চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

উমানজু যাহার নাম; তোমারে প্রেম থেকে



উমানজু যাহার নাম; তোমারে প্রেম থেকে
মীর হাবীব আল মানজুর


এক নতুন সৃষ্টির জন্য যেই সমস্ত মাওয়াদ দরকার হয় তারউদাহরণ জুইড়া নানা বালু-তৈল অস্থিরতা আটকায়ে থাকে। নতুনতা বইলা তো সত্যিই কিছু নাই। হয়তো নতুন কইরে পাওয়ার ব্যাপারটা হইতে পারে। ভাইবে দেখা লাগতেছিল উমানজুর। বুঝতে পারতেছিল না এক মহিলা গল্পকারের ইনবক্সে দেয়া গল্পটা কেন সে কয়েক লাইনের বেশি পড়তে পারতেছিল না। বিবমিষা লাগতেছিল পুরা কাহিনী না জাইনাই, পুরা গল্প না পইড়াই।

এইরকমের অভ্যাসগত অবভাস অনেক ধইরাই টের পাইতেছিল সে। যেমন বাসায় ওর বিছানায় ওর কাঁথাবালিশের পাশে আশ্চর্য আশ্চর্য বইগুলা দেইখাও প্রতিদিনের পুরানত্বে-যেন এন্টি একঘেয়েমির মতোন বিবমিষারে আটকায়া রাখতে হইতো। এইটারে দূর করতে এইদিকে আর মনোযোগ দিতে চাইতো না উমানজু। অন্য কিছু ভাবতে থাকতো। ওর মধ্যে পড়ার ক্ষেত্রেও এই জাতীয় একটা ব্যাপার ঘটতেছিল। যেন দুপুরে অল্প কতোক্ষণের অপরিতৃপ্তির ঘুম ভাইঙ্গা বোকা বোকা বেকুব বেকুব চিন্তায় মাথা ভইরে যাইতে থাকলে বিতৃষ্ণায় বিদঘুটে বিদঘুটে বিদঘুটে নামপুর্ব মেজাজ খারাপ হয়া যাওয়া।

এই ব্যাপারগুলা আইলেই উমানজুর নানা বিচ্ছিন্নতা তৈয়ার হইতো। একসময় বক্তৃতা দিতো নিয়মিত পাদপীঠের সাপ্তাহিক বক্তৃতা প্রশিক্ষণের। একই  বক্তৃতার বিষয় বছর ঘুইরা ঘুইরা চইলা আসায় বক্তৃতা দেয়াই সে ছাইড়ে দিছিলো, কবিতা লিখতে চাইতেছিল না ভালো কিছু নতুন না পাওয়ায়, আব্দুল্লাহ নামের এক পুরাতন সহপাঠীর অঙ্গভঙ্গী আর কথার ঘুরানফিরান দেইখা কমায়া দিছিলো তার সঙ্গের। এইগুলা প্রকট হয়া যাইতেছিল তার মধ্যে। স্থায়ী বা চিরায়তের মধ্যকার দৃশ্যায়ন, চিত্রায়ন তার স্মৃতিতে এতো পুরাতনরে ফিরায়া আনতেছিল, অস্থৈর্যে আর অদৃশ্যের দিকে হাত আর পায়ের তালু ঘাইমে ঘাইমে ঘাইমে যাইতেছিল। এমনকি নানাবিষয়ে তার সোল্লাস হাসিরেও একটু নীরব হইলে ভয়ানক অশ্লীল লাগতো।

এগুলা নিয়া ভাবতে থাইকা একটা নোকতা আইসা টক্কর খাইতে থাকে উমানজুর মনে-টনে। নতুনত্বের গাঠনিকতা নিয়া যে ক্রিয়েচারটা আইবো সামনে, তার সামগ্রিক অস্তিত্বের ভালোমন্দের নিরুপণতা অব্যবহিতগত সৃষ্টির লগে সংযোগে জায়গা রাখা, মিনিং ক্রিয়েট করতে পারা, একটা নূর ছড়ায়া দেয়ার কথাও তো নিয়াসে। রঠাজির নতুন ও নবীন শব্দ নিয়া যে আলাপ এবং তিরিশ ও তিরিশপূর্ব ভাষা কর্মকারদের লগে যে পাঞ্চিং তার কারণ বোধয় এইও আছিল।

প্রতিযুগে দেশে দেশে আভাগার্দ কবিদের প্রবল ভাঙচুর পরায়ণতা, কতোদিনের টিকে থাকা আমাদের দেখা হয়!
আভাগার্দ কবিরা সাহিত্যে খানিক সময় কাটাইবার পর সেই স্তিমিত, ধীর, চিরায়তই রয়া যায় অল্পকয় বাদে।
তো প্রাইমারী এই ফিউরিয়াসনেস কি তারপর যায়া সেই পুরানাগলির দিকে চইলা যাইতে থাকে এই জন্য যে, এতো হৈ-হুল্লোড় কইরেও কোনো সামগ্রিক ছাপ তারা ফালাইতে পারেন না তাগো ক্রিয়াকর্মে!
নাকি তারা এক অনিশ্চিত পতিত জায়গারে আবাদ করতে যায়া অনিশ্চয়তারে ডর ও পতনের জায়গা ভাইবা অপেক্ষাকৃত কম রিস্কি পন্থারে বাইছা নেন!!

***

তাহাদের ভিতর দিয়া একপ্রস্থ প্রস্থ গরম ভাপ উঠিয়া উঠিয়া মিলাইয়া যাইতেছিল-যে সামান্য বাতাস বইতেছিল-তাহাতে। তাহাদের প্রায় সকলেই শীতবস্ত্রে পেঁচাইয়া রাখিয়াছিল গা, তাহাদের হাত ধরিয়াছিল  র্যা কেট, তাহাদের চোখ পরখ করিতেছিল কর্ক।

কর্কের আভিধানিক অর্থ জানিবার সদুদ্দেশে প্রথম বাল গজাইবার কালে, অভিধান দেখা শিখিবার কালে অর্থকোষ খুলিয়া দেখিয়াছিল, কর্ক অর্থ ছিপি। এমত বস্তুর এমত নাম দেখিয়া তাহারা ভাবিতেছিল,এরকম পাখির পালক গুজিয়া উত্তল হইতে অবতলে যাইয়া এরকম একটা মুণ্ডু সৃষ্টি করিবার পর ইহার নামকরণ কর্ক করিবার উদ্দেশ্য 
কী হইতে পারে!

তাহারা আনুষঙ্গিক সবই ভাবিতেছিল।
তাহারা ভাবিতেছিল, এরকম গেমকোর্টের চারিপাশে মাটি যে খুঁড়িয়া রাখা হইয়াছে, ইহার মাটি গেল কই! এগুলো
কি ইঁদুর খাইয়াছে নাকি অন্যকোনো মাটি খাদক আসিয়া উহাদের দিয়া নিজেদের উদর পূর্তি করিয়াছে!
অথবা উহাদের কেউ এই সমস্ত কিছুই ভাবিতেছিল না।
অথবা ভাবিতেছিল, সর্বক্ষণ ভাবিয়া কাজ নাই। কিছু কর্মও অনুষ্ঠিত করিয়া উঠা আবশ্যক হইয়া দেখা দিয়াছে।
অথবা ভাবিতেছিল না, এমনিতেই তাহাদের মাথার ভিতর দিয়া নানাবিধ যৌন উত্তেজনাকর নীলছবি ভাগ ভাগ হইয়া নিজেদের মহিমার জানান দিয়া যাইতেছিল। তাহারা ক্ষণিকের তরে তাহাতে মজিয়া গিয়া পরক্ষণেই ধুৎধাৎ শব্দ করিয়া তাহাদের এ ভাবনা সরাইয়া ফেলিবার কোশেশ করিতেছিল। 

অথবা ভাবিতেছিল, তাহাদের স্বপ্নেও এরূপ গ্যালারি হইয়া আলাদা আলাদা ফ্রেমবদ্ধ হইয়া এরূপ অবচেতন পাপচৈতন্য আসিতেছে কোথা হইতে! অথবা পাঠিকাগণ এই বিভাবনসব সাহিত্যকারের কল্পিত।

উহারা নিজেদের ঠোঁট কামড়াইতেছিল প্রেমিত হইয়া পরস্পরকে দেখিয়া পরস্পর পুরুষ তাহাদের নিজেদের ঘ্রাণে গাছ ও ফুলমণ্ডলীর লিঙ্গের ব্যবচ্ছেদে আক্রান্ত হইয়াছিল। তাহাদের একজনের নাম, পিতামাতা তাহার ভূমিষ্ঠ হইবার সাত দিবস ও মাথা মুণ্ডিয়া তাহার চুলমতো সদকা করিবার পর এবং মুসলমান রীতি মোতাবেক ছেলে সন্তানের লাগিয়া দুইটা বকরী আল্লাহর নাম লইয়া জবাই করিবার কালে রাখিয়াছিল, উমানজু।

***

খোদা রব্বে তায়ালার প্রতি হামদ ও সালাত পেশ করিবার পর বাংলাদেশ স্মৃতি আলোচনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত অদ্যকার নিয়মিত বক্তৃতা মজলিসের সম্মানিত সভাপতি, দারুণ বুদ্ধিমান বিচারকদ্বয়, সুচতুর সঞ্চালক মহোদয়, সবাইকে আন্তর্জাতিক অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করছি।

প্রিয়তা ও বেকুবতা সম্পূরক শ্রোতাবৃন্দ,
আপনারা সকলে আমার বক্তব্যের বিষয় সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় অন্তরের অন্তস্তল থেকে আমার বিষয়টি স্মরণ করছি, তা হচ্ছে,
"উমানজুর কষ্টকল্পনাময় উপমার প্রাচীন সংকট, তাঁর সর্বব্যাপী আক্রমণাত্মক মনোভাব, দুরূহ সিনটেক্স পাড়ি দিয়ে মৌলের দিকে ক্রমশ যাত্রা, অতঃপর তা থেকে অবপতন, ছেড়া ও কুড়োনো শব্দের সমাহার-তা থেকে পালাবার পথ এবং আচ্ছিন্ন হরেক কিসিমের বাসনার অন্তর্সংলাপ।"

প্রিয় ও সুপ্রাচীন বৃদ্ধ শ্রোতকগণ,
বলুন আপনারা, বিষয়ের সাথে কেন বক্তব্যের সামঞ্জস্য থাকতে হবে!
শুনুন, উমানজু সম্পর্কে আপনারা এতোকাল যে সব গৎবাধা আলোচনা শুনে আসছিলেন, সে সমস্তকে আজ ফেলে দেবার সময় এসছে।

সে চাচ্ছিলো, অরণ্যে কিংবা পাহাড়ে চলে যাবে, খুব সবুজ কিংবা উত্তাল সমুদ্রে। তাঁর বিশ্বাসগুলো কেমন ছিন্ন ছিন্ন ছিত্তিছান হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মানুষের ভেতরেই শুধু এনাকণ্ডার কুণ্ডুলি, মানুষের ভেতরেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ঘূর্ণির অবতলতা।

আমাদের দীর্ঘ লোকগাঁথা ও প্রাচীন গীতিকাসমূহ থেকে এইরূপ ধারণা আমরা পাই যে, স্মৃতির অচল ঝনঝন থেকে ধারাবাহিক বিভ্রমের স্বরূপ যেভাবে আসছে যে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং গায়রে ক্রিয়াকলাপ শৈশবের অঞ্জলীভরে পরিপার্শ্ব থেকে জলভরে ভরে সিঞ্চিত করে দেয় এইভাবে যে, লোকেরা ছোট ছোট বহুচিত্রকে পুরাতন মুকুরে নানা এঙ্গেল থেকে প্রতিফলিত করে।

প্রিয় শয়ননিষ্ঠ পাঠক্রিয়াকারগণ,
উমানজু তাঁর প্রথম কবিতা প্রসবকালে ইরশাদ করিয়াছিলেন, সমস্ত তাচ্ছিল্যের জবাব উনি দিয়ে যাবেন। তো এমত উদ্দিষ্ট পূরণে উনি তাহার এমত ভাষাভঙ্গি গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন যে, উনি একলা অজস্র মুক্ত রচনায় ব্যাপৃত হইলেন। উনার সকল বিচ্ছিন্নতা, উপেক্ষা, অপেক্ষা এমন উপোদঘাত দ্বারা সংক্রমিত হইলো, যাহার তল খুঁজিয়া পাওয়া বড়ো বড়ো সমসাময়িক ভাষাযাজ্ঞিকদের দুষ্কর ঠেকিলো।

সুবঞ্চিত রস ও জলকামী পিপল,
আপনাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করিয়া পীরে মাওলা উমানজু সারাৎসারের সারকে লইয়া বৃক্ষের গোড়ায় ঢালিতে লাগিলেন এবং ভাবিতে লাগিলেন, উহাতে আঁতেলেকচুয়াল ফল হয়তো ধরিবে এবং দুর্বল, দরিদ্র, অশিক্ষিত বঙ্গবাসী তাহা খাইয়া এবং অল্পকয় বৈদেশে রপ্তানি করিয়া হয়তোবা উহারা বুদ্ধিফলধারিনী দেশ হিসাবে নিজ মাতৃকাকে এবং নিত্যনিতুন পুটুচিন্তার আবিষ্কারক হিসাবে খ্যাতি পাইয়া বিপুল প্রচার পাইবে।

ওহে বিদ্বৎসমাজ ও যাত্রাকারগণ,
শায়খে কামেল উমানজু নিয়া জ্ঞানিক উৎকর্ষতার নানাস্তরিক আলাপ করা যায়। কিন্তুক সময় সংক্ষিপ্ততা ও আপনাদের বিবমিষা উদ্রেকি খাউজানি আমার বক্তব্য সংক্ষেপে প্ররোচিত করতেছে। তবুও উমানজু দা.বা.র আরো কয়গুটি আলাপ আপনাদের সামনে পেশ করবার পিপাসা সামাল দিতে পারতেছি না, ভায়েরা। 
আরবী অলংকারশাস্ত্র নিয়া পীরে শায়খ উমানজু বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের বিশেষ বিশেষ শাখাগত মতপার্থক্য সহকারে গভীরভাবে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়ছিলেন।
উনি ভাবতেছিলেন, বুদ্ধিগত রূপক এবং ইঙ্গিতমূলক উপমা লইয়া দুই শায়খের মধ্যকার বিসম্বাদ তাহার অধ্যয়নে এইভাবে প্রবিষ্ট হইয়া আটকায়ে দিতেছে কেন?
এগুলারে উনি ব্যক্তিদৃষ্টায়নের জায়গা থিকা নিয়া ফিকশনের ভিন্নিক আবহে ফিট করতে চাইছিলেন।

অপ্রিয় অধিষ্ঠানে সুপ্রিয় উপবিষ্টগণ,
উমানজু উনার কর্মলিপিতে কবিতা, গল্প আর উপন্যাসের আঙ্গিকের রীতিফীতি নকশার বৈচিত্রে টোকাইয়া থুইছিলেন।
কোনো নির্দিষ্ট দৃষ্টায়নের দূরতম তাত্ত্বিক আভাসগত প্রচ্ছায়া দ্বারা উনি মলিত করে ফেলতে চাইতেছিলেন উনার বর্ণনা।
অনেক আলাপবেলাপ বকিবার পর তালেবে আদব উমানজুর কিতাবগত একটা পঙক্তি ফরমাইয়া আজকার আলোচনা শেষ করবো।

কুতুবে শে'র উমানজু অন্যত্র ফরমাইয়াছেন, 
হে আভাগার্দিয়ানরা! তোমরা এপথওপথ বিছরাইয়া যখন কোনো পথই পাইতেছো না, তখন ফিরা আসো মহান স্রষ্টাদের ঐতিহ্যের অবগাহনে, সুঅবগুণ্ঠনেনিজস্ব উসলুব, নিজস্ব আঙ্গিক, স্বালাদাত্ব নিইয়া।
সবাইরে অনেক অনেক সেলামলকি, বহুত অনুরাগ মানবেন বইকি।

***

উমানজু ভাবছিল তাঁর ডায়েরীর স্পর্ধার কথা। সেখানে নানান পাতাজুড়ে যে কালোপানি ব্রহ্মপুত্র ও কল্পস্বচ্ছ কলিঙ্গীর কথালিখা, তাঁর সিনথেসিস কোথায় হচ্ছে!
এইসব লিপিবদ্ধতা ও কালোর দিকে যাওয়া সাংকেতিকতা ভাবতে গেলে জায়ান্টদের জীবনের জানা যদ্দূর, তাঁর পরিদৃশ্যকতা তাঁর দিকে ভেসে আসতো, এখন যেমন সেলিম আল দীনের ডায়েরীর কথা ভাবছিল সে।
ভাবছিল, নামচার পাতায়, সময় ও স্মৃতির আরোপে কী কী উচ্চার্য যে লিখে গেছেন তিনি! যেন কুহেলী, যেন স্বমেহন আর স্বচারিতেযেন আত্যান্তিক আধ্যাত্মমরম! তাঁর নাটক, কতো অজস্র প্রহরিক নিষ্ঠীয় স্বরের গুঞ্জন! 
এ লোক নিপীড়ক ছিলেন! এ লোক দেখিয়েছেন লিপ্সা ও ক্ষমতার কাম!
শিল্পীর স্বচারিতা, তাঁর শুভত্ব-কল্যাণ ও সত্য থেকে দূরে! তাঁর বিমুখীনতা, অনার্যতা, গয়ংগচ্ছ, কামনায়ন, তারই মহত্তম ভণ্ডামোরনির্যাস!

শিল্পীর মহাত্ম, সুমহানতা, সাধারণ থেকে উচ্চতর হবার ভাবনা কোথা থেকে এসেছে? মানে ইনি একজন “মহান”
শিল্পী, এখানে “মহান” টাইপের সিফাত যখন আমরা নামের পূর্বে যোগ করি, তখন কি ব্যক্তিসত্তার দিকে  আমরা ইঙ্গিত করি নাকি তাঁর শিল্প যে বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে কিংবা সমাদর এতো অথবা তাঁর
অদৃতায়নের কারণে?

জাপানি লেখক আকুতাগাওয়া রিউনোসুকের বিখ্যাত গল্প “পটচিত্রঃনরক” গল্পের প্রধান চরিত্র খুব বড়ো শিল্প
য়োশাহিদের কর্মকাণ্ডকে কী করে ব্যাখ্যা করা যায়? ব্যক্তিসত্তা আর শিল্পীসত্তার ফারাকাত কেমনে করা যায়?

বোদলেয়ার কিংবা র্যাকবোর অত্যুগ্র আত্মপীড়নের ভিতর দিয়া জগতের সমস্ত তিতা নির্যাস শুইষা নেয়ার মধ্য
দিয়ে কবিতার যে অত্যুচ্চ শিখর স্পর্শ করছেন, ওই ব্যাপার সমস্তের ব্যবচ্ছেদ কে করবে? কীভাবে করবে?

"তোমার ঘ্রাণ বিনাশী তীব্র,
তোমার নিকটিস্থি চাবুতরার হাওয়া ,
গাভিন প্রেম তোমার দৃষ্টির প্রসাদ।
আমার আছে অজস্র দৃষ্টির প্রসাদ,
সেখানে ঘুম ও অবচেতনার অনেক দায়
সেখানে বিমর্ষতার কাছে ডুমো ডুমো মাছি।"

শিল্পের কি রিলেট হওয়া খুব জরুরী বা টেক্সট কি সবের কাছে পৌঁছার প্রয়োজন! চিন্তা বা কাঠামোর ভিতর স্তরিকতার প্রাধান্যতো পাবে, সে ক্ষেত্রে টেক্সটও তো সোচ্চার থেকে অনুচ্চারে আরো অন্তঃপ্রবণ আরো বিন্দু অভিগমে সারথিকে ইঙ্গিত দিবে।
শিল্পের কি শুধু শিল্পত্ব নেই! না হলে ফিনেগানস ওয়াক কেন লিখা হয়, কেন লিখা হয় মালার্মে বা পল সেলানের কবিতা!
“আমার একটা ভাষা দরকার। এমন এক ভাষা, যা দিয়ে তোমাদের ছোঁয়া যায়, তোমাদের স্পর্শ করা যায় না দেখবার মতো। আমি এমন এক ভাষায় এমন বামাতাল, এমন দোলাচল দেহ বিভায় এমন জড়োসড়ো টালমাটাল হয়ে আছি, তোমরা ওপারে কাঁচের, তা ভেদ করবার জাদুপ্রয়াস জ্ঞাত হবার সুসুলভ অথবা দুরূহদুর্লভ কোনো
মাধ্যম আমার নেই যে! 
দাঁড়িয়ে আছো কি গানের ওপারে! আমি গান কীভাবে ছুঁই! গান শুনতে এলে দ্রবীভূত তরলের কাঠামোয় আমার
অন্তর্গত বেদনাকে দেখি। 
আমি একটা ভাষা চাই। যে ভাষা তোমাদের রোমকূপে ধিমে ধিমে আগুনচুমো জ্বলন দিয়ে যাবে। অসহায় লাগে 
ভাষাকে দেখে আমার, আমি থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে যেতে পারে না যে। ভাষার মখমলে আমার নিজেকে ঘেঁষটে ঘেঁষটে শুষে দিতে ইচ্ছা করে।

ভাষা আমার, আমাকে জাদুভাষা এনে দেবে কোন মায়াকর মুকুর অধিপতি!"

উমানজু ডায়েরীর ভিতর দিয়ে রোমন্থন করছিল কলিঙ্গীর স্রোত,
উমানজু কাগজপাতায় দেখছিল উতরোল ব্রহ্মপুত্রের হাওয়া।
আবার ভাবছিল শিল্পের সংযুক্তিকে কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে? শিল্পী কি কোনকিছু বোঝাতে চান তার গৃহীতাকে? তিনি কি চান তার চিন্তা পৌঁছুক বা তার মতো ভাবুক সে গ্রহীতা? বা শিল্পী যে ভাবতে পারেন, ভাবছেন অন্যবিন্দুর অভিরেখা, তা বোঝাতে চান?
উমানজু ভাবছিল, শিল্প কি বিচ্ছিন্ন পাথরের নির্জনতা নিয়ে থাকতে পারে না? থাকতে পারে না একাকী নিজস্ব উদ্ভাসন নিয়ে?
সে নতুন ফয়সালার দিকে যেতে চাচ্ছিল এইভাবে, শিল্পের রিলেট হওয়ার জরুরত থেকে শিল্প গ্রহীতার রিলেট হওয়ার জরুরত অত্যাধিক।

***

উমানজু এরকম নানান চিন্তা ও বিক্ষিপ্ততার মধ্য দিয়া যাইতে থাকিয়া ভাবিতেছিল, তাহার যে বিষাদ-বিষণ্ণতা, তাহারই ধারাক্রম বাহিয়া এরকম আত্মহত্যার কাছাকাছি বসিয়া থাকা, তাহা সমস্তই কি ইউরোপীয় নাস্তি ও অর্থহীনতাময় শিল্প হইতে ঋণ করিয়া করিয়া অন্তরীণ করিবার দরুণ হইয়াছে!

এই যে প্রবল বিক্রমে অর্থহীনতা তাহারে বিপুল উলটপালট করিয়া দেয়, এই যে তাঁহার একাডেমীক পড়াশুনায় সে ডাব্বা মারিতেছে প্রতিনিয়ত, এ যে তাহার সমস্তের বিরুদ্ধেই বিক্ষোভ জাগিয়া থাকে-সে তো নিষ্পাপ, আলাভোলা, সহজ, সরল পরিচিত হিসাবে ছিল-তাহার উদ্ভব হইয়াছে কোথা হইতে! তাহার কেন পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি না সইতে পারিয়া নিজেরে ব্যাকেটের নাটকের অপচরিত্র বলিয়া ভ্রম হইতে থাকে!

আবার পরক্ষণেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিয়া সকলের গোয়া মারিয়া দিতে ইচ্ছা করে! তাহার কেন সকল কিছু ভাঙিয়া-চুরিয়া মিসমার করিয়া দিতে ইচ্ছা করে তারপর তাহার কেন আবারো মতি পাল্টাইয়া এই সমস্তের অনুশোচে ভুগিতে হয়!

সে যখন পুনরায় ধর্মের কাছে সমর্পিত হইতে যায় নিরুপায়-নিরুপথ হইয়া, যখন কাঁপিয়া উঠে আবারো পু্রাতন উপলব্ধিতে-আরশের উপরকা সত্তা বাদ দিয়া আর কোনো অস্তিত্ব তাহার সুবিধায় লাগিবেনা- তখন তাহার আবার কেন মন এতো দুর্বল হইয়া উঠে! তাহার পর তাহার কেন অসীমের সহিত সংযোগের অতনে ইচ্ছা ইচ্ছায় ফাটিয়া-গলিয়া-ছিঁড়িয়া-ফাঁড়িয়া যাইতে ইচ্ছা করে! এই সময়ে তাহার কেন একটা পাতা ছিঁড়িবার মতো ক্ষমতাও থাকে না!
তাঁহার মনদেহ এমন টাটকা সুপুক্ব ফলের মতো হইয়া থাকে কেন, যাহার গায়ে সামান্য টোকা লাগিলে তৎসময়ে ঝরঝর করিয়া জল ঝরিতে থাকে!

সে ভাবিতে থাকে, ইসলাম ধর্মে তো অবসাদ-হতাশা ইত্যকার আচ্ছিন্নতা মানুষের ভিতর সমর্থন করিয়া থাকে না। ইসলাম ধর্মে আশার কথা বলা হইয়াছে, বলা হইয়াছে, তাহার ইহকালের সমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মেরই কোনো না কোনো অর্থ সে পরকালে দেখিতে পাইবে। তাতে করিয়াই তাহার অন্যায় আচরণের কারণে শাস্তি দেখানো হইয়াছে , আর সুকর্ম ও কল্যাণের প্রতি রহিয়াছে পুরষ্কারতা।
যদিও মহামৌনী অরূপ এককের নিজের ব্যাপারে বারংবার বর্নণা করা হইয়াছে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ও আনুগত্যের প্রক্রিয়ায় যে সক্রিয়তা আসিয়া থাকে, তাহাতে মৌল বিষয় হচ্ছে, খোদাভীতি ও খাটিত্ব।
তাহা হইলে কি ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ কিংবা মনীষীগণ কখনো শ্রান্তিলগ্ন হন নাই? তাহাদের কি দুঃখ ও মনখারাপি কখনো আচ্ছন্নকরিয়া থাকে নাই মানসবিহারে?
তবে পবিত্র কোরানে দুঃখের সময় সবর এবং নামাজের মাধ্যমে প্রভুর সাহায্য চাইতে বলা হইয়াছে।

তাহলে কি কখনো এমত সময় আসিবা না কোনো ধর্মপালয়িতার, তাহার নামাজ পড়িতে গিয়াও প্রবল বিহ্বল্যে ও কান্নার চাপে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা হইবে? তাহার স্পর্শকাতরতার রূপ কি তাহা হইলে এমত হইতে পারিবে না কখনো, তাহার হাঁটিতে ইচ্ছা করিতেছে না, তাহার বসিতে ইচ্ছা করিতেছে না, তাহার সমস্ত কিছুই এমন অবগাঢ়ি, তাহার মরিয়া যাইবার ভাবনাও বড়ো কষ্টকর ঠেকে!

***

উমানজু ভাবতেছিল, মাঝে মাঝে এমন আনন্দ উড়ে উড়ে যাইতে থাকে, কেবল নাচতে ইচ্ছা করে, খালি গলা ছাইড়ে গায়া উঠতে ইচ্ছা করে।
তখন দেহে এতো শক্তি বোধ হয়, মনে হয়, দৌড়েই হিমালয় ছাড়ায়ে যাবে, যতোই ক্লান্তনা আসুক ওরে কোনো অবসাদই আবিষ্ট করতে পারবে না।
নিজের ঐশ্বর্যে পাগল পাগল মাত হয়া যাইতে ইচ্ছা করে।
তখন মনে হয় উমানজুর, কোনো প্রাপ্তিই অসম্ভব না আর, সমস্ত তাচ্ছিল্যের জবাব সে দিয়া যাবে।
রাস্তায় রাস্তায় বিহার সমগ্রে কতোকিছু দেখা হয়া গেল, সেইসব থেকে আরো কতো উচ্চে, কতো মহিমা ব্যেইপা 
তাঁর ক্রিয়া, তাঁর নিয়তি আরো কতো সুদূর সূনিম চূড়ায়!
***

উমানজু আবছায়ার ভেতর দিয়ে স্বপ্নের অবকাঠামো তৈয়ার করত করতে বারবার নতুন উপলব্ধিতে মনে করতে থাকতো, হায়! এতোদিন কতো ছেলেমানুষী ভাবা ভেবেছে!
প্রতিদিন সে নিজেকে আগের দিন থেকে মহত্তম ও উন্নততর ভাবতো।
তাঁর মনে পড়ে প্রথম কৈশোরে প্রতিদিন পত্রিকা পড়বার কারণ হিসাবে সে তাঁর মা'র নিষেধের দিকে তাকায়ে বলতো, আমি আগের দিন থেকে আরেকটু বড়ো হতে চাই, মা, আরেকটু বেশি জানতে চাই।

সে একে একে বিশ বছর পর্যন্ত আসতে আসতে তাঁর প্রতিপল অতীতকে নিজস্ব বোধিতে ছেনে তুলতে চাইতো। সে প্রতিকালকেভাবনার ছাঁকনিতে-সেই ছাঁকনি বায়াসড কিংবা শিশুসুলভতায় বিপর্যস্ত হবার সম্ভাবনাও রাখে-ফেলে নিরেট পেতে চাইতো। এ জন্য সে দেখছিল, তাঁর আগের বিশ বসন্তের উপর দিয়ে যে হাওয়া উড়ে উড়ে গিয়েছিল, সে হাওয়ায় অনেক প্রগলভতা, অনেক চাঞ্চলিক অপমান, অনেক তড়িৎ সিদ্ধান্ত কিংবা প্রজাপতির নড়াচড়ার অগোছালো স্টুপিডিটি।

উমানজু চাইছিল নিজেকে সাজিয়ে তুলতে, সাজিতে সাজানো গোছানো কিছু যেন সে, সেভাবে দেখতে। রাস টেনে ধরতে চাচ্ছিলো তার কেন্দ্রের, যেন ছাতির মতো সবটা এক সুইচ টিপে খাপে ঢুকে যায়।

দেখছিলো, যা করছে সব যেন ভুল হয়ে যাচ্ছে, যেখানে যাচ্ছে, বিভ্রমে ছেয়ে-ছেপে যেন যাচ্ছে, তারপর চেতনা রহিত হলে কী যে একলা পাহাড়ের একা পাথরের পরিমার্জনে লাগতো তাকে!

সে চাচ্ছিলো, অরণ্যে কিংবা পাহাড়ে চলে যাবে, খুব সবুজ কিংবা উত্তাল সমুদ্রে। তাঁর বিশ্বাসগুলো কেমন ছিন্ন ছিন্ন ছিত্তিছান হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মানুষের ভেতরেই শুধু এনাকণ্ডার কুণ্ডুলি, মানুষের ভেতরেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ঘূর্ণির অবতলতা।

নিজেকে গোছাবার দিকে উমানজু বড়ো কিছু সক্রিয়তায় জড়িয়ে যেতে চাচ্ছিল। তার কিছু তত্ত্বের দরকার ছিল। অনটনে টনটন করছিল। পিঠে এই সমস্ত ফেলে নিঝুম কোনো ঘরে ফিরবার প্রয়োজন বোধ করছিল।

সেই ঘর মহাউচ্চ স্তম্ভের উপর, তার হালকা দেয়ালের উপর আভা ফেলে রেখেছিল।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই