চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

কতিপয় মাইকফুলের আর্তনাদ



কতিপয় মাইকফুলের আর্তনাদ
সৌরভ মাহমুদ

স্টেইট জিনিসটার ভেতর আরেকটা স্টেইট যখন খাড়ায় তখন বোধহয় তারে ক্যান্টনমেন্ট বলা যায়। কিংবা ক্যান্টনমেন্ট নিজেই একটা স্টেইট যে মূলত কোন না কোন ভাবে একটা বড় স্টেইটরে কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ অথবা সেই স্টেইটের ব্যাকবোন হিসাবে অবস্থান নেয়। এই জগৎ যত মানুষ মারা গেছে তার বড় পার্টটা কোন না কোন টাইমের কোন না কোন আইডিওলজির আর্মির দ্বারাই হইছে। এইসব আলাপ আমরা করতে পারি যে কোন টঙ মার্কা চায়ের দোকানে বসে। তবে সমস্যা হইলো এইসব টঙালাপে জগৎ থেইকা আর্মি বা ক্যান্টনমেন্ট কিছুই উইঠা যাইতেছে না। বরং চলেন আমরা ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টের কাছেই যে সাদেক মিঞার বাড়িটা আছে, ওইখান থেইকা ঘুইরা আসি। তাকানোর সাথে সাথেই চোখে পড়বে নিচু টাইপের দেয়াল ঘেরা, শ্যাওলামাখা কোন একটা প্রাচীন জমিদার বাড়ির চিত্রকর্মের মতো ক্যানভাসে হাহুতাশ সৃষ্টি করে দেয়া একটা বাড়ি। যা বারবার দেখলে এক ধরনের নিস্তব্ধতা গ্রাস করে, মনে হবে বাড়ি এবং আপনি ঠিক এইখানে না অন্যকোন একটা জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। লোহার গেইটের পাশে অরুদ্ধ দুটি এলাবতি ফুলের গাছ এমনভাবে খাড়াইয়া আছে যেনো এই শহর টহর কিচ্ছু না জগতে তার এক্সিজটেন্সের বাইরে কিচ্ছুরে সে পরোয়া করে না। বানে ভাসুক সব আমি বড় হবো আমার মতো। তখন হয়তো মনে হইবো এ এক স্বৈরাচারী গাছ। কিন্তু যখন আপনি হলুদ এলাবতি ফুলগুলার দিকে তাকাইবেন বুঝবেন বৈরাগ্য আপনারে গ্রাস করবে। একটা জোছনা রাইতের লাইগা হাঁসফাঁস করে উঠবে আপনার অন্তর, যেনো এই মুহূর্তেই পথে আপনি নেমে পড়বেন পৃথিবীর প্রথম মানবের মতো পরিব্রাজন ব্যাতিরেকে যার কোন মুখ্য ভূমিকা নাই। দেখা আর মুগ্ধ হওয়াটাই যেনো কাজ। আর পথের সেইসব মুগ্ধতা আপনারে কোন শান্তি দিবে না, দিবে না পূর্ণতা। বরং আপনি হয়ে ওঠবেন আরও বেশি মুগ্ধতার পিপাসার্ত এক শিশু। আর এই বৈরাগ্য সৃষ্টিকারি ফুলগুলোরে আদর মোহাব্বত করে সাদেক মিয়া মাইক ফুল বলে ডাকে। 

মাইক জিনিসটার কথা শুনলেই মানুষের হয়তো মনে পড়ে যায়- ভন্ড নেতার না রাখা আশ্বাসের মধুর বাণী আর পতন চাই বলে অশ্লীল চীৎকার, মাহফিলের ইউনিক স্টাইলের ঘোষণা, অমুক তমুকের মৃত্যুজনিত জানাজা কিংবা ডাংগুলি মার্কা খেলার টুর্নামেন্টের ঘোষণা। এইসবই আপনি বিরক্ত করে যখন মনে করতেছেন তখন সাদেক মিঞা অসুস্থ হইয়া কাশতেছে নিজের বিছনায় শুয়ে শুয়ে। দুএকখানা বিরক্তিজনিত গাইল দিতাছে নিজের বিবিকে, কেনো তার পানি শেষ হবার পরও গ্লাসে পানি ভরে দিয়ে যায়নি তার বউ। সাদেক মিয়ার গলা এখন এমন একটি মাইক যেনো যান্ত্রিক গোলযোগে কাতর, যে কোন সময় ধুম করে অফ হয়ে যাবে স্বর আর সম্পূর্ণ নাটক দেখবার পূর্বেই লোডশেডিংয়ের মতো বিষণ্ণতা। অথচ.....

সজিব ফেরে না বাড়ি। সাদেক মিঞা ক্লান্তির ঘুম ঘুমায়। আর ঘুমায় তার স্ত্রী। কেবল জেগে থাকে আসমা। সজিবের তরুণী স্ত্রী আসমা অপেক্ষা করে। নিজের ঘর থেকে বারবার সাদেক মিঞাদের ঘরে যায়। ঘুমন্ত শ্বশুর শাশুড়িরে ডাক দিবার সাহস পায় না। কেবল অপেক্ষা করে।

একদিন এই সাদেক মিঞা তার গলার স্বরে মাইক দিয়ে কাঁপাইতেন এই শহর। প্রায় সেই সতেরো বছর হাতে তুলছিলেন মাউথপিস আর কতোকাল বিজ্ঞাপন মার্কা রিকশা চড়ে মাইকিং করে কাটাইলেন তার হিসেব কড় গুনে গুনে করতে গেলে দুই হাতের কড় ফুরায় কিন্তু হিসাব ফুরায় না। সাদেক মিঞার স্মৃতিশক্তি এখন জাদুঘরের রাস্তা খুঁজে, তাই হিসাব করে পায় না ওই দিনটা কী কোন গ্রীষ্মের কোন ঘামে গোসল করানো রইদের দিন ছিলো নাকি শীতের শৈতপ্রবাহ ইয়াদ হয় না। এখন ফুসফুসে ক্যান্সার লইয়া সাদেক মিয়া কাতরায় বিষণ্ন চোখে তাকাইয়া থাকে মাইক ফুলগুলার দিকে। যেনো ফুলগুলা তারে ডাকে, আয়! আয়! সাদেক মিঞা গুনে গতকাল কতগুলা ছিলো আর আজকে কতগুলা রইলো। পানির লাইগা কাতরায়- কই সজিবের মা পানি দেও না ক্যান? মরা মরছো নাহি? আমি একটা মানুষ যে ঘরটাতে আছি কারোর কি কোন খেয়াল নাই? সজিব কই? ছাদে গেছে নাকি? গাঞ্জা ফোটাইবার গেছে আবার? পোলাডা আমার মানুষ হইলো না! বলে বলে আহাজারি করে সাদেক মিয়া। আহাজারি জারি থাকতেই পানি নিয়ে ঘরে ডুকে তার ছেলের বউ আসমা। দেইখা সাদেক মিঞার রাগ ওঠে আবার মোহাব্বতও হয়। কিন্তু সাদেক মিঞা কোন রিয়্যাক্ট করে না। বরং আসমা খাটের কাছে পানি রাইখা চলে যায়। আর বিরক্তির অন্যতম কারন হইলো সজিব এই মাইয়াটারে তুইলা আইন্যা বিয়া কইরা ঘরে তুইলা রাইখা দিছে। হালার বাপেরে কওয়ার কোন জরুরাত মনে করলো না তার পোলায়? যদিও এই ব্যাপারে আসমা মাইয়াটার কোন দোষ নাই। সেইটা সাদেক মিঞা বুঝে যে- পোলা হইলো তার, পোলায় কিছু না জানাইলে তার বউয়ের আর কী করার আছে? তবু এক অজানা কারণে আসমার ওপর থেইকা রাগ উদ্বায়ু কোন কয়লার মতো উবে যায় না সাদেক মিয়ার। বরং ফ্যাসিবাদি স্টেইটের মতো ঘাড়ে চাইপা বইসা থাকে রাগটা।

মাগরিবের সময় সজিব তখন মাত্র দুই নম্বর টানটা দিছে স্টিকে তখনই সাদেক মিঞার ডাকটা কানে আসে। মেজাজটা খিটখিট করে ওঠে সজিবের কিন্তু চুপ থাকে। ধীরে ধীরে দুইটা স্টিক টাইনা শেষ করে। সকালে যখন বাপে পানি চাইছিলো আসমা পানি নিয়া গেছিলো। অথচ বাপেরে সালাম দেয় নায়! এই মাইয়্যা নিয়া সজিবের চিন্তার শেষ নাই। শ্বশুর শাশুড়ির প্রিয় না হইলে সংসার করবো কেমনে! কিছু কইলে আবার কয়, আমার কী ঠেকা পড়ছে! আপনে আমারে লইয়্যা আনছেন, আপনে পালবেন। ওনারা তো আমারে আনে নাই। এইসব নিয়া ভাবে সজিব মিঞা। কী যে হইবে, আর কী যে হইলো! চিন্তার স্তর সাজাইতে সাজাইতে অন্ধকারে রাস্তায় নামে সজিব। কোনদিকে যায় সে নিজেও জানে না। আমরাও রাস্তাগুলার নাম বলমু না। যেহেতু সজিবের এই স্থির ও স্বাভাবিক হেঁটে চলার পেছনেই যাত্রা করতেছে গোপন এক বাহিনী। যাদের আমরা রাইতের বেলায় আলাদা করতে পারি না। তাদের আমরা চিনি জানি কিন্তু নাম উচ্চারণ করি না।

রাইত ধীরে ধীরে বয়োজ্যেষ্ঠ হইতে থাকে। সজিব ফেরে না বাড়ি। সাদেক মিঞা ক্লান্তির ঘুম ঘুমায়। আর ঘুমায় তার স্ত্রী। কেবল জেগে থাকে আসমা। সজিবের তরুণী স্ত্রী আসমা অপেক্ষা করে। নিজের ঘর থেকে বারবার সাদেক মিঞাদের ঘরে যায়। ঘুমন্ত শ্বশুর শাশুড়িরে ডাক দিবার সাহস পায় না। কেবল অপেক্ষা করে। ভোর রাইতে কিছুটা ঝিমুনি তারেও গ্রাস করে। সজিবের বাড়ি না ফেরার ঘটনা নতুন না হইলেও বিয়ার পরে এমন হয় নাই। সারাদিন যাই করুক, রাইত হইলে ঠিকই ফিরে আসে স্ত্রীর কাছে। ভোর হয় সজিব বাড়ি ফিরে না।

দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়াই বাসার সকালের নাশতা বানায় আসমা। চারজনের জন্যই নাশতা বানায় আসমা। ভাবে এইবার অন্তত ফিরে আসবে সজীব। আসে না। খবর নিয়া আসে রুস্তম সরকার জোর দিয়া ডাকে সাদেক মিঞারে। ডাকে- সাদেক ভাই বাড়ি আছেননি। ভাবিসাব, ও ভাবিসাব একটু বাইরে আহেন। জরুরি খবর দেওয়ার ছিলো। 

তারপর রুস্তম মিঞার মুখ থেকে আমরা শুনতে পাই গত রাইতের ক্রসফায়ারের খবর। এবং আরও জানতে পারি সজিবের দেহঘড়িটা এখন নিশ্চল অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে অবস্থান করতেছে। তখন আমরা দেখি শেওলা ধরা দেয়ালের বাড়ির ভেতর থেইকা দুইজন বোর্কা পড়া মহিলা ছুটে বেরুচ্ছেন এবং হন্য হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। আমরা সহজেই চিনতে পারি এরা দুইজন আসমা ও আসমার শাশুড়ি। আর বাড়িতে একা পড়ে আছে সাদেক মিঞা। সাদেক মিঞা কাঁদে না তাকাইয়া থাকে বিষণ্ণ কাতর মাইকফুলেদের দিকে। ভাবে আজ হয়তো তারই মাইকে কেউ ঘোষণা দিবো তার পোলার মৃত্যু সংবাদ। সাদেক মিঞা দেখে শাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট পড়া জেলা স্কুলের ফার্স্ট বয়, দুইবার ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া সজিব দৌড়ে আসতাছে আব্বা আব্বা ডাইকা কিন্তু কিছুতেই মাইকফুল গাছটা পার হইতে পারতেছে না। মাইকফুলের গাছ থেকে ঝরে যাচ্ছে হলুদ ফুল, ঝরে যাচ্ছে হলুদ রোদ, ঝরে যাচ্ছে সজিব মিঞা। একা কেবল একা তাকাইয়া থাকে সাদেক মিঞা। গুনে গতকাল কয়টা ফুল ছিলো? আর আজ..... আজ কোন ফুল নাই। 

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই