চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আবিষ্কারক



আবিষ্কারক 

মূল লেখক : পিটার বিকশেল 

ইংরেজি অনুবাদক : মাইকেল হামবার্গার

বাংলা অনুবাদক : মিলু হাসান 


আবিষ্কারক হওয়া এমন একটা পেশা যা কারো পক্ষে শিখে নেয়া সম্ভব না, আর এ কারণেই আবিষ্কারকরা দুর্লভ। আজকাল আর কোনো কিছুই আবিষ্কারকদের আবিষ্কার করতে হয় না, সব জিনিস এখন বানায় ইঞ্জিনিয়ার-টেকনিশিয়ানরা, মেশিন, কাঠমিস্ত্রী, স্থপতি, নির্মাতারা; কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো কিছু আবিষ্কার করে না। 

এককালে আবিষ্কারকরা ছিলেন। তাঁদের একজনের নাম এডিসন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বাল্ব ও গ্রামোফোন —তখন অবশ্য ফোনোগ্রাফ বলা হতো, তিনি মাইক্রোফোন আবিষ্কার করেছিলেন আর তৈয়ার করেছিলেন দুনিয়ার প্রথম বিদ্যুৎ, তিনি আরো তৈয়ার করেছিলেন সিনেমাটোগ্রাফ আর পর্দায় ছবি ফেলবার যন্ত্র।

তিনি ইন্তেকাল ফরমান ১৯৩১ সনে। 

তিনি না থাকলে আমরা বৈদ্যুতিক বাল্ব পেতাম না। এতেই টের পাওয়া যায় আবিষ্কারকরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আবিষ্কারকদের সর্বশেষ জন ইন্তেকাল ফরমান ১৯৩১ সনে। সত্যি যে আরেকজন পয়দা হয়েছেন ১৮৯০ সনে, তিনি তখনো বেঁচে ছিলেন। কেউ তার সম্পর্কে জানে না, কারণ তিনি যে সময়ে বেঁচে ছিলেন তখন আবিষ্কারকদের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। ১৯৩১ সন থেকে তিনি একা বেঁচে থাকেন। তিনি নিজেও জানেন না, কারণ তখনও তিনি এ শহরে বসবাস করতেন না আর লোকদের সঙ্গে মিশতেন না; কারণ আবিষ্কারকদের যেটা খুব বেশি প্রয়োজন তা হলো শান্তি। তিনি থাকতেন শহর থেকে দূরে, কখনো বাড়ি থেকে বেরুতেন না আর কদাচিৎ কেউ তাকে দেখতে আসতো। 

তিনি সারাদিন হিসাব-নিকাশ কষতেন আর আঁকাআঁকি করতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন, কপালে ভাঁজ পড়তো, বার বার তার মুখে হাত বুলাতেন আর ভাবতেন। তারপর তিনি তার হিসাব-নিকাশ ছিঁড়ে ফেলতেন, ছেঁড়া কাগজগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতেন,ছেঁড়া কাগজগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতেন, আর একেবারে প্রথম থেকে আবার আরম্ভ করতেন আর সন্ধ্যাবেলা তিনি গোমড়ামুখো  হয়ে থাকতেন, মন-মেজাজ বিগড়ে থাকতো, কারণ আবারও, যেমন ভেবেছিলেন কাজ সেরকম করে আগায় নি। 

তিনি জানতেনও না লোকে এভাবে কথাবার্তা শুরু করে —কটা বাজে, দয়া করে বলবেন ?  অথবা  —আজকের আবহাওয়াটা ভালো মনে হচ্ছে না। এটা একবারও তার মাথায় এলো না, কেউ সরাসরি বলতে পারে না —এই যে শুনুন, আমি একটা কিছু আবিষ্কার করেছি। বাসে যখন কেউ একজন তাকে বললো —চমৎকার আবহাওয়া যাচ্ছে ক'দিন ধরে, তার জবাবে সে বললো না —হ্যাঁ, চমৎকার আবহাওয়া,তা না বলে বরং বলেছিলেন —এই যে শুনুন, আমি একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করেছি। তিনি আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছিলেন না, কারণ তার আবিষ্কারটি ছিলো বিরাট আলিশান ব্যাপার, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অসাধারণ কিছু। 

তিনি হাজারো খুঁজে একজনকেও পান নাই যে তার নকশাটা বুঝে, কাজেই লোকজনের সাথে কথা বলার মতোন কিছু ছিলো না। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ কাজে মজে আছেন, যখন কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসে তিনি তার নোটগুলি (নকশা, হিসাবপত্র) লুকিয়ে ফেলেন, কারণ তিনি ভয়ে থাকেন তারা যদি কেউ কপি করে নিয়ে যায় আবার এ আশঙ্কায়ও থাকেন যে লোকজন হয়তো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। 

তিনি তাড়াতাড়ি বিছানায় ঘুমোতে যেতেন, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতেন আর সারাদিন কাজ করতেন।

তার কাছে কোনো চিঠি-পত্র আসতো না, তিনি কোনো খবরের কাগজ পড়তেন না আর তিনি জানতেনও না রেডিও বলে কিছু একটা আছে। 

অনেক বছর পর এমন এক সন্ধ্যা আসলো যখন তার মন-মেজাজ খারাপ নেই, তিনি তাঁর আবিষ্কারটি আবিষ্কার করেছেন আর এবার তিনি শুতে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন। রাত-দিন তিনি তার সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন,সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন; না, এবার আর কোনো ভুল নেই, তার হিসাব-নিকাশ সঠিক। 

তারপর তিনি তার সব কাগজপত্র গুচ্ছায়া-গাছায়া অনেক বছর পর প্রথম শহরে এলেন৷ শহরটা পুরাপুরি বদলে গেছে৷ যেখানে ঘোড়া ছিলো এখন সেখানে মোটর যান, এক বড় শপিংমলে এস্কেলেটর, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ট্রেন এখন আর নেই। এখন রাস্তায় চালিত গাড়িগুলি মাটির তলে দিয়ে যায় -কী কী যেন ভিন্ন ভিন্ন নাম তাদের, লোকের হাতে ছোট্ট -ছোট্ট বাক্স থেকে বেরিয়ে আসছে গান। 

আবিষ্কারক তো পুরাই তাজ্জব। কিন্তু তিনি তো আবিষ্কারক তাই এসব ব্যাপার বুঝতে উনার বেশি সময় লাগলো না। তিনি রেফ্রিজারেটর দেখলেন আর বললেন —অ, বুঝচ্ছি। 

তিনি টেলিফোন দেখলেন আর বললেন —অ, বুঝচ্ছি। আর যখন তিনি লাল আর সবুজ বাতি দেখলেন তিনি বুঝতে পারলেন যে লাল বাতি মানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে আর সবুজ বাতি মানে এবার রাস্তা পার হয়ে যাওয়া যায়। 

আর তিনি যখন দেখলেন লাল বাতি জ্বালানো তিনি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন আর যখন সবুজ বাতি জ্বললো তিনি রাস্তা পার হলেন। 

আর তিনি সবকিছু বুঝতে পেরে একেবারেই অবাক, এতোটাই অবাক হলেন যে নিজের আবিষ্কারটি প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলেন। যখন তার আবিষ্কারটির কথা মনে পড়লো, তখন তিনি সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায় থাকা এক লোককে বললেন —এক্সকিউজ মি, জনাব, আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। লোকটি ছিলো বন্ধুভাবাপন্ন, লোকটি বললো —তা এটা দিয়ে আপনি কি করবেন ? 

আর আবিষ্কারক সে সম্পর্কে কিছু ভাবেন নি। আবিষ্কারক বললেন —বুঝলেন, আবিষ্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঠিক তখন লাল বাতির বদলে সবুজ বাতি জ্বললো আর তারা রাস্তা পার হলো। 

কিন্তু কেউ যখন দীর্ঘকাল শহরে আসে নি, শহরের আও-বাও সে বুঝবে কী করে, বিশেষত যখন কেউ একটা কিছু আবিষ্কার করেছে অথচ সে জানে না সেটা নিয়ে কোথায় যাবে। আবিষ্কারক যে সকল লোকদেরকে বলবেন —'আমি একটা কিছু আবিষ্কার করেছি ', তাদের তাঁকে কি বলা উচিত ? 

অধিকাংশ লোকই কিছু বললো না, কেউ কেউ আবিষ্কারককে নিয়ে হাসি-তামাশা করলো, আর কিছু লোক এমন ভান করে হেঁটে চলে গেলো যেন তারা শুনতেই পায় নি। যেহেতু, আবিষ্কারক দীর্ঘকাল লোকজনের সাথে কথা বলে নি, সেজন্য সে বুঝতেই পারছিলো না কিভাবে কারো সাথে কথাবার্তা  শুরু করতে হয়। 

তিনি জানতেনও না লোকে এভাবে কথাবার্তা শুরু করে —কটা বাজে, দয়া করে বলবেন ?  অথবা  —আজকের আবহাওয়াটা ভালো মনে হচ্ছে না। এটা একবারও তার মাথায় এলো না, কেউ সরাসরি বলতে পারে না —এই যে শুনুন, আমি একটা কিছু আবিষ্কার করেছি। বাসে যখন কেউ একজন তাকে বললো —চমৎকার আবহাওয়া যাচ্ছে ক'দিন ধরে, তার জবাবে সে বললো না —হ্যাঁ, চমৎকার আবহাওয়া,তা না বলে বরং বলেছিলেন —এই যে শুনুন, আমি একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করেছি। তিনি আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছিলেন না, কারণ তার আবিষ্কারটি ছিলো বিরাট আলিশান ব্যাপার, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অসাধারণ কিছু। 

যদি তিনি তার হিসাব-নিকাষ ঠিকঠাক কাজ করে কী না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুনিশ্চিত না হতেন আবিষ্কারটি তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারতেন না। 

তিনি এমন একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে অনেক দূরে ঘটতে থাকা জিনিসও দেখা যায়। তিনি বাসের মধ্যে নিজের সিট ছেড়ে উঠে এসে তার সমস্ত কাগজপত্র বাসের মেঝেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন যা যাত্রীদের পায়ের কাছে এসে পড়লো আর চেঁচিয়ে বললেন —এই যে দ্যাখেন, আপনেরা, আমি একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করেছি। যার মাধ্যমে আপনারা অনেক দূরে ঘটছে এমন কিছুও দেখতে পারবেন। 

কেউ একজন উচ্চস্বরে বললো —তিনি টিভি আবিষ্কার করেছেন। আর প্রত্যেকে হাসাহাসি শুরু করে দিলো। তিনি যাত্রীদের সওয়াল করলেন —হাসছেন কেন ?  কিন্তু কেউ কোনো জবাব দিলো না। তিনি বাস থেকে নেমে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন, যখন লাল বাতি জ্বলা দেখলেন থামলেন আর যখন সবুজ বাতি জ্বলা দেখলেন রাস্তা পার হলেন, আর একটা রেঁস্তোরায় গিয়ে বসলেন, কফি অর্ডার করলেন আর যখন তাকে পাশের লোকটি বললো —চমৎকার আবহাওয়া, তখন আবিষ্কারক বললেন —প্লিজ, আমাকে হেল্প করেন, আমি টেলিভিশন আবিষ্কার করেছি, কেউ বিশ্বাস করছে না। সবাই হাসি-তামাশা করছে আমাকে নিয়ে। এ কথা শুনে লোকটি আর টুঁ শব্দটিও করলো না, একটা কথাও বললো না৷ তিনি অনেকক্ষণ ধরে আবিষ্কারকের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর যখন আবিষ্কারক সওয়াল করলো —লোকজন মশকরা করছে কেন ?  লোকটি বললো —তারা মশকরা করে, কারণ অনেকদিন ধরেই আমরা টেলিভিশন দেখতাছি, এটা আর আবিষ্কার করার দরকার নাই। এটা বলে লোকটি রেঁস্তোরার কোণায় আঙুল দিয়ে দেখালো, যেখানে একটা টেলিভিশন রয়েছে আর জিজ্ঞাসা করলো —চালাতে বলবো ? 

কিন্তু আবিষ্কারক বললেন —না, আমি এটি দেখতে চাই না। সে রেঁস্তোরা থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লো। তাঁর সব কাগজপত্র তিনি পিছনে রেখে আসলেন। তিনি পুরো শহরটা হেঁটে বেড়ালেন, লাল-সবুজ বাতির তোয়াক্কা না করে হাঁটতে থাকলেন, যে কারণে গাড়ির ড্রাইভাররা তাকে যা-তা গালি দিলো আর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বোঝালো লোকটার মাথার বুঝি স্ক্রু ঢিলা। 

আবিষ্কারক আর কখনো শহরে যান নি। তিনি বাড়ি চলে গেলেন আর এখন থেকে কেবল নিজের জন্য সবকিছু আবিষ্কার করতে লাগলেন। তিনি এক টুকরা কাগজ নিলেন তাতে লিখলেন 'মোটর গাড়ি ',মাসের পর মাস হিসাব-নিকাশ করলেন, নকশা আঁকলেন, মাপজোপ করলেন, আর নিজেই নিজের জন্য আবিষ্কার করলেন —মোটর গাড়ি আর এভাবে আবিষ্কার করলেন এস্কালেটর/চলন্ত সিঁড়ি, আবিষ্কার করলেন টেলিফোন আর আবিষ্কার করলেন রেফ্রিজারেটর। শহরে যা কিছু তিনি দেখেছিলেন সব কিছু তিনি আবার আবিষ্কার করলেন৷ 

আর প্রত্যেক বার যখন তিনি একটা কিছু আবিষ্কার করেন ততবারই তিনি তার সমস্ত কাগজপত্র-নকশা-হিসাব-নিকাশ কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন আর বলেন —অনেক দিন ধইরাই এ জিনিশ আমাদের ছিলো। 

তবুও সারা জীবন ধরে তিনি ছিলেন সাচ্চা আবিষ্কারক কারণ যে জিনিশ আবিষ্কার হয়ে গেছে তা আবার আবিষ্কার করাও কঠিন কাজ আর একমাত্র আবিষ্কারকরাই তা আবিষ্কার করতে পারেন।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই