চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

চার্লস


[শার্লি জ্যাকসনের মূল গল্প থেকে অনুবাদ তৌকির হোসেন]

এক সুন্দর সকালের দিনে, যেহেতু আমার ছেলে লরি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যাওয়া শুরু করবে; তাই সে তার দীর্ঘদিনের বিবসওয়ালা কর্দুরয়ের জামা ছেড়ে ব্লু জিন্সের প্যান্ট বেল্ট দিয়ে পরা শুরু করে; আর আমি সেই সকালে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, আমার চোখের সামনে আমার জীবনের একটা যুগ যেন শেষ হতে যাইতেছে। লরি আমাদের পাশের বাসার বড় মেয়েটার সঙ্গে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে। ‍আমার নার্সারিতে পড়া সেই হাসিখুশি ছোট ছেলেটা এখন লম্বা ট্রাউজার গলায়ে কী থাগ, কনফিডেন্টভাবে আগায়ে যাইতেছে। আমার ছেলে। গলির কোনায় দাঁড়ায়ে যে গুডবাই বলবে- সে জন্যে হাত নাড়াইতেও ভুলে গেল বেচারা।

স্কুলশেষে লরি অনেকটা একইভাবে বাড়ি ফিরে। সে খুব শব্দ করে দরজা খুলে আর তাতে তার মাথার ক্যাপ মেঝেতে পড়ে যায় আর লুটোপুটি খেতে থাকে‌। তার কন্ঠ কেমন যেন কাকের মতো কর্কশ হয়ে উঠে তারপর সেইটা যেন একটা চিৎকারে রূপ নেয়, কেউ কি এইখানে নাই?
লাঞ্চের টাইমে তার বাবার সাথে কথা বলার ধরণটা ক্যামন জানি খুব রুড শুনাইলো, তার ছোট বোনের দুধ অনেকটা সে ইচ্ছা করেই ফেলে দিল, আর বলল, যে স্কুলে তার টিচার শিখাইছে যে আমরা আল্লার নাম নিয়ে যেন সবসময় বিনা কারণে শপথ না করি। 

অনেকটা ক্যাজুয়ালিই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজকের স্কুল ক্যামন গেল?
লরি উত্তর দেয়, ভালোই।
তার বাবা জিজ্ঞেস করে, তুমি নতুন কি কোনকিছু শিখছ?
লরি এইবার তার বাবার দিকে খুব শীতল একটা দৃষ্টি দেয়। সে বলে, আমি কোনকিছু না শিখি নাই।
কোনকিছু- আমি বলি, কথাটা হবে, আমি কোনকিছু শিখি নাই।
টিচার অবশ্য একটা ছেলের পাছায় বেত দিয়ে বাড়ি মারছে,- বাটার দেয়া পাউরুটি মুখের ভিতর পুরতে পুরতে লরি বলে, স্কুলে নতুন আসার জন্য। মুখভর্তি অবস্থায় কোনমতে কথাটা শেষ করে সে।
কেন? কেন? সে কী করছে?‌ আমি জিজ্ঞেস করি, ছেলেটা কে?
লরি একটু চিন্তা করে। তারপর বলে, ছেলেটার নাম চার্লস। স্কুলে সে নতুন আসছে আজকে। তার টিচার তারে মারার পর ক্লাসরুমের কোনায় দাঁড়া করায়ে রাখছিলো। সে একদমই নতুন, ফ্রেশ।
কিন্তু সে করছিলোটা কী? আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করি। কিন্তু লরি আর কিছু না বলে একটা বিস্কিট নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আর বেরিয়ে যায়, তার বাবা তখনও বলেই যাইতেছে, এই লরিইইই, এইদিকে আসো।
পরের দিন। লাঞ্চের সময়। লরি বসতে না বসতেই আবার বলতে শুরু করে, হা হা হা। চার্লস আজকে আবার শয়তানি করছে। সে হাসতে হাসতে বলে, আজকে চার্লস টিচাররেই ধরে মাইর দিছে।
মাই গড, মনে মনে আল্লার নাম নিয়ে আমি বলি, এবং নিশ্চয়ই সে এরপরে আবার বেতের বাড়ি খাইছে?
লরি বলে, অফকোর্স খাইছে। এরপর সে তার বাবাকে বলে, উপরের দিকে দেখ।
উপরের দিকে তাকাতে তাকাতে তার বাবা বলে, উপরে কী?
লরি বলে, নিচে দেখ। আমার বুড়া আঙুলটা নোটিশ করো। হিহি, তুমি এত ডাম্ব বাবা। সে পাগলের মতো হাসতে শুরু করে। 
আচ্ছা, চার্লস তার টিচারকে মারলো কেন? আমি দ্রুত জিজ্ঞেস করলাম। 
কারণ, টিচার তাকে রেড ক্রেয়ন দিয়ে রঙ করতে বলছিল, লরি বলতে থাকে, কিন্তু চার্লস চাইতেছিল সে সবুজ রঙ দিয়ে করবে। তো একটা পর্যায়ে সে টিচারকে ঘুষি মারে আর টিচার রেগেমেগে তাকে আবার বেত দিয়ে পিটায় আর সবাইকে বলে দেয়, চার্লসের সাথে কেউ যেন খেলা না করে। কিন্তু সবাই খেলছে তার সাথে। হিহিহি।

কিন্ডারগার্টেনের তৃতীয় সপ্তাহ পার হতে যাইতেছে। আর ইতিমধ্যেই চার্লস আমাদের ফ্যামিলিতে একটা ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়ে গেছে; আমাদের পিচ্চিটা যখন সারা বিকাল ধরে কাঁদতে শুরু করে, তখন আমার মনে হয়, সে চার্লসের মতো করতেছে। যখন লরি তার খেলনা ওয়াগন কার কাদা দিয়ে ভর্তি করে কিচেনে নিয়ে ঢুকে পড়ে, ওকে, লরি হয়তো চার্লস হয়ে যাইতেছে। এমনকি আমার হাজব্যান্ড যখন সে টেলিফোনের কর্ড কনুই দিয়ে ধরতেছিল, আর তাতে টেলিফোনে ধাক্কা লেগে টেবিলের উপর থেকে অ্যাশট্রে, ফুলের ভাস পড়ে যায়, একদম প্রথম মিনিটে আমার মাথায় যে কথাটা আসে তা হইলো, চার্লসের মতোই তো অবস্থা দেখতেছি।

তৃতীয় দিন- মানে প্রথম সপ্তাহের বুধবারে- সি-স তে খেলতে গিয়ে চার্লস একটা ছোট মেয়ের মাথার উপর বাউন্স করে, ফলে মেয়েটার মাথা ফেটে রক্ত বাইর হইতে শুরু করে, এবং এই দোষে টিচার তাকে শাস্তি হিসাবে টিফিন পিরিয়ডের সময় ক্লাসরুমের ভিতরে থাকার নির্দেশ দেয়। বৃহস্পতিবারে স্টোরি-টাইমের সময় চার্লসকে ক্লাসরুমের কোনায় দাঁড়া করায়ে রাখা হয়। কারণ, সে মেঝেতে পা দিয়ে শুধুশুধু শব্দ করতেছিল। শুক্রবারে তাকে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার যে সেশন সেইটা থেকে বিরত রাখা হয়।

এইসব শুনে আমার ভিতরে একধরণের টেনশন জন্মাইতেছিল। শনিবার আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলি, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলটা লরির জন্য প্রবলেমাটিক হয়ে উঠতেছে? স্কুলের এইরকম চাপ, খারাপ খারাপ শব্দ শিখা, আর এই চার্লস নামের ছেলেটা তো লরির উপর খুব বাজে প্রভাব ফেলতেছে বলে আমার মনে হয়।
সব ঠিক হয়ে যাবে বেব, আমার হাজব্যান্ড আমাকে অভয়ের সুরে বলে, এই পৃথিবীতে চার্লস ধরণের মানুষ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। এখন হোক আর পরেই হোক, এই ধরণের মানুষের সাথে আমাদের দেখা হবেই, হইতেই থাকবে।

সোমবারের দিন, লরি একটু দেরি করেই বাসায় ফিরে, তাকে দেখে বোঝাই যাইতেছে আজকে তার পেট টাটকা খবরে ভর্তি হয়ে আছে। আমি তার জন্য আমাদের বাসার সামনের দরজায় উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতেছিলাম। সেইখান থেকেই দেখতে পাই, লরি বাসা থেকে একটু দূরে গলির মাথায়। সেইখান থেকেই সে চিৎকার করে উঠল, চার্লস! ওইখান থেকেই চার্লস চার্লস করে প্রায় দৌড়ায়ে অবশেষে যখন সে বাসার দিকে আসতেছে, সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, চার্লস আজকে আবার ঝামেলা পাকাইছে।
আচ্ছা, আগে ভিতরে আসো, লরি আরেকটু কাছে আসলে বলি, লাঞ্চের সময় হইছে।
তুমি জানো আজকে চার্লস কী করছে? দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সে বলে, চার্লস আজকে স্কুলে এত জোরে চেঁচামেঁচি করতেছিলো যে পাশের ক্লাসরুম থেকে একটা ছেলে এসে টিচারকে বলল, তাদের ডিস্টার্ব হইতেছে, আর টিচার যেন চার্লসকে শান্ত করে। আর তাই চার্লসকে স্কুল শেষ হওয়ার পরও স্কুলে অনেকক্ষণ থাকতে হয়। আর অন্য সবাইও তাকে দেখার জন্য থেকে গেছিল। 
আমি প্রশ্ন করি, তারপর সে কী করল?
সে জাস্ট ওইখানে বসে ছিল, ডাইনিং টেবিলের সাথে লাগানো চেয়ারে বসতে বসতে লরি বলে, হাই ডাম্ব বাপি। (তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলা নিশ্চয়ই) 
আজকে চার্লসকে স্কুল শেষ হওয়ার পরও থাকতে হইছিল, আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলি, আর সবাই তার সাথে ছিল। 
আচ্ছা, এই চার্লস দেখতে ক্যামন? আমার হাজব্যান্ড লরিকে জিজ্ঞেস করে, তার আর অন্য কোন নাম আছে?
লরি বলে, সে আমার থেকে সাইজে বড়সড়। আর সে বেচারির কোন রাবারের জুতা নাই, এমনকি সে কোন জ্যাকেটও পরে না।   

সোমবার সন্ধ্যারাতে প্রথম প্যারেন্টস-টিচার মিটিং (পিটিএ) ছিল। আর আমার ছোট মেয়েটার ঠিক তখনই ঠান্ডা লাগে। তাই ওইরাতে আর আমার যাওয়া হয়ে উঠে নাই; কিন্তু আমার মন পুড়তেছিল, চার্লসের মা-র সাথে দেখা করতে। মঙ্গলবারের দিন, লরি হঠাৎ বলে উঠল, আজকে স্কুলে আমাদের টিচারের একটা ফ্রেন্ড আসছিল। দেখা করতে।
চার্লসের মা? আমি আর আমার হাজব্যান্ড একেবারে এক কন্ঠে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করি। 
আরে নায়ায়া, লরি বিরক্ত হয়ে বলে, উনি আমাদের স্কুলে এসে আমাদের এক্সারসাইজ করায়, কোমর বাঁকা করে পায়ের আঙুল স্পর্শ করতে বলে; এই যে এইভাবে দেখ, (লরি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়ে, কোমর পায়ের সাথে সমকোণে বাঁকা করে পায়ের আঙুল স্পর্শ করে) এই যে ঠিক এইভাবে। এরপর সে গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে পড়ে আর প্লেট থেকে কাঁটাচামচ তুলে নিয়ে খেলা করতে থাকে,- চার্লস এমনকি এক্সারসাইজও ঠিকমতো করে নাই। 
আহারে, ইটস ওকে, আমি সহানুভূতি দেখাই, আচ্ছা, চার্লস কি এক্সারসাইজ করতে চাইতেছিল না বা এইরকম কিছু?
নায়ায়ায়া, লরি বলে, আমাদের টিচারের ফ্রেন্ড চার্লসকে এতটাই নতুন ভাবতেছিল, যে উনি তাকে এক্সারসাইজ করতে দেন নাই।
আবার নতুনের ইস্যু? আমি বলি।
চার্লস টিচারের ফ্রেন্ডরে লাথি মারছিল তারপরে, লরি বলতে থাকে, টিচারের ফ্রেন্ড পরে তাকে তার আঙুল ছুইতে বলসিল যেমনটা আমি দেখাইলাম এবং চার্লস তখন তাকে লাথি মারে।
লরির বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, তারা তাহলে চার্লসকে নিয়ে কী করবে? তোমার কী মনে হয়?
লরি যেন ঘাড় নাড়ানোর জন্যই ঘাড় নাড়ায়। সে বলে, হয়তো স্কুল থেকে বের করে দিবে, আমার তো এইরকমই মনে হয়। 

বুধবার আর বৃহস্পতিবার একদম রুটিনের মতো পার হইল। স্টোরি-টাইমের সময় চার্লস চেঁচামেঁচি করল আর একটা ছেলের পেটে ঘুঁ‌ষি মারল তাতে ছেলেটা কাঁদতে শুরু করছিল। শুক্রবারে চার্লসকে আবার স্কুলের পরে থাকতে হয় এবং তার সাথে সাথে অন্য ছেলেপেলেরাও থেকে যায়।

কিন্ডারগার্টেনের তৃতীয় সপ্তাহ পার হতে যাইতেছে। আর ইতিমধ্যেই চার্লস আমাদের ফ্যামিলিতে একটা ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়ে গেছে; আমাদের পিচ্চিটা যখন সারা বিকাল ধরে কাঁদতে শুরু করে, তখন আমার মনে হয়, সে চার্লসের মতো করতেছে। যখন লরি তার খেলনা ওয়াগন কার কাদা দিয়ে ভর্তি করে কিচেনে নিয়ে ঢুকে পড়ে, ওকে, লরি হয়তো চার্লস হয়ে যাইতেছে। এমনকি আমার হাজব্যান্ড যখন সে টেলিফোনের কর্ড কনুই দিয়ে ধরতেছিল, আর তাতে টেলিফোনে ধাক্কা লেগে টেবিলের উপর থেকে অ্যাশট্রে, ফুলের ভাস পড়ে যায়, একদম প্রথম মিনিটে আমার মাথায় যে কথাটা আসে তা হইলো, চার্লসের মতোই তো অবস্থা দেখতেছি।

তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহের দিকে মনে হইল, চার্লসের মধ্যে একটা রিফর্মেশন আসা শুরু করছে। তৃতীয় সপ্তাহে বৃহস্পতিবারের দিন লাঞ্চের সময় লরি খুব মুখ শুকনো করে জানাইল, চার্লস আজকে এত ভালো বিহেভ করছে যে টিচার তাকে একটা আপেল গিফট দিছে।
কী! আমি আর আমার হাজব্যান্ড উদ্বিগ্ন হয়ে যোগ করি, তুমি বলতে চাইতেছো চার্লস?
হ্যাঁ চার্লস। লরি বলে, সে সবাইকে ক্রেয়ন সাপ্লাই করতেছিলো আর পরে সবার থেকে বই জোগাড় করে নিয়ে টিচারকে দিছিলো। টিচার বলছে যে চার্লস তার হেল্পার।
আমি প্রায় হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এমন কী ঘটল যে এত চেইঞ্জ?
লরি বলে, সে তার হেল্পার ছিল, ব্যস এতটুকুই। এই বলে সে ঘাড় নাড়ায়।
সেই রাতে আমি আমার হাজব্যান্ডকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, এইটা কি সত্যি হইতে পারে? এই যে চার্লসের ঘটনাটা, লরি যেইটা বলল লাঞ্চে। এইরকম কি কোন ঘটনা ঘটতে পারে?
জাস্ট ওয়েট এন্ড সি, আমার হাজব্যান্ড অনেকটা সংশয় নিয়ে বলে, যখন তুমি চার্লস ধরণের কারো সাথে ডিল করতেছ, আর যদি এইরকম ঘটনা ঘটে তার অর্থ হইতে পারে, তার মাথায় এমনকিছু চলতেছে যেইটা আমরা জানি না।
এবং আমার হাজব্যান্ডের সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়। এক সপ্তাহ ধরে চার্লস তার টিচারের হেল্পার হিসাবে কাজ করল; প্রতিদিন সে টিচারের হয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র সবার কাছে ডিস্ট্রিবিউট করল আর সেগুলা একত্রে জড়ো করে টিচারের কাছে জমা দিল; স্কুল শেষ হওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে আর কাউকে থাকতে হইল না সেই সপ্তাহে।
আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলি, এরপরের সপ্তাহে কিন্তু টিচার-প্যারেন্টস মিটিং আছে। আমি এইবার সেইখানে গিয়ে চার্লসের মা-কে খুঁজে বাইর করব।
জিজ্ঞেস করিও উনাকে, চার্লসের কী হইছে, এইরকম চেইঞ্জ…, আমার হাজব্যান্ড বলে, আমার জানতে ইচ্ছা করতেছে।
আমি নিজেও জানতে চাই। আমি বলি।

সেই সপ্তাহের শুক্রবারে সবকিছু পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিকে ফেরত যায়। লরি সেইদিন লাঞ্চে এসে একেবারে উত্তেজিত হয়ে বলে, তুমি জানো চার্লস আজকে কী করছে? তার গলার স্বর খানিকটা ভয়ার্ত শোনায়। সে বলে, আজকে চার্লস এক ছোট মেয়েকে কানে কানে কী জানি একটা কথা বলল, মেয়েটা গিয়ে টিচারকে কথাটা বলে দেয় আর টিচার মেয়েটার মুখ সাবান দিয়ে ডলে ধুয়ে দিল। চার্লস এইটা দেখছিল, আর এই কান্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাইতেছিল।
চার্লস তাকে কী কথা বলছিল এমন? তার বাবা একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে। 
লরি বলে, কথাটা খুব খারাপ। বললে তোমার কানে কানে বলতে হবে।
এই বলে সে চেয়ার থেকে নেমে পড়ে। তারপর সে তার বাবার কাছে যায়। তার বাবা মাথা নিচু করে ভালো করে শোনার জন্য, আর লরি চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে ফিসফিস করে কী জানি বলে তার বাবাকে। শুনতে শুনতে চিন্তিত পিতার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
গলায় একটু সংযতভাব রাখার চেষ্টা করে তার বাবা বলে, চার্লস ছোট মেয়েটাকে এই কথা বলতে বলছিল?
সে দুইবার বলছিল, লরি বলে, চার্লস তাকে দুইবার কথাটা বলতে বলছিল।
আমার হাজব্যান্ড জিজ্ঞেস করে, আর চার্লসের কী হইল তারপর?
লরি বলে, কিছুই না। সেব সবাইকে ক্রেয়ন বিলি করে বেড়াইতেছিলো। 
সোমবার সকালে চার্লস ছোট মেয়েটাকে এভয়েড করল, আর ওই খারাপ শব্দটা নিজে তিন, চারবার উচ্চারণ করল। নিজে নিজেই। তারপর প্রতিবার উচ্চারণ করার পরে সে নিজেই তার মুখ সাবান দিয়ে ধুইল। সে ওইদিন চকও ছুঁড়ে মারছিল।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা প্যারেন্টস-টিচার মিটিং এর যাওয়ার সময়ে আমি আর হাজব্যান্ড যখন দরজায় তালা লাগাইতেছিলাম, তখন আমার হাজব্যান্ড আমাকে বলে, আচ্ছা চার্লসের মা-কে হয়তো আমরা মিটিং এর পরে চায়ের দাওয়াত দিতে পারি, আমাদের বাসায়। আমি মানে উনাকে এক নজর একটু দেখতে চাই।
আমি বলি, দোয়া করি, যেন উনি ওইখানে থাকেন।
ওইখানে তাকে থাকতে হবেই, আমার হাজব্যান্ড বলে। চার্লসের মা ছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ আসলে কীভাবে পিটিএ মিটিং করবে তা আমার মাথাতেই ধরে না।

মিটিং এর পুরোটা সময় আমি রেস্টলেস ছিলাম, প্রত্যেকটা গার্ডিয়ানের চেহারা আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেছিলাম, বুঝতে চেষ্টা করতেছিলাম আসলে কোন চেহারা চার্লসের সিক্রেট লুকায়া রাখছে। কিন্তু কোন চেহারার মধ্যেই আমি লজ্জিত ভাব খুঁজে পাইলাম না, কোন চেহারার মধ্যেই নিজের ছেলের কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচনার চিহ্ন পর্যন্ত পাইলাম না। মিটিং এর মধ্যে কেউ উঠে দাঁড়ায়ে নিজের ছেলের এই ধরণের কাজের জন্য ক্ষমা চাইল না।
মিটিং শেষ হইলে আমি লরির কিন্ডারগার্টেন টিচারকে খুঁজে বাইর করি। উনি একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। তার হাতে একটা প্লেট আর তাতে চায়ের কাপ এবং একটা চকলেট কেকের টুকরো পড়ে আছে; আর অন্যদিকে আমার প্লেটে এক কাপ চা আর মার্শম্যালো কেকের টুকরো- খাওয়ার অপেক্ষায়। আমরা পরস্পরের দিকে হাত নাড়াই, অনেকটা সতর্কভাবে। আমাদের বিনীত হাসি সেই সতর্কতাকে ছুঁয়ে যায়। 
আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাইতেছিলাম একটু, আমি বলি, আমি লরির মা।
টিচার বলেন, আমরাও আসলে লরির ব্যাপারে খুবই ইন্টারেস্টেড।
আমি বলি, হ্যাঁ। সে তার কিন্ডারগার্টেন খুব পছন্দ করতেছে। সে তার স্কুলের ব্যাপারে বাসায় সবসময় কথা বলে।
টিচার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে নেয়, তারপর বলে, প্রথম সপ্তাহ বা ওই সময়ের দিকে আমাদের তাকে এডজাস্ট করাইতে একটু সমস্যা হইতেছিল। কিন্তু এখন সে ধীরে ধীরে খুব সুন্দরভাবে ছোট ছোট কাজে হেল্প করতেছে। তবে মাঝে মাঝে একটু বিগড়ে যায়, এই যা!
আমি বলি, লরি আসলে খুব দ্রুতই যেকোন কিছুর সাথে মানায়ে নিতে পারে। আমার মনে হয়, এইটা আসলে চার্লসের ইনফ্লুয়েন্স। হয়তো তার কারণেই, প্রথমদিকে লরির মানায়ে নিতে সমস্যা হইতেছিল।
চার্লস?
হ্যাঁ, চার্লস। আমি হেসে উঠি। তারপর বলি, আপনাদের নিশ্চয়ই চার্লসের জন্য স্কুলে খুব প্যারার ভিতর থাকতে হইতেছে? 
চার্লস? টিচার খুব অবাক হয়ে বলে, কিন্তু আমাদের স্কুলে তো চার্লস নামে কেউ নাই। 

[অনুবাদকের নোট: দ্য হন্টিং অফ দ্য হিল হাউজ সিরিজের মূল উপন্যাস খ্যাত শার্লি জ্যাকসনের লটারি গল্পটা বেশ জনপ্রিয়। তবে তার চার্লস নামেও আরেকটা গল্প আছে। গল্পটা প্রথম মাদমোয়াজেলের জুলাই সংখ্যাতে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তার দ্য লটারি কিংবা দ্য এডভেঞ্চারস অফ জেমস হ্যারিস নামক বইয়েও গল্পটা জায়গা পায়। এই গল্পটা আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব প্রিয়, প্রথম পড়াতেই আপন করে নিতে আমার কোন সমস্যা হয় নাই। গল্পটা খুব ক্রুশিয়াল একটা ব্যাপার বা যে বিষয়টা আমাদের সোসাইটিতে রয়ে গেছে, বিভিন্ন স্টিগমার আড়ালে, জেনারেশন গ্যাপের কারণে কিংবা আরও যে কারণেই হোক না ক্যানো, যে ব্যাপার আমাদের মাঝে রয়ে যায় অনেকদিন পর যা আমরা বুঝতে পারি না কিংবা বুঝলেও এড়িয়ে যাই, সেই নিষিদ্ধ বিষয়, যা আমাদের শৈশব, কৈশোরকে তাড়া করে বেড়ায়, কোন এক অশরীরী আত্মার মতো- তাকে তুলে ধরে। যা আমরা ছোটবেলায় সম্মুখিন হই। যা আমাদের শিখানো হয়- পুরুষেরা নিজেদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা অর্থাৎ আবেগ পরিবারের ভিতর প্রকাশ করতে পারবে না, এমনকি বন্ধুর কাছেও। পুরুষ মাত্রই কঠিন, পাহাড়ের মতো অটল, পৃথিবীর যাবতীয় ঝড়-ঝাপ্টা তার উপর দিয়ে গেলেও সে নীরবে সব সয়ে যাবে। পুরুষ কিংবা মানুষ কীভাবে তৈরি হয়, এবং সেই তৈরি হওয়ার প্রসেস এক শিশুর মনোজাগতিক ক্ষেত্রে কীভাবে প্রলেপের মতো দাগ রেখে যায় তা শার্লি জ্যাকসন এই চার্লস গল্পে লিখে গেছেন। 

এই গল্পটা এক অর্থে ফানি, আবার আরেকটা অর্থে হরিফাইং। চার্লস আর লরি যে একই ব্যক্তি সেই কথা আমরা একেবারে শেষে জানতে পারি, সেইটিই গল্পের টুইস্ট। গল্প তৈরিই হয়েছে এইভাবে। কিন্তু মাঝে আরও ছোট ছোট ব্যাপার হয়তো পাঠকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। কিংবা পাঠক হয়তো বুঝেছেন সবই। তবুও দুই একটা টোটকা দিলে তো সমস্যা নাই। লরি তার স্কুলের খারাপ লাগার যে ঘটনা সেইটা সে তার পরিবারে বলতে পারে না। তার বাবা-মাকে ঘটনা বলার আগে সে একটু চিন্তা করে বানায়ে নেয় চার্লসের নাম। তার স্কুলে মানিয়ে নিতে প্রচুর সমস্যা। কিন্তু হয়তো তার পরিবারেই এই জিনিসগুলো বলতে তার সমস্যা, তার ভয়। অভয় না পাওয়ার কারণে কিংবা বলা যায় একটা সার্টেইন দূরত্ব বজায় রাখার ফলে তাকে ইনভেন্ট করতে হয় নতুন ব্যক্তি ‘চার্লস’। লরি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করছিল মূল ঘটনা তার বাবা মাকে। এই কারণেই হয়তো সে তার বাবাকে ডাম্ব বলে, বুড়ো আঙুল দেখায়, নোটিশ করতে বলে, চার্লস আসলে কেউ না, সে নিজেই। তাতে কোন ফল হয় না। কিন্তু এইটা একটা খেলা হয়ে যায় তার কাছে। চার্লস নামক এক কাল্পনিক ছেলের উপর সমস্ত দোষ আরোপ করে লরি নিজে বেঁচে যাইতেছে। কিন্তু আদতে বাঁচতে পারতেছে না। তার নিজের ভিতরেই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হইতেছে। এইরকম সমস্যার ইশারা আমরা দেখি, যখন লরি একটা ছোট মেয়েকে বাধ্য করে কিছু বলতে। এমন কিছু যা বলা হয়তো সমাজ, পরিবার কিংবা ধর্মের কাছে গুনাহ। সেই গুনাহের জন্য শিক্ষক মেয়েটাকে মুখ ধুইতে বলে যার ফলে হয়তো সেই পাপমোচন হবে, এই আশায়। আমরা বুঝতে পারি, লরির ভিতরও এই কমপ্লেক্সিটি কাজ করে যখন সে নিজে বলে ওই কথাটা বলা গুনাহ বা খারাপ। তাই সে তার বাবাকে কানে কানে কথাটা বলে। আমরা বুঝি, লরির পরিবারও কথাটা ভালো করে গ্রহণ করে না। এই ধরণের কিছু কথা বলা ‘ভালো’, কিছু কথা বলা ‘গুনাহ’, বা ‘বলা উচিত না’, কিন্তু যা মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই ফিরে আসে, মনোজাগতিক স্বভাবের কারণে, এবং সোসাইটির ‘গুনাহ’, ‘শাস্তি’-র কথা ভেবে তা বারবার প্রায়শ্চিত্ত করবার চাড় জন্মায়। সাইকোলজির ভাষায় একে বলে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি। আমরা দেখি, লরির মধ্যেও এই ধরণের সমস্যা শুরু হয়েছে, সে নিজেও একটা পর্যায়ে বারবার সেই ‘নিষিদ্ধ কথা’ উচ্চারণ করে, আর প্রায়শ্চিত্ত করবার আশায় এবং সোসাইটির পানিশমেন্টের কথা মাথায় রেখে বারবার নিজের মুখ সাবান দিয়ে ধোয়।

আমরা আবার দেখি, একটা পর্যায়ে চার্লস রীতিমতো একটা ইনস্টিটিউশনে রূপ নেয় লরির পরিবারে। লরির আম্মা বারবার চিন্তা করে, যেকোন ধরণের কাজের সাথে চার্লসের অলিখিত সংযোগ। কারণ, চার্লস যা যা করে তা সবই ‘অ্যাবনরমাল’ বা ‘অস্বাভাবিক’। সে কোন মেয়ের মাথায় বাউন্স করে রক্ত বাইর করে ফেলতেছে, অথবা সে প্রচুর চেঁচামেঁচি করে ক্লাসরুমে, কিংবা সে টিচারকে ঘুষি মারে এবং এই সকল ব্যাপার আসলে সোসাইটিতে মানা যায় না, আর একটা স্কুলে ‘ভালো’ ছাত্রের কাছে তো নয়ই। তাই যেকোন ‘খারাপ’, ‘অস্বাভাবিক’ কাজ যদি ফ্যামিলিতেও দেখা যায়, সেইটা কফির কাপ পড়ে যাওয়াই হোক, কিংবা খেলনাগাড়ির কাদা নিয়ে কিচেনে ঢুকে পড়াই হোক- তা কোনমতেই মেনে নেয়া যাবে না। তা চার্লস-টাইপের কাজ। এইটা নিষিদ্ধ। এই কারণে, আমরা দেখি লরি অর্থাৎ চার্লসকেও স্কুলে শাস্তি পেতে হইতেছে, তাকে স্কুলের পর ঘন্টা ধরে থাকতে হয় কিংবা তার সাথে খেলতে সবাইকে নিষেধ করা হয় অথবা তাকে কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, যাবতীয় শাস্তির ভিতর দিয়ে ‘চার্লস-লরি’ যেতে থাকে, তখন আমরা ভাবি কিংবা লরির সাথে সাথে ফিল করি, লরি অনেক একা। 

লরি তার নিজের সমস্যার কথা, ইমোশনাল ঝামেলার কথা কাউকে বলতে পারতেছে না, না তার বাপ-মায়ের কাছে, অথচ সে স্কুলে একের পর এক ডিফিকাল্টিজ পার করে আসতেছে, তাতে তার ছোট মনোজগত, আমরা বুঝি, এক অবর্ণনীয় গিল্ট আর শেইমের ভিতর দিয়ে পার করতে থাকে। এই কারণে, সে চার্লস তৈরি করে বরং বলা যায় সে তৈরি করে নিজেকেই আরেকভাবে, যেখানে সে নিজে আর নিজে থাকে না। চার্লস হয়ে পড়ে তার কৃতকর্মের জন্য দোষী এক ছেলে। অথচ লরির মন গভীরভাবে খুঁড়লে আমরা বুঝব, সে নিজেই আসলে চার্লসের গিল্ট আর শেইমে জর্জরিত হয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। 

ফ্যামিলির সাথে বাচ্চাদের এই দূরত্ব তৈরি করতে সাহায্য করে ফ্যামিলি, স্কুল দুটোই। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ধরণের স্টেরিওটাইপ, পুরুষ কাঁদতে পারবে না, পুরুষ সবসময় রেসপন্সিবল, পুরুষ নিজের কাজের জন্য দোষী, আমাদের ভিতর ইনজেকশনের মতো পুশ করে দেয়ার কারণে আমরাও হয়তো ভুলে যাই নিজেকে (লরি নিজেও একটা ছেলে), আমাদেরও ভালো লাগা থাকতে পারে, খারাপ লাগা থাকতে পারে, আমাদেরও পেইন হইতে পারে, আমাদেরও কানেক্ট করা জরুরি কারও সাথে, শাস্তির ভয় না পেয়ে, ‘নিজের দোষে নিজের শাস্তি’ এই ধরণের কথা না শোনার চেয়ে সাপোর্টের যে জরুরত, নিজের কাছে সৎ হয়ে, অন্যকে নিজের খারাপ লাগার কথাটা কিংবা কোন ছেলের কাঁদতে পারার ব্যাপারটাও যে কোন নিষিদ্ধ ব্যাপার না, যা একদম নরমাল, ন্যাচারাল- এই বিষয়গুলোও আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়। দিনশেষে ভুলে যাই আমরাও। এবং বংশ-পরম্পরার মতো জেনারেশনের পর জেনারেশন একই বিষয় আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের শিখাতে থাকি, পুরুষ-নারীর ধারণা জোরদার করতে থাকি, পুরুষদের একা করে দিতে থাকি, বন্ধুহীন, নিজের কথা নাই অথচ হাসিখুশি সবার কাছে। একদিন এইভাবেই মানুষ মারা যায়, আমরা বলি সুইসাইড। কিন্তু হয়তো সেইটা হত্যা। 

ফুকোর সেই কথাই বারবার ফেরত আসে মনে, যে কথা বলতে গিয়ে ডোনাল্ড আনট্রিম তার বইয়ে মিস্টার রবার্টসনকে খুব বিপদে ফেলে দিছিলেন, ‘এখনকার সোসাইটির পানিশমেন্ট যতটা না বেশি ফিজিকাল, তার থেকে বেশি সাইকোলজিকাল।‘ আমিন।]


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com
  

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই