চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

এই মান্টো কোন শালা রে?



এই মান্টো কোন শালা রে?

মূল : সাআদাত হাসান মান্টো

তর্জমা : মওলবি আশরাফ


মান্টো সম্বন্ধে এযাবৎ অনেক কিছুই বলা ও লেখা হয়েছে— ওঁর পক্ষে কম, বিরুদ্ধেই বেশি। এসব বক্তব্য যদি সামনে রাখা হয় কোনো বুদ্ধিমান লোকই মান্টোকে ঠাওর করতে পারবে না। আমি এই প্রবন্ধ লিখতে বসে বুঝতে পারছি মান্টো সম্পর্কে কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত দেওয়া কতটা কঠিন। অবশ্য আমার জন্য খুব একটা কঠিন নয়, কেননা আমি সেই মহাভাগ্যদের একজন যে মান্টোর খুব কাছাকাছি থাকে, সত্য বলতে কী— আমি মান্টোর ছায়া।

এখন পর্যন্ত এই ব্যক্তির নামে যা যা লেখা হয়েছে আমি তার বিরোধিতা করি না বটে, তবে আমি কেবল এতটুকুই বুঝি— ওইসব প্রবন্ধে যা কিছু লেখা হয়েছে বাস্তবতার সাথে তার কোনো লেনাদেনা নেই। কেউ ওঁকে বলে শয়তান, আবার কেউ বলে টাকলা ফেরেশতা!... দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখে নিই কমবখতটা আবার এসব শুনছে কিনা... না না, সব ঠিকঠাক। ওহ হো, ভুলেই গেছিলাম, এখন তো ওঁর গলা ভিজানোর সময়। সাহেবের তো আবার রোজ সন্ধ্যায় তেতো শরবত গেলার অভ্যাস!

আমরা একসাথে জন্মেছি, আশা করি মরবও একসাথে। আবার এমনও হতে পারে যে সাআদাত হাসান মরে যাবে, কিন্তু মান্টো মরবে না! এই ভাবনাটা-না আমাকে সবসময় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এইজন্যেই ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে কোনো কসুর বাকি রাখিনি। যদি ওঁ বেঁচে থাকে আর আমি মরে যাই তাহলে ব্যাপারটা হবে এমন হবে যে,— ডিমের খোসা পড়ে আছে কিন্তু ভেতরের কুসুম আর শাদা অংশ গায়েব!

ভণিতা দীর্ঘায়িত করতে চাই না। আপনাকে সাফ বলে দিচ্ছি যে, মান্টোর মতো ওয়ান-টু পাবলিক (দুমুখো) আমি জিন্দেগিতেও দেখিনি। যেই আপনি ওঁকে ধরে ফেলবেন, ওঁ ‘তিনমুখো’ বনে যাবে! ‘তিনমুখ’ সম্পর্কে ওঁর জ্ঞানগম্যি যথেষ্ট, কিন্তু আমি জানি ওঁ এখনো ‘তিনমুখো’ হয়নি। এই ইশারা কেবল আকলমান্দরাই বুঝবে!

মান্টোকে আমি জন্ম থেকেই চিনি। আমাদের জন্ম ১১ মে ১৯১২ সালে একই সময়ে হয়েছিল। কিন্তু ওঁ সবসময় চেয়েছে কচ্ছপের মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। একবার মাথা খোলসে ঢুকিয়েছে তো হাজারবার খুঁজেও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। যা-ই করুক, আমি তো ওঁরই ছায়া, ওঁর মতিগতির অলিগলি আমার কাছে অজানা নয়।

এবার বলি কেমন করে ওঁ এত বড় গল্প লেখক হলো। লেখকগণ সাধারণত নিজেকে মহাপণ্ডিত প্রমাণ করতে লম্বাচওড়া প্রবন্ধ লিখেন, কথায় কথায় শোপেনহাওয়ার, ফ্রয়েড, হেগেল, নিৎশে বা মার্কস টেনে আনেন, কিন্তু বাস্তবতা এর ধারেকাছেও না— যোজন যোজন দূরে। মান্টোর কিসসা এতটুকুই— ওঁ দুই পরস্পরবিরোধী সত্তার দ্বন্দ্বের ফল। ওঁর বাবা, আল্লাহ মাফ করুন, খুবই রুক্ষ লোক ছিলেন, অপরদিকে মা ছিলেন যারপরনাই কোমলপ্রাণা। এই দুই কিসিমের যাঁতার তলে পড়ে বেচারা গমের দানার চেহারা কেমন হয়েছে দেখতেই পাচ্ছেন!

এবার ওঁর স্কুল-জীবনের আলাপে আসি। ওঁ খুব মেধাবী ছিল বটে কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত দুষ্ট। ওই সময় ওঁর উচ্চতা ছিল বেশি থেকে বেশি সাড়ে তিন ফুট। বাবা-মার ছোট ছেলে, ভালোবাসা একটু বেশিই পেতো। কিন্তু তিন বড় ভাই— যাঁরা বয়সে অনেক বড় এবং বিলেতে পড়াশোনা করতেন— তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের কখনো মওকাই মিলেনি। কেননা তাঁরা ছিলেন বৈমাত্রেয়, যদিও ওঁ মনেপ্রাণে তাঁদের সঙ্গ ও ভ্রাতৃস্নেহ পেতে চাইত, কিন্তু তা আর হয়নি। ভাইদের সাক্ষাৎ ও যখন পায় ততদিনে সাহিত্যের জগত ওঁকে মহান গল্পকার হিশেবে তসলিম করে নিয়েছে।

এবার ওঁর গল্প-লিখনী সম্পর্কে শুনুন। ওঁ একেবারে প্রথম সারির প্রতারক। ওঁর প্রথম গল্প ‘তামাশা’ জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা নিয়ে লেখা। যা ওঁ পুলিশের ধরপাকড় এড়াতে নিজের নামে ছাপায়নি ।

এরপর হঠাৎ ওঁর মাথায় আরো পড়াশোনা করার খেয়াল জাগল। এখানে একটা মজার গল্প বলি : এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ওঁ দু’বার ফেল করে পাশ করেছিল তৃতীয় বারে, তাও আবার তৃতীয় বিভাগে। আর আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে ওঁ ‘ডাব্বা মেরেছিল’!

এখন, আমি হাসি চেপে রাখতে পারি না যখন শুনি লোকে বলছে মান্টো নাকি উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক। কেননা, উর্দু ভাষাটা ওঁর এখনো ভালো করে রপ্ত হয়নি। শিকারি যেভাবে জাল হাতে প্রজাপতির পেছনে ছোটে, ওঁ ঠিক সেভাবে ভাষার পেছনে তাড়া করে বেড়ায়। আর ভাষা ওঁকে ফাঁকি দিয়ে আঙুল গলে বেরিয়ে যায়। তাই ওঁর লেখায় সুন্দর শব্দের সমাহার নেই। বরঞ্চ লেখার ছত্রে ছত্রে রয়েছে হাতুড়ির আঘাত, যত আক্রমণ জীবনের কাছ থেকে ওঁ পেয়েছে, খুশিমনে সব গ্রহণ করে বদলা ঘটিয়েছে গল্পের খাতায়।...

ওঁ এমন এক লোক যে কখনো সাফ ও সিধা সড়কে চলে না, বরং চলে বিপজ্জনক দড়ির উপর দিয়ে। লোকে ভাবে এই বুঝি পড়ে গেল, কিন্তু ওই কমবখত আজতক পড়ে যায়নি। অবশ্য পতন একদিন ঘটবে, এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে যে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আমি জানি মরার সময় ওঁ বলে যাবে ‘আমি এই জন্য পড়ে গিয়েছিলাম যেন জীবনে পতনের অনভিজ্ঞতার আপসোস না থাকে!’

আমি আগেই বলেছি মান্টো প্রথম সারির ‘ফ্রড’। এর সবচেয়ে বড় দলিল হলো আকছার ওঁ বলে বেড়ায় ‘আমি গল্প নিয়ে ভাবি না, গল্পই আমাকে ভাবে’— এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা।

যদিও আমি জানি, ওঁর যখন গল্প লেখার ‘প্যারা’ উঠে তখন ওঁর অবস্থা ডিম-পাড়া মুরগির মতোই হয়, কিন্তু ওঁ কোনো লুকিয়েছুপিয়ে ডিম পাড়ে না, পাড়ে সক্কলের সামনে— বন্ধুরা পাশে বসে আছে, তিন মেয়ে শোরগোল-ছোটাছুটি করছে, আর এদিকে ওঁ বিশেষ চেয়ারে ঝিম মেরে ডিম পাড়ছে, কিছুক্ষণ বাদেই যা ‘গল্প’ হয়ে কিচিরমিচির শুরু করবে!

ওঁর বউ খুবই বদমেজাজি। প্রায় ওঁকে বলে যে, ‘তুমি এসব গপ্পোবাজি ছেড়ে একটা দোকান খুলে বসো। কিন্তু মান্টোর দেমাগে যেই দোকান খোলা— অলঙ্কার-জহরতের চেয়ে মূল্যবান সামগ্রীতে ভরপুর। তাই ওঁ ভাবে ‘আমি যদি কোনো স্টোর খুলি না-জানি সেটা ‘কোল্ড স্টোরেজ’ হয়ে গিয়ে আমার সব চিন্তাভাবনা জমাটবদ্ধ করে ফেলে।’

এই প্রবন্ধ লিখছি আর ভয়ে আছি মান্টো না আবার রেগে যায়। ওঁর সবকিছুই বরদাশত করা সম্ভব কিন্তু রাগ বরদাশত করা সম্ভব নয়। রেগে গেলে ওঁ একদম মূর্তিমান শয়তান বনে যায়, যদিও কয়েক মিনিটের জন্য, তবু ওই কয়েক মিনিট... আল্লাহর পানাহ চাই!

গল্প লেখা সম্বন্ধে ওঁ প্রচুর গুজব ছড়ায়। আমি জানি কারণ আমি ওঁর প্রতিচ্ছায়া। ওঁ নেহায়েত মিথ্যাবাদী। একবার ওঁ কোথাও লিখেছিল যে, ওঁর পকেটে অসংখ্য গল্প পড়ে থাকে। আসল কাহিনি পুরো উল্টো। যখন ওঁর গল্প লেখার ইচ্ছে হয়, রাতভর ভাবে, মাথায় কিছুই আসে না। তারপর ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই গল্পের রসদ যোগাতে খবরের কাগজে চোখ বুলায়। কিন্তু কোনো ফল হয় না। তারপর ওঁ গোসলখানায় যায় এবং মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে— যেন কোনো গল্প উঁকি মারে। কিন্তু এবারও নাকাম হয়। তারপর হতাশা থেকে বউয়ের সঙ্গে খামোখা ঝগড়া বাধায়। তাতেও ব্যর্থ হলে পান কেনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। পানটা টেবিলে রেখে দেয় তবুও গল্পের কোনো বিষয় মাথায় আসে না। সবশেষে কলম বা পেন্সিল হাতে নিয়ে ৭৮৬ লিখে যেই শব্দটা প্রথম মনে আসে তাকে কেন্দ্র করে গল্প লিখতে শুরু করে। ‘বাবু গোপীনাথ’ ‘টোবা টেক সিং’ ‘হাতক’ ‘মাম্মি’ ‘মোজেল’— গল্পগুলো এইরকম ফেরেববাজির মধ্য দিয়েই লেখা।

একী আজব বাত— লোকেরা ওঁকে ধর্মহীন ও অশালীন মনে করে। অবশ্য আমারও মনে হয় এসব দোষ ওঁর মধ্যে কিছু না কিছু পরিমাণ আছে। কেননা আকছার ওঁ খুবই জটিল বিষয় নিয়ে কলম ওঠায় এবং এমন সব শব্দের ব্যবহার করে যে এই ধারণা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমি জানি যে যখনই ওঁ লিখতে বসে পৃষ্ঠার শুরুতে প্রথমে ৭৮৬ লেখে— যার মানে ‘আল্লাহর নামে শুরু করছি’ বা বিসমিল্লাহ’।... এবং যে-লোকটা আকছার বিষয়ে খোদার নাফরমান কাগজে সে মুমিন হয়ে যায়! আর এই কাগজের মান্টোকে আপনি যেকোনো মুহূর্তে কাগজি-বাদামের মতো আঙুল দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারেন, অন্যথা লোহার হাতুড়ি পিটিয়েও বাঁকা করা যাবে এমন লোক ওঁ নয়।

এবার খুব অল্প কথায় মান্টোর ব্যক্তিত্ব সম্মন্ধে কিছু বলি। ওঁ একজন মিথ্যুক, চোর, দাগাবাজ আর অযথা চেঁচামেচি করে লোক জোগাড় করতে ওস্তাদ।

বেশিরভাগ সময় ওঁ বউয়ের অমনোযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে শতশত রুপি উধাও করে ফেলে। কোথাও থেকে ৮০০ ₹ এনে বউয়ের হাতে দিয়ে ব্যাটা চোর আড়চোখে দেখে নিবে রুপিগুলো কোথায় লুকাচ্ছে। দ্বিতীয় দিন দেখা যাবে ওখান থেকে একটা নোট গায়েব! বেচারি বউ যখন টের পাবে কুছ তো গড়বড় হ্যায়, ‘নিশ্চয় চারকবাকরদের কেউ একাজ করেছে’ ধরে নিয়ে আচ্ছামতন বকাঝকা শুরু করবে।

মান্টোর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে ওঁ সোজাসাপটা-কথা-বলার-মানুষ, কিন্তু আমি একথার সাথে একমত হতে মোটেও রাজি নই। মান্টো প্রথম সারির মিথ্যুক।... প্রথম প্রথম মিথ্যা দিয়েই সংসার চলে যেত, কেননা সেখানে থাকত মান্টোর বিশেষ ‘ছোঁয়া’, কিন্তু পরবর্তীতে ওঁর বউ ব্যাপারটা ধরে ফেলে যে, এখনতক ‘বিশেষ’ বিশেষণ যুক্ত করে ওঁ যা-ই বলেছে, সবই মিথ্যা। মান্টো অনর্গল মিথ্যে বলতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ইদানিং ওঁর পরিবারের লোকজন ধরে নিয়েছে যে ওঁর সবকথাই মিথ্যা!

মান্টো অশিক্ষিত। এই অর্থে যে ওঁ মার্কস পড়েনি, ফ্রয়েডের কোনো লেখা আজতক চোখেও দেখেনি, হেগেল বা হ্যাভলক এলিস— এঁদের নামটাই জানে কেবল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো লোকেরা, মানে সমালোচকরা বলে ওঁ নাকি এসব চিন্তকদের দ্বারা প্রভাবিত। আমি যদ্দূর জানি, মান্টো অন্য কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ওঁ মনে করে শিখাতে-চাওয়া-লোকজন সব ‘উল্লু'। দুনিয়া কাউকে শিখিয়ে বোঝানো যায় না, নিজে নিজে বুঝতে হয়।

মান্টো নিজেকে বোঝাতে আর সমঝাতে সমঝাতে এখন নিজেই ‘সমঝে’ পরিণত হয়েছে,— ওঁর অবস্থান এখন জ্ঞান ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। কোনো কোনো সময় ওঁ এমন ‘আউট-পটাং’ আলাপ করে যে, আমি না হেসে পারি না।

আমি আপনাদের জোর গলায় বলতে পারি যে মান্টো— যার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মোকদ্দমা চলছে— খুবই শুদ্ধতাপ্রেমী, আপাদমস্তক ভদ্রলোক। এর সাথে একথাও বলে রাখি— ওঁ এমন এক ফরাশ যে নিজেকে ঝাড়পোঁছ করে চলছে প্রতিনিয়ত।

সূত্র : রিসালায়ে নুকুশ, লাহোর। সংখ্যা ৪৫/৪৬। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই