চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

সমাধিফলক




লেখক সম্পর্কেঃ 
শাহনাজ বশিরের জন্ম ও বেড়ে উঠা কাশ্মীরের শ্রীনগরে। পড়াশোনা করেছেন কাশ্মীর ইউনিভার্সিটিতে। জার্নালিজম সাবজেক্টে গোল্ডমেডেল লাভ করেছেন। ভারতের দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের প্রতিরোধমূলক সাহিত্যে প্রবেশ করেন ছাত্র বয়স থেকেই। বয়সে তরুণ এবং অসাধারণ প্রতিভাবান এই লেখক একই সাথে লিখে চলেছেন, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, একাডেমিক গবেষণামূলক পেপার, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় কাশ্মীর বিষয়ক কলাম। তার প্রথম উপন্যাস "দ্যা হাফ মাদার" বেশ জনপ্রিয়। ইতিমধ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি দেশি বিদেশী পুরস্কার লাভ করেছেন। কাশ্মীর লাইফ নামক একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন তাকে সেই নয়জন ব্যাক্তিত্বের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যারা জম্মু-কাশ্মীরের বারো মিলিয়ন মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। বর্তমানে তিনি কাশ্মীর ইউনিভার্সিটিতে "ন্যারেটিভ জার্নালিজম" বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তার তৃতীয় বইয়ের কাজ করছেন। বর্তমান গল্পটি তার দ্বিতীয় বই "the scattered souls" থেকে নেয়া হয়েছে।

সমাধিফলক

মূলঃ শাহনাজ বশির
অনুবাদঃ হুজাইফা মাহমুদ


কুয়াশার আবরণ সরে যাওয়া মাত্রই সে পথে নেমে আসবে। জোর পায়ে হেঁটে সোজা চলে যাবে গোরস্থানের দিকে। এপ্রিলের হঠাৎ বৃষ্টির পর আজকের সন্ধ্যাটা বেশ ঠান্ডা হবে বলে মনে হচ্ছে। এবং সে নিশ্চিত নেশাখোর আর জুয়াড়িদের আড্ডাটাও থাকবেনা আজ, নির্জন গোরস্থান যাদের জন্য নেশা আর জুয়া খেলার জন্য উত্তম জায়গা।

এই কাজটা রাতে করতে তার ভয় হয়। ঘরের লোকজন সজাগ থাকা অবস্থায়ত আর সিঁদ কাটা  যায় না। এজন্য সে সাধারণত সন্ধ্যায় গ্রামের দোকান থেকে শস্তা পানামা সিগারেট কিনতে যায় যখন, তখনই কেবল এই কাজটা করতে পারে।

ফিল্টারবিহীন একটা সিগারেট ধরিয়ে কাঁচা পাকা বাড়িটার বাইরে ছোট্ট সরু ও এবড়োখেবড়ো সিমেন্টের পথটার পাশে এসে দাঁড়ায়। দেয়ালের পাশে বাতিল ও পুরনো রঙের ডিব্বা আর ছোটছোট খালি ফেভিকলের বালতিতে ফনিমনসা ও মৃত গেরানিয়াম ফুলের গাছ লাগানো আছে। 

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আবার বাড়িতে ঢুকে পড়ে।
ক্যাঁচক্যাঁচে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে উপরতলায়। তারপর ধুলোয় ধূসরিত মাকড়সার জাল বিছানো যন্ত্রপাতির বাক্সটার  দিকে এগিয়ে গেলো। রুমের কোনার অংশটায় টিনের চাল ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন ব্যাপার,সেখানে টিনের নিচে রাখা আছে বাক্সটা। তার কারিগরি হাতের আঙুলে কড়া পড়ে আছে। আঙুলের ডগায় তৈরী হয়েছে ফাটল,চামড়া রুক্ষ ও কর্কশ। নখগুলো একটাও জায়গামতো নেই।  বাক্সটার ভেতর সেই পরিশ্রমী হাত দিয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে একটি যন্ত্রের খোঁজে। সিঁড়ি বেয়ে উঠার পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে তখনো।

এর কিছুক্ষণ পরই সে নিজেকে আবিস্কার করলো গোরস্থানের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ানো অবস্থায়।  বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে। সন্ধ্যার বিবর্ণ ম্লান আলো গলে গলে পড়ছে পিচঢালা রাস্তায়। কাদা আর পানিভর্তি গর্ত মিলে রাস্তাটাকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে। গাছের পাতা আর বাড়ির ছাদ থেকে এখনো টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। কুয়াশা ভাবটা একদম কেটে গেছে। তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়াগুলোকে এখন খুব কাছে মনে হচ্ছে,যদিও সেগুলো এতোটা কাছে না। গ্রামের ভেতর থেকে উঠে আসা এক দমকা হাওয়া এসে চারপাশ দুলিয়ে গেলো। ফুল আর আপেলের বাগান, শরিষার চারা, ঘাস, সকলে একযোগে সাড়া দিলো দমকা হাওয়ার তালে। ছড়ানো ছিটানো পলিথিন ব্যাগ আর বেলুন উড়ে গেলো শূণ্যে। 

দৌঁড়ের সাথে সাথে তার ধূসর মুখের প্রতিটা  ভাঁজ আর বলিরেখা টানটান হয়ে হয়ে আসছে। ছাইবর্ণের চুলগুলো সটান দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় খানা-খন্দ থাকার কারণে তাকে খুব সাবধানী হয়ে তার প্লাস্টিক মোড়ানো পা দুটো ফেলতে হচ্ছে। বাম হাতটা প্রায় অবশ, অচল। খুব বাজেভাবে কাঁপছে সেটা। পরনে থাকা পিরানের একপাশ আঁকড়ে ধরলো হাতটাকে স্থীর রাখার জন্য। 

পুরনো, জরাজীর্ণ পিরান থেকে বৃষ্টি আর বাসী ধোঁয়ার গন্ধ আসছে। সে আরও দ্রুত পায়ে ছুটছে। পিরানের ভেতর থেকে ফাঁপানো ধাতব আওয়াজ আসছে। দৌড়ানোর কারণে জং ধরা হাতুড়ি আর ভোঁতা বাটালিটার ঠুকাঠুকি লাগছে। তার নাকের ফুটো থকে ধুমায়িত বাষ্পের ধারা বের হচ্ছে। মাঝে মাঝে হুশ হাশ করে তার পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে একটা বাস কিংবা স্কুটার। 

আজ আবারও তাকে স্বাগাত জানালো সেই রুক্ষ ও কর্কশ বিছুটি আর কাঁটাগাছের ঝোঁপ। পুরো গোরস্থান জুড়েই জন্মেছে এসব বিরক্তিকর আগাছা। আরেকটু দূরে,কবরগুলোর কাছে ফুটে আছে হরেকরকমের আইরিস ঘাস। ঘাসফুলের সাদা পাপড়ি আর ধুলোরাঙা পরাগ একসাথে মিশে আছে যেন। সরু একটা পথ ধরে সে এগিয়ে গেলো কবরটার দিকে। যার এপিটাফে উর্দু হরফে লেখা আছে :-  শহীদ মুশতাক আহমেদ নাযার।

******

এর আগে মোহাম্মদ সুলতান ছিল খুবই প্রতিভাবান ও সুদক্ষ একজন কাঠমিস্ত্রী। একদা কাজের সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে তার বাম হাত চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। তার হাতের আঘাতটা কোনরকম সুস্থ হওয়া শুরু করলো যখন, তখনই সে আবার কাজে ফিরে যায়, ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই। ফলে, হাড়ের ভেতরে কোমল টিস্যুতে লাগা আঘাত ক্রমেই খারাপ হতে হতে একসময় সেটা হাইমাটমায় পরিণত হলো। একটি ব্যর্থ অপারেশনের পর তার হাতকে সুতারের কাজ কিংবা যেকোন হাতের কাজের জন্য অনুপযোগী বলে ঘোষণা দিলেন ডাক্তার। সুলতান ছিলো খতমবন্দ বা কাঠের ঝাঁঝরি তৈরীর উস্তাদ লোক। কাঠ কাটার আগে গাছের ঘ্রাণ শুঁকেই বলে দিতে পারতো কাঠের মান কেমন হবে। 

প্রাচীন ও আধুনিক স্টাইলের মিশেলে ফার্নিচার তৈরীতে বিশেষ দক্ষতা ছিলো। এমনসব স্টাইল আবিষ্কার করতো যা কাশ্মীরের জোয়ান বুড়ো সকলেরই পছন্দ হতো। আশপাশের কোন গ্রামে তার কাজের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো দ্বিতীয় কেউ ছিলো না। দরজা জানালাই বানাতো বেশিরভাগ, একজন সুতার যেটা করে সাধারণত। কাজের সময় একটু পরপর হুঁকো টানতো,আর  প্রতিবার হুঁকোয় টান দিয়ে যেন ফিরে আসতো নতুন কোন আইডিয়া নিয়ে। 

সুতারের কাজ স্রেফ তার জীবিকা নির্বাহের উৎস ছিলো না, বরং এর শৈল্পিক রূপটাও তাকে প্রবলভাবে টানতো। এই শিল্পের মাধ্যমে মূলত সে নিজেকেই প্রকাশ করতো।  কাজ যখন শুরু করতো তখন গভীর নিষ্ঠা ও মনযোগের ভেতর ডুবে যেতো। কখনো রাত কেটে যায়,সে টেরটিও পায় না। এমনকি মাঝে মাঝে অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে শুক্রবারেও কাজ করতো,যেদিন অন্যান্য কাঠমিস্ত্রী আর রাজমিস্ত্রীরা ছুটি কাটায়। টাকা পয়সা নিয়ে মোটেও ভাবেনা, যতক্ষণ না একেবারে অপারগ হয়ে পড়ে।

সে যতটা না নিয়ম বান্ধা গতানুগতিক কাঠমিস্ত্রী, তারচে বেশি একজন ভবঘুরে ধরণের বিশৃঙ্খল শিল্পী। তার কাজের নৈপুণ্য ও শিল্পশৈলী দেখে মুগ্ধ ক্রেতারা বলে, এ লোকের হাত দুইটা সোনার চেয়েও দামী। বিস্ময়কর মেধা আর কর্মদক্ষতার কারণেই লোকজন তার সকল অনিয়ম ও বুনো অভ্যাসকে খুশি মনেই মেনে নিতো।

তথাপি সুলতানের সমস্যা ছিলো একটাই, তার দোকানে মনোযোগি ও পরিশ্রমী কোন কাজের লোক নাই। সে স্রেফ ঝোঁকের বশে কাজের ফরমাশ নিয়ে নেয়। যদিও এমনিতেই সে তার সাথে  কোন সহযোগী বা শিক্ষানবিশ কাউকে  রাখতে চায় না। একা একা কাজ করাতেই তার আনন্দ। মাঝে মাঝে কখনো দিন কয়েকের জন্য উধাও হয়ে যেতো।কেউ জানে না কোথায় যায়। পরবর্তিতে সেই অনুপস্থিত দিনগুলোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিনে-রাতে কাজ করে সেটা পোষিয়ে দিতে হতো। সুতারের কাজ ছাড়া তার আরও একটা জিনিসের প্রতি প্রবল টান ছিলো তার,সেটা হলো স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে এলাকার আশপাশে ঘুরে বেড়ানো। তাদেরকে সবরকমের সহযোগিতার জন্য সে সদা প্রস্তুত । একেবারে সিগারেট এনে দেয়া থেকে শুরু করে টাকা পয়সার যোগান দেয়া পর্যন্ত। নিজের পকেট থেকেও প্রচুর টাকা খরচ করতো তাদের পেছনে।

কিন্তু তার হাতের বর্তমান অবস্থা তাকে একদমই নিরাশ করে ফেলেছে। এই হাত নিয়ে কাজ করাটা প্রায় অসম্ভব। বাম হাতে কোন যন্ত্রপাতি ধরতেই পারে না। তথাপি কিছুদিন পর্যন্ত সে কাজ নেয়া শুরু করলো এই চুক্তিতে যে, সে কাজ করাবে অন্য মিস্ত্রিদের দিয়ে, আর নিজে পাশে থেকে তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দেবে। কিন্তু সেসব কাজের ডিজাইন এবং কাজের মান কোনটাই তার ক্রেতাদের মন জয় করতে পারলো না। এই কাজে মোটেও সন্তুষ্ট না তারা।  যদিও মিস্ত্রিরা তার সকল নির্দেশনাই মানতো, কিন্তু যথাযথ ভাবে বা আক্ষরিক অর্থে সেমতে কাজ করাটা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। সেইসব মিস্ত্রিরা টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা আর কমিশন নিয়ে তার সাথে ধোঁকাবাজিও করেছে। ফলে খুব দ্রুতই সে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হলো। 

অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো, যখন তার বড় মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে চার বছরে ষষ্ঠবারের মতো বিতাড়িত করে দেয়া হলো তাদের যৌতুকের দাবী পুরা না করায়। এর আগেরবার ফিরে এসেছিলো মারের চোটে ফুলে যাওয়া হাতের কব্জি নিয়ে। সাথে ছিলো তার অসুস্থ ও নাক দিয়ে শিকনি ঝড়া এক বছর বয়সি মেয়ে।

তার বাস ড্রাইভার স্বামী ঝগড়ার একপর্যায়ে মারাত্মকভাবে হাত মুচড়ে দিয়েছিলো, তারপর ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। অথচ বাপের বাড়িতে এসে সে এমন ভাব ধরলো যেন এমনিতেই কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। উপরন্ত তার অন্যান্য বোনদের কাছে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দিলখোলা প্রশংসা আর গুনগান গাইতো সারাটা দিন। তারা কতটা ভালো মানুষ আর কতটা মহৎপ্রাণের অধিকারী একেকজন, এই ছিলো তার আলোচনার প্রতিপাদ্য। তার সাথে যেন কিছুই ঘটেনি। তার ননদ, ভাসুর,দেবর সম্পর্কে এতো এতো বর্ণনা বিবরণ শুনে বোনেরা বিরক্ত হয়ে পড়ছিল।

সুলতান এমনিতেই তার বাড়িতে থাকা দুই মেয়েকে নিয়ে কুল কিনারাহীন অবস্থায় ছিলো। মেঝো মেয়েটার বয়স তিরিশ পেরিয়ে যাচ্ছে। প্রায় মূর্খ, আইবুড়ী এক মেয়ে। বাপের হাত অচল হয়ে যাওয়ার পর নিজের সেলাই দক্ষতা দিয়ে কোনরকম সংসারের সংগ্রামটা চালিয়ে নিচ্ছে। রাতে সেলাইয়ের কাজ ভালো হয়,সেজন্য জোর করে, চোখের উপর নির্যাতন চালিয়ে রাতেই কাজ করতো। নিজের উপর চাপিয়ে নেয়া অতিরিক্ত বোঝার কারণে একদিকে তার ওজন বেড়ে গেলো, আবার চেহারায় দেখা দিয়েছে এই অকাল বয়সেই ভাঁজ ও বলিরেখা। তিন বোনের মাঝে সেই ছিলো সবচে সুন্দর। কিন্তু ঠোঁটের উপরে অস্বাভাবিকভাবে গজিয়ে উঠা মিহিন কালো পশমের  কারণে তাকে এখন কেমন বেখাপ্পা আর শ্রীহীন দেখায়। 

অমিমাংসিত ধাঁধার ভেতর পড়ে সুলতান বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে, যতক্ষণ না তার বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য একটি আবেদনপত্র লেখার কথা ভাবতে। প্রথম প্রথম তার নিজের উপরই ঘৃণা জাগতো এমন কথা চিন্তা করার জন্য। দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা সন্তানের বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা নেবে কোন মুখে সে? দিনরাত মনের সাথে এই যুদ্ধ চলে। 

কিছুদিন হলো তার কাজ আসা একদমই কমে গেছে। সেজন্য প্রতি শুক্রবারে গোপনে গোপনে শাহ মাখদুম সাহেবের মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করা শুরু করে দেয় সে। একটা ময়লা, লম্বা কালো বোরকা গায়ে চাপিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতো। যাওয়ার সময় বলে যেতো শাহ মাখদুমের মাজারে যাচ্ছে মান্নত ও প্রার্থনা করার জন্য। কিন্ত তার এই তড়িঘড়ি করে অবগুণ্ঠিত হয়ে বাইরে যাওয়াতে সুলতানের সন্দেহ হওয়া শুরু করলো অন্যকিছু। মেয়েটা কি ভিন্ন কোন উপায়ে পয়সা রুজি করতে যাচ্ছে?  সুলতান মনে মনে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। বিশেষত সে কখনো এটা চায় না যে এ নিয়ে তত্ত্ব তালাশ চালানোর কারণে তার আশঙ্কা ও সন্দেহ শেষমেশ বাস্তবে পরিণত হোক।

ছোট মেয়েটা মাধ্যমিকে এসে স্কুল ছেড়েছে, সুলতানের বউ যখন মারা যায় আমাশয়ের রক্তস্রাবে। মায়ের মৃত্যুর পর সেই বাড়ির কাজ কর্ম সব দেখাশোনা করে। বাড়িতে তার উপস্থিতি খুবই নিরব। মাঝে মাঝে তার নিজের বাবাও টের পায় না সে আশপাশে থাকলে। সুলতানের জন্য সে প্রায় অনুপস্থিত একজন মানুষ।

সে যেন তাদের গাভীটার মতোই নিরব নিশ্চুপ, যাকে সে খাবার খাওয়ায়, গোসল করায়, আর সময়মতো দুধ দোহায়। মাঝেমাঝে তার শব্দহীন কান্নার অশ্রুফোঁটা টপটপ করে গাল বেয়ে নামে, বিগলিত মুক্তা দানার মতো। সুলতানের একমাত্র ছেলে মুশতাকের জন্মের বছর দেড়েক আগে তার জন্ম। আর, মুশতাক মারা গেলো একেবারে কিশোর বয়সে। 

পড়াশোনা, বইপত্র, স্কুল এসবের কোনকিছুর সাথেই মুশতাকের কোন সম্পর্ক ছিলো না। সবসময় দূরত্ব বজায়ে চলতো। বরং বাবার মতোই এলাকার বিদ্রোহী মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে চলাফেরা করতো সারাদিন। একদিন এরকম সশস্ত্র একটি গ্রুপের সাথে সেও আশ্রয় নিয়েছিল গোপন আস্তানায়, নিশাত এলাকার চমৎকার একটি বাড়িতে। মাঝরাতের দিকে তাদের আস্তানা ঘেরাও করে ফেলা হলো। সকলেই সেখান থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও কেবল মুশতাকই ছিলো, যে পালাতে পারেনি। সেই বাড়ির রান্নাঘরে হত্যা করা হলো তাকে। পরদিন সকালে সুলতান খবর পেয়ে কোনরকম সে বাড়িতে প্রবেশের ব্যবস্থা করলো, এবং মৃত ছেলের মুখ দেখলো। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে মুখ থুবড়ে পরে থাকা ছেলের লাশ দেখে সুলতান সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। পুনরায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখে মুশতাকের লাশ  খাটিয়ায় রাখা হচ্ছে। 

তার জানাজার নামাযে মুক্তিযুদ্ধারাও উপস্থিত হয়। মুখে মাস্ক লাগিয়ে শবযাত্রার লোকজনের সাথে মিশে যায় তারা। পরবর্তীতে তারাই গোরস্থান কমিটির লোকজনের সাথে কথা বার্তা বলে উন্নতমানের একটি খোদাই করা স্মৃতি-ফলক সংগ্রহ করে তাদের বন্ধু মুশতাকের জন্য। তাদের ইচ্ছা মুশতাকের কবরের উপর উর্দূ হরফে লেখা থাকবে একটি এপিটাফ। সেখানে মুশতাকের পূর্ণ নামের আগে লেখা হবে "শহীদ", যার মাধ্যমে বুঝা যাবে মুশতাকের মৃত্যু স্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়, সে প্রাণ দিয়েছে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য! 
" আমরা স্বগর্বে তার সমস্ত খরচ বহন করবো"।
যোদ্ধাদের এরিয়া কমান্ডার গোরস্থান কমিটির লেকজনকে খরচের ব্যাপারে আশ্বস্ত করলো।

মুশতাক কে সমাহিত করার কিছুদিন পরই একটি চকচকে কালো গ্রানাইট পাথরের সমাধিস্তম্ভ নির্মান করা হলো শিয়রের কাছে, যাতে ঝলমলে সোনালী কালিতে লেখা হলো একটি উর্দু এপিটাফ।

****

মুশতাকের মৃত্যুর মাস কয়েক পরই সুলতান সেই দুর্ঘটনার শিকার হয়, যার ফলে তার বাম হাত চিরতরে অচল হয়ে যায়। এবং দুর্ঘটনার পরপরই  বড় মেয়ে ফিরে আসে, এবং মেঝো মেয়ের কাজ কমে আসে। আয় রোজগারের সকল সম্ভাব্য পথই বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। নানামুখী জ্বালাতন ও দুশ্চিন্তায় পড়ে সে কাপের পর কাপ তেতো  লবন চা আর ফিল্টারবিহীন সিগারেট ফুঁকে চললো।

কখনো কখনো লোকমুখে শুনতো, তার প্রতিবেশী সাত্তার ওয়াগা কিভাবে সরকারের কৃপায় এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরন হিসেবে পেয়েছে। এই টাকা সরকার অনুমোদিত। সাত্তারের ছেলে সেনাবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে। তার লাশও ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো ঝিলাম নদিতে। প্রথম প্রথম সুলতান সাত্তারকে ঘৃণা করতো এই ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণ করায়। তখনও নিজের ট্রাজেডির বোঝা চাপেনি তার ঘাড়ে। নিজ সন্তানের আত্মত্যাগ ও বিসর্জন কে সরকারের কাছে বিক্রি করে দেয়ায় তাকে গাদ্দার বলতো। কিন্তু সুলতান দ্বিধায় পড়ে গেলো, যখন রহমান পাররে, তার  আরেক প্রতিবেশী একই কাজ করলো। রহমান ছিলো স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের একজন সক্রিয় কর্মী। তার ছোট ভাই আর্মীর হাতে নিহত হলে, সে নানান সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে সরকারের দেয়া ক্ষতিপূরণের এক লাখ টাকা গ্রহণ করে।

তাহলে ঠিক কাজটা করলো কে? সাত্তার, রহমান নাকি সে নিজে? অমিমাংসিত ধাঁধার ভেতর পড়ে সুলতান বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে, যতক্ষণ না তার বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য একটি আবেদনপত্র লেখার কথা ভাবতে। প্রথম প্রথম তার নিজের উপরই ঘৃণা জাগতো এমন কথা চিন্তা করার জন্য। দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা সন্তানের বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা নেবে কোন মুখে সে? দিনরাত মনের সাথে এই যুদ্ধ চলে। 

ইতিমধ্যেই সে আকণ্ঠ ঋণে ডুবে আছে। প্রতি সকালে দোকানদার এসে হুমকি ধামকি দিয়ে যায়। যথাশীঘ্রই বাকির টাকা পরিশোধ না করলে সে সুলতানের গরু নিয়ে যাবে। সুলতান এমনকি তার পাশের রুটির দোকান  আর নাপিতের কাছেও ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে। সে তাদের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া আসা বন্ধ করে দিলো। গ্রামের বাইরে কোথাও যেতে হলে পেছনের পথ ধরে অনেক ঘুরানো প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে যায়। কিন্তু সবশেষে তার একবছর বয়সী নাতিটা যখন মারাত্মক  নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়লো, তখন সে একদম হাল ছেড়ে দিলো। চূড়ান্তরূপে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিলো। ছুঁড়ে ফেলে দিলো স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গিকারের বাহানা, এড়িয়ে গেলো ভেতরে জন্মানো অপরাধবোধ। এবং ক্ষতিপূরনের টাকার জন্য সে আবেদনপত্র দাখিল করলো।

অবশ্য যতটা সম্ভব সে এই কথাটি গোপন রাখতে চাইলো। বিশেষত তার খুবই ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু গুল ভাগওয়ানের কাছ থেকে। গুল ভাগওয়ানের ছেলে আর্মিদের হাতে মারা যাওয়ার পর সে অত্যন্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এই সরকারি  টাকার অফার। 

এখন মোহাম্মদ সুলতান ও ক্ষতিপূরণের টাকার মাঝে কেবল একটাই বাধা, সেটা হলো মুশতাকের এপিটাফে লেখা "শহীদ" শব্দটি, যেটা খুব প্রকটভাবে ফুটে আছে পাথরের ফলকে, গভীর করে খোদাই করে লেখা শব্দটি। যদি কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে যায় এটা, তাহলে তার টাকা পাওয়ার সুযোগ পুরোটাই বিফলে যাবে। এই একটি শব্দই ব্যর্থ করে দেবে তার সকল প্রচেষ্টা কে।

                                                                                     ****

গোরস্থানের জায়গাটি উঁচু সমতল ভূমি। মাটিতে গেঁথে আছে পাথর, সবখানে শন আর লম্বা ঘাসের ঝোঁপ। গ্রামের লোকবসতি থেকে দূরে, বিশাল বিস্তৃত ধানক্ষেতের একপাশে। এই মেঘমেদুর সন্ধ্যায় আইরিস ঘাসের দিকে তাকালে সুলতানের মাথায় একটা বিচ্ছিন্ন চিন্তা খেলে যায়, বাড়িতে ফনিমনসার ঝোঁপের পরিবর্তে এই আইরিস ঘাস যদি লাগানো যায় তাহলে খুবই ভালো হতো। 

অন্ধকার আরও গাঢ় হওয়ার হওয়ার অপেক্ষায় থাকে সুলতান। ছেলের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে রেখে বিড়বিড় করে মৃতের জন্য ফাতেহা পাঠ করছে। সন্ধার আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। একটু পরেই কাছের কোন মসজিদ থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের দরাজ কন্ঠ। বৃষ্টির হিসহিস আওয়াজের সাথে মিশে গেলো আজানের সুর। ভেজা মাটি আঠার মতো লেগে যাচ্ছে জুতোর তলায়।পায়ের সাথে উঠে আসছে জমিনের প্রথম স্তর, প্রকাশিত হচ্ছে নিচের মাটির গৈরিক বর্ণ।


এর কয়েক মিনিট পর, যখন বৃষ্টি থেমে গেলো, সে ভোঁতা বাটালিটা ধরলো তার কম্পিত বাম হাতে, শহীদ শব্দটার উপর। হাতুড়ি দিয়ে পরপর কয়েকবার আঘাত করলো। লোহার টুংটাং শব্দ, আর হাতুড়ির আঘাত মাটি ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মুশতাক আহমেদ নযর পর্যন্ত। হাতুড়ির প্রথম আঘাতে "শহীদ" শব্দের  উপর ধরে রাখা বাটালিটা পিছলে গিয়ে তার ছেলের নাম মুশতাক আহমেদের উপর পড়লো।


chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই