একটা অতিবাস্তব প্রবন্ধ এবং খুনের গল্প
সালমান সাদ
এ উপত্যকার কারো মৃত্যু নেই। বরং মৃত্যুবরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়াই এনাদের কাছে জীবনধারণের উপকরণ।
ব্যাপারটি জটিল? খুব নিখুঁতভাবে আপনাদের কল্পনাপটে গেঁথে দেয়ার জন্যই আমার আলোচ্য প্রবন্ধটির অবতারণা।
পিপাসা পেলে তারা ঢুকে পড়ে, আগুনে। টপ পটাপট শব্দে বয়ে যাচ্ছে আগুনের তপ্ত ধারাস্রোত। বা পাহাড়চূড়া থেকে ঝরণার মতো নীরবে নেমে আসছে জ্বলজ্বলন্ত লাভা।
হাতের তালুতে থুতনি ঠেকিয়ে এনারা বসে থাকে লাল অঙ্গারে, পিপাসা দূর করে।
এদের বিয়ের উৎসবগুলো দারুণ। দিনে না, রাতেও না। এদের কোন দিনরাত নেই। এরা হলো এরা। এদের আছে শুধু জোৎস্না ও অমাবস্যা। অমাবস্যা তিথি এদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত। পূর্ণিমা এদের ভয়ের রাত। এদের কবিরা অমাবস্যার রূপ নিয়ে লিখে কবিতা, অন্ধকার অমাবস্যার কালি পান করতে এরা বের হয়ে পড়ে ঘর থেকে।
চাঁদ এদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা। চাঁদের আলো এদের শরীরে, মনে, সহ্য হয়না। পূর্ণিমা এদের কাছে ভীষণ অশুভ। অমাবস্যায় তাদের বিয়ের নিমন্ত্রণ।
ভেবে ফেলেছেন এরা আগুনে তৈরী জ্বীনসম্প্রদায়? এরা কয়লা খাবে, মানুষের উচ্ছিষ্ট হাড্ডি চাবানো হাড় নিয়ে উৎসবে মাতবে? ভুল। সবই ভুল।
বলেইছি; মৃত্যুর উপকরণই সকল এদের কাছে জীবিকার প্রক্রিয়া।
তারা আসে, দাওয়াতে। ঝুলে পড়ে, গাছে।
বিয়ের আগের রাতেই বহু রঙে আঁকানো, নানান আকৃতিতে কাটানো হয় সেসব গাছের ডাল, আপ্যায়নের জন্য।
যেমন একটা আইটেম হলো, সবুজ সবুজ লতায় তারা জিভে-জল এক গোলাকার গলার ফাঁস বানায়। ফাঁসের মধ্যে থাকে পাঁচটি ফুল। মালার মতো সম্মানে গলায় পেঁচিয়ে তারা ঝুলতে থাকে গাছের ডালে, পা গুলো দুলতে থাকে ছফুট উপরে। এই তাদের বিবাহপরবর্তী উৎসব। যারা যত অভিনব অসহ্য যন্ত্রণার আয়োজন করতে পারে, দশ গায়ে তাদের সুনাম।
এই প্রবন্ধে উল্লেখিত ও উল্লেখ্য এদের সকল গাছ, পাখি, ফুল, রঙ,গন্ধ, আকৃতি ; তথা কোনকিছুই আমাদের চেনাপরিচিত এ জগতের গাছ পাখি ফুল নদী রঙ গন্ধ আকৃতির তথা কোনকিছুর মতো নয়। অন্যরকম থিং, অন্যরকম কিছু। সেটা আপনার কল্পনাশক্তির ইচ্ছায়, যার যেমন এখতিয়ারে, স্বাধীনতা রইলো, আপনি নির্মাণ করতে থাকুন !
এখানে স্বামী - স্ত্রীরা ভালোবাসা করার প্রক্রিয়াও শুনুন।
এখানে চুমু করা মানে চরম একটা গালিপ্রদান। ভালোবাসি শব্দের অর্থ তিন তালাক।
কেউ কারো উদোম পিঠে পাথরের ধারালো চাকু ঘ্যাঁচ করে সেঁধিয়ে দিয়ে , প্রবল বেগে ছোটা লালে মুখ ডুবিয়ে গাল ভরিয়ে রক্ত পান করার নামই সঙ্গম। আর নিহতের আর্তচিৎকারই এখানের শুদ্ধতম সঙ্গীত।
এখানে ঘুমানোর নিয়মও অন্য। যদিও প্রতি এক মিনিট অন্তর অন্তর এরা ঘুমায়। যদিও ঘুম বলে এঁদের কিছুই নেই। কিন্তু আমাদের ভাষায় সেই ক্রিয়াটিকে প্রকাশ করার জন্য ঘুম ছাড়া অন্য যথাযোগ্য শব্দও নেই।
এঁদের সবার পকেটেই সাড়াশির মতো দেখতে বিঘৎ খানেক লম্ব এক লৌহধাতব থাকে।
ঘুমাতে হলেই এরা সেই মাথা বাঁকানো সাড়াশিটার বক্র ফলা বাম নাকের ফুটোর মধ্যে বিদ্যুৎগতিতে ধাক্কা মারে, নাকের নরোম গোশত, পেলব হাড্ডি বিদীর্ণ করে সেই তীক্ষ্ণ ফলা চোখ, কপাল, মাথার সামনের ভাগ ভেদ করে নেমে যায় মস্তিষ্কে। এক চিমটি মগজ আটকায় সাড়াশিটার বাঁকানো মাথায়। তারপর আরেক টানে সাড়াশিটা তারা বের করে আনে। আবার ঢোকায়। আবার বের করে। এভাবে সাতবার আঘাত করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সমস্ত মগজটুকু বের করে আনলেই তাদের ঘুম। সেই ঘুম বড়জোর এক বারো নয় সেকেন্ড।
আমাদের কেউ যদি একবার গিয়ে সেই উপত্যকায় পড়ে, তাহলে দেখবে, উপত্যকার সবাই প্রতিমুহূর্তেই মগজ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনার কাজটি অনবরত করছেই - পেট ভরে পোলাও মাংসের মেজবানি খাবার পর পুকুরের ঘাটায় বসে ঘটক সাহেবের পরম আরামে মিষ্টির মতো মিহি একটা যন্ত্রণায় দাঁত খুঁচিয়ে লাল লাল মাংসকণা টেনে খেলাল করার ভঙ্গিতে।
আমাদের কেউ সেই এদের উপত্যকায় নেমে প্রথম দেখামাত্র কারু সাথে সৌজন্যতার করমর্দন করতে গেলেই সে আঁতকে উঠে বলবে, সে কী, আমাকে তুমি বটিতে কাটছো কেন ?
এই উপত্যকাতেও জন্ম আছে। জন্ম থাকেই। পৃথিবীর মধ্যেই সে উপত্যকা।
কেউ কেউ ধারণা করে, এদের জন্মদান প্রক্রিয়া আমাদেরই মত। কেউ কেউ বলে শয়তানের মতো।
আচ্ছা, শয়তান কীভাবে জন্ম দেয়?
শয়তানের ডান হাতের কনুই ভাজ করলে তা একটা স্ত্রীলিঙ্গের আকার নেয়। আর বাম হাত ভাঁজ করলে তা একটা পুলিঙ্গের মতো উত্থিত হয়। সে দুটির- ডানহাত বামহাতের মিলন হলেই তার মাঝখানে, একটি সন্তান বা শয়তান সৃষ্টি হয়। শুন্য থেকে।
কিন্তু এঁদের যাদের কথা বলছি, তাদের জন্মদান প্রক্রিয়া এতটা হাবিজাবি নয়। কিছুটা হস্তমৈথুনের মতোই, এদের কাজ। আসল কাজটা তারও পরে হাতের মধ্যে লেপ্টে থাকা বীর্যের প্রতিটি দানায় এঁদের একটি করে সন্তান ।
নয়বছর গর্ভধারণ। নয় বছর হাতের আঙুলের ফাঁকেফাঁকে, তালুর মধ্যে, চামড়ার নীচে বীর্য জমতে থাকে। আর ফুলতে থাকে। সন্তানদের দেহ তৈরি হতে থাকে।
নয়বছরে কত হাজার হাজার দানা জমে যায়? তারপর এদের আসে সেই নির্দিষ্ট দিন।
সন্তান হলে আমরা খুশি হই। কিন্তু এরা যে কী হয় সেই অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো শব্দভাণ্ডার আমাদের নেই।
এক বহু প্রতীক্ষিত অমাবস্যায়, নয়বছর পরপর, একটা নির্দিষ্ট গাছে একরকমের ফল আসে। একগাছে একটাই ফল। বিশাল সেই গাছে বিশালাক্ষী সেই ফল। এক গ্রামে একটাই হয় সেই গাছ।
বিরাট ফলটা ঝুলতে থাকে সে অমাবস্যায়। একধরণের উত্তাপ ছড়ায়। সতেজ গরোম কিন্ত প্রফুল্ল নরোম একটা বায়ু বের হতে থাকে তার থেকে। লোকের ভীড় জমে যায় গাছের শেকড়ের চারপাশে। সবাই সারিবদ্ধভাবে, এক এক করে হাত নেয় সেই ফলটার কাছে, উষ্ণ বাতাসে। আর তাদের ফোলা গর্ভবান হাত থেকে পটাপট, পপকর্ণের ফুটে বের হওয়ার মতো করে বেরিয়ে পড়তে থাকে সন্তান । মাটিতে পড়তে পড়তেই তারা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো হয়ে যায়। তারপর যার যেদিক ইচ্ছা।
এই উপত্যকাতেও বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিও তো জীবনের প্রত্যক্ষ উপকরণ, এবং হৃদয়গতও।
আকাশ ফুরায়ে যায়- এত বড় এক ফণাধর সাপ বা হয়তো সাপ নয়, সাপের মতো কিছু একটা - নিঃসরিত করতে থাকে তার লালা, নীলকণ্ঠ বিষ। অঝোর ধারায় বড় বড় ফোটায় নিঃশব্দে, ছন্দহীন লয়-তাল-সুরহীন সে বিষের বৃষ্টি, কালচে একপ্রকার পানি ঝরতে থাকে উপত্যকায়। একমুঠো সাইজের শামুকের খোলসে তারা ধরে জমিয়ে রাখে সেই বৃষ্টি। জোৎস্নার অশুভ রাতে তারা সে পচা বিষহাতে বের হয়। চাঁদের দিকে মুখ করে আকণ্ঠমগ্ন পান করতে থাকে বিষ। তাদের মুখ, কণ্ঠ, নীল হতে থাকে। সমস্ত শরীর ক্রমশ হতে থাকে বিষক্রিয়ায় নীলাভ। তারপর এক ধরণের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে তাদের বিষনীল দেহ থেকে।
যেদিকে চোখ যায়, সবার অনাবৃত গা থেকে বিকোচ্ছে বিষাক্ত আলো, তাদের ঘর থেকে, উঠোনের গাছ থেকে, পরানের কাঁথ থেকে। তখন এদের সবাইকে নারীদের মতো দেখাতে থাকে।
বৃষ্টি তাদের এভাবে অনাবিল করে যায়।
এদের কবিরা কবিতা লিখে- শব্দের ভেতর কেবলই বুনো মহিষের আর্তনাদ, কেবলই শিকারি বিড়াল, মধ্যরাতে ইঁদুরের ছেঁড়ামাথা মুখের চাপা গর্জন।
গরুজবাইয়ের পর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটা বন্ধ হবার পর গড়গড় যে এক করুণ আত্মাশুকানো আওয়াজ, এমনই তাদের শব্দমালার উচ্চারণ। ময়ুরের পায়ের মতো কুৎসিত এদের কবিতার বর্ণ। এগুলোই এই উপত্যকার শ্রেষ্ঠ কবিতা।
অদ্ভুত আর গাঁজাখুরি নয় মোটেও, অতিবাস্তব একটি গল্প আপনারা পড়লেন।
অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কারণ জীবনধারণের ওরকম পদ্ধতির সঙ্গে আপনাদের সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত চিন্তাভাবনার ছক এবং কল্পনার গন্ডির ভেতরের উপাদানগুলো কখনওই পরিচিত নয়।
পক্ষান্তরে আমাদের জীবনের যে যাপনপদ্ধতি, ভেবে দেখুন না কেন, এদের চোখে সেটাও কিন্তু সমান অদ্ভুত ও গাঁজাখুরি।
এখন তবে এরা পৃথিবীগ্রহের কোথায় বাস করে তা খুঁজতে বেরিয়ে পড়বেন ভাবছেন? ভার্নিয়ানরা যেমন জুল ভার্নের রচনা করে যাওয়া অদ্ভুত দ্বীপ আর চরিত্রদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আজো, পৃথিবীর কোণায় কোণায়, বহুবছর ধরে!
তা হবেনা কারণ -
আমি একটা খুন করেছি। না অনেকগুলো।
এই মহাজগতের কেউ যদি কখনো কোথাও এঁদের কথা জেনে লিখে ফ্যালে, সেটা যেখানেই হোক, পাতায় হোক, শুকনা ঘাসে হোক, পাথরে কেটে হোক, গুহার দেয়ালে হোক, এমনকি প্রবহমান পানিতে বিলীয়মান আঁচড়ে হোক, সঙ্গে সঙ্গে তারা মরে যাবে। লেখার মধ্যে যতগুলো শব্দ থাকবে, ততগুলো আণবিক বোমা তাদের বিস্ফোরিত করে যাবে।
মৃত্যুবরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়াই যাদের কাছে জীবনের উপকরণ, তাদের মৃত্যুর প্রক্রিয়াও তো অন্যরকমই হবে?
সুতরাং এটি একটি নৃশংস গণহত্যারও গল্প বটে।
লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন