চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আরবে উঠিল রবির কর



আরবে উঠিল রবির কর

আব্দুল্লাহিল বাকি

সমগ্র এশিয়ার সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরষ্কারবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের বিমল প্রভা, অশেষ আবেগ ও নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের বিপুলা ঐশ্বর্য আরবি ভাষায়ও বিকিরণ ছড়িয়েছিল। আধুনিক আরব মানস তাকে অস্বীকার করেনি। তার মাঝে হয়তোবা তাদের পূর্বসূরী মরমী কবিদের অনুরণন শুনতে পেয়েছিল। এজন্যই বিমুগ্ধতার সাথেই তাকে গ্রহণ করেছিল।

'দ্য প্রফেট' গ্রন্থের লেখক জিবরান তার বান্ধবী মেরি হাসকেলকে এক চিঠিতে 'ট্যাগোরে'র সাহিত্য পড়ার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "ট্যাগোরের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে এবং আমি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি।"

জিবরানের সাহিত্যে যে অন্তর্মুখী আত্মস্বর শোনা যায়, তাতে অন্যান্য ইউরোপীয় রোমান্টিক কবিদের পাশাপাশি ট্যাগোরেরও ঋণ থাকলে, অবাক হবার কিছু নেই।

মুস্তফা সাদিক রাফেয়ী ( হুজ্জাতুল আদাবিল আরাবি ) তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ 'ওহিয়ুল কলাম' এ একটা স্বতন্ত্র প্রবন্ধই লিখেছেন ট্যগোরকে নিয়ে, "শাইতানী ওয়া শাইতানু তাগুর।" আরবিতে কখনো কখনো শাইতান বলে আত্মা বা কাব্যধর্মী মানসকে বোঝানো হয়। কারণ অনেকেই মনে করত, কবিতা শয়তানের পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়। এই প্রবন্ধে এই অর্থেই শয়তান শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। এখানে রাফেয়ী তার সাথে ট্যাগোরের সাহিত্যগত বিচ্ছিন্নতা সুস্পষ্ট করলেও, রাফিয়ী তার দ্বারা প্রভাবিতও ছিলেন। এটার প্রমাণ হল তার সাহিত্য। তিনি 'রাসাইলুল আহযান ফী ফালসাফাতিল হুব্বি ওয়াল জামাল' গ্রন্থে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে বেরুতে পারেননি।

আহমদ আমিনের বুদ্ধিজীবির কাছে যদি যাই,  গবেষণায় যার ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা, চিন্তামূলক কাজে যিনি এগিয়ে ছিলেন, তিনিও ট্যাগোরকে তুলে আনতে ভুলেন নি। 'আস-সাকাফা' ম্যাগাজিনে, যে মাসে রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন, উনিশশো একচল্লিশ সালের অক্টোবর মাসে, আহমদ আমিন একটা প্রবন্ধ লিখেন ট্যগোরকে নিয়ে। শিরোনাম 'আয-যুআমাউস সালাসাহ'।

এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তার একটি বাক্য তুলে দিচ্ছি -
" فأما "تاغور" فرجل روحاني، هو خلاصة أفكار الهند، و عصارة نزعاتها الروحية و الحلولية، عبر عنها بأساليب العصر الحديث و لغته و روحه،

অর্থ: 'আর ঠাকুর হলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। হিন্দুস্তানের চিন্তাধারার নির্যাস তিনি। তিনি ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবধারা ও অবতারবাদের সারাৎসার। এটাকেই তিনি আধুনিক কালের ভাষা, পরিভাষা ও মর্মে প্রকাশ করেছেন।'

তাছাড়া আরবী সাহিত্যের ঋষি বলে খ্যাত আব্বাস মাহমুদ আক্কাদও 'মুকতাতাফ' ম্যাগাজিনে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, 
كتاب ساد هنا للحكيم الهندي طاغور

(ভারতীয় দার্শনিক ঠাকুরের যে বইটি এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে)

তাহা হুসাইন আরো একধাপ এগিয়ে। তিনি যখন মিসর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন তখন সেখানে রবীন্দ্রনাথের জন্য একটা সংবর্ধনাসভার আয়োজন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আরবে পৌঁছতে খানিকটা দেরি হয়েছিল। যখন থেকে তিনি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই তিনি আরবে প্রবেশ করতে পারেননি। বিখ্যাত ফরাসি উপন্যাসিক আদ্রেঁ জিদ যখন ভারতের দুজন কবিকে অনুবাদ শুরু করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ আর কবিরের কবিতা, ঠিক তখনই আরবি ভাষায় তার সাহিত্য প্রবেশ করে। ফরাসিতে তিনিই সম্ভবত প্রথম, ঠাকুরের কবিতা অনুবাদ করা শুরু করেছিলেন। এই ফরাসি থেকেই আরবী ভাষায় সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ অনূদিত হন। ইংরেজি থেকে নয়। এর একটা পলিটিক্যল সাইডও আছে। আরবি সাহিত্যের রাজধানী তখন মিসর। আর মিসরে তখন চলছিল ফরাসিদের কলোনিয়াল রাজনীতি, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের হাতে যার সূচনা। এজন্যই মিসরে তখন মাতৃভাষা আরবির পরই ফরাসির গুরুত্ব ছিল অধিক। ইংরেজি এর পরের স্থানে। পরবর্তীকালে অবশ্য পরিস্থিতির পট পরিবর্তিত হয়। ইংরেজি সাহিত্য হতে ব্যাপকভাবে অনূদিত হয় ঠাকুরের গ্রন্থাবলি। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদিসহ তার প্রায় আটচল্লিশটার মত বই আরবিতে অনূদিত হয়। কিছু নাম উল্লেখ করলে বোধ হয় মন্দ হয় না।

কবিতা :- কল্পনা (الخيال) প্রকাশ: ১৯০০, খেয়া ( زورق المعبر) প্রকাশ: ১৯১০, গীতাঞ্জলি ( قربان الغناء) প্রকাশ: ১৯১০, সোনার তরী ( السفينة الذهبية ) প্রকাশ: ১৮৯৪, মানুষী ( المحبوبة المخيلة) প্রকাশ: ১৮৯০, স্ফুলিঙ্গ ( شرارة) প্রকাশ: ১৯০৩,

উপন্যাস ও গল্প:- গোরা ( غورا) প্রকাশ: ১৯১০, চোখের বালি ( رمداء العين) প্রকাশ: ১৯০৩ , ঘরে বাইরে ( في البيت و في الخارج) প্রকাশ: ১৯১৬ , নৌকাডুবি ( غرق السفينة) প্রকাশ :১৯০৬ ,শেষের কবিতা ( القصيدة الأخيرة) প্রকাশ : ১৯২৯,

নাটক: ডাকঘর ( مكتب البريد)প্রকাশ: ১৯১২, রাজা ও রাণী ( الملك و الملكة) প্রকাশ: ১৮৮৯, ফাল্গুনী ( الربيع) ১৯১৬, বিসর্জন ( الضحية) ১৮৯০,রক্তকরবী (الزنابق الحمر) ১৯২৬,

প্রবন্ধগ্রন্থ:- আত্মপরিচয় (تعارف شخصي) ১৯৪৩, আধুনিক সাহিত্য (الأدب الحديث) ১৯০৭,প্রাচীন সাহিত্য (الأدب القديم) ১৯০৭, জীবনস্মৃতি (ذكريات الحياة) ১৯১২, সভ্যতার সঙ্কট (أزمة الحضارة) ১৯৪১, সাহিত্যের স্বরূপ (شذا الأدب) ১৯৪৩,

এসব লিখছি দুবছর আগে এক আরব যুবক বাংলাদেশে এসেছিলেন। কথায় কথায় আমাকে তিনি বললেন, তোমরা ট্যাগোরকে পড়ো? আমি বললাম, তাকে অনেকেই পড়ে । কিন্তু আমি বেশি পড়তে পারিনি। তিনি খানিকটা মনক্ষুণ্ন হয়ে বলেছিলেন, ঘরের জিনিস তো এজন্য মূল্যবান হলেও  গুরুত্ব নেই। তাই না!

কথাটা আমার মনে যে তোলপাড় তুলেছিল, তার ভূমিকাস্বরূপ এই লিখন।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই