অনুসঙ্গীত
মূলঃ ফ্রেডরিখ নিৎশে
অনুবাদঃ মাহীন হক
ও জীবনের দ্বিপ্রহর! এখন তো সময় আনন্দোৎসবের !
ওহ গ্রীষ্মের পুষ্পকুঞ্জ!
অধীর আনন্দ–দাঁড়িয়ে থাকায়, তাকিয়ে থাকায়, প্রতীক্ষায়:-
আমি বন্ধুদের অপেক্ষায় থাকি দিবানিশি!
ওগো বন্ধুগণ, কোথায় তোমরা? এসো! সময় হয়েছে! এখনই তো সময়!
তোমাদের জন্যই কি আজ তুষার নদীর ধূসরতা
নিজেকে গোলাপের আবরণে ঢাকেনি?
এর স্রোত খোঁজে তোমাদের, এবং বাতাস আর মেঘ আজ
ব্যাকুল হয়ে নিজেদের আকাশের গাঢ় নীলিমার আরও গভীরে ঠেলে তোলে
বিহঙ্গ দৃষ্টিতে কেবল তোমাদের খুঁজে নিতে।
তোমাদের জন্য আমি সর্বোচ্চ শিখরে সাজিয়েছি টেবিল,
তারার এত নিকটে আর কার বসবাস?
এই হিমশীতল গহ্ববের গভীরতম তলের এত কাছাকাছি কেবা থাকে আর?
আমার রাজত্ব–আর কোন রাজত্বের বিস্তৃতি এত বিশাল?
আর আমার পুষ্পরস–কে নিলো তার স্বাদ?
এইতো তোমরা, বন্ধু আমার! হায়! তবে কি আমি সে লোক নই,
সে নই যাকে তোমরা খুঁজছো?
তোমাদের সঙ্কোচ, বিহ্বলতা!–আহ! এরচাইতে তো তোমাদের ক্রোধও উত্তম!
আমি কি আর এক নেই? বদলে যাওয়া হাত, চালচলন, এবং মুখ?
আমি কি-তোমাদের জন্য আমি কি আর সে নই?
আমি কি তবে অন্য কেউ হয়ে গেছি? নিজের কাছে এক আগন্তুক?
আমি কি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি নিজের থেকে?
এক কুস্তিগীরের মতন যে সহসা নিজেকেই পরাস্ত করেছে?
নিজেরই শক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম ঠেলে চলেছে,
এবং দমে যাচ্ছে নিজেরই বিজয়ের ক্ষতে?
যেখানে বায়ুর প্রবাহ প্রবলতম, আমি খুঁজেছি সেখানে!
আমি বাঁচতে শিখেছি
বিরান শীতলভূমিতে, যেখানে নেই কারও বসবাস,
ভুলে গেছি মানুষ ও ঈশ্বর, অভিশাপ ও প্রার্থনা!
প্রেতাত্মা হয়ে ভেসে বেড়িয়েছি হিমবাহের ওপর!
পুরনো বন্ধু আমার! দ্যাখো! তোমাদের দৃষ্টি এখন ফ্যাকাশে,
ভালোবাসা আর ভয়ে ভরা!
না, চলে যাও! রেগো না! এটা তোমাদের জায়গা নয়:
বরফ ও পাথরের মধ্যিখানের সবচেয়ে দুর্গম এই অঞ্চলে
বাঁচতে হলে চাই শিকারী কৃষ্ণসার হরিণের মত ক্ষিপ্রতা।
আমি এক ক্রূর শিকারীতে পরিণত হয়েছি! দ্যাখো কত গভীরে প্রসারিত হয় আমার ধনুক!
এহেন টান দিয়েছিল সর্বশক্তিমান পুরুষ!
তোমাদেরই দুর্ভাগ্য! এই তীরটি মারাত্মক–
অন্য কোনো তীরের মত না–বহুদূর দেশের!
তোমাদের ভালোর জন্যই!...
মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো তবে তোমরা? হে হৃদয়, যথেষ্ট ছলনা করো তুমি!
তোমার আশা যদিও ছিল অটল:
এখন নতুন বন্ধুদের জন্য মনের দরজা খোলা রেখো,
পুরনোদের যেতে দাও, চলে যাক স্মৃতিরাও!
একদা তুমি তরুণ ছিলে–আর এখন, আরও তরুণ!
কী তবে বেঁধে রেখেছে আমাদের, আশার এক বন্ধন
যে পাঠোদ্ধার করে নেয়
প্রেমের খোদাই করা ক্ষতচিহ্নের–যা আজও ম্লান?
আমি এর তুলনা করি সেই বিবর্ণ, পুড়ে যাওয়া খামের সাথে
যা ছোঁয়ার সাহস করেনি এই হাত!
আর কোনো বন্ধু না–তারা...কিন্তু কীভাবে তাদের নাম দেবো আমি?
কেবল কিছু বন্ধুসুলভ প্রেতাত্মা!
যারা রোজ মাঝরাতে জানালায় ও অন্তরে কড়া নাড়ে আমার খোঁজে!
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, "আমরা কি তোমার বন্ধু নই?"
–হে কুঞ্চিত ধরণী, একদা তুমিও ছিলে গোলাপের মত সুরভিত!
ও তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষা–যে নিজেকেই ভুল বোঝে!
যাদের প্রতি ছিল আকুলতা,
ভেবেছি যারা পরিণত হয়েছে আমার নিজ আত্মীয়ে,
তারাই পড়েছে জরার কবলে, নির্বাসিত করেছে নিজেদের।
ক্রমাগত যারা বদলায় তারাই থাকে কেবল আমার সান্নিধ্যে।
ও জীবনের মধ্যাহ্ন! তারুণ্যের এক দ্বিতীয় প্রহর!
ওহ গ্রীষ্মের পুষ্পকুঞ্জ!
অধীর আনন্দ–দাঁড়িয়ে থাকায়, তাকিয়ে থাকায়, প্রতীক্ষায়!
আমি বন্ধুদের অপেক্ষায় থাকি দিবানিশি!
ওগো বন্ধুগণ, কোথায় তোমরা? আসো! সময় হয়েছে! এখনই তো সময়!
থেমে গেছে সব গান–আমার ব্যাকুল কামনার মিষ্টি আর্তনাদ আমারই মুখে নিহত:
এক যাদুকর করেছে এসব, সুসময়ের এক বন্ধু,
মধ্যাহ্নের এক বন্ধু–না! জিজ্ঞেস করো না সে কে–
তখন তো ছিল মধ্যাহ্ন যখন এক হলো দুই....
এখন বিজয়ের নিশ্চয়তায় আমরা উল্লাস করি, একসাথে,
সর্বোত্তম ভোজনোৎসব:
বন্ধু জরাথুস্ত্র এসেছিল, শ্রেষ্ঠতম অতিথি!
এখন পুরো দুনিয়া হাসে, ভীতির পর্দা উন্মোচিত,
অন্ধকার ও আলোর পরিণয়ে...
* কবিতাটা নিৎশের 'Beyond Good And Evil' হতে নেয়া এবং কবিতাটার আসল নাম 'Aftersong'।
লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন