চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ঔপনিবেশিক শিরদাঁড়া (নতুন দেহ, পুরোনো রীতি)



ঔপনিবেশিক শিরদাঁড়া (নতুন দেহ, পুরোনো রীতি)
তৌকির হোসেন

আড়াইশরও বেশি বছর আগে ইংরেজরা যখন এই বাংলা ভূখন্ডকে অর্থনৈতিক আস্তানা বানিয়েছিলো সেই থেকে শুরু– উপমহাদেশের উপনিবেশায়ন। এই উপনিবেশায়ন পরে বাইরের দেহ পাল্টিয়েছে। কিন্তু ভেতরের রক্তের রঙ পাল্টায় নাই। বরং বিভিন্ন উৎসাহ, উদ্দীপনা পেয়ে রক্তের রঙ লাল হতে হতে কালো হয়েছে। দেশ হয়েছে স্বাধীন, স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পরে নানা কিছু পাওয়া, না পাওয়ার নৈরাশ্য, সব কিছু ভেঙে যাচ্ছে, স্বাধীনতার চেতনা, আদর্শ ইত্যাদির কথা তুলে পেসিমিস্ট ধোঁয়া উঠানো হয়। কিন্তু এই ভেঙে পড়া, জাতির আত্মসংকটের প্রকাশ একদিনে ঘটে নাই। বরং এই আত্মসংকট উৎপাদন করা হয়েছে একটি দীর্ঘ মনোযোগী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তাই সত্তর কিংবা আশির দশকে জাতির মধ্যকার বিভাজন, সংশয়, অসঙ্গতি স্পষ্ট না হলেও এখন ইয়োরোপের উত্তর–উপনিবেশকালে, বিউপনিবেশায়নের ধাক্কায় এই বাংলাদেশেও ঔপনিবেশিক সিম্পটম প্রকট হয়ে উঠছে। তাই আমাদের বেশিদূর যেতে হবে না। দেশের ভেতর নানা অনুষঙ্গের মধ্যেই ঔপনিবেশিক চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। খোঁজার জন্যে আমাদের খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হবে না৷ এই দেশের তথাকথিত 'জ্ঞান উৎপাদনের কারখানা' বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দিকে তাকালে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে কী প্রকার জ্ঞানীয় রস বের হয়ে আসছে বা এই যন্ত্রের চালিকাশক্তি কারা, সর্বোপরি এই কারখানাগুলো যে এখনও বিলেতি কাঠামো হয়েই 'একদা এই দেশে আমরা ছিলাম, এখনও আছি'– জানান দিচ্ছে তা বোঝা যায়৷ এই সমস্ত কারখানা থেকে উঠে আসা শিক্ষিত সমাজের কেতাদুরস্ত ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, চালচলন, মনস্তত্ত্বের রূপরেখা সবই যে ঔপনিবেশিক নিদর্শন তাও বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না।

যে দর্শনের উপর ভিত্তি করে ইয়োরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছিলো, সেই সার্বিক জ্ঞানের দর্শন, যা কান্টের যুক্তির উপর তৈরি, একই জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন কিন্তু বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্মেও পাওয়া যায়। এইরকম জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন বিশিষ্ট পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রতিষ্ঠার তিনশ শতাব্দী পর বাংলাদেশের পাহাড়পুরে প্রতিষ্ঠিত হয় সোমপুর বিহার। আক্ষরিক অর্থেই নালন্দা, সোমপুর মহাবিহার ছিলো 'বিশ্ব'বিদ্যালয়। ইরান, তুরস্ক, চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগমন করত শিক্ষার্থীরা। জ্ঞান উৎপাদন, বিতরণের একটি ইতিহাস আছে এই ভূখন্ডের৷ এর একটি সিলসিলাও তৈরি হতে পারতো। কিন্তু ভারতের পাঞ্জাব, কলকাতায় যখন ইংরেজরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলো, অর্থনৈতিক উপনিবেশায়নের পাশাপাশি জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়নের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমও শুরু হলো। প্রথমদিককার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (কলকাতা, মাদ্রাজ, মুম্বাই) ছিলো পরীক্ষাকেন্দ্রিক। পরে ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো ছিলো এই অঞ্চলের প্রথম পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ, ১৮৫০ সালের পর থেকেই ইয়োরোপে পাঠদানকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় গুরুত্ব পেতে শুরু করে গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (নিজার ২০১৮)।একভাবে বলা যায়, এই স্থানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ঔপনিবেশিকসূত্রেই জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গায় পিছিয়ে পড়েছে৷ তখনকার সময়ে ভারতের নতুন গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো ইয়োরোপীয় দর্শন, ইয়োরোপীয় ইতিহাস এবং ইংরেজি সাহিত্য। 

প্রভু–দাসের এই মনোবৃত্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে পোশাক–আশাকের বেলায়। উঁচুমহল থেকে মধ্যবিত্ত সমাজে কোট–প্যান্ট পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের একটি সংস্কৃতি এসেছে যার আমরা নাম দিয়েছি, 'ফরমাল'। অর্থাৎ, কোট–প্যান্ট পরাটা ভদ্রতা, 'ফরমালিটি', গাম্ভীর্য বজায় রাখবার বাহ্যিক প্রোজেকশান। এর একটি অর্থ এটাও– ইংরেজ সংষ্কৃতি 'ভদ্র'। 

ভারতবর্ষের ভূখন্ডে বসে একজন যদি ইয়োরোপীয় দর্শন, ইয়োরোপীয় ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করে তাহলে কী ঘটে? সে নিজের শেকড়, মাটি, সংষ্কৃতি, লোকাচার ইত্যাদির সাথে ইয়োরোপকে যুক্ত করতে পারে না। ফলে জ্ঞান ও জীবনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব থেকেই যায়। তখন ওই বিদ্যে মুখস্থ করা ছাড়া তৎকালীন শিক্ষার্থীদের উপায় ছিলো না। একদিকে ইয়োরোপের দর্শন নিজের ভেতর গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ব্যর্থতা, অন্যদিকে উপমহাদেশের দর্শন না জানা সবকিছু মিলিয়েই দর্শনশূণ্য অবস্থা তৈরি হওয়া অবধারিত ছিলো। এটির সমান্তরালে ছিলো এই ভূখন্ডের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞান করে রাখবার প্রক্রিয়া। এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে আর্য–অনার্য মিথ উৎপাদন করতে পারে ইংরেজরা। মজার ব্যাপার, প্রথম 'ইংরেজি সাহিত্য' বিষয় হিসেবে পড়ানো শুরু হয় ইংল্যান্ডের আগে ভারতে (নিজার ২০১৮)। 

এই ইয়োরোপীয় জ্ঞানপ্রীতি বা প্রেম একদিনে তৈরি হয় নাই৷ এটি ধীরে ধীরে হয়েছে। বলা যায়, তৈরি করা হয়েছে। কেননা ঘরের প্রেমিককে তখন কেউ পরিচয় করিয়ে দেয় নাই। বাইরের প্রেমিককেই মনে হয়ে হয়েছে আকর্ষণীয়, সুদর্শন। এই ধরণের বিষয় পড়াবারও কারণ রয়েছে। তখন উদ্দেশ্য ছিলো নূন্যতম ইংরেজিভাষী গড়ে তোলা। পরে বিজ্ঞান শিক্ষা আবির্ভূত হলো। এর উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো ইংরেজদের মতো ভাবতে শেখা। নতুন নতুন গড়ে উঠা কলকারখানায় কাজ পাওয়ার জন্যে উপযোগী হয়ে উঠা। শিক্ষা তাই চাকরিক্ষেত্রে কাজে লাগতো৷ ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু 'চাকরির জন্যে পড়া' নামক বর্তমান শিক্ষার সংষ্কৃতি। অর্থাৎ বর্তমানে ডিগ্রির জন্যে পড়াশোনা করবার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে তার শিকড় ঔপনিবেশিকতায়। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি– এই সমস্ত পাবলিক পরীক্ষাগুলো ঔপনিবেশিক সিলসিলাই ধরে রাখে। বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষাই দেওয়া হয় ইংরেজ হয়ে উঠবার জন্যে। এই প্রবণতা ঔপনিবেশিক প্রবণতা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো চাইতো ছেলেরা ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সরকারি চাকরিতে যেন ঢুকতে পারে। এখনকার সময়ে, পরিবার চায় ছেলেরা বিএসসি পাস করে সরকারি চাকরিতে যেন ঢুকতে পারে। তখনকার সময় সোনার হরিণ ছিলো ICS (Indian Civil Service) এখন তা BCS (Bangladesh Civil Service)। দেহটাই কেবল পাল্টেছে, রীতি পাল্টায় নাই। বিশ্ববিদ্যালয় যেসব রয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ইয়োরোপীয় পঠন–পাঠন রীতিনীতি অনুসরণ করে। এর ফলে যে জ্ঞানের ডিসকোর্স উৎপন্ন হচ্ছে তা এই দেশীয় না। ভিনদেশী। দেড়শ বছর আগে যেসব বিষয় পড়ানো হতো তা যেমন কর্মক্ষেত্রের উপযোগিতা লাভের জন্যে, তেমনি এখনও যা পড়ানো হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়গুলো খুব চলে অর্থাৎ বাজারের ভিত্তিতে জনপ্রিয়– চিকিৎসা, ব্যবসায় শিক্ষা, প্রকৌশল, তাও চাকরি লাভের জন্যেই। ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা থেকে আমরা তেমন বের হতে পারি নি। আমাদের পড়ানো বিষয়সমূহ নতুন জ্ঞানের ডিসকোর্স তৈরি করছে না বরং প্রশিক্ষিত কর্মমুখী শিক্ষার্থীদের ঔপনিবেশিক ধারা চলমান রাখছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে পাশে রেখে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমকে একটু কাছ থেকে দেখি তাহলে প্রত্যক্ষ করব যা শেখানো হচ্ছে বর্তমানে তা খুব নতুন কিছু না। একরৈখিক বা সরলরৈখিক ইতিহাস যেখানে তথ্য ছাড়া আর কিছু থাকে না। এসব মুখস্থই করা লাগে। তবে ঔপনিবেশিককালীন মুখস্থবিদ্যার চর্চার কতটুকু বাইরে আমরা? এর বড় ভুক্তভোগী ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা। ছোট থেকেই ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে শেখা ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশের ইতিহাসও ইংরেজিতে পড়া লাগে৷ কিন্তু সেই ইতিহাস পাঠ একরৈখিক। ফলে তারা আগ্রহী হয় পশ্চিমা ন্যারেটিভের ইতিহাসে (মশিউর ২০১৮)। যে ইতিহাস পুনরায় নয়া–উপনিবেশায়নের মাধ্যমে তৈরি করছে ইংরেজিভাষী নতুন বাংলাদেশিদের৷ এই ইতিহাস পশ্চিমকে বড়, মহৎ করে দেখায়। সেই বড়, মহৎ, সর্বৈব পশ্চিমাদের বাইরে অন্যকিছু যে থাকতে পারে তা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না। তাদের ইংরেজি ভাষা ভেতরে–বাইরে শেখা, চর্চা করা বাধ্যতামূলক। আরেকটি ভাষা শেখা খারাপ কিছু না। কিন্তু বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানোর মাধ্যমে বাংলা ভুলিয়ে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া নয়া জমানার উপনিবেশায়ন না তো কী? যেন এটি ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই। এমনকি পাশের দেশ ভারতের মতো আমাদের দেশেও বিচারকার্যে এরকম নমুনা হরহামেশাই পাওয়া যাবে। উকিলদের উচ্চারণ করতে হয়, ‘ইয়োর অনার’, ‘মাই লর্ড’ (দাস ২০১৮)। যা ইংল্যান্ডের কোর্টে একটি পুরোনোর স্বীকৃত সংষ্কৃতির এ দেশীয় চর্চা। আবার বিচারকার্যের প্রক্রিয়াও দুইশ বছর আগের তুলনায় ভিন্ন কিছু না। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ডায়াসের চল রয়েছে। সেই ডায়াসে শিক্ষক দাঁড়ায়, একটু উঁচুতে। শিক্ষার্থীরা একটু নিচুতে বেঞ্চ বা ডেস্কে বসে। শিক্ষক যেন এখানে প্রভু, শিক্ষার্থীরা দাস। প্রভু–দাসের এই মনোবৃত্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে পোশাক–আশাকের বেলায়। উঁচুমহল থেকে মধ্যবিত্ত সমাজে কোট–প্যান্ট পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের একটি সংস্কৃতি এসেছে যার আমরা নাম দিয়েছি, 'ফরমাল'। অর্থাৎ, কোট–প্যান্ট পরাটা ভদ্রতা, 'ফরমালিটি', গাম্ভীর্য বজায় রাখবার বাহ্যিক প্রোজেকশান। এর একটি অর্থ এটাও– ইংরেজ সংষ্কৃতি 'ভদ্র'। 

বাংলাদেশি সংষ্কৃতি কোনটা সেটি সম্পর্কেই আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারি নি৷ অনিশ্চিতকে অভদ্র ঠাউরে তাই তাকে বাদ দিয়েছি, অনুসন্ধান করবার প্রয়াস চালাই নাই। কিন্তু চোখের সামনে 'পশ্চিমা ভদ্র' সংষ্কৃতি চোখে পড়ে বেশি। তাই এটিকে নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক করেছি। রেস্তোরাঁগুলোর কথাই ধরা যায়। সম্পূর্ণ নতুন ধরণের খাবারের দোকানগুলো আমদানি করা হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে বিপুল হারে। ওয়েটার, ম্যানেজার, গার্ড, টেবিল, ন্যাপকিন, খাবারের ধরণ, মেন্যুকার্ড, পোশাক (এখানেও ফরমাল) – কোন বস্তুটি রয়েছে যা ঔপনিবেশিক পরম্পরা তুলে ধরে না? নাকি বলা হবে, মানুষগুলো তো ঔপনিবেশিক না?

কিন্তু ফাঁনো তো বলছেন, মানুষগুলোও ঔপনিবেশিক হতে চায় (ফাঁনো, ১৯৮৬)। যখন থেকে আমরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলা শুধু গুরুত্বই দিই নি বরং আধুনিকতার অনিবার্য উপাদান হিসেবে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই আমাদের মনস্তত্ত্বে ঔপনিবেশিকতা ঢুকে গেছে। উত্তর–উপনিবেশকালে যেসব জায়গায় ঔপনিবেশিক চিহ্ন, নিদর্শন ঢুকে থাকে এবং যা মনে হয় তথাকথিত 'অনিবার্য নির্ভরতা' তাকেই বলা যায় 'পোস্ট–কলোনিয়াল হ্যাঙওভার'। চীন বা ভারতে এই হ্যাঙওভারের উপস্থিতি অর্থনৈতিক। বাংলাদেশে এটি সামাজিকও বটে। তবে এই হ্যাঙওভারের উপস্থিতি মনস্তাত্ত্বিক শিকড়ে। 

মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের ইংরেজ–নির্ভরতা এখনও কাটে নাই। ফাঁনোর ভাষায়, এই তথাকথিত ‘ডিপেন্ডেসি কমপ্লেক্স’, ইংরেজ ভাষার উপর নির্ভরতা, ইংরেজ আদব–কায়দার অনিবার্য উপস্থিতির ধারণা তৈরি করে দিয়েছে ঔপনিবেশিকরাই। তাঁর ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’ গ্রন্থে তিনি বলছেন,

"I wonder sometimes whether school inspectors and government functionaries are aware of the role they play in the colonies. For twenty years they poured every effort into programs that would make the Negro a white man. In the end, they dropped him and told him, 'You have an indisputable complex of dependence on the white man.' " (ফাঁনো, পৃ. ১৬৮) 

এখানে ফাঁনো শ্বেতাঙ্গ–কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যকার ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্বের দিকে নজর দিলেও প্রায় সবরকম উত্তর–উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে এই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই নির্ভরযোগ্যতার নামে উত্তর–উপনিবেশায়নের বৈধকরণ চালানো হয়। আমাদের ইংরেজি ছাড়া গতি নাই, তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ছাড়া গতি নাই। যেন ঔপনিবেশিক শাসনকালে ইংরেজরা একটি শিরদাঁড়া তৈরি করে দিয়েছিল আমাদের যেটা ছাড়া এখনও আমরা হাঁটতে পারি না৷ এই নির্ভরযোগ্যতার তত্ত্ব সঠিক না। একইসাথে এগুলো মিথও বটে। এইসব মিথ তৈরি করতে অবশ্যই ভূমিকা রাখছে এবং এখনও রেখে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। কালোরা যেমন সাদা হতে চায় তেমনি বাংলাদেশিরাও ইংরেজ হওয়ার চেষ্টা করে। শুধু তারাই হতে চায় না, তাদের বানানোও হয়। এই চাওয়া–বানানোর কার্যক্রম চলতে থাকে সামাজিকভাবে, শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে (ফাঁনো ১৯৮৬)।

বি–উপনিবেশায়নের চর্চা তাই এদেশে শুরু হওয়া জরুরি। আমাদের ইংরেজ হতে চাওয়ার মধ্যে গর্বের কিছু নাই। যদিও এই হতে চাওয়াটা নগ্ন না। এটা সুপ্ত আকারে মন–মানসিকতায় ঠাঁই নিয়েছে। এজন্যে উত্তর–ঔপনিবেশিক চিহ্ন খুঁজে বের করতে হবে। চিহ্নগুলো ধরে উত্তর–উপনিবেশায়ন কোথায় কোথায় ঘটছে তা দেখতে হবে। সেই জায়গাগুলো ধরে ফেললে শিরদাঁড়ায় কুঠারাঘাত করতে সমস্যা হবার কথা নয়। ঔপনিবেশিক শিরদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে কোন জাতি জাতীয়তাবাদের যদি দাবি তুলে তবে বিষয়টি আসলে মানায় না, এটা উত্তর–উপনিবেশায়নকে বৈধতা দেয়। এই প্রহসন মেনে নেওয়া যায় কি?

তথ্যসূত্রঃ
Das, Pratigyan. "Are Indians still suffering from a colonial hangover?" The Times of India. 3 22, 2018. https://timesofindia.indiatimes.com/blogs/melange/are-indians-still-suffering-from-a-colonial-hangover/ (accessed 2 22, 2019).
Fanon, Frantz. Black Skin White Masks. United Kingdom: Pluto Press, 1986.
Mashiur, Zoheb. "Let's get rid of our colonial hangover, please." The Daily Star. 10 26, 2018. https://www.thedailystar.net/star-weekend/news/lets-get-rid-our-colonial-hangover-please-1651705 (accessed 2 22, 2019).
নিজার, সৈয়দ. বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন. ঢাকা: প্রকৃতি-পরিচয়, ২০১৮.

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই