চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

মুসলিম বিশ্বে বই ও পাঠাভ্যাস: একটি মারাত্মক সংকট



মুসলিম বিশ্বে বই ও পাঠাভ্যাস: একটি মারাত্মক সংকট

মূল: হাতেম বাজিয়ান

অনুবাদ: তুহিন খান 

কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দটি ছিলো একটি অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়া—'পড়'; এবং প্রথমদিকের আরও কয়েকটি আয়াতে একাধিকবার এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের মতে মানুশের জন্য সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ঐশীবাণী আল কুরআনের প্রথম আদেশটিতেই, ধর্ম পর্যন্ত পৌঁছা, এর সাথে যুক্ত হওয়া, একে জানা ও বোঝার মূল ভিত্তি ও পন্থা হিশেবে, পাঠকেন্দ্রিকতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাঠই জ্ঞানার্জন এবং স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকে ভালোভাবে বোঝার চাবিকাঠি। এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, 'কুরআন' শব্দটিও একই শব্দমূল থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ: 'পড়া', 'বারবার পড়া' বা 'আবৃত্তি করা'। সুতরাং, ইসলামের সঠিক বোঝাবুঝিতেও পাঠ-ই একটা আলাদা এবাদত।

কুরআনের অন্যান্য নামগুলোর মধ্যে একটি হল 'আল কিতাব' বা 'বই'; যদি প্রথম অবতীর্ণ শব্দ 'পড়'-র অনুষঙ্গে বিচার করা হয়, দেখা যাবে যে: 'পড়' ক্রিয়াটা ইসলাম এবং মুসলিম বিশ্বের মূল জ্ঞানতাত্ত্বিক বুনিয়াদ; সকল প্রকার জ্ঞান অর্জন, সংরক্ষণ এবং আদান-প্রদানের একটি ঐশী নির্দেশ। বই হল জ্ঞান সংরক্ষণের উৎস, মৌলিক কেন্দ্রবিন্দু। বই মানবমনের সীমানাগুলোকে ক্রমাগত প্রসারিত করার একটি মাধ্যম, পাঠের সাথে যুক্ত থাকার মধ্য দিয়েই যা মূর্ত হয়ে ওঠে।

আমার বলার কথাটি হল— মুসলিম জনগণের ভয়াবহরকম বিপুল একটি অংশের মধ্যে, 'পড়া' একটি বিলুপ্ত শিল্পে পরিনত হয়েছে; এবং সব ধরনের বইয়ের সাহচার্য এখন একটি মৃতপ্রায় ব্যাপার। ফলত, হাতেগোনা অল্পকিছু পাঠক মুসলিম বিশ্বের হাল হাকিকতের সাথে সংযোগ রাখতে পারছে। আগেকার সবগুলো ইসলামি সভ্যতায় বই এবং পাঠাভ্যাস ছিলো সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। 'Knowledge Triumphant: The Concept of Knowledge in Medieval Islam' বইয়ের উপসংহারে ফ্রাঞ্জ রোসেন্থাল লিখেছেন: 'জ্ঞানের ধারনা ইসলামে অভিনব সাফল্য ও মহিমা অর্জন করেছে।' গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, অতীতে জ্ঞানের এই সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জিত হয়েছিল গোগ্রাসে বইপাঠ এবং বিচিত্র সব টেক্সটের সফল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে, যার মধ্যে এমন বিষয়ও আছে যা ইসলামের বিশ্বাস ও ধারনার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫৬ টি প্রকাশনা সংস্থার একটিও মুসলিম বিশ্বের না। এমনকি কুরআন, বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বাদে, বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত ও পঠিত বইগুলিও মুসলিম বিশ্বের বা মুসলিম লেখকের লেখা নয়। ব্যক্তিগত চর্চা ও উদ্যোগের বাইরে ব্যাপক পাঠাভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে।মুসলিম বিশ্বে একটি যুগোপযোগী গ্রন্থসংস্কৃতির অভাব বর্তমানে একটি বড় সংকট এবং কাঠামোগত অজ্ঞতার কারণ, যা প্রতিহত করা জরুরি।

অনেকেই হয়ত ইন্টারনেট ও আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর উদ্ভাবন এবং ছোট ও সংক্ষিপ্ত ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের (Abbreviated Language, যেটা একটা সীমা পর্যন্ত সহনীয়) নিন্দা করবেন, কিন্তু এই সমস্যাটা আরো গভীর; এটা ইন্টারনেট যুগেরও আগে শুরু হয়েছে। পাঠাভ্যাস ত্যাগ ও গ্রন্থবিযুক্তি— এগুলো অনেক অনেক আগ থেকে, কম করে হলেও ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে; এবং যথারীতি এখনও চলছে।

এর কারণ অনেক। তবে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হল: আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়, মিলিটারি ও কারিগরি জ্ঞানে একচেটিয়া আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও এসবে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান, অর্থনৈতিক অবনতি, ওয়াকফ (ধর্মীয় বৃত্তিমূলক সংগঠন) প্রতিষ্ঠানগুলোর পতন, যা ছিল ইসলামি সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের মেরুদণ্ড এবং বিদ্বান, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবৃত্তিকে সমাজে প্রান্তিক করে তোলা। ধর্মীয় ওয়াকফ সংগঠনগুলোর ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এগুলোর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ এবং ওয়াকফ সংস্থাগুলোকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে একীভূতকরণের কাজটা প্রথমে করা হয়েছিলো এগুলোর বিদ্যমান অর্থসংস্থানের পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু পরবর্তীতে এটা ওয়াকফ সংস্থাগুলোর বিপুল পরিমান উদ্বৃত্ত অর্থ আত্মসাতের পথ খুলে দেয়, যার ফলে পতনোন্মুখ রাষ্ট্রের রাজস্বে চুরিচামারি শুরু হয় এবং ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি-তহবিল ভরে উঠতে থাকে।

পাঠাভ্যাস যেকোন সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত, আর পাঠবিযুক্তি এর বিপরীত। সবচে বড় সংকট হলো, বর্তমানে মুসলিমরা একটা ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পোদ্যম আকারে বইপড়ার চর্চাটা সম্মিলিতভাবে ছেড়ে দিয়েছে। সবধরনের জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে শব্দগ্রাহক যন্ত্র, ডিভিডি, সরাসরি সম্প্রচার এবং ইউটিউব লেকচারে। মনে হচ্ছে যেন, আমাদের এই সভ্যতা অনলাইনে লাইক এবং শেয়ারের স্তরে নেমে এসেছে, যা বই পড়ার কিংবা নিয়মতান্ত্রিক  জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভাগ/ডিসিপ্লিন গড়ে তোলার কোন দায়ই অনুভব করেনা। অনেকে হয়ত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, যেসব সংকটপূর্ণ ইস্যু সমাজকে প্রভাবিত করছে সেগুলোর প্রতি মানুশের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে অনলাইনভিত্তিক এসব কাজের গুরুত্বকে মূল্য দেন, উৎসাহিত করেন। কিন্তু এই কাজগুলো বইপড়া বা সমাজের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হিশেবে একটি গ্রন্থসংস্কৃতি গড়ে তোলার বিকল্প হতে পারেনা।

এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫৬ টি প্রকাশনা সংস্থার একটিও মুসলিম বিশ্বের না। এমনকি কুরআন, বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ বাদে, বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত ও পঠিত বইগুলিও মুসলিম বিশ্বের বা মুসলিম লেখকের লেখা নয়। ব্যক্তিগত চর্চা ও উদ্যোগের বাইরে ব্যাপক পাঠাভ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। মুসলিম বিশ্বে একটি যুগোপযোগী গ্রন্থসংস্কৃতির অভাব বর্তমানে একটি বড় সংকট এবং কাঠামোগত অজ্ঞতার কারণ, যা প্রতিহত করা জরুরি।

এই সমস্যা নিরসনে দরকার জ্ঞানদীপ্ত নেতৃত্ব, দীর্ঘকালীন ও বহুমুখী পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ। এটা শুরু হতে পারে তরুণদের জন্য 'পাঠচক্র' ও পাঠ-প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে, যা প্রশাসনের উচ্চতর পর্যায়ের আয়োজনে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্প ও লেখকদের পেছনেও বিনিয়োগ করতে হবে; এতে করে বইমেলাকেন্দ্রিক একটি যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানুশের বইকেন্দ্রিক প্রতিভার উদযাপন ও বিকাশে সহায়ক হবে। বিশেষ গুরুত্বের সাথে, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম ও পাঠব্যবস্থার পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে চাকরির জন্য ডিগ্রি ও গ্রেড অর্জনই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য— এই প্রচলিত প্রবনতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা বই পড়ে বোঝাপড়ামূলক জ্ঞানার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়। 'পড়'— এটা সমগ্র জীবনব্যাপী শিক্ষার জন্য এবং মুসলিম বিশ্বে একটি নতুন গ্রন্থসংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য এক ঐশী নির্দেশই বটে।


অনুবাদকের নোট: 

'মুসলিম বিশ্বে বই ও পাঠাভ্যাস: একটি মারাত্মক সংকট'— হাতেম বাজিয়ানের এই লেখাটা অনুবাদ করছিলাম ২০১৫ সালে। বাজিয়ানের এই লেখার সাথে কয়েকটা জায়গায় আমি দ্বিমত করছিলাম লেখাটা অনুবাদের সময়ই। দ্বিমতগুলা এখন আরো পোক্ত হইছে। 

প্রথমত, নলেজ বা বইকেন্দ্রিক নলেজরে, অ্যাকাডেমিয়ারে উনি যেভাবে ও যে পদ্ধতিতে গুরুত্ব দিছেন, মানে 'অ্যাকাডেমি' বলতে উনি জ্ঞানচর্চার যে সংস্কৃতিটারে বুঝাইছেন, হাইলাইট করছেন, ট্রাডিশনাল মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কারণে আমি বুঝি যে, এইটা মূলত ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমির আলাপ। ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমির ভাল দিকগুলা তো নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা লাগবে, কিন্তু একচেটিয়া অ্যাকাডেমিয়ামূলকতা, তায় আবার ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমি— এইটা জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিভিন্নতাগুলারে সামহাউ অস্বীকার করে, ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমির শ্রেষ্ঠত্ব তৈয়ার করে, মুসলমানদের এবং আরো অনেক ধর্ম ও জাতির মানুশের নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতিগুলারে নেগেট করে। ওরাল ট্রাডিশন ইসলামি জ্ঞানের খুবই কেন্দ্রীয় পদ্ধতি, কিন্তু বাজিয়ানের এই লেখা পড়লে তা একদমই বোঝা যায় না। নবিজিরে যখন জিবরাইল আমিন বললেন 'পড়', তখন নবিজির সামনে কোন বই ছিল না। ফলে, 'পড়' মানেই 'বই পড়', এমন ভাবলে মুশকিল। 'পড়' শব্দের যে কনটেক্সুয়াল অর্থ তৈরি হইছিল হেরা গুহায়, 'পাঠ'র অর্থগত সম্ভাবনার যে বহুমাত্রিক বিস্ফোরণ ঘটছিল, তারে বই বা কিতাবাদি বা অ্যাকাডেমিয়ায় সীমিত করলে মুশকিল।

দ্বিতীয়ত, সরকারি তত্ত্বাবধানে পাঠচক্রের যে আইডিয়া উনি দিছেন, তা সর্বত্র অ্যাপ্লিকেবল না। যেমন, আজকের বাঙলাদেশে। এমনকি, ধরা যাক, ইসলামি কোন দল ক্ষমতায় থাকলেও তা সম্ভব না। গণ-পাঠরুচি হয়ত তাতে তৈয়ার হবে (আজকের বিসাকের মত), কিন্তু বাজিয়ান এই পাঠরুচি তৈয়ার করার মধ্য দিয়া যে মনজিলে পৌঁছতে চান, এই প্রক্রিয়ায় তা হাসিল হবে না। এমনকি ইসলামের সোনালি যুগেও, ক্ষমতার আন্ডারে জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটতে পারে নাই। দুইটার মধ্যে বিভাজন করতে হইছে।

তৃতীয়ত, লেখাটার শেষদিকে মুসলিম সমাজে বইকেন্দ্রিক সংস্কৃতি গইড়া তোলার জন্য যেসব টোটকা লেখক দিছেন, সেগুলার বেশ কয়েকটা এখন আমাদের চোখের সামনেই ঘটতেছে ইসলামি বইয়ের মার্কেটে। প্রকাশনাশিল্প ও লেখকদের পেছনে অর্থলগ্নি, বইমেলাকেন্দ্রিক যোগাযোগ তৈরি করা, পাঠচক্র— এগুলা জোরেশোরেই শুরু হইছে। সমস্যার জায়গাটা হইল, স্রেফ পলিটিকাল বা পলিটিকো-কালচারাল পোলারাইজেশান বা মতামত তৈরির বাইরে, অবজেক্টিভ জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ বা স্কলারশিপ তৈয়ার করতে পারতেছে কিনা এই উদ্যোগগুলা, আই ডাউট। যদি না পারে, এই উদ্যোগগুলা যদি পলিটিকাল, কালচারাল ও ইকোনমিক পোলারাইজেশানের তলে হারায়ে যায়, যদি অবজেক্টিভ জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈয়ার না হয়, তাইলে বাজিয়ানের এই টোটকাও অর্থহীন হইতে বাধ্য। 

যাহোক, বাজিয়ানের লেখার ওই অনুবাদটা একদমই কাঁচা হাতের অনুবাদ ছিল। লেখাটার এই ভার্শন একদমই নতুন। আশা করি, লেখাটার মূল এসেন্স মাথায় রাখলে, দ্বিমতসহও, পাঠকের ফায়দা হবে ইনশাল্লাহ। 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই