চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে কিংবা ঘোরগ্রস্ত জাদুর জগতে ডুব দেবার ফাঁদ


বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে কিংবা ঘোরগ্রস্ত জাদুর জগতে ডুব দেবার ফাঁদ
মিলু হাসান 


এ শাদামাটা, ক্লান্তিকর, নশ্বর জীবনে কিছু জিনিশ আবিষ্কার করার পর মনে হয় জীবন বুঝি প্রাচুর্যতায় ভরে গেলো, জীবনকে বুঝি আরো কতভাবেই দেখা যায়; জীবন কতই না সুন্দর, 'আহা! যদি আগে তাকে জানতাম, আগে চিনতাম ' কতই না আনন্দ হতো, জীবনের ঘুটঘুটে আবেদনময়ী রহস্যময় আঁধারের কুচি আস্তে আস্তে উন্মোচন করতে পারতাম, এরকম হররোজ আফসোস হতো যখন আমি কলেজে পড়ার অক্তে একটা দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্রে পহেলা আবিষ্কার করি  গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে। ওই ক্রোড়পত্র ছাপার দিনটা ছিলো উনার ইন্তেকাল করার পরপরেই ঘটনা। পত্রিকায় উনার দুটি গল্পের তরজমা ছাপা হয়েছিলো, ওই দুটি গল্প পড়ার পরের অনুভূতি এখনো সঞ্চারিত হয় মনে ও মগজে। কিরূপ আন্দোলিত হয়েছিলাম অনেকটা একটা পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেরকম আন্দোলিত হতে থাকে পুকুরের পাড় আর ভাবছিলাম কি বিচিত্র আর অদ্ভুত সব কথাবার্তা গল্পে লেখা। (যেরকম গল্পে ছিলো —এক মহিলা নিজের কবর নিজে খোদাই করতাছে, খোদাই শেষ হলে উনার মউত এলো, তিনি আপসে করে কবরে শুয়ে পড়লেন ।) কেমনে লেখে লোকটা, তার হাতটা যদি ধরতে পারতাম, পরক্ষণেই স্মরণ হয় —আহারে! লোকটা তো দুনিয়াতে নাই। আর উনার মরণের বিনিময়ে পত্রিকার নিউজ মারফত কলম্বিয়ার মার্কেজ পৌঁছাইলো মফস্বলের এক কলেজ পড়ুয়া আমার  নিকট। সাধারণত একজন লেখকের প্রতি আমার মোহ বেশিদিন থাকে না, চলে যায় ক্রমশ; নয়া নয়া আলো আবিষ্কারের দুনিয়ায় ম্লান হয়ে  যায় অতীত হয়ে যাওয়া কিছু আলো। কিছু থাকে কলবে, সিলগালা করে—সজীব ও টসটসে; মার্কেজ সেরকমই একজন।

কলেজে পড়ার অক্তে আমার বন্ধু রোহানকে পরামিশ দেই কিছু বই খরিদ করতে, তন্মধ্যে একটা ছিলো গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ১-২৮ বছর বয়সের আত্মজীবনী 'Living to tell to tale ' এর তপন শাহেদের তরজমা ' বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে '। আর ততদিনে পড়া হয়ে গেছে মার্কেজের কিছু নভেল ও নভেলা। যতই পড়ছি ততই আগ্রহ বেড়েই চলছে ব্যক্তি মার্কেজের প্রতি। বিচ্ছিন্নভাবে এ বইটির বিভিন্ন সিপারা পড়তে পড়তে বছর ছয়েক চলে যায়।করোনার লকডাউনে ৪০০ পৃষ্ঠার বইটার প্রথম থেকে শেষ অবধি পড়ার নিয়ত করি, যা পুরা করতে পারছি —শুকরিয়া। 

আমি সাধারণত সাক্ষাৎকার ও আত্মজীবনী পড়তে ভালো পাই। সাক্ষাৎকারে স্বল্পে লেখককে পাওয়া যায় আর সবিস্তারে আত্মজীবনীতে। সাধারণত কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ থেকে একটা লোক লেখক ও শিল্পী হয়ে উঠলো সে মেটামরফসিসের একটি দীর্ঘ জার্নির তিল তিল করে গড়ে উঠার প্রক্রিয়া পরতে পরতে থাকে অটোবায়োগ্রাফিতে।

'শয়তান লেখে ফেরেশতার আত্মজীবনী ' এরকম মিথ চালু হওয়া দুনিয়ার ভিতরে  মার্কেজের আত্মজীবনী সেখানে একটা বড় ধাক্কা,  নিজের জীবন ও সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিবিধ ঘটনার তথ্যের বয়ানে গাবো সর্বোচ্চ সৎ ও নিঁখুত থাকার চেষ্টা করেছেন, সেখানে তার কোনো  কমজোরি নজরে আসেনি। তার একটা উদাহরণ পেশ করছি: কলা কোম্পানির কলাশ্রমিকদের উপর চালানো গণহত্যায় শহীদের সংখ্যার ব্যাপারটা গাবো যেভাবে বইয়ে খুব সতর্কতার সাথে উল্লেখ করেছেন — 

"আমার মার ভাষ্যে সংখ্যাটা এতো ছোট্ট এবং ঘটনাটা আমার কল্পিত সেই জমকালো নাটকের পক্ষে এতো মর্যাদাহানিকর যে, আমার একটা হতাশার অনুভব হয়েছিলো। পরে আমি বেঁচে-যাওয়া লোকজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেছি এবং পুরনো খবরের কাগজ ও দাপ্তরিক নথিপত্র ঘেঁটেছি। তাতে আমি বুঝতে পেরেছি যে, সত্যিটা কোথাও নেই। সাধারণ লোকেরা বলতো, আসলে কেউ মরেনি। অন্য মতের লোকেরা দৃঢ়তার সাথে নির্দ্বিধায় বলতো, শতাধিক লোক মারা গিয়েছিলো। তাদেরকে তারা চত্বরের ওপর রক্ত ঝরতে ঝরতে মরে যেতে দেখেছে এবং তারপর একটা মালগাড়িতে নষ্ট কলার মতো সমুদ্রে ছুড়ে ফেলতে দেখেছে। এই দুই চরম ভাষ্যের মাঝখানের কোনো অসম্ভব স্থানে আমার নিজের ভাষ্য চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে।"

লেখালেখি করার ব্যাপারে মার্কেজ আম্মা বলেছিলেন —"হাজার হোক, ক্ষুধায় মরার এর চেয়ে ভালো উপায় আছে।" সে কথা যে একেবারে মিথ্যা এরকম না, বরং অনেকাংশে সত্য; ৪০ বছর অবধি বই লিখে ১ পয়সাও রয়ালিটি পাননি মার্কেজ। 

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, একজন ঔপন্যাসিকের রচিত অটোবায়োগ্রাফিও এক ধরনের ফিকশন। রাখঢাকের যে প্রচেষ্টা আত্মজীবনীতে লক্ষ করা যায়, সে প্রবণতা সেখানে নেই। স্বচ্ছন্দ্য ও স্বত্বঃস্ফূর্ত কিছিমের। বাদ পড়েনি নিজের যৌন জীবনের কথা, বেশ্যালয়ে গমন, পিতা ও মাতার রোমাঞ্চকর প্রেমের কাহিনী, সৎ বোনদের প্রেমের কাহিনী কিংবা মার্কেজের বাপের পরকীয়া  প্রেমের সম্পর্ক ও অন্য নারীর গর্ভে বাচ্চা উৎপাদনের কিসসা। বই থেকে একটা অংশ কোট করছি — 

"একদিন এই উদ্বেগ আমার আর সহ্য হলো না।... এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন রহস্যের মধ্যে আমরা বাস করছি আর বাড়ির পরিস্থিতিই বা কী। সে একটা আস্ত দীর্ঘশ্বাস গিলে ফেললো যাতে তার কন্ঠ না কাঁপে এবং সে আমার কাছে প্রাণ খুলে বললো:"আরেক মহিলার গর্ভে তোমার বাবার একটা ছেলে আছে।" মার কন্ঠে আমি যে ভারমুক্তি লক্ষ করলাম, তা থেকে আমি বুঝতে পারলাম, কী অস্থিরতা নিয়ে সে আমার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছিলো।"

গতানুগতিক আত্মজীবনীর মতোন মার্কেজের আত্মজীবনী শুরু হয়নি জন্ম, বংশের ফিরিস্তি দিয়ে এবং ধারাবাহিক কোন বর্ণনা নেই; বরং যখন যে ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন তার ফিরিস্তি দিয়েছেন নিজের নির্মিত মোহগ্রস্ত কাব্যিক বর্ণনায়, যে বর্ণনা অনেকটা এরকম যে একটি ঘটনা বলা শুরু করলে তার সাথে যোগসুত্র আছে এরকম অন্য ঘটনার বয়ান শুনাতে শুনাতে আপনি ভুলে যেতে বসেছেন প্রথম ঘটনাটি তখনি তিনি আবার আপনাকে টান দিয়ে প্রথম ঘটনার  বর্ণনার বাকিটুকু বলা আরম্ভ করেছেন। পুরো বই জুড়েই এ স্টাইলটি বজায় রেখেছেন। 

মার্কেজের আত্মজীবনীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘরের হাঁড়ির খবর থেকে শুরু করে তৎকালীন কলম্বিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস এ স্মৃতিকথার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে,সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে রাজনীতির সাথে সাংবাদিক মার্কেজের জীবনের গল্প। এতো বিস্তীর্ণ, নিঁখুত পর্যবেক্ষণমূলক লেখা  সম্ভব হয়েছে তরুণ বয়স থেকে পত্রিকার সাথে জীবিকা সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে আর সাংবাদিক হওয়ার কারণে দেশের প্রতিদিনকার রাজনৈতিক ঘটনাগুলি খুব সহজেই অবগত হওয়া গেছে এবং মার্কেজের প্রাত্যহিক জীবনকে দেখার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি ও নিঃসন্দেহে উনার প্রখর স্মৃতিশক্তির তারিফ না করলে কবিরা গোনাহ্ হবে এবং একইসাথে নিজের স্মৃতিও যে প্রতারণা করতে পারে তা উল্লেখ করা তো আউটস্ট্যান্ডিং। তৎকালীন কলম্বিয়ার যেসব রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বইয়ের সাথে লেপ্টে আছে:  কলা কোম্পানির মিথ্যা সমৃদ্ধির টোপ ও জনগণের দুর্গতি ও জীবনের উলটপালট, ধর্মঘটের কারণে কলা কোম্পানি কর্তৃক কলাশ্রমিক হত্যার ইতিহাস, আসন্ন নির্বাচনে তুমুল জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গাইতান হত্যা ও হত্যার পর দেশের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খল উত্তপ্ত সেইসব দিনের বর্ণনা, কনজারর্ভেটিভ পার্টির স্বৈরশাসক দ্বারা সংবাদপত্রে সেন্সরের করাতের নিচে সাংবাদিকদের জীবনের দুর্বিষহ ইতিহাস ও বেনামে কলাম লেখার দিনগুলি, সেইসাথে এতো সেন্সর কাচির ফাঁকফোকরে জাহাজডুবিতে নাবিক মৃত্যুর খবরে সরকারের ভুল তথ্যের বিপরীতে গাবোর সাংবাদিকতার মাধ্যমে সঠিক তথ্য বের করে আনার সেই উত্তেজনাভরা টান টান করা দিনের গল্প এবং সে  রিপোর্ট বের হওয়ার পর জানের ভয়ে পত্রিকা অফিস থেকে বার্সেলোনায় গাবোকে অফিসিয়াল ট্যুরে পাঠানো, গাবোর বাপের রাজনৈতিক দলের ভয়ের কারণে পরিবারসহ বাসস্থান ত্যাগ, কনজার্ভেটিভ পার্টির  প্রেসিডেন্টের ধূর্ত কৌশলের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী এবং লিবারেল ও কনজার্ভেটিভ নামক দুটি দলে বিভক্ত একটি রাজনৈতিক কলহপ্রিয় দেশের কথা, কোরীয় যুদ্ধ ফেরত সৈনিকের সাথে সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা ও নিকোলাস মার্কেজের পেনশন ইত্যাদি। এতোসব রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা পড়ে আপনার মনে পড়বে —ক্ষমতার অপব্যবহার কত ভয়াবহ ও নির্মম হতে পারে আর একটি রাজনৈতিক ঘটনা একটি দেশের মানুষের জীবনের চিত্র কেমন উলটপালট করে দিতে পারে, দেশে বয়ে আনতে পারে অন্ধকার তিমিসার রাত্রি। যেমন: লিবারেল নেতা গাইতান খুন হওয়ার পর সারা দেশে যে অরাজকতা ও খুনাখুনি তৈরি হয়েছেল তা ব্যাখ্যাতীত। ২ লক্ষ মানুষ এ খুনাখুনিতে মারা যায়। 

বইটির পুরো অংশ জুড়ে যে জিনিশটা এক মুহূর্ত নিস্তার পায়নি তার নাম দারিদ্র্যতা। বইটিতে আছে দারিদ্র্যতার সাথে  প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা মার্কেজের বিশাল বড় পরিবারের অজস্র গল্প আর মার্কেজের বোহেমিয়ান গরিবি জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনা আর উদ্দেশ্যহীন ও লক্ষ স্থির করতে না পারা দ্বিধাগ্রস্ত মার্কেজ যে শুধু লেখক হতেই চেয়েছে; এর বাহিরে একটি দিনের ভবিষ্যতের কথাও সে জানে না আর যে কোনোভাবে উৎযাপন করতে চেয়েছে জীবন —সেসব জীবনের গল্প। চরম দারিদ্র্যতার দিনে মার্কেজ আইন পড়া ছেড়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিলো পরিবার বিরুদ্ধী,কারণ মার্কেজ ছিলো এগারো ভাই-বোনের সংসারের বড় ছেলে, যার উপর পরিবার ভরসা করেছিলো আইনজীবী হয়ে তিনি পরিবারের হাল ধরবেন, কিন্তু তিনি বরং আইন পড়া  ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিলেন প্রথমে পত্রিকার ফিচার লেখক, পরে সাংবাদিকতা পেশাকে আর পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে গেলেন ।  লেখালেখি করার ব্যাপারে মার্কেজ আম্মা বলেছিলেন —"হাজার হোক, ক্ষুধায় মরার এর চেয়ে ভালো উপায় আছে।" সে কথা যে একেবারে মিথ্যা এরকম না, বরং অনেকাংশে সত্য; ৪০ বছর অবধি বই লিখে ১ পয়সাও রয়ালিটি পাননি মার্কেজ। 

যে কোনো লেখকের জন্য একজন বড় লেখকের জীবন থেকে অনেক তালিম নেয়ার আছে। মার্কেজের ম্যাজিক-রিয়েলিয়েজমে মুগ্ধ হওয়া পাঠক যখন এ আত্মজীবনী পড়তে যাবে সে দেখবে মার্কেজের নিজের জীবনের সাথেই  লেপ্টে আছে ম্যাজিক রিয়েলিজম। তিনি আসমান থেকে এ দিদার লাভ করেনি, বরং  রচয়িতার কৌশল ও কারিগরী দক্ষতা লক্ষ করা পাঠকী মন ও জীবন  থেকে টোকাইয়া নেওয়ার চুম্বকীয় ক্ষমতা তার সামনে নিমিষেই হাজির করেছে জাদু-বাস্তবতার গল্প । তাঁর লিখিত বইয়ের সমস্ত কিছুই তিনি জীবন থেকে দক্ষ মুন্সিয়ানায় লেখায় ব্যবহার করেছেন। মার্কেজ এ  বইতে লিখেছেন —"কারণ পৃথিবীতে কিংবা পরজন্মে এমন কিছু নেই যা লেখকের জন্য দরকারি নয়।" এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সুনিপুন কারিগরের মতোন কাজে লাগিয়েছে মার্কেজ। মার্কেজ কিভাবে বাস্তব জীবনের কাহিনীকে উপন্যাসে মিশিয়ে দিয়েছেন তার একটা উদাহরণ পেশ করছি : 

"খুনের ঘটনাটা নিজে আর আমার আগ্রহের বিষয় ছিলো না, বরং আমি ভাবছিলাম এর পিছনে যে সবাই দায়ী এটা সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে। যাই হোক, কোনো যুক্তিতেই আমার মাকে বোঝানো গেলো না, আর তার অনুমতি ছাড়া লিখলে সেটা তাকে অসম্মান জানানো হতো। কিন্তু তারপর থেকে একটা দিনের জন্যেও গল্পটা লেখার আকাঙ্ক্ষা আমাকে ছেড়ে যায়নি। অনেক বছর পর আমি তখন হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছি। একদিন আলজিয়ার্স বিমানবন্দরে প্লেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। প্রথম শ্রেণীর লাউঞ্জের দরজাটা খুলো গেলো এবং নিঁখুত একখানা দেশীয় আলখাল্লা পরা এক আরব রাজপুত্র ঢুকল। তার মুঠোর ওপর একটা বিরাট শিকারী মেয়ে বাজপাখি বসা।... অবধারিতভাবে আমার কায়েতানো জেনতিল এর কথা মনে পড়লো, যে তার বাবার কাছ থেকে বাজ-প্রশিক্ষণের বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলো ;...বাস্তব জীবনের একটা চরিত্রকে উপন্যাসের চরিত্রে রূপ দেওয়া নিয়ে দ্য প্যারিস রিভিউ-এ প্রকাশিত জর্জ প্লিম্পটনের নেওয়া আর্নেস্ট হেমিংয়ের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটা সম্বন্ধে আমি জানতাম। হেমিংওয়ে বলেছিলেন : "কখনও কখনও সেটা কীভাবে করা হয় আমি যদি সেটা ব্যাখ্যা করে বলতাম তাহলে সেটা অপরাধ আইনজীবীর হ্যান্ডবুক হতো। "কিন্তু আলজিয়ার্সের সেই অলৌকিক সকালের পর আমার অবস্থা দাঁড়ালো ঠিক উল্টো; কায়েতানোর মৃত্যুর কাহিনী না লিখে শান্তিতে জীবন যাপন করার কোনও ইচ্ছা আমার আর রইলো না।..ঘটনার ত্রিশ বছর পর বার্সেলোনায় সে (মার্কেজের মা) নিজেই আমাকে ডেকে দুঃসংবাদ দিলো যে, কায়েতানোর মা হুলিয়েতা চিমেন্তো মারা গেছেন; ছেলের মৃত্যুশোক তাঁকে একদিনের জন্যেও শান্তি দেয়নি। প্রবল নীতিবোধসম্পন্ন আমার মার কাছে এখন আর্টিকেলটার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আর কোনও কারণ রইলো না।... কাহিনীটা ' পূর্ববর্ণিত এক মৃত্যুর ঘটনাপঞ্জি' নামে প্রকাশিত হয় দুই বছর পরে। আমার মা সেটা পড়লো না। কারণ হিসেবে সে যে কথাটা বললো সেটা আমি আমার নিজস্ব জাদুঘরে তার আরেকটা মূল্যবান রত্নের মতো রেখে দিয়েছি :"জীবনে যার পরিণতি এতো করুণ হয়েছে, বইয়ে তা ভালো পরিণতি আনতে পারে না। " "

মার্কেজের ২৮ বছরে জীবনের এ আত্মজীবনী বইটা যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের এমন মিশেল কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব নির্ণেয় করা কঠিনই। লাতিন এমেরিকার জীবনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবনের যে কি মিল পড়তে পড়তে আপনি তা আবিষ্কার করতে পারবেন। পড়বেন আর ভাববেন আয় হায়! এ তো আমার জীবন, আমার চারোপাশের জীবনের গল্প আর আমাদের বাঙলাদেশের ইতিহাসের সাথে কত প্রাসঙ্গিক। আশেপাশের ঘটনার সাথে মিল পেয়ে চমকে উঠবেন, হয়তো হুবহু মিল খোঁজা হাস্যকর কিন্তু আমাদের জীবনের সাথে বইটি খুবই প্রাসঙ্গিক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। জাস্ট কয়েকটা উদাহরণ দেই : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আতশবাজি ফুটিয়ে সাধারণ জনগণের ঘর পুড়ে ফেলা,ক্ষমতায় থাকা শাসকের ক্ষমতার মেয়াদ ফুরাবার আগে চতুর কৌশলের মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানিয়ে আবার স্বৈরশাসকের ক্ষমতা দখল, কলা কোম্পানি স্থানীয় জনগণকে মিথ্যা উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির লোভ দেখিয়ে জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত করা, সেন্সরের কাচির নিচে সংবাদপত্রের মরণ, গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের গল্প,যৌথ পরিবারের দারিদ্রতার সাথে সংগ্রামের গল্প ইত্যাদি। 

একজন বড় লেখক হওয়ার পিছনে যে কত মানুষের অবদান থাকে তা গুণে শেষ করা মুশকিল। মার্কেজের জীবনও এর ব্যতিক্রম না। আমার মনে পড়ছে এ মুহূর্তে  তাঁর  বন্ধু আলভারো সেপেদার মতোন নির্মম সমালোচক বন্ধুর প্রয়োজনীয়তার কথা , যে মার্কেজের লেখা পড়ে বলছিলো —"ওটা এক টুকরা পায়খানা" আর  পণ্ডিত দন রামোন যাঁর নাম মার্কেজের যুবক বয়স হওয়ার আগে থেকেই কলম্বিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়াতে স্থান করে  নিয়েছে, তাঁর চারোপাশে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতোন তাঁর কথা  থেকে সংগ্রহ করতেন জ্ঞান ও শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যবান বক্তব্য  আর পরামিশ নিতেন লেখালেখির ব্যাপারে তাঁর কথা মনে পড়ছে, কিংবা সর্বোচ্চ সস্তায় থাকার যাওয়া পাওয়া বেশ্যালয়ের সেই বদ্ধ ঘর যেখানে গরমে টিকে থাকা ছিলো অনেক কষ্টকর, সেখানে রাত জেগে উইলিয়াম আইরিশের বই পড়া মার্কেজের কথা আর ভাড়া না দিতে পারায় গভীর রাতে লুকিয়ে বেশ্যালয়ে  ঘরে ঢুকতে দেয়ার জন্য দয়ালু সে দারোয়ানের কথা । মার্কেজের সেই চোর বন্ধুর কথা আমার মনে পড়ছে যে সন্ধ্যায় সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতো সকলের সাথে, রাত গভীর হলে চুরি করতে যেতো আর গোপনে লিখতো প্রেমের কবিতা আর মনে পড়ছে সংবাদপত্রের সেই অফিসগুলির কথা যেখানে রাত জেগে টাইপরাইটারে লিখতেন গাবো। আমার মনে পড়ছে, পাসকিন নামক স্থানীয় সেই সংবাদপত্রের কথা যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের রাতের ঘুম হারাম হতো,কারণ সেখানে ভদ্রলোকের বউয়ের সাথে কার পরকীয়া, ভদ্রলোকদের মেয়ের সাথে কার ছেলে প্রেম করে ইত্যাদি গোপন খবর প্রকাশিত হতো যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে এলাকা গরম করতো আর ইজ্জত যেতো স্থানীয় বাসিন্দাদের, পাসকিন দ্বারা ইজ্জত লুটার ভয়ে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়েও চলে যায়। আমার আরো মনে পড়ছে, অভাবে ভেঙ্গে না পড়া মার্কেজের মায়ের কথা, যে  এরকম বলেছিলো —"বাচ্চাদের খাবারের জন্য চুরি করা যেন পাপ না হয়, ঈশ্বরের এ নিয়ম করা উচিত।" আমার আরো মনে পড়ছে, সেই ব্রিফকেসের কথা যা মার্কেজকে কোনো এক বন্ধু দিয়েছিলো কোনোদিন নিদারুণ অভাবে পড়লে বিক্রি করতে, যার ভিতর সে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিশ রেখে  থাকার জায়গা না থাকলে বাড়ি থেকে দূর শহরে থাকা মার্কেজ ব্রিফকেস মাথার নিচে দিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকতেন কিংবা সেই বন্ধুদের কথা যাঁরা বেশ্যালয়ে গিয়ে সঙ্গম করা বাদ দিয়ে সারা রাত সাহিত্য নিয়ে আড্ডা আর তর্ক-বিতর্ক করতে করতে শেষ করে ফেলেছে রাত কিংবা বেশ্যালয়ের ফুটপাতে থাকা সেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর কথা যে মার্কেজের গল্পের জন্য ফ্রি ছবি এঁকে দিয়েছিলো। কিংবা মার্টিন ফনসেকার নামক সেই বিবাহিত  নারীর কথা যে মার্কেজের যৌবনে যৌনসঙ্গী হয়ে প্রভাবিত করেছিলো তাঁর জীবন আর তাকে দিয়েছিলো অসীম বেদনা। কমিউনিস্ট পার্টির ফেরারী ও আত্মগোপন করা সেই নেতার কথা যে দোলনাতে তার মেয়েকে  দোল খাওয়াতে খাওয়াতে গাবোর সাথে কথা বলছিলো অথচ সারা দেশের সমস্ত পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। মার্কেজকে বই ধার দেয়া হরিহর আত্মার বন্ধুদের কথা, যাঁরা তাকে পড়তে ধার দিয়েছিলো কাফকা, ফকনার ও জয়েসের উপন্যাস  অথবা ইউলিসিস ছদ্মনামে লেখা পত্রিকার সম্পাদক এদুয়ার্দো সালামিয়ার কথা যে পত্রিকায় ২২ বছর বয়সী মার্কেজের একটা গল্পের নিচে একটা মন্তব্যের লাইন লিখলো, এরকম—" গার্সিয়া মার্কেজের মধ্য দিয়ে একজন নতুন ও উল্লেখযোগ্য লেখকের জন্ম হয়েছে", যা মার্কেজকে উস্কে দিয়েছে লেখালেখির দিকে কিংবা বার বার সংশোধন করে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরির পর অসন্তুষ্ট অতৃপ্ত মার্কেজের কথা, যে একটি বিরামচিহ্ন বা শব্দ নিয়েও সতর্ক থাকতো! আমার মনে পড়ছে মার্কেজের বাপ-মার হাত খরচের টাকা পাঠাতে দেরি হলে টেলিগ্রাম অফিসের সারিতা কষ্টের-বর্ণনায়-ভরা টেলিগ্রাম বাকিতে করে দিতো ও একাধিকবার তাকে অগ্রিম মানি অর্ডারের টাকা দিয়েছিলো, মার্কেজ লিখেছেন —"...সারিতাকে কখনো ভুলব না।"আমার আরো মনে পড়ছে চির অতৃপ্ত পাঠক ড. আদোলফো গোমেস তামারার কথা যিনি অপরিচিত  মার্কেজকে দস্তয়েভস্কির 'দ্য ডাবল' বইটি উপহার দিয়েছিলেন কিংবা মনে পড়ছে বোগাতার উদ্দেশ্য রওনা করা সেই দীর্ঘদিনের ক্লান্তিকর লঞ্চ ভ্রমণের কথা, যার প্রত্যেকটা যাত্রা মার্কেজকে দিয়েছে মূল্যবান শিক্ষা। 

নিঃসন্দেহে, 'বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে ' একজন তরুণ লেখকের কাছে একটা বাইবেল আর সাধারণ পাঠকের কাছে ঘোরগ্রস্ত জাদুর জগতে ডুব দেবার উপযুক্ত ফাঁদ!

ঋণস্বীকার : উদ্ধৃতিচিহ্নের ভিতর আবদ্ধ বাক্যগুলি নেয়া হয়েছে 'বেঁচে আছি গল্পটা বলবো বলে ',যার অনুবাদক তপন শাহেদ।

নোট : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ডাক নাম গাবো।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই