চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আলাদা হয়ে যাওয়া মানুষ



আলাদা হয়ে যাওয়া মানুষ 
মিলু হাসান 


বিকেল গড়িয়ে এল। কাক আর এল না। সে মন খারাপ করে বসে আছে৷ নোট খাতাটি নিল। লাল কালিতে একটা দিন-তারিখ লিখল। ইংরেজি আর বাঙলা দিন -তারিখ লিখতে লিখতে আর ভালো লাগে না। আরবিতে লেখা দিন-তারিখ তার গৎবাঁধা জীবনে এক ফোঁটা রিফ্রেশ।

দুইটা থেকে তিনটার দিকে একটা কাক তার বেলকনির গ্রিলে এসে বসে। সে টোস্ট বিস্কুট দেয়। কাক খেয়ে চলে যায়।কাক কা কা করে কি যেন বলে। সে বুঝে না। কাক তার দিকে এক মায়াবী করুণ চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে-মাঝে মাঝে৷ সে-ও চায়। এক অদ্ভুত মায়ার জন্ম হয়। 

কাক আর এল না। অপেক্ষায় থেকে থেকে এ বেলকনিতে সে বুঝতে পারল - পণ্ডশ্রম! কাক আর আসবে না।সে ভাবল এ গতানুগতিক জীবনে একটা চেঞ্জ দরকার। একটা কিছু করে আনন্দ পাওয়া দরকার। রোমাঞ্চিত হওয়া দরকার। টান টান উত্তেজনা দরকার। সে কোন কিছুতেই জীবনের মিনিং খুঁজে পাচ্ছিল না৷ আসলে মিনিং খোঁজা একটা ধাঁধা। বরং যা করতে ভাল লাগে তাই মিনিং। সে একটা লাল গোলাপের চারা কিনে আনল। প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় চারায় পানি দিল। গোলাপের চারাটি বাড়ছে। বড় হচ্ছে। হঠাৎ সে ফুলের চারাটি টেনে তুলে ফেলল। দু'দিন পরে সে আবার তা টবের মাটিতে রোপণ করলো। সে আধমরা গোলাপের চারাটিকে যত্নপাতি করে বাঁচাতে চায়। এভাবে সে তার বোরিং লাইফে একটা থ্রিলিং ঘটাবে। এক সপ্তাহ পরিচর্যা করে ফল হল না৷ চারাটি মরে গেল।তার মনে একটা বড় দাগ কাটল। খোয়াবে সে তিন রাত অবধি গোলাপের চারাটা জ্যান্ত হয়ে বেড়ে উঠছে দেখে আর সুবাস ছড়ায় আর খোয়াবের ভিতরেই সে বড় নিশ্বাস নিয়ে সুবাস টেনে নেয় বুকের ভিতর। ঘুমের ভিতরে সে বিড় বিড় করে বলে- মরে গেল। ঘুম থেকে উঠেও নিজের অজান্তে সে বিড়বিড় করে -মরে গেল। 

তার আরেকটা কাজ করার অভ্যেস ছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার সাথে নিজের কথোপকথন৷ নিঃসঙ্গতা কাটাতে সে এটা করতো। নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করতো - কেমন আছেন, মিয়া ভাই। আবার সে নিজেই বলতো- হুঁ, ভালোই আছি। আপনে? 
এসব করার সময় সে কখনো হাসতো না। পুরা সিরিয়াস হয়ে সে তা করতো। যেন সত্যি সত্যি সে কথা বলছে আরেকজনের সাথে। এরকম সে করে আসছে অনেক দিন ধরে। সাধারণত রাত বারোটার দিকে এটা করতো সে। আবার কখনো সন্ধ্যা হয় হয় যখন তখন করতো। যখন তার একা লাগতো খুব বেশি, তখনই তা করতো।এখন আর তা করার মধ্যে কোনো ইন্টারেস্ট নাই তার। এক বিন্দুও না। 

একটা সময় তার জানার প্রতি ইচ্ছা ছিলো। জানার জন্য সে বইটই পড়তো। তার জানার ইচ্ছাটাও মরে গেছে৷ এখন আর তার কোনো কিচ্ছুই জানতে মন চায় না । বই দেখলে সবচে বেশি বোরিং লাগে।

কোনো কিছুতেই আর ভাল লাগছিল না। সে বুঝতে পারল তার মরণ দরকার৷ মরণই পারে তার জীবনের একটা গতি করতে। মরণ ব্যাপারটা একটা থ্রিলিং ব্যাপার।কারণ এর পরে কী ঘটবে সে আসলে জানে না৷আসলে সকলেই জানে না। সকলেরই একটা কৌতূহল। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাস করতে গিয়ে একটা ব্যাখ্যা মনে-পরানে বিশ্বাস করে একটা স্বস্তি পায়। কিংবা যারা বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে তারাও একটা বিশ্বাস করে স্বস্তি পায়৷ প্রত্যেকে তার ফিলোসফিতে বিশ্বাস করে ব্যাখা করে বিষয়টা। আদৌ কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা তার সার্বজনীন স্বীকৃত প্রমাণ অসম্ভব। কিংবা যা ঘটবে তা হয়তো কোনো ফিলোসফিতেই পড়ছে না। তো সে এসব ভাবতে ভাবতে ভাবল তার আসলে মরণ দরকার। 

সে প্রতিদিন মরণের অপেক্ষা করছে। সে তার মরণ কামনা করে। তো, সে মরণের অপেক্ষা করে। মরণ নিয়ে ভাবে। কখন আসবে মরণ। আহা! সেই রোমান্টিক মুহূর্ত! মরণের অপেক্ষা করতে করতে  ক্লান্ত। মরণ আসে না। সে অপেক্ষা করে যায়। আর ভালো লাগে না তার। এরকম করে চলে যায় অনেক দিন। 

সে সুইসাইডের কথা ভাবে।পরক্ষণে তার খেয়াল হয় সে-তো সাধারণ ধার্মিক মুসলমান। ধর্মকর্ম না করুক কিন্তু বিশ্বাস তো করে অথবা বিশ্বাস করে না হয়তো। যদি সত্যি সত্যি জাহান্নাম থেকে থাকে আর সে সুইসাইড করে বসে তো তার শাস্তি তো চিরকাল জাহান্নাম। আবার ভাবে স্বাভাবিক মরণ ঘটলো। সে তত পাপী মানুষ না।বেহেস্তেই যাবে হয়তো। তো বেহেস্তে গিয়া ও তো সে বোরড হয়ে পড়বে। কারণ বেহেস্তে তো একটা অনুভূতি৷ শুধু সুখ আর সুখ। এতো সুখ পাইতে পাইতে কখনো কি তার কাছে সুখ অসহ্য লাগবে না? সে সুখে সুখে থাকতে থাকতে কি বোর ফিল করবে না কখনো। ও মনেই নাই, বোরড হবে কেন সেখানে তো অন্য অনুভূতির সুযোগ নাই। শুধু তো সুখ। বোরড হবেই বা কেমনে। তারপরেও  বোরড। যেহেতু সুখই আছে শুধু। আবার  ভাবে এরকম কিছু হয়তো নাই। আবার ভাবে আছে হয়তো। এ সব ভাবনাতে সে প্যাঁচে পড়ে যায়। সুইসাইড করা আর হয় না তার। সে মরণের অপেক্ষায় বসে থাকে। কিন্তু মরণ আর আসে না। হয়তো একদিন আসবে। সে অপেক্ষায় সে বসে থাকে।

এভাবে আরেকটি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার শরীর শুরু হয়। সন্ধ্যার শরীর থেকে বেরিয়ে আসে অন্ধকার। সে বেলকনিতে বসে থাকে অন্ধকারে। আর মরণের অপেক্ষা করে। হয়তো আগামীকাল তার মরণ ঘটবে। এ আশা নিয়ে সে বেলকনির অন্ধকারে বসে থাকে। একটা মশা তার গায়ে বসে। রক্ত খায়। রক্ত খেয়ে মশাটা ফুলে উঠে। আর রক্ত খেতে পারে না। তার ও মশাকে মারতে ইচ্ছা করে না। মশা ও নড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না। সে বসে থাকে মরণের অপেক্ষায়। আর তার শরীরে বসে থাকে একটা মশা যে আসলে বাঁচতে চায়, কিন্তু সে নিরুপায়।

লেখা পাঠান: chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই