী কোনো গবেষকের একটি আর্টিকেল থেকে কপি করার কারণে প্লেইজারিজমের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পত্রিকার পাতার খবর হয়েছিল! পরে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে তাহেরের করা টুইট ব্লগ, অনলাইন পোর্টালসহ প্রায় সব পত্রিকাতে এসেছিল। আমার বিশ্বাস করতে রীতিমতো কষ্ট হয়েছিল যে, আমাদের ক্লাসে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পাওয়া ছেলে এই তাহের! তাহেরের উস্কানিমূলক কথা শোনার পর সেদিন চাইলেই আমি ওকে কথার আঘাতে ধুলিসাৎ করে দিতে পারতাম। কিন্তু বহুবছরপর নয়নের নাম শুনে বিব্রত আমি কফি দেবার নাম করে তাহেরের সামনে থেকে সরে এসেছিলাম। ওরা আজো কেনো নয়নের মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করে? কী ভাবে ওরা? নয়নের সাথে আমি প্রতারণা করেছি বলে ও আত্মহত্যা করেছে? কিন্তু আমি তো জানি যে, নয়নকে আমি কখনো ভালোবাসিনি।

আমি এত বোকা না যে নয়নের মতো লোয়ার-ক্লাস একটা ছেলের জন্য শোক করে করে আমি জীবনের হিশেবনিকেশে ঠকে যাবো। তবু কী অবাক কাণ্ড সেদিনের পর থেকে হঠাৎ হঠাৎ আমার নয়নের কথা মনে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি যখন মাথায় চেপে বসে তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামার মতোন নয়নের স্মৃতিও আমাকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে তোলে। শেষ যেদিন ছেলেটার সাথে দেয়া হয়েছিল সেদিন ওর মুখটা খুব মলিন ছিল; চোখ দুটো ছিল জলে ঠাসা। একটু বাতাসের কাঁপুনি পেলেই যেন সেখানে নদীর স্রােত শুরু হবে। বোকামানুষ নয়ন এভাবেই আমার স্মৃতির দুয়ারে সজল চোখে, ভীরু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

তবে আমি চাইলেই নয়নের এসব ঠুনকো স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে পারি, যেভাবে তিন বছর আগে আমার প্রথম স্বামী আনস্মার্ট, আনকালচারড সবুজকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম। সবুজ বড় বেশি বেঁধে ফেলতে চাইছিল আমাকে; তাই বাধ্য হয়েছিলাম ওর সাথে সম্পর্কের শেকড়টা উপড়ে ফেলতে। আর সেটা আমি খুব স্মার্টলিই করেছি। অফিসের বা আত্মীয়স্বজনের পরিমণ্ডলে সবাই আমাকে এক কথায় স্মার্ট বলে। যে শব্দের বাংলা অর্থ চটপটে, বুদ্ধিমতী, সুন্দরী, দক্ষ ইত্যাদি সবই হয়। সবুজও আমাকে স্মার্ট বলতো।

সবুজ, আমার প্রথম প্রেমের বিস্মৃতি। বাবা-মায়ের আগ্রহ দেখে সহকর্মী সবুজকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা আমি হুট করে নিয়েছিলাম। জীবনরথে ছুটতে ছুটতে আসলে ততোদিনে আমার ওপর অবিনাশী একটা ক্লান্তি ভর করেছিল। তাই সবুজকে বিয়ে করে একটু থিতু হতে চেয়েছিলাম। সবুজের নতজানু দৃষ্টি আর কোমল কণ্ঠস্বরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে বছরখানেক সংসারও করেছিলাম। কিন্তু সবুজ ক্রমশ একটা বাচ্চার জন্য অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। আমি তখন সবে দেশের বাইরে গিয়ে একটা এম.এস. করবো বলে ভাবছি; সিডনির এন.এস.ডব্লিউ. ইউনিভার্সিটিতে একটা স্কলারশিপ হবে হবেও করছে। হুট করে বাচ্চাকাচ্চা নিলে আর কখনোই এসব সুযোগ কাজে লাগানো যাবে না তা আমি বুঝলেও সবুজ কিছুতেই বুঝতে চাইতো না।

সবুজকে আমি বোঝাতে পারছিলাম না যে, আমি এত তাড়াতাড়ি নিজের শরীরী সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাই না, আরও কিছু বছর আমি ঝাড়া হাত পা থাকতে চাই আর বাইরে থেকে এক-আধটা ডিগ্রি না আনলে আজকাল কর্মজীবনে উন্নতি করা যায় না। তাছাড়া প্রমোশনের কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে নিজেদের একটু গুছিয়ে নিয়ে নিদেনপক্ষে একটা পনেরশো বা দু’হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্লাট বুকিং দেবার পরই না বুদ্ধিমান দম্পতিরা সংসার বড় করার কথা ভাবে। কিন্তু বোকা সবুজ ক্রমশ অবুঝ হয়ে পড়াতে আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কটা একদিন ছিন্ন হয়ে গেল।

একদিকে ভালোই হয়েছিল, ওর সাথে সম্পর্ক ছেদের পর সকল টানাপোড়েন ভুলে আমি আবার গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে মারমেইডের মতোন নির্ভার সময় কাটাতে শুরু করেছিলাম।

কোনো বাঁধন নেই। মুক্তির অপার আনন্দ। ঝাঁপখোলা খাঁচা থেকে মুক্ত পাখির মতোন। একা থাকি, একাই উপভোগ করি দুনিয়ার তাবৎ সৌন্দর্য। আবার কোনো কোনো দিন খুব ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে যাই। সেদিন স্বপ্নেরা ঘুমের চেয়ে আরো বেশি গাঢ় হয়ে দুচোখে নেমে আসে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে যাপিত দিনের সাথে এর ফারাক থাকে না। কী অদ্ভুত সুখময় অনুভূতি যে তৈরি করা যায় স্বপ্নে! নিজের অস্তিত্বকে ওলোটপালট করে কত যে দুঃসাহসী হওয়া যায়! সেই কিশোরীবেলার মতোন মারমেইড বা সাইরেন হওয়া যায়! স্বপ্ন দেখার সুখ হলো নিজে বেভুলে হারালেও আবার পুরনো ঠিকানায় ফিরে আসা যায়। গন্তব্য ভুল করলেও শেষমেশ কেউ এসে হাত ধরে টেনে তোলে, চিত্রা ওঠো, চিত্রা! চলো গান গাই।

আমার দেখে ফেলা অতৃপ্ত স্বপ্নের মতোন কত প্রিয় সুখ, কত প্রিয় নাম যে সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছি। জানি, সময় হলো পৃথিবীর চরম পরাক্রমশালী ঢেউ। যে ঢেউ তালে তালে কালে কালে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সুখ, দুঃখ, ক্লান্তি, গ্লানি, শরীরের সৌরভ অথবা কোনো সুখস্মৃতির দম্ভ। তাই সময় ঢেউয়ের ফেনা সাজিয়ে যখন আমাকে শূন্য করার প্রস্তুতি নেয় তখন আমিও সাবধানী হয়ে উঠি। স্বপ্নঘোরে ঠিক যেই মুহূর্তে টের পাই কেউ আমার প্রিয় নাম ধরে ডাকছে তখন আমি ইচ্ছে করে বিবশ হয়ে থাকি। ভান করি, আমি তখনো গভীর ঘুমে। মন চায়, যেন আরেকটু শুনি, আরেকবার শুনি সেই ডাক, চিত্রা ওঠো, চিত্রা! চলো গান গাই। চলো সমুদ্রতীরে যাই।

কে ডাকে আমায়! নয়ন? সবুজ? নাকি সৌরভ? আমি বুঝতে পারি না। অসংখ্য অচেনা মানুষের সাথে কোকড়া চুলভর্তি নয়নের নত মাথাটা বিন্দুর মতোন শূন্যে মিলিয়ে যেতে যেতে স্বল্পভাষী কর্পোরেট কর্মকর্তা সবুজের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে আসে। তারপর সবশেষে আসে সৌরভ।

সৌরভ। প্রচণ্ড এলোমেলো একজন যুবক, যে সবুজের পর আমাকে ভালোবেসেছিল। হয়তো আমিই ওকে ভালোবেসেছিলাম; জীবনে প্রথমবারের মতোন আক্ষরিক অর্থেই কাউকে নিজের করে চেয়েছিলাম। সৌরভের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল একটা কফিশপে। সেসময় আমার দিনগুলো খুব বাজে কাটছিল। সিডনি থেকে ফিরে নতুন অফিসে যোগদানের পর কিছুতেই মন স্থির করতে পারছিলাম না। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর তীব্র একটা একাকিত্ব প্রেতছায়া হয়ে আমাকে ঘিরে রাখতো। তাই ইচ্ছে করেই বাসায় দেরি করে ফিরতাম, অনেকরাত অবধি বাইরে থাকতাম, কলিগ বা বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করতাম। তেমনই একরাতে কফিশপে পাশের টেবিলে বসা সৌরভের সাথে আমার পরিচয়। তারপর একদিন দুদিন করে অনেক দিন ফুরিয়ে দুজনে সম্পর্কের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে শুধু কাছেই এসেছি। বড় চমৎকার ছিল আমাদের যুগলজীবন।

নাগরিক কুশলাদি শেষে আমরা একে-অন্যকে বানোয়াট সব গল্প শোনাতাম। সৌরভ বলতো, ও একটা এলাচবাগান করবে, সেই বাগানের ঘাসের বিছানায় মৌ মৌ সৌরভের মাঝে আমাদের দুজনের অবিন্যস্ত রাত কাটবে। আমি বলতাম, ‘উফ্, মাংসঝোল মাখা ভাতে এলাচ কামড় পড়লে ভীষণ অসহ্য লাগে আমার; তুমি বরং একটা বিশাল দীঘি কাটো। বর্ষায় টইটম্বুর সেই দীঘিজলে আমি মৎস্যকন্যার হয়ে ডুবসাঁতার কাটবো আর বিশাল সিঁড়িঘাটে বসে আমার চুল শুকাবো।'

সৌরভও জানতো আমার সাইরেন আর মারমেইড প্রীতির কথা। আমি যখন সৌরভের প্রেমে মশগুল তখন ওর কাছে প্রায় দিনই আমি আমার মেয়েবেলার এসব গল্প করতাম। তারপর কী যে হলো! একদিন সৌরভ সেই গল্প শুনতে শুনতে বিচ্ছিরিভাবে হেসে উঠলো। মৎস্যকন্যা নাকি সমুদ্রডাকিনী যার সুরের মায়াজাল জাহাজের যাত্রীদের মৃত্যুর দিকে আকর্ষণ করতো। এইসব মৎস্যকন্যা ছিল ছলনাময়ী। এই শতাব্দীতেও অনেক নারীচরিত্র নাকি এই মৎস্যকন্যা সদৃশ। যাদের সাথে সৌরভের বাস্তবেই সাক্ষাৎ ঘটেছে। সেদিন সৌরভকে এত নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল!

জীবন ঘেঁটে ক্লান্ত আমি সৌরভের মুখে বাস্তবতার সেসব গল্প শুনতে চাইনি। তাই ওর চোখে মৎস্যকন্যার জন্য ঘৃণাভরা দৃষ্টি দেখে আমার ভেতরটা কেবল অচীন সুরে কেঁদে উঠেছিল। সাইরেনের মায়াজালের গল্প আমিও জানি, তাই বলে ও এভাবে মৎস্যকন্যাদের তাচ্ছিল্য করবে!

ছেলেবেলায় বাবা আমাকে যেসব গল্প শোনাতো সেসব গল্পে অর্ফিউস আর বর দেয়া মারমেইড থাকতো। যাদের গানের গলা এতই চমৎকার ছিল যে সেই গান নাবিকদের কানে পৌঁছালে নাবিকেরা পথভুলে সেই দ্বীপের দিকেই যাত্রা করতো। সেদিন সৌরভকে তা বলতেই ও বলেছিল, ‘তুমি ভুল জানো, মৎস্যকন্যারা বর দিতে জানতো না, জাদুর মায়ায় নাবিকদের টেনে নিয়ে একসময় জাহাজ চূর্ণ বিচূর্ণ করে সবাইকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতো।’

আমি এ সব কিছুই জানতাম। তবু মৎসকন্যার বেদনার্ত কণ্ঠস্বর মনে করে আমি চাইতাম সৌরভ হাসিমুখে বলুক, ‘ঠিক আছে তুমি মৎস্যকন্যা হলে আমি সুরস্রষ্টা অর্ফিউস, এসো আমি তোমাকে জগতের সেরা বাঁশির সুর শোনাই।’ কিন্তু সৌরভ বলেনি।

সেদিনের পর থেকে কী যে হলো ওর, ও আমার স্বপ্নসুখকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতে শুরু করলো। আমার সুরসঙ্গী হবার বদলে সৌরভ আমাকে কটাক্ষ করে গ্রীক পুরাণ শোনাতে চাইতো। সৌরভ কী নির্মমভাবে যে এই পুরাণের বয়ান করতো! ট্রয়যুদ্ধ শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে মহাসমুদ্র দেবতা পোসিডনের ষড়যন্ত্রে দিকভ্রান্ত অডিসিউস সুন্দরী মৎস্যকন্যাদের কবলে পড়ে কী করে শোধ নেন তার বিশদ বিবরণ দিতে দিতে ও আমার দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকাতো। অডিসিউস সাইরেনদের দ্বীপ অতিক্রম করার আগে প্রত্যেক নাবিকের কান মোম দিয়ে বন্ধ করে দেন এবং নিজেকে মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে রাখেন যাতে চরম ব্যর্থতার লজ্জা পেয়ে মৎস্যকন্যারা সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করে আর সমুদ্রশিলা হয়ে সাগরের পানিতে হারিয়ে যায়।

তারপর এমনও একদিন এলো যে, সৌরভ আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। কফিশপে ওর অপেক্ষায় থেকে থেকে দু’তিন কাপ কফি ফুরিয়ে গেলেও ওর দেখা মিলতো না। সৌরভের সাথে সাময়িক বিচ্ছিন্নতায় আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়তে শুরু করলাম। এই তো গত শীতেও আমি অফিস ট্যুরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গিয়ে দুই হাতের মুঠো ভরে শিলা-নুড়ি কুড়িয়েছি আর মৎস্যকন্যার করুণ পরিণতির কথা ভেবে নীরবে কেঁদেছি। আহা, অর্ধমানবীর প্রাণহীন রূপান্তরের জন্যই যেন সমুদ্রের ফেনিল ঢেউরাশি এত বিষাদময়!

সেই বিষাদকে উপেক্ষা করে সৌরভ যেদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেল, সেদিন ও অকপটে আমাকে মৎস্যকন্যা বলে স্বীকার করলো। সেদিন সৌরভের ঘৃণাকুঞ্চিত ঠোঁটে মৎস্যকন্যা ডাকটা গালির মতো শোনালো। কাজ ফুরোলে সবাই বারবণিতাকে যেমন পায়ে ঠেলে তেমনিভাবে সৌরভ আমাকে পায়ে ঠেললো আর জানিয়ে গেল, আমি সমুদ্রডাকিনী, যে কথার মায়ায় তার মতো সাধুসন্তকে নষ্ট করেছি। তাই নিজের সৌরভ অপাপবিদ্ধ রাখতে সকল মায়া উপেক্ষা করে সৌরভ চলে গেলো।

সৌরভের প্রস্থানের পর থেকে আমি সমুদ্রশিলা হয়ে নোনা জলে ভাসছি আর কারো মায়াবী ডাকের জন্য কান পেতে রয়েছি, ‘চিত্রা ওঠো, চিত্রা! চলো গান গাই।’

লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই