চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

উন্মাদ লোকের উপাখ্যান



উন্মাদ লোকের উপাখ্যান

মূলঃ ফ্রিডরিখ নীৎশে 

অনুবাদঃ নিসর্গ নিলয়


আপনারা কি সেই লোকটির কথা শোনেন নি? সেই উন্মাদ লোকটা, যে খুব উজ্জ্বল এক সকালবেলায় একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে ঘুরছিল বাজারে। “আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছি, আমি খোদাকে খুঁজছি!”, সে ক্রমাগত চিৎকার করছিল। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করত না। লোকটার কথা শুনে তারা হো হো করে হাসল। একজন বলল, লোকটা হারিয়ে গেছে নিশ্চয়ই? সে কি ছোট শিশুর মত পথ হারিয়ে ফেলেছে? আরেকজন বলল। সে কি ভয় পাচ্ছে আমাদের দেখে? সে কি অন্য কোন দেশে গিয়েছিল? – এসব বলে তারা শব্দ করে হাসতে থাকল। উন্মাদ লোকটা লাফিয়ে তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি যেন চিরে ফেলছে সবাইকে। সে আবার চিৎকার করে বলল, “কোথায় খোদা?...... আমি বলছি, আমি বলছি তোমাদেরঃ আমরা তাঁকে খুন করেছি, তুমি, আমি, আমরা সবাই। আমরা সবাই তাঁর খুনী। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে আমরা তাঁকে খুন করলাম? কবে থেকে আমরা পুরো সমুদ্রটাকে গিলে খেতে শিখলাম? যখন পৃথিবীকে তার সূর্য থেকে ছিন্ন করা হল [১], তখন আমরা কোথায় ছিলাম? কার চারপাশে ঘুরছে এখন পৃথিবী? আমরা ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যাচ্ছি? সূর্য থেকে সরে যাচ্ছি আমরা? আমরা কি সব সূর্য থেকে যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছি? আসলে কি আমরা পড়ে যাচ্ছি না? আমরা পিছনে, পাশে, সামনে, নিচে, উপরে, সবদিকে পড়ে যাচ্ছি না? উপর-নিচ বলে কিছু কি আছে এখন আর? একটা অসীম না-থাকা, অসীম নিরর্থকতার ভিতরে কি আমরা চরে বেড়াচ্ছি না? একটা বিশাল শূন্যতা কি আমাদের গ্রাস করছে না? সবকিছু কি আরও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে না? শুধু কি রাত, রাতের পর রাত, আরও রাত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে না? সকালবেলাতেও কি আমাদের আলো জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে না? যারা স্রষ্টার জন্য কবর খুঁড়ছে, এখনো কি আমরা সেই কবর-খুঁড়েদের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না? আসছে না গন্ধ? স্রষ্টার পবিত্র পচনের গন্ধ, পাওয়া যাচ্ছে না? – স্রষ্টাও পচনশীল! স্রষ্টা মরে গেছেন! স্রষ্টা মৃতই থাকবেন! আমরা, এই আমরা তাঁকে খুন করেছি![২] আমরা সকল খুনীর খুনী, কীভাবে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দেব! এই জগতের পবিত্রতম, সর্বশক্তিমান সত্তাটিকে আমরা রক্ত ঝরিয়ে খুন করেছিঃ এই রক্তের দাগ কে মুছবে, কে? কোন পানিতে আমরা এই দাগ মুছতে পারব? প্রায়শ্চিত্তের কোন অনুষ্ঠান, কোন পবিত্র আচার আমরা আবিষ্কার করতে পারব, আমাদের জন্য? এই মহান পাপের ব্যাপকতা কি আমাদের জন্য অনেক বড় নয়? এই কাজ করার মত যোগ্য হয়ে উঠতে আমাদেরই কি একেকজন স্রষ্টা হয়ে উঠতে হয় না?[৩] এর থেকে মহান কাজ এর আগে কখনো কেউ করে নি; আর আমাদের পরে যারা জন্ম নেবে, শুধুমাত্র এই খুনের জন্য তারা আগেকার যে কোন ইতিহাসের চেয়ে উচ্চতর ইতিহাসের পাতায় নিজেদের জায়গা করে নেবে!”

এইটুকু বলে উন্মাদ লোকটা থামল। তার শ্রোতাদের দিকে সে আরেকবার তাকিয়ে দেখল। তারাও নিশ্চুপ। তাদের চোখে অস্বস্তি, বিভ্রম। লোকটা শেষপর্যন্ত তার লণ্ঠনটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। লণ্ঠন মাটিতে পড়ে চৌচির হয়ে গেল, আলো নিভে গেল। “আমি অনেক আগে এখানে এসে পড়লাম”, লোকটা বলল, “আমার এখনো সময় হয় নি। এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা এখনো চলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, এখনো মানুষের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। বজ্রপাত কানে আসতে সময় লাগে। দূর তারাদের আলো এসে পৌঁছাতেও সময় লাগে। কোন কাজ শেষ হতেও সময় লাগে, এমনকি সেটা সম্পন্ন হবার পরেও সেটার কথা জানতে হয়, দেখতে হয়। আর এই মহান কাজটা এখনো সবচেয়ে দুর্গম তারাদের থেকেও দুর্গম –কিন্তু মানুষ কাজটা করে ফেলেছে!”

এখনো সবার মুখে মুখে সেই লোকটার কথা ছড়িয়ে বেড়ায়, কীভাবে সেই একই দিনে লোকটা অনেকগুলো উপাসনালয়ে গিয়ে গিয়ে মৃত খোদার শান্তি কামনা করে গান গাইতে থাকল। এ বিষয়ে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হত, সে কেবল বলত, “এই উপাসনালয়গুলো যদি স্রষ্টার কবর হয়ে না থাকে, তবে এগুলো কী এখন?”


ফুটনোটঃ 
১. নীৎশে ছিলেন এন্টি-এনলাইটেনমেন্ট দার্শনিক। এনলাইটেনমেণ্টের কালে (অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী) র‍্যাশনালিজম বা যৌক্তিক চিন্তাভাবনার প্রবল প্রসার ঘটে। ফলে ইউরোপের অনেক প্রচলিত ধারণার মোটামুটি কবর ঘটে। বিজ্ঞান, দর্শন নতুন জোয়ার পায়। কিন্তু নীৎশে একে দেখেন মানুষের অনুভূতি, আবেগ, অযৌক্তিক সৃজনীক্ষমতার ক্ষতিকারক হিসেবে। ‘সূর্য থেকে দূরে সরে যাওয়া’ বলতে নীৎশে আসলে আমাদের মধ্যে খোদাকেন্দ্রিক বা কোন এক আধ্যাত্মিক আশ্রয়কে কেন্দ্র করে যে ইমেজ ছিল- যার কাছে ভয়াবহতম সময়েও আশ্রয়ের জন্য যাওয়া যেত- তার মৃত্যুকে নির্দেশ করেন। আধুনিক সময়ের যৌক্তিকতা সেই ইমেজকে অযৌক্তিক বিধায় খারিজ করে দেয়।
২. ‘খোদা মৃত এবং আমরা তার খুনী।‘ এর অর্থ হল সর্বশক্তিমান, বিপদে আশ্রয়দাতা ইমেজের যে ধারণা ছিল মানুষের মাঝে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। অর্থাৎ মানুষের কাছে আর আশ্রয় চাওয়ার মত কেউ নেই। প্রবল দুর্যোগ, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদি যে কোন ঘটনা, যা তার অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে, সেসময় মানুষের কাছে আশ্রয়দাতা হিসেবে আবির্ভূত হত খোদা/খোদার ইমেজ। আধুনিকতার যুক্তিতর্ক সেই ইমেজকে খারিজ করে দিয়েছে। আমার যতটুকু দেখা, এই বাক্যটা নীৎশের সবচেয়ে পরিচিত উক্তি এবং অনেকেই পুরো টেক্সট না পড়েএর ব্যাখ্যা করেন।
৩. নীৎশে মূলত নিরর্থকতা থেকে দর্শন শুরু করলেও নিরর্থকতায় পড়ে থাকেন নি। অর্থাৎ তাঁর দর্শননায়ালিজম(nihilism) থেকে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। তিনি প্রথমে বলছেন, আমাদের মাঝে অনেক কিছুর মৃত্যু ঘটিয়েছে ‘আলোর পথ দেখানো’ এনলাইটেনমেন্ট। তিনি দেখাচ্ছেন মানুষের জীবনের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ আসলে আর আট দশটা প্রাণীর মতই প্রজাতির সংরক্ষণ বৈ আর কিছু নয়, এবং তার ইতিহাস দুর্যোগময়, অরৈখিক। কিন্তু তিনিই আবার এখানে দাঁড়িয়ে বলছেন, স্রষ্টাকে খুন করার মত ভয়াবহ কাজ করে আমরা আসলে নিজেরাই স্রষ্টা হয়ে উঠছি, হয়ত আমাদের ভবিষ্যৎ হবে আরও সম্ভাবনাময়, বা ‘অদ্ভুত’। 

সম্পাদকীয়ঃ

অনেকেই বলেন, যেহেতু ‘দ্য ম্যাডম্যান’ একটি প্যারাবল, তাই এটিকে ওপর থেকে যেমন দেখায় এটি আসলে তেমন নয়। কেউ কেউ বলেছেন- নীটশে আমাদের সামনে একাধিক সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। হয় স্রষ্টাসহ নৈতিকতা অথবা স্রষ্টাও নেই, নৈতিকতাও নেই। আর যদি স্রষ্টা না থাকে, নৈতিকতার ভাগ্যও নির্ধারিত। ফলে, নৈতিকতা-মানবিকতার বিকল্প কিছুকে মেনে নিতে হবে।

এরমানে নৈতিকতার আর ভিত্তি থাকে না। মানুষকে এখন নৈতিকতা বিবর্জিত বলা যায়। স্রষ্টা মৃত মানে নৈতিকতাও মৃত। প্রশ্ন আসে- নীৎশে কী এই নৈতিকতার বর্জনকে স্বাগত জানিয়েছেন না এটি তাকে ব্যথিত করেছে? এই প্রশ্নের আসলে উত্তর নেই। নীৎশের এই রচনা নিয়ে বেশ ভাল বিতর্ক আছে। অনেকেই বলেন- উন্মাদ লোকটির চারপাশে যেসকল লোক ছিল, যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করতো না, তারা আসলে দার্শনিক। তারা উন্মাদ লোকটির কথায় হেসে উঠেছে, কেননা স্রষ্টার প্রশ্নে তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু, শেষে গিয়ে তাদের চোখে যখন থাকে অস্বস্তি তার মানে দাঁড়ায়, তারা বিভ্রান্ত। উন্মাদ লোকটি তাদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। বিভ্রান্ত-দিশাহীন প্রশ্নের স্রোতে।

উন্মাদটির বক্তব্যে আরো কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, যেমন- কেন সে স্রষ্টাকে মৃত বলছে? স্রষ্টার মৃত্যুর মানে কী দাঁড়ায়, এর প্রভাব কী হতে পারে? উন্মাদটি আসলে কে?

নীৎশে আরো অনেকের মতই নিজ সময়ের বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুগ্ধ ছিলেন। প্রভাবিত ছিলেন। ডারউইন তাকে প্রভাবিত করেছে এটা ধরে নেয়া যায়। ‘সারভাইবাল অব দা ফিটেস্ট’ এর প্রতি মুগ্ধতা ছিল তার।  অথবা বলা যায় সবলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। তিনি ‘Thus Spoke Zarathustra’ বইয়ে সুপারম্যান বিষয়ে আলাপ করেছেন। ডারউইনের বিবর্তন তত্বের প্রভাবেই বোধহয়। 

‘দ্য ম্যাডম্যান’ এ উন্নত মানবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, উন্মাদ লোকটি যখন বলে- ‘আর আমাদের পরে যারা জন্ম নেবে, শুধুমাত্র এই খুনের জন্য তারা আগেকার যে কোন ইতিহাসের চেয়ে উচ্চতর ইতিহাসের পাতায় নিজেদের জায়গা করে নেবে!’

তিনি কল্পনা করেছেন, এসকল মানুষেরা নৈতিকতার অনুসরণ না করে নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করবে। এরা হবে মানবজাতির উন্নত সংস্করণ। এরা দুর্বলদের মতো দয়াশীল হবে না। মানবিকতার চর্চা করবে না। এরা জয় করবে। দুঃখের বিষয় তার এসকল বক্তব্য হিটলার তথা নাৎসী বাহিনী মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। যে কারণে নীৎশে ছিল নাৎসীদের পীর। ‘Thus Spoke Zarathustra’ বইটি জার্মান সৈন্যরা এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও সাথে রাখতো। তার ‘Will to Power’ বইটিকেতো বলা হয় নাৎসীদের মূখ্য প্রচারপত্র। এটাকে নাৎসীরা বাইবেলসমান গুরুত্ব দিতো। 

অনেকেই বলে, নাৎসীরা নীৎশের অনেক বক্তব্যকে বিকৃত করেছে নিজেদের স্বার্থে। অভিযোগ আছে যে, এই বইটিতে মৃত্যুর পর তার নাৎসী সমর্থক বোন নীৎশের বক্তব্য কাট পেস্ট করে বইটি প্রকাশ করেছে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, হিটলার বা নাৎসী বাহিনীর পছন্দের বক্তব্যগুলো নীৎশের রচনায় কমবেশি ছিলই।

সে যাক, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুগ্ধ নীৎশে’র মনে হয়েছে, মানুষের কাছে স্রষ্টার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ফলে স্রষ্টাকে এখন মৃত ঘোষণা করা যায়। স্রষ্টার মৃত্যুর মানে কিন্তু দাড়ায় নৈতিকতারও মৃত্যু। মানুষের মধ্যে চলমান নৈতিকতার ধারণা, স্রষ্টার অপ্রয়োজনীয়তাবোধ তৈরী হবার সাথে সাথেই মিলিয়ে যেতে শুরু করবে। 

এটা আসলে নীৎশে’র এক প্রস্তাবনা। নীৎশে বাস্তব জীবনে যেহেতু নৈতিকতার ধার ধারতেন না, সেহেতু এটা বলা যায় যে, নীৎশে চেয়েছেন মানুষকে নৈতিকতা, মানবিকতা বিষয়ে নতুন করে ভাবাতে। এসবকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে। ‘ঈশ্বর মৃত’ এ কথা না বলে নীৎশের পক্ষে এ প্রস্তাবনা দেয়া সম্ভবপর ছিল না। কেননা অবিশ্বাসী নীৎশে বিশ্বাস করতেন, সকল নৈতিকতার উদ্ভব স্রষ্টা হতে। তার মতে, স্রষ্টার ধারণাই নৈতিকতার ভিত্তি। এই ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। 

স্রষ্টা আছে কী নেই, এই তর্কে নীৎশে না গেলেও তিনি ম্যাডম্যান রচনার মাধ্যমে আমাদের সেই তর্কেই টেনে নেন আসলে। এই রচনাতে তিনি বলতে চান, স্রষ্টা থাকুক বা না থাকুক, স্রষ্টার ধারণা বর্তমান। এবং তিনি ভাবতেন আধুনিক যুগ সেই ধারণা বাতিল করে। তার যুগের তুলনায় আমাদের কাছে বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত বেশি রয়েছে। এই তুলনায় নীৎশের যুগকে রীতিমত অন্ধকার যুগই বলা চলে। আমাদের সময়ে অনেক নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীও বলছেন আমরা এই মহাবিশ্বের মাত্র ৪-৫% জানতে পেরেছি। ফলে, স্রষ্টার ধারণাকে যৌক্তিকভাবে আমরা বাতিল করতে পারি না। 

তো এই ভয়ানক কম জ্ঞান নিয়ে কী করে সিদ্ধান্তে চলে আসা যায়- স্রষ্টা বলতে কিছু নেই? স্রষ্টা কোনো সত্তা নয় বরং মানুষের ধারণার সমন্বয় মাত্র? আধুনিক যুগের সাথে সাথে স্রষ্টার ধারণার সমাপ্তি ঘটে গেছে? ‘আধুনিক সময়ের যৌক্তিকতা স্রষ্টার ইমেজকে অযৌক্তিক বিধায় খারিজ করে দেয়’’? স্রষ্টা মৃত? ‘আমরা আসলে নিজেরাই স্রষ্টা হয়ে উঠছি, হয়ত আমাদের ভবিষ্যৎ হবে আরও সম্ভাবনাময়’? অথবা কী করে আমরা আশা করি, বিজ্ঞান হয়ে উঠবে স্রষ্টার বিকল্প? স্রষ্টায় বিশ্বাসের মতো মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিলীন হয়ে যাবে?

বিশ্বাসের যৌক্তিকতার লেখক ড. রাফান আহমেদের মতে- 

“স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস সহজাত ও মৌলিক। এর বিপক্ষে আপনি যদি কোন বস্তুগত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন, তখন আমরা আলোচ্য মৌলিক বিশ্বাসের ধারণা পুনঃবিবেচনা করতে পারি। কিন্তু ব্যাপার হলো, স্রষ্টায় বিশ্বাস অধিবিদ্যার বিষয়, যা বস্তুগত সীমার বাইরে (বস্তুজগত থেকে আলাদা)। আর অন্যদিকে বিজ্ঞান বস্তুজগতের পর্যব্ষেণেই সীমাবদ্ধ, এখানেই আমাদের সমস্যা; এ কারণেই বিজ্ঞান কখনোই প্রত্যক্ষভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ত্ব প্রমাণ বা বাতিল করতে পারে না। স্রষ্টার অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন বিজ্ঞানের আওতার বাইরে।”

এ বিষয়টা একদম সহজে বুঝতে ধরা যাক-  ভিডিও গেইমের চরিত্ররা যদি কোনো এক উপায়ে, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে গেইমের কোনো প্রোগ্রামার থাকতে পারে বলে স্বীকার না করে, তাতে কী কিছু বদলায়?  

আসলে স্রষ্টার ধারণা বিলীন হবার প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্ত তখনই কেউ দেয় যখন সে Confirmation bias নামক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। ‘কনফার্মেশন বায়াস’ নামক বৈশিষ্ট্যটি মানুষের  ভেতরে একরৈখিক চিন্তাধারার জন্ম দেয় বা লালন করতে শেখায়। যখন কেউ একজন কোনো দর্শন বা মত বা জ্ঞানে পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করে তখন তার মধ্যে একটা প্রবণতা থাকে তার পছন্দনীয় মতের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপনের বা নিদেনপক্ষে একপাক্ষীক বক্তব্য তৈরীর। এটা মানুষ অবচেতনেই করে। এমনকি মানুষ নিজের পক্ষে বক্তব্য তৈরী করতে গিয়ে বাতিল করে দেয় বিপরীত গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো। নিজ মত বা দর্শনকেই কেবল গুরুত্বের সাথে প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবং এমন প্রস্তাবনা সামনে রাখে যা, তার মতামতকেই কেবল সমর্থন করে। 

‘দ্য ম্যাডম্যান’ রচনাকে নীৎশের প্রস্তাবনা বলছি আমি একারণে যে, নীৎশে নৈতিকতা বিষয়ে, উন্নত মানব (সুপারম্যান) বিষয়ে, বীরত্ব-বিজয়ীদের প্রশংসাসূচক যেসকল রচনা লিখেছেন তা এই ‘দ্য ম্যাডম্যান’ এর পরে রচিত। যেমন- ‘Thus Spoke Zarathustra’, ‘Genealogy of Morality’, ‘তার Will to Power’ ইত্যাদি।

যেমন তিনি ‘Genealogy of Morality’ বইয়ে বলেছেন, গ্রীক দাসদের অভিজাতদের প্রতি ঈর্ষাই জন্ম দিয়েছে মানবিকতা। অতীতের বীরদের গুণমুগ্ধ নীৎশে যুদ্ধে বীরত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন মানবিকতা, দয়াশীলতা ইত্যাদির ওপরে। তার মতে বীরদের গুণাবলিই ইতিবাচক। ক্রীতদাস ও দুর্বলদের গুণ নেতিবাচক। তারা (দুর্বলরা) অভিজাতশ্রেণীর বীরত্ববোধকে বা বীরত্বের গুণাবলী অর্জন করতে ব্যর্থ হয়ে একে নেতিবাচকতায় পাল্টে দিয়েছে। তার এই ধারণাকে পুরো করতে ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’ ঘোষণা ছাড়া গতি কী? আর আমার মতে তার ‘দ্য ম্যাডম্যান’ রচনায় উন্মাদ লোকটি নীৎশে নিজে। যে নিজে এই ঘোষণা দিয়ে আবার বলছে- সময়ের অনেক আগেই সে এই ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। এখনো মানুষ প্রস্তুত নয়। 

তবে মানুষ প্রস্তুত থাকুক বা না-ই  থাক নীৎশে তার দর্শন রচনার মাধ্যমে চেয়েছেন নৈতিকতা মানবিকতার সংজ্ঞা পাল্টে দিতে। তার ‘দ্য ম্যাডম্যান’ -কে এই প্রচেষ্টার প্রবল এক প্রস্তাবনা বলেই মনে করি আমি। সরাসরি নয় অবশ্যই। প্যারাবল হিসেবে। 

তিনি কী সফল হয়েছেন? না। দার্শনিক হিসেবে তার ব্যর্থতা- তিনি ঈশ্বর মৃত বলে নৈতিকতা-মানবিকতাকে বাতিল করে আস্থা রাখতে চেয়েছেন বিজ্ঞানে, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ভুলে । আদর্শ জীবন আঁকতে চেয়েছেন দর্শনে আদর্শ (নৈতিকতা) বাদ দিয়ে । কিন্তু তিনি আদর্শ জীবনের মডেল আমাদের দেখাতে পারেন নি। যা পেরেছেন তা হলো- কিছু চমকপ্রদ উক্তি উপহার দিয়েছেন। এর বেশি কিছু নয়।
  ----আখতার মাহমুদ


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই