চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অসম্ভব খরগোশ



অসম্ভব খরগোশ

মিলু হাসান 

আমাদের পিতা সর্বদা অভাবের ট্রেনে চড়ে উনার মনে খিটখিটে মেজাজী লাল লাল বিষপিঁপড়া সারাক্ষণ  কিলবিল কিলবিল করতো। উনার রাগের তোহমে ঘরের কোণায় আশ্রিত চড়ুই তিন সন্ধ্যা বাড়ি ফিরতো না। আমাদের কলিজা ভয়ে কোথাও যেন উধাও হয়ে যেতো। এ মানুষটা আমূল বদলে  যেতো গভীর রজনীতে, গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে নিজস্ব মুখ নিয়ে হাজির হতো আমাদের বিছানার ধারে আর আম্মার স্বপ্নে বোনা কাঁথা জড়িয়ে দিতো আমাদের গায় আর বিড়বিড় করে বলতেন  —ওদের যেন অভাবের হাড়গিলা শীতে গায়ে দেয়ার মতোন স্বচ্ছলতার একটি রঙিন কম্বল থাকে। থাকে যেন একটি লাল টুকটুকে খরগোশ। তখন তিনি হয়ে যেতেন একটি মায়ার পাহাড়, যা তিনি আজন্ম লুকিয়ে রাখতেন উনার বুকপকেটের ঠিক নিচে।

ভাতঘুমে তিনি খোয়াবের ভিতর টাকা গুনতেন, যা কখনো বাজার করতে গিয়ে ফুরাবে না । ঘুম ভাঙার পর বিকালের দিকে উনার হাঁপানি উঠতো, তিনি হাঁপাতেন —আমাদের আসন্ন রাতের অভাবের কথা ভেবে ভেবে। আমাদের পিতা সর্বদা অভাবের ট্রেনে চড়ে আমাদের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখাতেন, আমরা চোখ বুজে বিশ্বাস করতাম আর দিনশেষে অভাবের নরকের চিতায় আমরা জ্বলতাম কিন্তু কোনো কান্নার শব্দ হতো না। আমরা আমাদের কান্না আম্মার আঁচলে জমা করতাম যেন মুরগির ছাওগুলি মা মুরগির ডানার ভিতর কী সুন্দর আগলে রাখছে কান্নাগুলি আর আমাদের কান্না জমে জমে আম্মা এতো ভারবাহী হয়ে উঠতেন যে উনার নিজস্ব কান্না বলে কিচ্ছুই থাকতো না। আমাদের পিতা আম্মাকে নিয়ে রাতে খোয়াব দেখতেন ১ সপ্তাহ বেহেস্তে অভাবহীন সংসারে দিন গুজরান করিতেছেন, যে ১ সপ্তাহ কখনো ফুরাবে না!

আমাদের আব্বা আল্লার দরবারে মোনাজাত করতেন —আমাদের সকলের যেন পেট নাই হয়ে যায়। গত ২৩ বছর ধরে তিনি একই মোনাজাত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, চোখের জল হয়েছে —নিঃশেষ। একরাতে তিনি বোরাকে চড়ে আরশে আজিমে চলে গেলেন, আল্লাকে সওয়াল করতে —তিনি কি পাথর ? আব্বা আবার ফিরবে বলতেন আম্মা। আমরা নীল আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বড় হয়ে গেলাম— আব্বা আর ফিরলেন না। আমার ছোট্ট ভাই আব্বাকে 'মিথ্যুক' বলে গালি দিলো, কারণ ওর জন্য এক টাকার একটি লজেন্স কিনে আনতে গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেন নি। সেদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন লোক দেখেছিলো লোহার বুটের মতোন দৃঢ়, বুকভরা সাহসী একটা মানুষ অভাবের ট্রেনের নিচে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো। আর একটা লালে লাল রক্তের স্রোত সারাটা জীবন ধরে আমাদের জীবনের রেললাইনের পাতে হামাগুড়ি দিয়ে আস্ত একটা অবয়ব তৈরি করছে, কী ভয়ংকর সুন্দর সে অবয়ব, আমরা খেয়াল করলে দেখি অঙ্কিত হয়ে আছে আব্বার অভাবহীন মুখ! তার পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছে লাল টুকটুকে একটি অসম্ভব খরগোশ ।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই