চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বেওয়ারিশ


বেওয়ারিশ

মিলু হাসান


সকলে দেখলো কথা বলতে গেলেই তাদের মাথার ভিতর কোনো এক ডরের ভূত আইসা হাজির হয় আর ডরের ভূতের হাতে অদৃশ্য রাইফেলের নল মাথার দিকে তাক করে ঘুরতেই থাকে যতক্ষণ না সে কথাটা সেন্সর করে পলিশ না করে, সবার যে একসঙ্গে এরকম হলো তা না;  নেজমত তার অধীস্তন কেরানি করিম বক্স এর রুমে এক ফাইলের খোঁজে যখন গিয়ে দেখে যে করিম বক্স যথারীতি লাঞ্চের আগেই অফিস থেকে চলে গেছে তখন  সে তার বস কে এম রহমত উল্লাহর কাছে নালিশ নিয়ে গেলো যে, 'স্যার করিম  সাহেব তো অফিসে নেই ', তখন  কে এম রহমত উল্লাহ তাকে সতর্কতার ভঙ্গীতে বলে যে, 'করিম তো দল করে জানেন না? ওর যখন মন চায় অফিসে আসবে যাবে, মাতব্বরি কম করবেন' তখন থেকেই নেজমতের উপর আছর করে ডরের ভূত আর ঘুরতে থাকে তাক করা অদৃশ্য রাইফেলের নল; ঠোঁটকাটা স্বভাবের নেজমত অফিস থেকে ফিরে বউয়ের কাছে এ বিবরণ দিতে গিয়ে প্রথম টের পেলো কোনো এক ডরের ভূত আইসা তারে ডর দেখায় আর সে সেই কথাটা কইতে পারে না; নেজমতের ভিতরের সে ডরের ভূত বউয়ের সঙ্গে রাত্রিবেলা শরীরকর্ম করতে গিয়ে যখন ভিতরে ফেলতে বলে নেজমত না করে বলে যে 'এমন দেশে বাচ্চা জন্ম দিবো না' বলতে গিয়ে না বলে চুপ থাকে ঠিক তখন চালু চালু সে ডরের ভূত আছর করে নেজমতের বউরে; পরদিন নেজমতের বউ যখন পাশের ফ্লাটের ভাবি নাজমার সঙ্গে বিকাল বেলা ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে 'দেশের কি  অবস্থা' নিয়ে মামুলি কথা বলতে গিয়েও বললো না তখন সে ডরের ভূত আছর করলো নাজমারে; নাজমা থেকে নাজমার স্বামী জমিরের কাছে সে ডরের ভূত চলে গেলো আর নাজমার স্বামী যখন তার গেরামের বাড়িতে তার আম্মাকে সতর্কতার ভঙ্গিতে বললো, 'আব্বারে চায়ের দোকানে গিয়া বকবক কম করতে কইও, দেশের অবস্থা কিন্তু ভালা না' তখন এ ডরের ভূত ছড়িয়ে গেলো ময়ূরপঙ্খী গ্রামে; কেননা, আপনারা জানেন ও বুঝেন গেরামের মাইনসে সারাদিন কাজকর্ম করে, ক্লান্ত শরীর; প্রযুক্তির বিনোদন নিতেও জুয়ানরা অল্প অল্প অভ্যাস গড়ে তুললেও বৃদ্ধ -মধ্যবয়স্ক বিশেষত মহিলারা আর চায়ের দোকানের মুরব্বিরা নতুন কোনো কথা পাইলে এইটা চাবাইতে থাকে চাবাইতে থাকে; তাদের এ বুদ্ধি থাকে না যে  'এইডা ডরের ভূত' ছলিমের মেয়ে টুনি প্রেমিক গানজুটি মতিনের লগে পলায়া যাওয়ার ঘটনা না তো যে চাবাইলে বীভৎস রস উপভোগ করা যাবে;  দেখা গেলো যে জমির তার আম্মারে ফোনে কথা বলছে দুপুরে আর ওইদিন এশারের আজান না পড়তেই গেরামের সকলের উপরে সমানে আছর করলো ডরের ভূত আর ঘুরতে থাকলো ভূতের হাতের তাক করা অদৃশ্য রাইফেলের নল; এর প্রভাব এতোই বিধ্বংসী ছিল যে, তৎকালীন চেয়ারম্যান মনু মিয়ার মেয়ে টুনির জামাই কুদরত প্রধান তার বউয়ের তরকারিতে নুন বেশি হওয়ায় বলতে পারলো না, 'মাগী রানধনের সমায় মন কই গিয়া থাহে লো' তা না বলে বললো, 'মাছের সালুনডা মজা হইছে বউ', কিন্তু কুদরত প্রধান টের পেলো যে জিহ্বা নামক ইন্দ্রিয় বেশিদিন আপোস করতে পারে না; সে অজানা এক জায়গায় আত্মগোপন করে ডির্ভোস লেটার পাঠাইলো আর এক ডরের ভূত থেকে তারে আরেক কিছিমের ডরের ভূত তারে ধরলো; যাতে কইরা তার আর ডরের ভূত থেকে কোনো রেহাই মিললো না আর ময়ূরপঙ্খী গ্রাম থেকে সদরুদ্দিনের চর গেরাম, সেখান থেকে কাউনিয়াকান্দি, করিম খাঁ হয়ে মল্লিকার চর, সেখান থেকে চলতে চলতে কখন যে দেশের এক কোণার বর্ডারের গ্রাম ডাকাতিয়া পল্লীতে চলে গেলো ডরের ভূত তা শুধু জল্লিলুল জব্বার খোদাই কইতে পারবেন এমনকি হাওয়ায় ভাসমান ফিরিশতারা কিংবা কাঁধে বসা দুজন কেরামান কাতিবিন কিছুই ঠাহর করতে পারলো না, শুধু লিখে রাখলো আমলের খাতায় ডরের ভূতের নাম ;  এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, আরেক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম; এক শহর থেকে আরেক শহর, আরেক শহর থেকে আরেক গ্রাম চলতেই থাকলো রেপিড ফায়ার; তবুও কিছু লোক সাহসীমনস্ক হওয়ায় ডরের ভূতের আছড়কে 'নয়া জমানার কুসংস্কার' মনে করলো আর কোনো এক পত্রিকায় কলামিস্ট প্রথম লিখলো এ শিরোনামে কলাম —নয়া জমানার কুসংস্কার, তারপর প্রথম বাক্যে লিখলো 'ডরের ভূত নয়া জমানার কুসংস্কার' আর তারপর তিনি দেখলেন যে দিনদুপুরে কারা যেন তাকে সবুজ পোশাকে ধরে নিয়ে গেলো; সারাদেশের পত্রপত্রিকা এটা ফলাও করে ছাপালেও দিনকে দিন এ নিউজে এতো অভ্যস্ত হয়ে পড়লো যে সেসব নিউজ এতো মামুলি হয়ে দাঁড়ালো যে তার জায়গা আর পত্রিকায় হলো না; সেসব স্থান দখল করলো 'ঋতুরাজ বসন্তে এবার কৃষ্ণাচূড়ায় ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর' এ, কেননা, ডরের ভূত সমস্ত জায়গায়ই আছড় করে ফেলেছে; কেউ কেউ এক কাঠি সরেস বুদ্ধিমান ডরের ভূতকে পূজা করতে থাকলো পূজা করতে থাকলো; এতো পূজা করতে থাকলো যে উপরে যে একজন খোদা বসে আছে তার সঙ্গে শরিক ঘটে গেলো; খোদাও এমন নিশ্চুপ হইয়া রইলেন, তিনি  অবাক হন না; কেননা তিনি সমস্তকিছুই অগ্রিম জানেন আর কিছু কিছু লোক থেকে একটা গোষ্ঠী তৈরি হইলো সে গোষ্ঠীর একটি মাত্র কাজ ডরের ভূতের পূজা করা আর অপরদিকে, অধিকাংশ মানুষ ডরের ভূতের ভয়ে এমনই নাজেহাল অবস্থা হলো যে মামুলি নিরপেক্ষ কথা বলা বলতে গিয়েও টের পেলো যে কথাটি নিরপেক্ষ তো নয়ই, প্রচ্ছন্নভাবে কোনো এক পক্ষের করে বিরোধিতা— যেমন সেদিনই নেজমত যখন  তার বউরে বলে — বউ সারাদিন বাসায় কেমন কাটলো, বলতে না বলতেই তার বউ বলতে চাইছিলো —আজকে সকালে আব্বারে  কারা জানি  ধরে নিছে মন কেমনে ভালা থাকবো; তাই নেজমত কেমন কাটলো ভালো আছেন শব্দগুচ্ছ বলা বাদ দিলো; কেননা এ প্রশ্নটি বড়ই অনিরপেক্ষ কিংবা কল্যাণপুরের আরসি গলিতে থাকা যুবক এসডি মকবুল  বিপরীত পক্ষের প্রেমের সায় সম্পূর্ণ পাওয়ার পরেও প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারলো না মেয়েটাকে —ইনবক্সে; কারণ যেদিন রাতে সে দেখলো মেয়েটি তার বাবাসমেত দলের এক হর্তাকর্তার সঙ্গে একটি সুসজ্জিত ছবি আপলোড দিলো; তাতে লিখলো, 'চাচাজান বড় ভালো মানুষ। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন' তখন সে যুবকের হৃৎপিণ্ড কাঁপতে ছিলো ডরের ভূতের ভয়ে যে বাইচান্স প্রপোজাল রিজেক্ট হইলে মেয়েটি ক্ষুদ্ধ হয়ে কি জানি না করতে পারে; তাই সে আর প্রপোজালটি দিলো না; শুকুর আদায় করলো পরওয়ারদেগারের আর এভাবে  ডরের ভূত এতোটাই আছর করলো পুরো দেশকে যে ঢাকা শহরের কিছু লোক বোবা হয়ে যেতে থাকলো; কেননা, জিহ্বা ও কণ্ঠও তো একটা বস্তু; দীর্ঘদিন অচল থাকার ফলে তারাও ভোতা হয়ে জং ধরে; স্বভাবতই কারো কারো ক্ষেত্রে এরকম হলো যে তারা বোবা হয়ে যেতে থাকলো আর ব্যবসায়ী আজগর মিয়া বিবিধ ব্যবসাপাতি করে এ গত কয়েক বছরে লস খেতে খেতে যখন পথে বসে যাবে যাবে, তখন  তার ব্যবসায়ী মন তারে এ কাজ করাতে বাধ্য করলো  যে চিটাগাং এর পাহাড়ের উপরে তার যে নিরিবিলি রিসোর্ট সেটার নাম বদলে 'বোবাদের আশ্রম' নাম করে আর সে 'বোবাদের আশ্রম' এর স্লোগান দেয় —'এখানে বোবারা কথা বলা শিখতে পারে' আর এহেন বিজ্ঞাপনের বদৌলতে  সেখানে মধ্যবিত্তরা তাদের জমানো পয়সায় কোনো এক শুকুরবারে ঢাকা শহরের বোবারা সেখানে গিয়ে থাকা শুরু করলো এ আশায় যে তারা হয়তো সেখানে গেলে কথা বলতে পারবে পুনরায়; নেজমতের বউ নেজমতকে নিয়ে সেখানে গেলো গত শুকুরবার আর  আশ্চর্য ব্যাপার, সেখানে নিরাপত্তার কারণে ডরের ভূত আছর করে না বলে নেজমত 'নাদিয়া নাদিয়া ' বলে হুট করে কান্দন জোয়ায়া দিলো আর ব্যবসায়ী আজগর মিয়া সে শুকুরবার "বোবাদের আশ্রম" দেখভাল করতে গিয়ে দেখলো বোবাদের কথার আওয়াজে রিসোর্ট এতোটাই গমগম করতে থাকলো যে রিসোর্টের টিনের চালের নতুন স্কুরুপ নড়তে নড়তে খুলে গড়িয়ে পড়ে গেলো পাহাড়ের ঢালের ঝরণায় আর পাশ্ববর্তী আদিবাসী জেলে অং উই অং মাছ না পেয়ে যখন মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিলো তখন সে পেলো এক ডেকচি স্কুরুপ ;সে খুশিতে যখন তা বাজারে বিক্রি করতে গেলো মুদি দোকানে কম দরে ;তখন কারা যেন তারে ধরে নিয়ে গেলো আর আজগর মিয়ার 'বোবাদের আশ্রম' সিলগালা করে দিয়ে গেলো ভ্রাম্যমান মেজিস্ট্রেট; কেননা তাদের কাছে এ খবর ছিলো এখানে ঢাকা শহরের বোবা লোকরা আইসা এখানে কেমনে জানি কথা শুরু করছে; এটা বড়ই আতঙ্কজনক অবস্থা! 

ডরের ভূত যখন এরূপ শক্তিশালী অবস্থায় উপনীত হলো চারপাশে 'ডরের ভূত' এর আছড় এতোই শক্তিশালী হলো যে বৃদ্ধ-শিশু ও অসুখে ভোগা লোকেরা ডরের ভূতের ভয়ে সমানে মারা যেতো লাগলো আর দিন এখন পুরাপুরি গভীর রাতের মতোন হয়ে গেলো; গভীর রাতে বাদুড়ের ডানাঝাপটানি, বিড়ালের নিশ্চুপ হাঁটার শব্দ যেমন পাওয়া যায়; ঠিক তেমনি দিনের বেলায়ও পিঁপড়ার হাঁটার শব্দ পিঁপড়া পেয়ে নিজেই আচমকা অবাক হয়ে গেলো; কেননা মানবসমাজ সমস্ত শব্দ করতেই ভুলে গেলো ডরের ভূতের আছরের কারণে; এমনকি শরীরকর্ম করতেও যেহেতু শীৎকারের শব্দ হয় আর  জীবজগতের পশুপ্রাণির মধ্যে কেঁচো যখন নিজের হাঁটাচলার শব্দ শুনে নিজেই হতবাক হয়ে মারা গেলো আস্তে আস্তে কেঁচো মারা যাওয়ায় মাটির উর্বরতা কমে গেলো আর এদিকে শহরের কাকরা দিনদুপুরে নিজের কা কা ধ্বনি অতি উচ্চস্বরে প্রতিধ্বনি শুনায় তারা হতবাক হয়ে মনমরা হয়ে গেলো আর  কা কা ধ্বনি দিতে যাওয়া ভুলে গেলো আর নিজের মনকে যখন শাসাইলো নারী-পুরুষরা, শরীর তো তা বুঝে  না তাই কতিপয় দুর্ঘটনায় হসপিটালে স্বামীর অসতর্কতাবশত বউ গর্ভবতী হলে সব্বাই  লক্ষ করলো তার বউয়ের পেটের বাচ্চা বিয়ানোর পরে আর কাঁদে না; শিশুরা জন্মের পরে কাঁদবে তা স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু এদেশে এখন শিশুর জন্মের পর না কাঁদাই স্বাভাবিক হয়ে গেলো ; কিন্তু এক আচানক ঘটনা ঘটলো নেজমতের অসতর্কবশত যখন বউ গর্ভবতী হলে বাচ্চা বিয়ানোর পরে দেখে যে বাচ্চা কাঁদা শুরু করে কথা বলতেও শুরু করে দিলো আর পয়লাই বললো 'আমার নানা কই' তখন  ডাক্তাররা আন্দাজ করলো নেজমতের বউ একলা একলা ঘরে সারাদিন বাপের কথা কইতে না পাইরা যখন মনে মনে ঘুসতো  বাপের নিঁখোজ হওয়ার তসবি, তখন  তার ফলস্বরূপ এ দশা হইলো তার বাচ্চার আর হসপিটালের রুমের খোলা থাইগ্লাসের ফাঁকে বসে থাকা এক কাক মানবশিশুর কথার শব্দ শুনে নিজে সাহস পেলো কা কা করার আর শুরু হলো সারা ঢাকা শহর কাকের কা কা ; যেহেতু কাক দলবদ্ধ তাই ;  নেজমত গিয়ে মুখ ধরলো তার বাচ্চার আর  কাকের কা কা দেখে কানতে কানতে খুশিতে চোখের পানি ফেললো উক্ত হসপিটালে থাকা একদল ঢাকা শহরবাসী; কেননা তারা শব্দ করতে পারে না, কেউ একজন করলো তা দেখে খুশি; যেহেতু মানুষ অনুকরণপ্রিয় তারা কাককে দেখে  অনুকরণ করতে চেষ্টা করলে ব্যর্থ হলো আর কারা যেন সারা ঢাকা শহরের কাক গুলি করে মেরে পরদিন রাতে আজিমপুর গোরস্তানে কবর দিলো আর যেহেতু এ লেখার লেখকও এ দেশের অধিবাসী তাই তার উপর ডরের  ভূত এতোটাই আছড় করলো যে সে আর মানুষের দুর্দশার কথা লেখতে পারলো না বরং লিখতে থাকলো অবাস্তব এক বাক্যে 'বড় সুখে আছে এদেশের নাগরিকরা' আর... 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই