চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আমি কেন লিখি





আমি কেন লিখি

মূলঃ সাদাত হাসান মান্টো

তর্জমাঃ মাহীন হক

(প্রবন্ধটা আকর পাটেল কর্তৃক অনুদিত ও সংকলিত Why I Write শিরোনামে মান্টোর প্রবন্ধ সংকলন হতে অনুবাদ করা।)

বহুবার আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কীভাবে আমি লিখি। আসলে আমি এই প্রশ্নটি কখনোই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, এই "কীভাবে"টার মানে কী? আমার অভিধান যা বলে, সে অনুযায়ী তারা জানতে চাচ্ছেন আমি "কী পদ্ধতিতে লিখি?" 

এ ব্যাপারে আমি আর কী বলবো? 

সবচেয়ে ভালোমত বুঝিয়ে কীভাবে বলা যায়? উম্ম, আমি আমার লিভিং রুমের একটি সোফায় বসি, সামনে একগাদা কাগজ নিয়ে বসি, আমার ফাউন্টেন পেনের খাপখানা খুলে লেখা শুরু করে দেই। 

আমার ছোট্ট তিনটি মেয়ে একই রুমে নিজেদের মধ্যে খেলা করে। আমি মাঝে মাঝে তাদের সাথে একটু গল্প করি। তাদের ঝগড়ার মিটমাটও করে দিতে হয় কখনো কখনো। মাঝে মাঝে নিজের জন্য সালাদ বানিয়ে খাই। এর মধ্যে যদি আবার কেউ বাসায় বেড়াতে আসে, তখন আদর্শ অতিথিসেবকের ভূমিকা পালন ক'রে তাদের সাথে আড্ডাও দেই। কিন্তু এসবের মধ্যেই, আমি ক্রমাগত লিখতে থাকি। 

কিন্তু এখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে আমি কেন লিখি, তাহলে তার জন্যও আমার একটা উত্তর প্রস্তুত রয়েছে।

সর্বপ্রধান কারণ হলো লেখালেখি আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক যেমন মদ আমার নেশা। যখন আমি লিখি না, তখন আমার নিজেকে উলঙ্গ মনে হয়, যেন আমি এখনও গোসল করিনি। যেন এখনও মদের প্রথম গ্লাসটা গেলা হ'লো না। আসলে গল্পগুলো আমি লেখি না, বুঝলেন, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে লিখে নেয়। এতে তো আসলে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। দেখুন, আমি তো খুব একটা পড়াশুনা করিনি। তাও আমি কীভাবে কীভাবে যেন বিশটা বই লিখে ফেলেছি এবং এখনও আমার প্রায়ই অবাক লাগে যে এই বইগুলোর লেখক আসলে কে? নিশ্চয়ই, সে লেখক অন্তত এতটা গুরুত্বপূর্ণ লোক তো বটেই যে তাকে অশ্লীলতার দায়ে নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দিয়ে আসতে হয়। 

যখন এই কলম আমার হাতে থাকে না, তখন আমি স্রেফ সাদাত হাসান, এমন এক লোক যার জ্ঞান খুবই অল্প, এবং প্রকাশ ক্ষমতা তার চাইতেও কম। কিন্তু যখন এই কলমটা হাতে নিই, তখন আমি মান্টো হয়ে উঠি।

কোনো গল্প লেখার আগে সেটা কখনোই আমার মাথায় কিংবা চিন্তাতে থাকে না। এটা সবসময় থাকে আমার পকেটে, অগোচরে। আমি খালি নিজের মাথার সাথে জোরজবরদস্তি করি গল্পের শুরুর প্যারাগ্রাফগুলো লেখার জন্য। কিন্তু তাতে কোনো লাভই হয় না। 

আমি একজন গল্পলেখক "হতে" চেষ্টা করি, তাদের মত হাবভাব নিয়ে লিখতে বসি। একটার পর একটা সিগারেট ধরাই। কিন্তু কিছুই বেরোয় না। 

শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে ব্যবহৃত নারীর মত শুয়ে পড়ি, অলিখিত গল্পের ভারে। তারপর উঠে অন্য কাজকর্ম করা শুরু করি। চড়ুইদের খাবার দেই, বাহিরে ময়লা ফেলে আসি, মেয়েগুলোর সাথে খেলি। তাদের জুতো, পুরো ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট্ট জুতোগুলো আমি ধরে জায়গামত রেখে আসি। 

আর ওই হারামজাদা গল্প, তখনও আমার পকেটে লুকিয়ে, মগজে দেয় না ধরা। 

যখন পেটে চাপ বাড়তে থাকে, আমি উঠে বাথরুমে গিয়ে অবসর নিই, কিন্তু সেখানেও মাথায় কিছু আসে না।

বলা হয় প্রতিটি মহৎ মানুষ বাথরুমে বসে চিন্তাভাবনা করেন। সে অনুযায়ী আমি প্রমাণসহ বলতে পারি আমি মহৎ মানুষ নই, কারণ সেখানে আমার মাথায় আজ পর্যন্ত একটিও ভালো চিন্তা আসেনি। 

এটা খুবই অদ্ভূত যে আমাকে ভারত ও পাকিস্তানের বড় একজন লেখক মনে করা হয়। সম্ভবত আমিই চালাকি করে তাদের এই গু বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছি।

ওহহো মাফ করবেন। মুখ থেকে বাথরুমের ভাষা বেরিয়ে এলো।

সত্যি যদি বলি, আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমি কীভাবে লিখি। 

যখন মাথায় কিছুই আসে না, তখন আমার স্ত্রী, যে আমাদের পরিবারের হিসাব-নিকাশ সামলায়, সে গম্ভীর হয়ে বলে: "দয়া করে ভাবা বন্ধ করো আর লেখা শুরু ক'রে দাও।" 

আর আমি তার কথামত কলম তুলে নিই আর খাতায় কিছু লাইন লেখা শুরু করি। আমার মাথা তখনও ফাঁকা – কিন্তু ইতিমধ্যে, আমার পকেট ভরে গেছে। আর তখন আপনাআপনিই, যেনবা জাদু, একটা টসটসে গল্প বেরিয়ে আসে। 

এভাবে দেখলে, আমি আসলে নিজেকে লেখকের চাইতে পকেটমার মনে করি। 

যে নিজেরই পকেট মেরে তার মালসামানা আপনাদের কাছে হাজির করে দেয়।

আমার মত নির্বোধ আর একটাও দেখেছেন?


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই