চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

নস্টালজিয়া



নস্টালজিয়া
সারোয়ার রাফি

(১)

আমাদের সময়টা ছিলো অদ্ভুত! জানালার ধারে বসে রেললাইন দেখা, ওপারের মানুষ- অভাব, দুঃখ, আনন্দ, অনটন-আমরা নিজেদের জীবনের সাথে তা মেলাতাম। মাঝে পুকুর সেখানে মাছের সাথে বড়শির রিলেশনশিপে ভরা-ভোরবেলা এক আপন রাতা'র ডাকে রেডিও বাজানো। আমাদের সময়টা ছিলো অশ্রুতে কাঁদা, ট্রেনের হুইসেল ছিলো এক নস্টালজিয়ার এ্যালার্ম- আহা, হাআ

আমাদের সময়ের বৃষ্টি ছিলো মেঘ না চাইতে বৃষ্টিতে মরা!

(২)

আমাদের সময়টায় কোনো বিদ্যুতের বাড়াবাড়ি ছিল না। আসা যাওয়ার প্রতিযোগিতা এখন কুটিল ভঙ্গিতে লেখা।হারিকেন জ্বলতো ঝাপসার ইমাজিনেশনে, সেখানেই তীব্র পড়ালেখা, কেরোসিন যেন কচ্ছপ গতিতে কমতো-- একটু একটু-অন্ধকারে কোনো প্রলাপে ঝগড়া করা, ব্যাঙের সুনিপুণ ডাক যেন এক শিল্প-কাছ থেকে পাতার চুপসানো গন্ধে কবরস্থান-- আহা, হাআ

আমাদের সময়ের আনন্দ ছিলো বাতি না চাইতে কুপিতে ধরা!

(৩)

আমাদের সময়ের গাছ ছিলো যেন সব গাছের ডালে বসে ভূতের ভয় দেখানো অথবা দড়িতে ঝুলে দোল খাওয়া, পিঁড়িতে বসে গায়ে লাগানো বুনো হাওয়া-পিছন থেকে কেউ ঠেলতো, দুই হাত যেন বিষণ্নতার ,রাগানোর, খেলার, খেলানোর মজা পাওয়া-পাতাগুলো আলতো নাচতো যেন তারাও খেলার অংশীদার। দিনশেষে মেঠো পথ বেয়ে ফেরার হাঁক, দড়িটি ঝুলতো তখনো যেন কোনো পোড়-খাওয়া বধূর নিজস্ব পিঁড়িতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ অথবা পিঁড়িবিহীন রহস্যের সুইসাইডাল-- আহা,হাআ

আমাদের সময়ের খেলা ছিলো বই না চাইতে সঁইকে পড়া!

(৪)

আমাদের সময়ের মাটি ছিলো হাড়ি-পাতিল বানানোর দৌড় ঝাপ, রোদে শুকানো, কাদায় কাদায় হাতের ছাপ-একেকজন একেকজনের কাছে ভিন্ন নামে পরিচিত হওয়া। বালু ভরে হাড়িতে ভাত ভেবে রান্না করা, ঘন জঙ্গল থেকে নানান হেলেঞ্চা, কলমি লতা, কত নাম না জানা উপাদান। পরিশেষে রান্না করা, মিছিমিছি খাওয়া, পাখিরাও নিমন্ত্রিত নিয়ে খড় কুটো উপহার। এতসব কিছুর ভীড়ে আজলা ভরা জলই ছিলো সত্যি সত্যি পান।আমাদের সময়ে ছিলো ঝোলাবাত্তির মেলা-- আহা,হাআ

আমাদের সময়ে স্টোরি ছিলো চাঁদ সওদাগরের গল্প বলা!

(৫)

আমাদের সময়ে স্কুল নয় ছিলো পাঠশালা, স্যার নয় ছিলো মাস্টারমশাই, কলম নয় ছিলো বড়ইয়ের দানা, চক, জানলা বেয়ে অদূরে সুদূরে ভাসতো কল্পনাতীত হাজারো বক। আমরা বকের থেকে এক পায়ে দাঁড়ানো শিখতাম। হৈ-চৈ ছিলো মোহনীয়তায়। রোল কল নয় ছিলো নাম মনে রাখা, খাতা ছিলো পাতা, সবার 'অ' ছিলো আল্পনায় বেলা। নোট নয় ছিলো মুগ্ধপাঠ। আহা, হাআ

আমাদের সময়ে পড়া ছিলো শুধু একে অপরকে বোঝাপড়া!

(৬)

আমাদের সময়ে নদী ছিলো লাফ দেয়ার ঠিকানা। জলের নিচের কাদা দিয়ে ঢিল ছোঁড়া, কেউবা পুকুরের, দীঘির প্রান্তে লাগানো গাছ থেকে ঝাপ দেওয়া যেন অলিম্পিকের মহড়া। একবার ডুব দেওয়া, ভাসা, ডুব দেওয়া, ভাসা- হঠাৎ  বৃষ্টি শুরু হলে আমাদের নদীতে, পুকুর, পুকুরে দীঘি, দীঘিতে সাগর ছিলো মাছেদের মেলা। তারাও ডুব দিতো, ভাসতো, ডুব দিতো- বজ্রপাতের করুণ আঘাতে ঘাট থেকে পিছলে পড়া। কোমর ভাঙ্গা-ঝাড়ফুক দিয়ে পাড়া মাতাতো কবিরাজ।ঔষধ নিয়ে বসে কোনো অচেনা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। আহা, হাআ

আমাদের সময়ে নদী ছিলো প্রেজেন্টের রূপকথা!

(৭)

আমাদের সময়ে রাস্তা ছিলো চারপাশে ঝোপঝাড়, গাছেদের শীতার্ত রোমাঞ্চ। একটি, কয়েকটি, হরেকটি পাতা পড়তো হঠাৎ। অজানা ফল কুড়োনোর মাদকতা। রাস্তারাও যোগ দিতো আমাদের সাথে, লুকিয়ে রাখতো না নিজেদের, প্রতিটি দৌড়ের প্রগাঢ়তায় ভাসতো পায়ের ছাপ। গরুর গাড়ি, রাখাল, শীতের সন্ধ্যায় পাশের তালগাছের রস চুইয়ে পড়া-আমাদের রাস্তায় দোলা দিতো সাথে গান গাইতো ডাক হরকরা। আহা, হাআ

আমাদের সময়ের রাস্তা বর্তমানে আটকে থাকে ভায়োলেন্সের বাস্তবতায়!

(৮)

আমাদের সময়ে ঘর যেন এক দুরন্ত হারিকেনের রূপান্তরতা। ঝাপসা অথচ রহস্যের আলোয় মানুষ বেড়ে ওঠা।কালো, কালো অপরূপ অক্ষর। গুণগুণ কোনো কবির জন্ম হতো নয়তো গল্পকার। রাত আটটার পর সবাই ঘুমিয়ে যেতো নামায সেরে, মন্দিরে পূজা সেরে, গির্জা-প্যাগোডায় সেরে প্রার্থনা। ঘর ছিলো মাটির-ঝি ঝি পোকার ডাক, ভয় পাওয়া, টর্চ ঠেলে দুর্গম ঘরে ফিরে আসা। প্রতিঘরই রাতের আঁধারে রূপকথা। ইঁদুরের বড় বড় গর্ত, তাতে সাপ, আমাদের সময়ে ঘরের মাটিতে গোবর মাখা। জাদু নয় এ এক পরম বাস্তবতা। আহা, হাআ

আমাদের সময়ের ঘর এখন ডায়নোসরের চোখের পাতায় ঘর বাঁধে-- চারপাশ অসহ্য বিবর্ণতায়!

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই