চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

পাউরুটি



ছোটগল্পঃ পাউরুটি
মূল লেখক: উলফগ্যাং র্বকার্ট
অনুবাদ: মিলু হাসান 

[বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত এ গল্পটির প্লটের পেছনে আছে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৬ সালের জার্মানির প্রতিদিনকার খাদ্য সংকটের বয়ান। গল্পটি র্বকার্ট লেখেন ১৯৪৭ সালে। এখানে অনূদিত গল্পটি জার্মান 'Das Brot ' থেকে ইংরেজি 'The Bread ' যা  Baltic-Black Sea Text এ প্রকাশিত তা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।]

হঠাৎ করে ভদ্রমহিলার ঘুম ভেঙে গেল। তখন ২ টা ৩০। তিনি ভাবলেন কেন তিনি জেগেছেন। ও হ্যাঁ! কেউ একজন রান্নাঘরের চেয়ারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। তিনি রান্নাঘরের দিকে কান পাতলেন। সবকিছু নিস্তদ্ধ। এতটাই নিস্তদ্ধ যে, তিনি পাশের বালিশে হাত দিয়ে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। পাশের মানুষটির নিঃশ্বাসের অনুপস্থিতিই আসলে এতটা নিস্তব্দ করে রেখেছে চারপাশ। তিনি বিছানা ছেড়ে অন্ধকার হাতড়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। রান্নাঘরে তাদের দেখা হলো। তখন রাত ২ টা ৩০ মিনিট। তিনি রান্নাঘরের ক্যাবিনেটের দিকে শাদা কিছু একটাকে  দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি বাতি জ্বালালেন। তারা মুখোমুখি হয়ে একে অপরের জামার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাতে। ২ টা ৩০ মিনিটে। রান্নাঘরে। 

রান্নাঘরের টেবিলে পাউরুটির প্লেট পড়ে আছে। ভদ্রমহিলা দেখলেন মানুষটা নিজের জন্য কিছু পাউরুটি কেটেছে। তখনো ছুরিটা প্লেটের পাশে রাখা। টেবিলক্লথের উপরে পড়ে আছে পাউরুটির গুড়া। ঘুমাতে যাবার আগে ভদ্রমহিলা টেবিলক্লথ পরিষ্কার করে যান। প্রতিরাতেই। কিন্তু এখন টেবিলক্লথে পাউরুটির গুড়া পড়ে আছে এবং পাশেই ছুরিটা। ভদ্রমহিলা অনুভব করছিলেন টাইলসের শীতলতা শরীরে ঢুকে পড়ছে ধীরে। তিনি প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। 

'আমি ভাবছিলাম এখানে কিছু একটা আছে ' এই বলে রান্নাঘরের চারদিকে তাকালো মানুষটা।

'আমিও কিছু একটার শব্দ শুনেছি' ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন এবং একইসাথে তিনি ভাবলেন রাতে শার্টে তাকে বেশ বয়স্ক দেখায়। তার বয়স যতটা ঠিক ততটাই দেখায়। তিষট্টি বছর। কখনো কখনো দিনে তাকে আরো অল্পবয়সী দেখায়। মানুষটা ভাবলো- নারীটিকে সত্যিই বয়স্ক দেখাচ্ছে । কিন্তু সেটা সম্ভবত চুলের কারণে। নারীদের ক্ষেত্রে, চুলের কারণে রাতে তাদের আচমকাই বয়স্ক মনে হয়। 

‘তোমার জুতো পরা উচিত। এভাবে খালি পায়ে হাঁটলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।’

ভদ্রমহিলা মানুষটার দিকে তাকালেন না, কারণ তার মিথ্যে কথা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। তাদের বিয়ের ঊনচল্লিশ বছর পার হবার পরেও মানুষটা মিথ্যা বলছে। 

‘আমি ভাবলাম এখানে কিছু একটা আছে,’ রান্নাঘরের চারদিকে অকারণে তাকিয়ে মানুষটা বার বার কথাটা বললো, ‘আমি কিছু একটার শব্দ শুনেছি। সেকারণেই ভেবেছি কিছু একটা আছে এখানে।’    

‘আমিও কিছু একটার শব্দ শুনেছি। কিন্তু এটা বোধহয় কিছুই না।’ ভদ্রমহিলা টেবিল থেকে প্লেটটা নিলেন এবং ঝাড়া দিয়ে টেবিলক্লথের উপর থেকে গুড়াগুলো পরিষ্কার করলেন। 

মানুষটা তাল মিলিয়ে বললো ‘না, এটা বোধহয় কিছুই না।’ 

ভদ্রমহিলা তাকে সাহায্য করলেন, ‘চলে আসো। নিশ্চয়ই বাইরের শব্দ এটা। বিছানায় আসো। শীতল টাইলসে ঠান্ডা বাধাবে তুমি।’ 

মানুষটা জানালার দিকে  তাকালো । ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই শব্দটা বাইরে হয়েছে। আর আমি ভেবেছি এখানে হয়েছে শব্দটা।’

ভদ্রমহিলা বাতির সুইচ বন্ধ করতে হাত ওঠালেন । তিনি ভাবছিলেন, এখন আমাকে বাতি বন্ধ করতে হবে অথবা প্লেটের দিকে তাকাতে হবে। আমি প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই না। 

‘চলে আসো এখন।’ বলেই বাতি নেভালেন তিনি। ‘এটা অবশ্যই বাইরের শব্দ। সবসময় ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন নল দেয়ালে আছড়ে পড়ে। আমি নিশ্চিত এটি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন নলের শব্দই ছিলো। ঝড়ো বাতাসে এটা সবসময় ঘর্ঘর শব্দ করে।

দুজনেই অন্ধকার হাতড়ে বেডরুমের দিকে গেলেন ।  মেঝেতে তাদের খালি পা পড়ছিল বিক্ষিপ্তভাবে।

‘হ্যাঁ, এটা ঝড়ো বাতাস। এটা সারারাত ছিল।’

তারা বিছানায় শোয়ার পর ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ঝড়ো বাতাস সারা রাত ছিল। তবে সেই শব্দটা ছিলো সম্ভবত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন নলের।’   

পুরুষটি আধাঘুমের ভান ধরে বললো, ‘হ্যাঁ, আমি ভেবেছি এটা রান্নাঘরের শব্দ। এটা সম্ভবত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন নলের শব্দই।’ 

ভদ্রমহিলা খেয়াল করলেন যখন পুরুষটি মিথ্যা কথা বলে, তখন তার গলার স্বর কতটা মেকি শোনায়। মহিলাটি মৃদু হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘অনেক ঠান্ডা, আমি কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ছি। গুড নাইট।’ 

মানুষটা উত্তর দিলো, ‘নাইট। হ্যাঁ, সত্যিই ভালো ঠান্ডা পড়ছে।’

অতঃপর সব নিস্তব্দ।  অনেকক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা টের পেলেন মানুষটা নিঃশব্দে সতর্কতার সাথে কিছু একটা চিবুচ্ছে। তিনি গভীরভাবে সমানতালে শ্বাস নিলেন যেন মানুষটা বুঝতে না পারে তিনি এখনো জেগে আছেন। কিন্তু মানুষটার চিবুতে থাকাটা এতই নিয়মিত চলতে থাকলো যে তিনি এর কারণেই ক্রমশ গভীর ঘুমে চলে গেলেন। 

পরের সন্ধ্যায় মানুষটা বাড়ি ফিরলে ভদ্রমহিলা চার টুকরো পাউরুটি তার দিকে ঠেলে দিলেন। আগে সে তিন টুকরো পেত।

ভদ্রমহিলা বাতি থেকে একটু দূরে সরে বললেন, ‘এখন থেকে তুমি চার টুকরো খেতে পারো। আমি আমারটা পুরো খেতে পারি না।  তুমি এক টুকরো পাউরুটি বেশি খেতে পারো। আমি পুরোটা খেতে পারি না।’

ভদ্রমহিলা দেখলেন মানুষটা কেমন যেন নুয়ে গেছে প্লেটের ওপর। মানুষটা তাকাল না। এ মুহূর্তে মানুষটার জন্য তার দুঃখ হলো।

মানুষটা প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার শুধু দু’টুকরো খেলেতো হবে না।’

‘অবশ্যই হবে । সন্ধ্যাবেলায় পাউরুটি আমার সাথে ঠিক যায় না। নাও, খাও! খাও!’

কিছুক্ষণ পরেই কেবল ভদ্রমহিলা ডাইনিং টেবিলের বাতির নিচে এসে বসলেন।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

  1. অ্যাবসার্ড৷ মারিয়া রেমার্ক এর নভেলে পড়ছিলাম ওইসময়ের মুদ্রাস্ফীতির কথা। দিনেও লাখ ডয়েসমার্ক বেতন দিত। মাইনষে গাট্টি টাকা লইয়া দোকানে যাইত৷ বাট দোকানে পাইত না কিছুই৷ পন্য সংকটের বিশাল চিত্র দেখাইছিলেন রেমার্ক থ্রি কমরেডস এ।

    এই গল্পে মহিলা যখন কয়, বিয়ার ৩৯ বছর পার হওনের পরও লোকটা মিছা কথা কইতেছে৷ হা হা হা পিউর অ্যাবসার্ড৷ গল্পের গ্রাউন্ডটা ওইসময় তৈরি ছিল বলেই মনে হয় এরকম অ্যাবসার্ড গল্প গুলা লেখা গেছিল৷ আমাদের দেশের বেকারত্ব+মাথাপিছু ঋন বাড়ার চাপেও হয়ত সামনে এরকম অ্যবসার্ড কিছু লেখা হইবে৷

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই