চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

মাই নেম ইজ রেডঃ সাক্ষাৎকারের বাছাই করা অংশ



মাই নেম ইজ রেডঃ সাক্ষাৎকারের বাছাই করা অংশ

ওরহান পামুক

অনুবাদঃ সারোয়ার রাফি 


[এই প্রবন্ধটি তার্কিশ ঔপন্যাসিক ও ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী ওরহান পামুকের 'OTHER COLORS, ESSAYS AND A STORY' বইটি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পামুকের ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হওয়া মাই নেম ইজ রেড উপন্যাসটি নিয়ে। যাদের বইটি পড়া আছে তারা খুব সহজেই পামুকের চিন্তাগুলো ধরতে পারবেন। তাছাড়া উপন্যাসটি লেখার পেছনে যে ইতিহাস,প্রস্তুতি সে ব্যাপারেও জানতে পারবেন পাঠক-পাঠিকারা।] 

তোপকাপি প্যালেসের পরিচালক ফিলিজ কগম্যান আমার মাই নেম ইজ রেডের প্রথম পাঠক ছিলো, এবং সে ছিলো খুবই সুবিবেচক। যখন আমি বইটা লিখতে শুরু করি তখন এই প্যালেসের লাইব্রেরির পরিচালক ছিলো ফিলিজ হানিম। বইটি লেখার আগে, আমরা দীর্ঘ আলাপ করেছিলাম। এটা ছিলো ফিলিজ হানিম যে কিনা আমাকে বলেছিলো, একটা অসমাপ্ত মিনিয়েচারে আমরা কি দেখি- এই যে আর্টিস্টেরা ঘোড়ার পা হতে আঁকা শুরু করে, তারা এটা স্মৃতি হতে আঁকছে বলে জানায়।

মাই নেম ইজ রেড প্রকাশের আগে, ফিলিজ হানিম এবং আমি রোববারের এক সকালে তোপকাই প্যালেসে দেখা করেছিলাম এবং বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে আলাপ করেছিলাম। দিনের আলো শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা আলাপ করে যাই। তারপর বাইরে  অন্ধকার হয়ে আসে; সে দিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় প্যালেসের জাদুঘর। আমরা বইটায় উল্লেখিত হারেমের আঙ্গিনা জুড়ে যাচ্ছিলাম। যেখানেই তাকাচ্ছি সেখানেই অন্ধকার,শূন্যতা এবং ভীতি নেমে এসেছিলো। চারিদিকে শরতের পাতা, বাতাস, ঠাণ্ডা। রাজকোষের দেয়াল জুড়ে নেমে এসেছিলো কালো ছায়া যা আমি বইতে বর্ণনা করেছিলাম।  আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং দীর্ঘ সময় ধরে নীরবতায় দেখছিলাম। আমাদের হাতে তখনও অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলি। অন্ধকার এবং বায়ুময় রোববারে প্যালেসে দাঁড়িয়ে আমার লেখা মাই নেম ইজ রেডের আলাদাই একটা গুরুত্ব ছিলো।

শিরিন হুসরেভের ছবি দেখেই প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু কেন? যখন সে বন দিয়ে যায় তখন ছবিটা প্রথম দেখে প্রেমে পড়লো না কেন? দ্বিতীয়বারও সে যখন যখন বন দিয়ে যায়, সে এটাকে ফের দেখে এবং আবারো তার প্রেম পড়েনি। কিন্তু তৃতীয়বার বন দিয়ে যাওয়ার সময় আবার দেখেই প্রেমে পড়ে গেলো। তাহলে, প্রথম দেখাতেই এই সুদর্শন এবং আর্কষণীয় লোকটির প্রেমে পড়লো না কেন? আমার নায়ক ব্ল্যাক এই প্রশ্ন তুলেছিলো। শেকুরে শ্রুতির সাহায্য নিয়ে উত্তর দিয়েছিল, সবকিছুই তিনবারে ঘটে।শ্রুতিতে, সকলেরই তিনটে সুযোগ আছে, কিন্তু আধুনিক উপন্যাসে প্রতিটা মোটিফ মাত্র একবারই ব্যবহৃত হয়।

এই উপন্যাসটির ব্যাপারে কল্পনা করার আগে, আমার ইসলামিক অনুচিত্রশিল্পীদের ব্যাপারে বোঝাপড়া এবং ভালোবাসা খুবই সীমিত ছিল। এই পেইন্টিংগুলোকে দশক হিসেবে আলাদা করা এবং তাদের শৈলীর ব্যাপারে উপলব্ধি করার জন্যে একজনের খুব ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়। আর এই ধৈর্য্যকে ভালোবাসার মাধ্যমে জিইয়ে রাখতে হয়। শুরুতেই,বিষয়ের প্রতি আলাদা ভালোবাসার মতোন এই পেইন্টিংগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসা গড়ে তোলা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের ইসলামিক সেকশনের মিনিয়েচারগুলো এখনকার তুলনায় আগে ভালোই প্রদর্শনী হতো, বিশেষত ফার্সি মিনিয়েচারগুলো, এবং আপনি অই পৃষ্ঠার এবং পেইন্টিংগুলোর খুব কাছেই যেতে পারতেন। ১৯৯০ এর শুরুতে যখন প্রদর্শনীর অনুমতি ছিল,আমি সেখানে যেতাম এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।কেউ কেউ আমার উপর বিরক্ত হতো অবশ্য; তবে অন্যের মাঝে আমি খেলার অনুভূতি,আনন্দোচ্ছ্বাস খুঁজে পেতাম; এবং অন্যের মতোন, আমি সেই পেইন্টিংগুলোর দিকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে তাকিয়ে থাকার যে প্রেম তা শিখেছিলাম। আমি শিখেছিলাম আপনাকে তারিফ করতে হলেও কাজ করতে হবে। শুরুর দিকে,এটা এমন একটা বই পড়ার চেষ্টার মতোন ছিল, যেটার ভাষা আপনি খুব জানেন না, এজন্যে আপনাকে একটা বাজে অভিধানের সাহায্য নিতে হয়েছে; আপনার শুধু এটুকুই ধারণা আছে, বইটাতে কি চলছে আসলে; ঘণ্টা পেরিয়ে যায় এবং তেমন কিছুই ঘটে না। এটা জানার পর আপনার দুঃখ হয়, এই ভাষায় আরো বহু দক্ষ লোক রয়েছে এবং আপনি তাদেরকে হিংসা করেন। ভাবেন যে, আপনি কখনোই তাদের সমান দক্ষতা অর্জন করতে ও আনন্দের অনুসারী হতে পারবেন না। কিন্তু অন্যদিকে এখানে একটা গর্বের বিষয়ও রয়েছে। প্রথমত, আপনি জানেন না কিভাবে এই অদ্ভুত এবং অতিমাত্রার ভিন্নতা, সমাপ্তি, কষ্ট, বাঁকা চোখে তাকানো এবং অভিন্ন মানুষগুলোর কৌশলের সাথে অগ্রসর হতে হয়-আপনি কিভাবে এই মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা নিজের মধ্যে খুঁজে পাবেন যাদের পোশাকগুলো খুব দূরবর্তী এবং পূর্বদেশীয়?- কিন্তু তাদের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, আপনি তাদেরকে ভালোবাসতে শিখে যাবেন। এটা এমন না যে, সব বইয়ের মাধ্যমে হয় যেগুলো আমি পড়েছিলাম বরং আমি খুশি যে দশবছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তাদেরকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম।

মাই নেম ইজ রেডের প্রকৃত হিরো হচ্ছে একজন গল্পকথকঃ প্রতি রাতে সে কফি হাউজে যায়, একটা ছবির সামনে দাঁড়ায় এবং গল্প বলা শুরু করে। বইটার সবচে দুঃখের অংশ হলো তার বিষণ্নতার সাথে সমাপ্তি। আমি জানি চলমান চাপের মধ্যে এই গল্পকথকের কেমন অনুভূত হচ্ছে।এটা লিখো না,ওটা লিখো না; যদি আপনি একবার লিখতে শুরু করেন তবে এই পথেই চলতে থাকবেন; আপনার মা রাগ হতে পারে, আপনার বাবা রাগ হতে পারে, রাষ্ট্র রাগ হতে পারে, সবাই রাগ হতে পারে; কথায় তারা কোঁ কোঁ করে উঠবে এবং আঙুলগুলোকে নাচাবে; আপনি যাই করেন,তারা বাম হাত ঢোকাবেই। আপনি বলতে পারেন, "প্রভু,আমাকে সাহায্য করো", কিন্তু একই সময়েই আপনি ভাববেন, আমি এমন একটা উপায়ে লিখছি যেটা সবাইকে রাগিয়ে তুলতে পারে, কিন্তু এটা সুন্দরও হয়ে উঠতে পারে এবং সেইদিন তারা আপনারা সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হবে।আমাদের এই আবদ্ধ আধা-গণতান্ত্রিক সমাজে নিষেধাজ্ঞা এতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে যে, উপন্যাস রচনা আমাকে এমন একটা অবস্থানে ফেলেছে যেটা চিরাচরিত গল্পকথকদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন নয়; তবে এই স্পষ্ট রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যাই হোক না কেন, একজন লেখক ট্যাবু,পারিবারিক সম্পর্কে, ধর্মীয় অনুশাসনে,রাষ্ট্র এবং আরো কিছুর মধ্যে আবদ্ধ থেকেই নিজেকে খুঁজে পাবে। এই বিবেচনায়, ঐতিহাসিক কল্পকাহিনি ছদ্মবেশী আকাঙ্খার মধ্যে থেকেই কথা বলে।

আমার প্রধান চিন্তা ছিলো, মাই নেম ইজ রেডের শৈলীর প্রশ্ন নিয়ে।শৈলীর খাতিরে আমি বুঝতে পারি, আজকের পোস্ট-রেঁনেসা সংক্রান্ত ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমা আর্ট ইতিহাসবিদদের দ্বারা একাত্ম হয়ে রয়েছে, এবং এরই ফলে প্রত্যেক আর্টিস্টকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে। কিন্তু নাটকীয়তা হলো, প্রতিটা আর্টিস্টের শৈলীর মহিমা তার ধর্মীয় মহিমাকে অনুপ্রাণিত করে। পনেরো এবং ষোড়শ শতাব্দীর পার্সিয়ান আর্টিস্ট এবং অনুচিত্রশিল্পীরা শুধু তাদের নিজস্ব শৈলীর দ্বারাই পরিচত ছিলো না বরং যে শহরের কর্মশালায় তারা কাজ করতো সেখানকার শাহের আধিপত্যের নিরিখেও পরিচিত ছিলো।

মাই নেম ইজ রেডের প্রধান সমস্যা প্রাচ্য-পশ্চিমের প্রশ্ন নয়; এটা হলো অনুচিত্রশিল্পীদের দুঃসাধ্য কাজঃ আর্টিস্টের কষ্ট এবং কাজের প্রতি পূর্ণ আস্থা।এই বইটা হলো আর্ট, জীবন, বিয়ে এবং সুখ সম্পর্কে। প্রাচ্য-পশ্চিমের প্রশ্নটা কোথাও না কোথাও এর ব্যাকগ্রাউন্ডে চুপিসারে অবস্থান করে।

আমার সমস্ত বই ই লেখা হয় প্রাচ্য-পশ্চিমের প্রক্রিয়ার, শৈলীর, অভ্যাসের এবং ইতিহাসের মিশ্রণে এবং এর ফলে আমি যদি সফল হই তবে ধন্যবাদ জানাবো এই সম্পত্তিগুলোকে। আমার স্বস্তি,দ্বিগুণ আনন্দ একই উৎস থেকে আসেঃ আমি কোনোপ্রকার অন্যায় ছাড়াই এই দুই জগতের মধ্যে বিচরণ করতে পারি এবং উভয় প্রক্রিয়াই ঘটে ঘরে হতে। রক্ষণশীলেরা এবং ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসীরা যারা পশ্চিমা পৃথিবীর প্রতি স্বচ্ছন্দ নয়, যেমন আমি স্বচ্ছন্দ, এবং ভাববাদী আধুনিকতাবাদীরা যারা ওদের ঐতিহ্যের প্রতিও স্বচ্ছন্দ নয় তারা কখনোই বুঝবেনা এই প্রক্রিয়াগুলো কীভাবে সম্ভব হয়েছে।

সাইলেন্ট হাউজ বইটার মতোন আমার এই বইটার চরিত্রেরাও ফার্স্ট পার্সনে কথা বলে। সবকিছুই কথা বলে, শুধু চরিত্রেরাই নয় বরং প্রতিটা বস্তুও কথা বলে যায়। বইয়ের শিরোনামটাই এর সুরটাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে।

মাই নেম ইজ রেডের নামটা আমার মাথায় প্রথম এসেছিল যখন আমি বইটা শেষ করি, এবং জলদিই নামটি আমি পছন্দ করে ফেলি। বইয়ের আসল নাম ছিল "Love at First Picture"। এটা এসেছিল হুসরেভ এবং শিরিনের প্রেমে পড়ার ছবির দিকে তাকিয়ে, এর থিমের সাথে মিল রেখে যার ক্যাপশন ছিলো "প্রথম দেখাতেই প্রেম"। হিডেন ফেস নামক একটা মুভি আমার The Black Book এর গল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো, যেটার জন্যে আমি স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম একই থিমের উপর ভিত্তি করেঃ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার মাধ্যমে ভালোবাসায় পড়া।

শিরিন হুসরেভের ছবি দেখেই প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু কেন? যখন সে বন দিয়ে যায় তখন ছবিটা প্রথম দেখে প্রেমে পড়লো না কেন? দ্বিতীয়বারও সে যখন যখন বন দিয়ে যায়, সে এটাকে ফের দেখে এবং আবারো তার প্রেম পড়েনি। কিন্তু তৃতীয়বার বন দিয়ে যাওয়ার সময় আবার দেখেই প্রেমে পড়ে গেলো। তাহলে, প্রথম দেখাতেই এই সুদর্শন এবং আর্কষণীয় লোকটির প্রেমে পড়লো না কেন? আমার নায়ক ব্ল্যাক এই প্রশ্ন তুলেছিলো। শেকুরে শ্রুতির সাহায্য নিয়ে উত্তর দিয়েছিল, সবকিছুই তিনবারে ঘটে।শ্রুতিতে, সকলেরই তিনটে সুযোগ আছে, কিন্তু আধুনিক উপন্যাসে প্রতিটা মোটিফ মাত্র একবারই ব্যবহৃত হয়।

শিরোনামটি আমি বাতিল করে দিই বইয়ের প্রধান ইস্যুর কথা বিবেচনা করে, মাই নেম ইজ রেড এই প্রশ্নেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সকল দিক হতেই তা উচ্চারিত হচ্ছিলঃ যদি শিরিন শুধু হুসরেভের ছবি দেখেই প্রেমে পড়ে, তবে হুসরেভ অবশ্যই পশ্চিমা প্রতিকৃতির ঢঙে অঙ্কিত হবে, কারণ ইসলামিক অনুচিত্রশিল্পীরা আরো জেনেরিক ধরণের সৌন্দর্যের বর্ণনা করে। ছবিটাকে দেখার পরে, সে রাস্তাতেই তাকে চিনে ফেলে (ছবির সাথে একটা আইডি কার্ডও ছিলো)। তাম্বুরলাইন,সুলতান এবং খানদের সময়ে শত শত ছবি আঁকা হতো, কিন্তু এখন আমাদের কোনো ধারণাই নেই সেগুলো দেখতে কেমন ছিলোঃ হুসরেভের ছবিটাকে সর্বদাই একজন আদর্শ সুলতান অথবা খানের ছবির মতোন লাগে। এটা কি সম্ভব যে, সবার মতোন দেখতে এমন কারোর উপর শিরিন প্রেমে পড়বে?

আমার বইটি এই থিমের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলে। কারা'কে(ব্ল্যাক) হুসরেভের আদলেই নির্মাণ করা হয়েছিল, তার ভালোবাসা ফিরে না আসার দুঃখে নির্বাসনে চলে যায় এবং বছরের পর বছর ধরে প্রিয়তমার মুখ চিন্তা করেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এরপরে সে আর মুখ মনে করতে পারে না কারণ যদি তার কাছে পশ্চিমা বোধের আদলে কোনো ছবি থাকতো তবে সে খুব সহজেই সেটা তার চোখের সামনে নিয়ে আসতে পারতো। সে জানে, আমরা যাকে ভালোবাসি তার প্রকৃতই যদি কোনো ছবি না থাকে, এটা তখন ব্যাপারই না আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি, তার ছবি আস্তে আস্তেই স্মৃতি হতে মুছে যেতে থাকে। তার মুখের পরিবর্তে আমরা যা দেখি তা শুধু বিচিত্র স্মৃতিই। এটা ছিল বইয়ের আরেকটা থিমঃ কারো মুখ মনে করা, মানুষের মুখের অনন্যতার জন্যেই বইয়ের প্রথম নাম "Love at First Picture" ছিলো।

হুসরেভ এবং শিরিনের গল্পটি ইসলামিক সাহিত্যে খুব পরিচিত গল্প। এবং এটা আমার উপন্যাসের বহু দৃশ্যে, জমায়েত, অবস্থা এবং পদক্ষেপের একটি মডেল ছিলো। আমরা সবাই সংস্কৃতি বিনিময় করি; আমরা উপন্যাস পড়ি এবং ছবি দেখি। আমাদের মাইন্ডে (জাঙিনিয়ান সেন্সে) যা আছে তার সবকিছুই ন্যারেটিভে আদিরূপ হিসেবে রসদ যোগায়। আমাদের মাথায় যে একটা পুরাতন গল্পের টেমপ্লেট থাকে তার বিপরীতে নতুন একটা গল্প ছুটে আসে, এবং এরই ভিত্তিতে আমাদের তা পছন্দ হয় বা হয় না। একটা মুভির মতোন যা আমরা জীবনভর মনে রাখি, একটা ছবি যা আমরা স্টার দিতে পছন্দ করিঃ তখন কি আমরা বলি এটা রোমিও এন্ড জুলিয়েট অথবা পশ্চিমাদের গল্প? আমি হুসরেভ এবং শিরিনের গল্প কম রোমান্টিক এবং অধিক বাস্তববাদিতায় খুঁজে পেয়েছি। এই গল্পটি অধিক রাজনীতির, অধিক লাজুকতার, অধিক কূটকৌশলের এবং এই বোধে অধিক বাস্তববাদিতার।

আমার উপন্যাসের প্রধান চিন্তা ছিলোঃ এর গতি, ক্ষমতা এবং চরিত্রের রিয়েলিজম পার্সিয়ান অনুচিত্রশিল্পীর শৈলীর কাজ হতে আরো কাব্যময় মিশ্রণে নিয়ে আসা যাতে আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা তা বুঝতে পারি। এরই পরিক্রমায় উপন্যাসের চরিত্রেরা-প্রথম শিরোনামটিকে অতিরঞ্জিত ভাবে তুলে ধরে- কিছু সূত্র পরামর্শ দেয়, প্রকৃত রক্ত-মাংসের চরিত্রের মতোন খেলা খেলতে যেমন উপন্যাসে শেকুরে এবং সময় হতে সময় তারা আজ আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্য সেন্সে, অনুচিত্রশিল্পীর অঙ্কিত দৃশ্যগুলো নেওয়ার পর, চরিত্রেরা আমাদের কাছে আরো দূরবর্তী হয়ে ওঠে। আমার উপন্যাস দুটো মেরুর মধ্যে ভ্রমণ করে, নৈকট্য ও স্বীকৃত হওয়া একদিকে এবং দুর্গম ও জনসাধারণ অন্যদিকে।

বইয়ের চরিত্রেরা প্রকৃতিকে দেখে ছবি অথবা শিল্পীর নকশার সাহায্যে। বইয়ের এই অংশটাকে আমি ভালবাসি। এটা আমার কাছে এমন একটা অংশ হয়ে এসেছিলো যেটা আমার আকাঙ্খাকে উস্কে দিয়েছিল অতীতের সংস্কৃতিতে ফিরে যেতে- আমাদের ঐতিহ্যে- এবং এর সাথে খেলা করার ও নতুন প্রভাব তৈরি করতে। আমার বইয়ের কেন্দ্র আসলে একটাই, একটাই হৃদয়ঃ রান্নাঘরটি।এটা সেই জায়গা যেখানে হেয়রিয়ে, কাপড়ওয়ালী এস্থারের সাথে গল্পগুজব করে; শেকুরেও, সিঁড়িবেয়ে কিচিনে নেমে আসে তার গুপ্ত কৌশলকে এগিয়ে নিয়ে যায়, চিঠি এবং নোটস পাঠায়, তার সন্তানদেরকে বকে এবং রান্নার তদারকি করে। রান্নাঘরের প্ল্যাটফর্মটিতেই সবকিছু অবস্থান করে। কিন্তু যখন আমি বইটি লিখছিলাম তখন ছবির সাথে এটায় বহুকিছু ছিলো, আমি চরিত্রগুলোর চোখ দিয়ে এর প্রকৃতিকে দেখতে পারিনি, এমনকি অনুচিত্রশিল্পীদের চোখ দিয়েও পারিনি। আমার চরিত্রগুলোর জন্যে- এবং আধুনিক রিডারদের জন্যে- আমরা যা জানি, সে সব ব্যাপারে নয় বরং আগ্রহ হলো অনুচিত্রশিল্পীরা যা এঁকেছিল তার প্রতি।এই সত্যটা বলাই যায়, আমার বইটি এক প্যারোডি হতে ওঠে এসেছে।

বইটাতে ঘোড়ার বহু বর্ণনা আছে। ঘোড়াগুলো পৃষ্ঠা জুড়ে কথা বলে যায় তাদের অঙ্কিত হওয়া নিয়ে। একটা ঘোড়া এমনকি নিজেকে বর্ণনাও করে। একটা ঘোড়াকে আমি কীভাবে দেখছি এটা সে সম্পর্কিত বই নয়, এটা হলো কীভাবে অনুচিত্রশিল্পীরা ঘোড়াকে দেখে সেটা নিয়ে। এবং আমার ঘোড়া বাস্তব ঘোড়া নিয়ে কথা বলে না, কিন্তু কথা বলে কিভাবে অনুচিত্রশিল্পীরা তাদেরকে তুলে ধরে।যখন আমি একটা ঘোড়াকে স্বচক্ষে দেখি, আমি এটাকে জলদিই ঘোড়ার ছবির সাথে মিলিয়ে নিই, এবং সেখানেই এই দেখার সমাপ্তি ঘটে।

আমি খুব সহজেই এই মিস্ট্রি প্লটটিকে নির্মাণ করেছিলাম। এটা কোনো সমস্যাই ছিলো না, কিন্তু আমি তার জন্যে গর্বিতও না। এখন আমরা বইগুলো লিখি, এবং মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি এটা পছন্দ করেছো? এবং তারা জবাব দেয়, হা, আমি পছন্দ করেছি।এসব কিছুই আমাদের চাওয়া হিসেবে যথার্থ নয়; আমরা চাই একটা নির্দিষ্ট কারণের জন্যে বইটি তার পছন্দ হোক, এবং কারণটা হলো, "আমি মাই নেম ইজ রেডকে পছন্দ করেছি তার পেইন্টিংগুলোর প্রতিধ্বনির জন্যে যেটা প্রধান বিষয় এবং মিনিয়েচারগুলোর পৃথিবী ছিলো"। আমি পাঠকদের কাছ থেকে আমার শৈলীর ধারণা, পরিচয় এবং ভিন্নতার ব্যাপারেও শুনতে আগ্রহী; আমি তাদেরকে এই চমৎকার পেইন্টিংগুলোর অদ্ভুত ও অনন্যতার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে চাই এগুলো যেভাবে বইটিতে আবির্ভূত হচ্ছে। কিভাবে এই দুটো প্রিয় সাবজেক্টই পুরো বিষয় হয়ে ওঠে। বইটা আমার কাছে বিশেষ ছিলো, যেখানে আমি সমস্ত পেইন্টিং এবং চরিত্রগুলোর শৈলী,পরিচয় ও সংলাপগুলোকে ঠিক সময়েই বর্ণনা করেছিলাম এবং এর ফলে আমার মনে হয়েছিলো, আমি নিজেকে আরো শক্তিশালী করে তুলছি।

কিছু পাঠক বইটা পড়ার পর পার্সিয়ান এবং অটোমান ছবিগুলো দেখতে যেতে অনুভব করেছিলো। এটা খুবই স্বাভাবিক কারণ পুরো বইটা মিনিয়েচার এবং তাদের দেখতে পারার আনন্দ এবং বর্ণনা নিয়ে। আমি অই পেইন্টিংগুলোকে পাঠকদের নিকটে আরো আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছিলাম, যাই হোক, আমি বইটাকে ক্রমানুসারে লিখেছিলাম এবং পেইন্টিংগুলোর প্রতিটি শব্দ বর্ণনা করেছিলাম। এখন আমি দুঃখের সাথে দেখতে পাচ্ছি, আমার কিছু পাঠক খুবই হতাশ হয়েছিলো যখন আসল মিনিয়েচারগুলোকে দেখেছিলো। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের মতোন আমরাও পশ্চিমা পোস্ট-রেঁনেসা শিল্পের শিক্ষিত মানুষ এবং ফটোগ্রাফির জন-উৎপাদনের সময়ের অধিবাসী, তাই যেরকমই আঁকা থাকুক আমরা এই পেইন্টিংগুলোকে বুঝতে অথবা দেখে আনন্দ পেতে সমর্থ হই না। এরই ফলে, কেউ যদি এই মিনিয়েচার আর্টের ব্যাপারে জানাশোনা না হয় তবে তার কাছে এগুলো বিরক্তিকর এবং সেকেলে লাগতে পারে। এটা ছিলো আমার বইয়ের আরেকটা থিম।

মিনিয়েচার আর্ট এবং বইটার ভাষার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু তার থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলোঃ যদি আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে মিনিয়েচারের মানুষগুলোর পৃথিবীর দিকে তাকান এবং একইসাথে তাদেরকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন- তখন মনে হবে একজন পেইন্টার পেইন্টিংগুলোকে দেখছে। যখন শিরিন এবং হুসরেভ স্পষ্টভাবেই সামনে আসে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখে, তখন কিন্তু তাদের চোখে চোখ পড়ে না, কারণ তাদের শরীর ঘুরন্ত অবস্থায় আমাদের সামনে আবর্তিত হয়। ঠিক একই উপায়ে, আমার চরিত্রগুলো তাদের গল্প বলে যায়, একে অন্যকে এবং পাঠকের সাথেও নিজেকে পরিচিত করে তোলে। তারা বলে ওঠে, "আমি হলাম ছবি এবং আমি কিছু বোঝাতে চাচ্ছি", এবং আরও, " ও,পাঠকেরা, এখানে তাকাও; আমি তোমার সাথে কথা বলছি"। মিনিয়েচারগুলো আমাদেরকে সর্বদা বলে যায়, তারা হচ্ছে ছবি। আর আমার পাঠক বইটি পড়তে পড়তে সর্বদা সচেতন থাকে তারা একটি উপন্যাসই পড়ছে।

নারী চরিত্রগুলো ভিতরে ভিতরে এতোই সচেতন, পাঠকেরা এদের গোপনীয়তার দ্বারা বেষ্টিত থাকে। যেমন তারা যখন কথা বলে, তখন ঘর পরিপাটি করতে থাকে, কাপড়চোপড় গোছাতে থাকে এবং যত্নও নিতে থাকে যাতে তারা কোনো ভুল কথা না বলে ফেলে। এই দৃষ্টিতে নারী চরিত্রেরা কোনো সুখকর সত্তা নয়; তারা উদ্ভটও নয়। একমাত্র যখন তারা কোনো পাঠক-পর্যবেক্ষককে অন্তরঙ্গ কিছুতে মোড় নিতে প্রভাবিত করে তখনই তারা কোনো আউটসাইডারকে ভাই হিসেবে মেনে নেয়, একটা নতুন সম্পর্কের পথ তৈরি করে।

এই বইয়ের সমস্ত অনুচিত্রশিল্পীরা, শুধু একজন ছাড়া, জেইতিন(ভেলিকেন), বাস্তবিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। সে পার্সিয়ান-অটোমানের গুরুত্বপূর্ণ পেইন্টার এবং পার্সিয়ান পোট্রের্ট আর্টিস্ট সিয়াভিশের ছাত্র ছিলো। অন্য দুই অনুচিত্রশিল্পী ছিলো কাল্পনিক। আমাকে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে, ষোড়শ শতাব্দীতে মিথ্যা স্বাক্ষী বহন করার অপরাধটা কেমন ছিলো এবং এর অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করতে হয়েছে যে, ঐ সমস্ত ঘটনাগুলোতে কী ঘটে যখন স্বামী নিখোঁজ হয়ে যায়, যাতে এরই উপর ভিত্তি করে, আমি শেকুরের তালাকের খুঁটিনাটির ব্যাপারে কাজ করতে পারি।

এস্থারের কাপড় ফেরি করার দিকটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো। এই চরিত্রটি অটোমানদের ব্যাপারে উপন্যাসে শুধু প্রধানই নয় বরং উপন্যাসের মধ্যযুগটার একজন মুখ্য ব্যক্তিত্বও, যে কিনা বিয়ের পূর্বে প্রেমের একটা যোগসূত্রও বটে। সামাজিক আইন পুরুষ এবং নারী চরিত্রগুলোকে একসাথে থাকতে নিষেধ করে। কিন্তু উপন্যাসটার যেহেতু একটা জীবন্ত পরিপার্শ্বিকতা ঠিক করা হয়েছিলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং অনিশ্চয়তা বর্ণনা করার জন্যে, মননের পরিবর্তনের জন্যে, প্লটের আঁকাবাঁকা ক্ষেত্রগুলোকে অঙ্কিত করার জন্যে, অন্য শব্দে- পুরুষ এবং নারীদের তবে অবশ্যই ব্যালেন্স অবস্থায় থাকতে হবে, পিছু ছোটা এবং প্রত্যাখ্যান হওয়া একত্রে পরিমিতভাবে হতে হবে- ভালোবাসা কিংবা যুদ্ধে, আর্মিরা পাহাড়ে অবস্থানকালে প্রথমেই তাদের জীবন বাজি ধরে। তখনকার দিনে, পুরুষদের এমন কাজ করা সম্ভব ছিলো না, কারণ নারীদের কাছে যাওয়ার অনুমতি তাদের সীমিত ছিলো, বিশেষত ইসলামিক সংস্কৃতিতে।

মধ্যযুগে অটোমানদের সময়ে এই রণকৌশলে- যেটাকে আমি একটা পয়েন্টে নিজামীর শব্দ ধার করে "ভালোবাসার দাবা খেলা" রূপে বর্ণনা করেছিলাম- এইটা তখনই সম্ভব হতো যখন একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চিঠিগুলোকে পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে পারতো। ইস্তাম্বুলে এটা ছিলো কাপড় ফেরিওয়ালী যে কি নারীদের বাড়ি বাড়ি যেতো। নারী হিসেবে তারা খদ্দেরদের মুখোমুখি হতে পারতো এবং তাদের ব্যক্তিগত কথাও শুনতে পারতো, এবং তারা অমুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ থেকে আসতো, তারা মুক্তভাবেই শহরে যাতায়াত করতে পারতো। অটোমান নারীরা উচ্চশ্রেণির ছিলো, তারা মার্কেটে আপেল,টমেটো,শাকসবজি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কিনতে যেতে পারতো। একজন ইহুদি বণিক যে কিনা Tanzimat reform period এর সাহিত্যের চুটকিগুলো বহন করে নিয়ে যেতো। আমরা এস্থারকে একজন মজার চরিত্ররূপেই গ্রহণ করে নিয়েছি। এস্থারের ড্রামার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে হলো অন্যলোকের ড্রামার একজন মজার মাধ্যম।

প্রতিটা উপন্যাসে- এটা বিষয়ই নয় কতটুকু আমি রেজিস্ট করেছি- একটা চরিত্র আছে যার চিন্তা, গঠন এবং স্বভাব আমার নিজেরই কাছাকাছি এবং যে কিনা আমার মতো বহু দুঃখ ও অনিশ্চয়তা বহন করে চলে। এই বোধে সে Galip, The Black Book এর নায়কের মতোই, এই উপন্যাসে সে হলো কারা। মাই নেম ইজ রেডের একটা চরিত্র যাকে আমি খুব আপন মনে করি। আমি এমন চরিত্রকে নির্মাণ করতে পছন্দ করি কারণ আমার খাতিরে তাদের পথটাকে উজ্জ্বল রূপে তুলে ধরতে না পারলে আমি পৃথিবীটাকে ভালোভাবে দেখতে পাবো না।তারাই হলো সেইজন যাদের কারণে আমি তাদের পৃথিবীতে বাস করছি বলে বেশ বুঝতে পারি। কারা আমাকে তার মধ্যে কিছু মাত্রায় গ্রহণ করেছে। অন্যান্য চরিত্রেরা যেখানে বেশিই করেছে, কারা কোনো ঘটনাকে দূর হতে অনুসরণ করতে আরো আসক্ত ছিলো।

এটা চরিত্রের নীরবতা, অনিশ্চয়তা এবং দুঃখগুলোই আমাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিল, তার সাহস কিংবা বিজয়ী হওয়া নেয়নি। আমার পাঠকদের এভাবেই তাকে ভালোবাসতে পছন্দ করবো। আমি আমার বইয়ের ছায়া অংশ এবং ভঙ্গুরতার মুহূর্তগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছি, যেভাবে অনুচিত্রশিল্পীরা তাদের পেইন্টিংগুলোকে দেয়, এবং একই ভাবে আমি পাঠকদের লক্ষ করাতে চাই, কোথায় আমি সমস্যায় এবং কোথায় আমি দুঃখে পড়েছি।

আমার মায়ের কিছু বৈশিষ্ট্য শেকুরের মধ্যে ছিলো, যা আমার মায়ের নামও আসলে। যেভাবে সে শেভকেটকে বকে, উপন্যাসে ওরহানের ভাই, যেভাবে সে ভাইগুলোর দিকে তাকায়- এটা অন্য সব ক্ষুদ্র বর্ণনার সাথে, এগুলো আমার জীবনের প্রতিলিপিই। সে ছিলো খুবই শক্ত এবং উঁচু মহিলা যে কিনা জানত, সে কি করছে- অন্তত কীভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে হয়। কিন্তু ঐ স্থানেই মিলগুলো শেষ হয়ে যায়। এটা সেরকমই যা উত্তর-আধুনিকতার সাথে মিলে; এমনভাবে ভান করছে যদিও সে একই আছে কিন্তু আসলেই সে ভিন্ন। এই ক্রমানুসারে একটি মজার খেলা আছেঃ আমি মাঝে মাঝেই আমার মা ও ভাইকে বলি, আমি ১৯৫০ এর দশকের ইস্তাম্বুলকে সবকিছু ঠিকঠাক রেখে ১৫৯০ সালের সাথে পুর্নকল্পনা করি। মায়ের আকাঙ্খার পুরোটাই দ্বন্দ্বমূলক, এবং আরও সে  জানতো, তার প্রত্যাশার আঘাতগুলো কখনোই তাকে বিচলিত করতো না। শান্তভাবেই এই ভাবনা দাঁড়াত, জীবন বহু অসঙ্গতি দিয়েই তৈরি, সবকিছুই বোঝা হয়ে শেষ হয়, সে এটাকে সমৃদ্ধিরূপেই বিবেচনা করতো।

                                                                           ... 

মাই নেম ইজ রেডে উল্লেখিত বাবার মতোন বহু বছর ধরেই আমাদের বাবাও দূরে থাকে (যদিও বইয়ের বাবা আসতো-যেতো না যেমন আমাদের বাবা আসতো)। আমার মা, ভাই এবং আমি একসাথে থাকতাম। বইয়ের মতোই, আমরা ভাইয়েরা মারামারি করতাম। বইয়ের মতোই, আমরা আমাদের বাবার ফিরে আসা নিয়ে কথা বলতাম। যখন এমনটা করতাম তখন মা আমাদের সময় দিতেন। মাই নেম ইজ রেডের মতোনই, রেগে গেলে তিনি খুব চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন। দুটোর মধ্যে এই মিলগুলি ছিলো।

শিশুকাল হতেই এবং সাত বছর থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত, আমি একজন আর্টিস্ট হতে চাইতাম। আমি ঘরে থেকেই পেইন্টিংয়ে বহু সময় অতিবাহিত করেছিলাম। বাবা-মা এর উপর কিছু মৌলিক পকেট বই কিনে দিতো, যেগুলোর মধ্যে অটোমান আর্ট নিয়েও বই ছিলো, এবং আমি অটোমান মিনিয়েচারগুলো কপি করার চেষ্টা করতাম। আমি তা পূর্ণ মনোযোগের সাথেই করতাম। তেরো বছর বয়সে যখন মিডল স্কুলে ছিলাম, তখন আমি ষোড়শ শতাব্দীর মিনিয়েচারিস্ট ওসমান এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর মিনিয়েচারিস্ট লেভনির মধ্যে পার্থক্য বলে দিতে পারতাম। আমার খুবই শক্ত কিন্তু শিশুসুলভ আগ্রহ ছিলো এই বিষয়ের প্রতি এবং এ নিয়ে আরো জানার জন্যে অন্যান্য বই কিনতাম। 

আমি মিনিয়েচারিস্টদের নিয়ে একটা বইয়ের ব্যাপারে বহু বছর ধরেই ভাবছিলাম। কিছু সময়ের জন্যে, আমি বইটাকে একজন মিনিয়েচারিস্ট নিয়েই কল্পনা করেছিলাম, কিন্তু পরে এই চিন্তাটাকে মুছে ফেলি। যাই হোক, ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত আমি একপ্রকার মিনিয়েচারিস্টের জীবনই কাটাচ্ছিলাম। যদি একজন মিনিয়েচারিস্ট বছরের পর বছর ধরে বসে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্ধ হয়ে যায়, এটা ছিলো সেরকমই যা আমি ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের টেবিলে বসে কাজ করতাম, কলম দিয়ে লিখে বই পূর্ণ করে দিচ্ছিলাম (Kalem, যে শব্দটা পেইন্টাররা ভালোবাসে)। মাঝে মাঝে কেউ লেখে, কেউ বা লেখে না। মাঝে মাঝে কেউ আশা ছেড়ে দেয় এবং নিজেই বলে ওঠে তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। মাঝে মাঝে কেউ তিনদিন একনাগাড়ে লেখে যায় যাতে পরিশেষে তা ছুঁড়ে ফেলতে পারে। মাঝে মাঝে একটা কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে; মাঝে মাঝে আমি খুবই সন্তুষ্ট হই এবং সুখ অনুভব করি। তারপর সবকিছু কিছুই খোলামেলা ভাবে বলি। আমি আমার বইতে বর্ণনা করেছিলাম,  আর্টিস্টেরা ঈর্ষায়,আনন্দে,আশায়,রাগে এবং বির্তকে লিখে যায় এটা দেখতে কিভাবে মানুষেরা এতে সাড়া দিয়ে ওঠে; কারণ আমি সামাজিকভাবেই বহু লেখককে চিনি, মিনিয়েচারিস্টের মধ্যে নয় বরং এই ইমোশনগুলো তাদের মধ্যে দেখেছিলাম এবং এই উপায়ে তাদেরকে "একটি আর্টিস্টের জীবন" রূপে বর্ণনা করতে শুনেছি।

যদি এই বইটাতে সৌন্দর্য এবং পরিমাপের একটা বোধ থাকে, এটা আমার চরিত্রগুলোর আগের সময়কার দীর্ঘ একতা, সৌন্দর্য এবং স্বচ্ছতার কারণে। (আমার নিজের পৃথিবী মাই নেম ইজ রেডের ছন্দোবদ্ধ, মার্জিত এবং দেবানুগত শব্দের মতোন নয়; দ্যা ব্ল্যাক বুক উপন্যাসটার পৃথিবী হলো অন্ধকার, বিশৃঙ্খল এবং অবশ্যই আধুনিক)

আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারেন, মাই নেম ইজ রেডের শিল্পের ভয়ের হারানোর ব্যাপারটা, একটা চরম মাত্রায় এই ভয়টার ব্যাপারে ভুলে যাবার। Tamburlaine হতে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ২৫০ বছর ধরে চলে আসা পার্সিয়ানদের প্রভাবের পর, অটোমানরা যা-ই এঁকেছিলো হোক তা ভালো কিংবা খারাপ- এরপরে পশ্চিমা প্রভাবে বহুকিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। বাহু এবং কোণের রিপ্রেজেন্টেশনের বিপরীতে মিনিয়েচারিস্টরা ইসলামিক নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কারণ সুলতান, শাহ, ক্ষমতাবান, রাজা এবং পাশাদের জন্যে বই বানানোর খাতিরে তারা এর ইলাস্ট্রেটে ছোট পেইন্টিংগুলো ব্যবহার করে। এর জন্যে তখন কেউই তাদের প্রতি প্রশ্ন ছোঁড়েনি। কেউই এগুলো দেখেনি। এগুলো বইয়ের ভিতরেই থাকতো। এই সমস্ত কাজের ভূয়সী প্রশংসা করতো শাহরা বিশেষত শাহ তাহমাস্প। এরপরে চিত্রকলাকে নিষ্ঠুরভাবে হারিয়ে ফেলা এবং ভুলে যাওয়া হয়েছে- ইতিহাসের নির্দয় ক্ষমতার কাছে- এগুলো পশ্চিমা পোস্ট-রেঁনেসার পেইন্টিং এবং নীরিক্ষার দ্বারা স্থানচ্যূত হয়ে গিয়েছে, বিশেষত প্রতিকৃতি আঁকাতে। এটা খুব সহজই কারণ পশ্চিমা উপায়ে পেইন্টিং এবং নীরিক্ষা দেখতে খুবই চমৎকার লাগতো। তাই আমার এই বই মুছে ফেলা সেই দুঃখ এবং ট্র্যাজেডির অপূরণীয় ক্ষতির ব্যাপারে। এটা হলো হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের দুঃখ এবং কষ্টের ব্যাপারে।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই