চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

এক ঝাঁপি জেন গল্প



এক ঝাঁপি জেন গল্প

তর্জমা : মওলবি আশরাফ 


ভূমিকা

সংস্কৃত ‘ধ্যান’ শব্দ থেকে জাপানি ‘জেন’ শব্দের উৎপত্তি। জেন দর্শন বৌদ্ধ দর্শনের একটি শাখা। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারত থেকে চীন ও জাপানে পরিভ্রমণের পরিক্রমায় এর উদ্ভব ও বিকাশ। স্থির সংকল্পের সাথে চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের বিকাশ ও অবসান ঘটিয়ে পরম বিশ্বাস ধারণের এই পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়ার যাবতীয় কার্যকলাপের অধিশ্রয় এই মতবাদ। জেন সাধকগণ মনে করেন ধ্যান জরুরি, ধ্যানের মধ্য দিয়েই মন স্থিতিশীল হয়, মন উপলব্ধ করে জগতের রহস্য। 

এই দর্শনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হচ্ছে শূন্যতা। জাপানি লেখক দাইসেতসু তেইতারো সুজুকি তাঁর প্রবন্ধ The Philosophy of Zen-এ শূন্যতার ধারণাকে বাস্তবতার সমার্থক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, মানুষ তার পারিপার্শ্বিক জগতকে নিজের কাছে বোধগম্য করে তোলার চেষ্টায় বিভিন্ন প্রত্যয় বা ধারণা তৈরি করে এবং পরবর্তীকালে তাদের এই স্বনির্মিত ধারণাগুলোকেই বাস্তব হিসেবে ভাবতে শুরু করে। জেন দর্শনের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর উদ্দেশ্য থাকে বাস্তবতাকে ঘিরে থাকা এসব নিয়ম-জ্ঞানের বিদ্যা সরিয়ে এর স্বরূপ বা suchness-কে বের করে আনা, যা আদতে এক ধরনের শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নয় এবং তাঁর মতে, ‘এর অনুধাবন সম্ভব তখনই যখন এটি একই সাথে অনুসন্ধানের লক্ষ্য এবং উপলক্ষ্য।’

জেন চর্চা বিভিন্ন ধরণের ধ্যানের মাধ্যমে আত্মজ্ঞানের বিকাশকে কেন্দ্র করে সম্পাদিত হয়ে এলেও এর শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে Kōan, বা জনসাধারণ্যে প্রচলিত গল্প। মূলত দশম-একাদশ শতক থেকে জেন গুরু এবং শিষ্যের মৌখিক কথোপকথনগুলোর লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে এই প্রথার সূত্রপাত, পরবর্তীকালে এই পুরনো আলোচনা বা case এর ওপর পরবর্তী প্রজন্মের গুরু বা শিক্ষার্থীদের নতুন করে মন্তব্য করার প্রক্রিয়াই মূলত এর পুরো কার্যপদ্ধতি। এই কথোপকথনের এবং এতে সংযোজিত মন্তব্যের মূখ্য বিষয় হিসেবে থাকে কোন উপদেশ, নির্দেশনা অথবা কোন ঘটনার মূল্যায়ন অথবা কোন দ্ব্যর্থতা নিরূপণের প্রচেষ্টা। 

তবে জনসাধারণের কাছে জেন দর্শনের প্রচারণার প্রধানতম উপকরণ হিসেবে কাজ করে কিছু ‘গল্প’ যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূলত এই Kōan বা ঘটনাগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশ। সুতরাং এগুলোতে কাল্পনিক উপাদান কতটুকু তা প্রশ্নের অধীন। 

কিন্তু এ ধরণের বিচ্ছিন্ন গল্পগুলোর প্রকাশ ও পঠন কী উপযোগিতা ধারণ করে সাধারণের জন্যে তা আলোচনাসাপেক্ষ। কেননা গুরু-শিষ্যের প্রত্যক্ষ আলাপচারিতা, দ্ব্যর্থতার উত্থান ও তার অবসানের মধ্যবর্তী প্রক্রিয়া অথবা জেন দর্শনের তাত্ত্বিক ও প্রথাগত চর্চা এখানে পাঠকের অভিজ্ঞতায় অনুপস্থিত। 

এই পাঠ ব্যর্থ হবে না যদি প্রতিটি গল্পে আলোচ্য বিষয়ের কেন্দ্রকে ঘিরে পাঠক সক্রিয়ভাবে চিন্তাপ্রক্রিয়ায় নিযুক্ত হন, কারণ জেন দর্শনের অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই গল্পগুলোরও মুখ্য উপাদান— দ্বন্দ্ব, আর গল্পের আলোচনায় এর নিষ্পত্তি যদি থেকেও থাকে, এর উৎসের অনুসন্ধান বা বা অর্থ বিশ্লেষণ অথবা নতুন যুক্তির উত্থান হতে পারে পাঠকের ব্যক্তিগত অর্জন। [1] [2]


তুমি সাপ তুমিই ওঝা

এক জেন ছাত্র গুরু বানকেইর কাছে এসে অভিযোগ করল, ‘আমার প্রচণ্ড রাগ, রাগ উঠলে নিজেকে থামাতে পারি না, এর কোনো চিকিৎসা আছে?’

গুরু বললেন, ‘বেশ তো, একটু রাগ দেখাও তো।'

ছাত্র হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এখন কিভাবে দেখাব?’

গুরু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কখন দেখাতে পারবে?’

ছাত্র বলল, ‘এটা তো হঠাৎ করে ওঠে।’

বানকেই বললেন, ‘তাহলে নিশ্চয় এটা তোমার স্বভাবজাত নয়, নাহলে যখন তখন আমাকে দেখাতে পারতে। যখন তোমার জন্ম হয়েছে, এটা তোমার সাথে ছিল না, এমনকি তোমার বাবা-মাও এটা তোমাকে দেয়নি। তার মানে এই “সাপ” তোমারই লালিত। তো এবার ভেবে বের করো “ওঝা” কোথায়?’


সত্যিকার সুখ ও সমৃদ্ধি

এক ধনাঢ্য ব্যক্তি জনৈক জেন গুরুকে বললেন তার জন্য এমন কিছু ‘মন্ত্র’ লিখে দিতে যা তার পরিবারে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা আগলে রাখবে।

গুরু বড় একটি কাগজে লিখলেন, ‘পিতা মারা গেছে, ছেলে মারা গেছে, নাতি মারা গেছে।’

ধনী লোকটি গুরুর এহেন কর্ম দেখে রেগে গেলেন, বললেন, ‘আমি বলেছি সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে এমন কিছু লেখতে, অথচ আপনি কীসব অলক্ষুণে কথা লিখে দিলেন।’

গুরু বললেন, ‘যদি তোমার ছেলে তোমার আগে মারা যায়, তোমার পরিবার অসহনীয় দুর্দশায় পড়বে। তোমার নাতি যদি তোমার ছেলের আগে মারা যায়, সেটা তোমার পরিবারে বড় ধরনের দুঃখ বয়ে আনবে। কিন্তু তোমার পরিবার যদি প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমি যেভাবে লিখেছি সেভাবে মারা যায়, তাহলে সেটা স্বাভাবিক নিয়মমাফিক হবে। এবং এটাই সত্যিকার সুখ ও সমৃদ্ধি।’


পথই লক্ষ্য

এক তরুণ কিন্তু পরিশ্রমী শিক্ষার্থী জনৈক জ়েন গুরুর কাছে এসে বলল, ‘যদি আমি শিক্ষার্জনে অন্যদের চেয়ে বেশি সময় দিই, নিরলস সাধনা করি, তাহলে আমার আলোকপ্রাপ্ত হতে কতদিন লাগবে?’

গুরু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘দশ বৎসর।’

‘যদি আমি খুব বেশি শ্রম দিই, বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সারাক্ষণ শিক্ষার্জনে নিজেকে নিয়োজিত রাখি, তাহলে কতদিন লাগবে?’ ছাত্রটি এবার জিগ্যেস করল।

গুরু বললেন, ‘বেশ, তাহলে বিশ বৎসর লাগবে।’

ছাত্রটি বলল, ‘কিন্তু, আমি যদি তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি, সর্বোচ্চ শ্রম দিই, সেক্ষেত্রে?’

‘তিরিশ বৎসর’, গম্ভীরস্বরে জবাব দিলেন গুরু।

‘কিন্তু... আমি বুঝতে পারছি না’, হতভম্ব ছাত্রটি বলল, ‘যতবারই আমি বেশি শ্রমের কথা বলি, আপনি সময় আরো বাড়িয়ে দেন, এমন হচ্ছে কেন?’

গুরু বললেন, ‘তোমার এক চোখ যখন লক্ষ্যের দিকে থাকবে, পথ দেখার জন্য তখন একটি চোখই বাকি থাকবে।’


বিড়াল বাঁধার রীতি

অধিবিদ্যার শিক্ষক যখন ধ্যানচর্চার ক্লাস শুরু করেন, তাঁর গৃহপালিত বিড়াল এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে অসুবিধা তৈরি করছিল। তো তিনি বললেন ক্লাসের সময় প্রতিদিন বিড়ালটিকে বেঁধে রাখতে। এক বৎসর পর অধিবিদ্যার শিক্ষক মারা যান, কিন্তু ধ্যানচর্চার ক্লাসে বিড়াল বেঁধে রাখার নিয়ম তার পরেও জারি রয়ে যায়। এরপর ওই বিড়ালটি মারা গেলে নতুন আরেকটি বিড়াল এনে বাঁধা হয়।

একশ বছর পরে অগ্রসরী শিক্ষকদের জীবনকর্ম নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করতে গিয়ে একথাও উল্লেখ করা হয় যে— ধর্মীয় রীতি মোতাবেক তাঁরা সকলেই ধ্যানচর্চার ক্লাসে বিড়াল বেঁধে রাখার নিয়ম বজায় রেখেছেন!


ভাজা পিঠা

তিনজন চাকরিপ্রার্থী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিলেন। পথে হালকা নাস্তার উদ্দেশ্যে একটা পিঠার দোকানে ঢুকেন। একজন চুপচাপ স্থির হয়ে বসেছিলেন, বাকি দুই চাকরিপ্রার্থী সাহিত্য নিয়ে বাহাস করছিলেন।

পিঠাওয়ালি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?’

আলাপরত দুই চাকরিপ্রার্থী বললেন, ‘ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি।’

পিঠাওয়ালি বললেন, ‘আপনারা দুইজন পাশ করবেন না, ওই লোক করবে।’

তারা রুষ্ট চোখে পিঠাওয়ালির তাকিয়ে বের হয়ে আসলেন।

যখন রেজাল্ট বের হলো, দেখা গেলো পিঠাওয়ালির কথাই সঠিক।

তারা পিঠাওয়ালির কাছে ছুটে এসে জানতে চাইলেন তিনি মুখ দেখে ভবিষ্যৎ বলতে পারেন কিনা।

পিঠাওয়ালি বললেন, ‘না, আমি কেবল পিঠা সম্পর্কেই জানি— পিঠা যখন পুরাপুরি ভাজা হয়ে আসে, তখন আর আওয়াজ হয় না।’


সূত্র :

[1] কানিজ রাবেয়া বুশরা মোম রচিত জেন পাঠের ভূমিকা থেকে গৃহীত

[2] গল্পগুলো Zen stories to tell your neighbors থেকে অনূদিত 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই