চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বই না পড়ে থাকার উপায়


বই না পড়ে থাকার উপায়

মূল : আর্টুর শোপেনহাওয়ার 

তর্জমা : মওলবি আশরাফ 

অজ্ঞতা কেবল তখনই নিন্দনীয়, যখন অজ্ঞ ব্যক্তিটি ধনবান হন। গরিব মানুষের হাত-পা অভাব আর দারিদ্র্যে বাঁধা থাকে, দুই পয়সা কেমনে কামাই করা যায় এটাই তার একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান, এই চিন্তাই তার জ্ঞানার্জনের জায়গা দখল করে নেয়। কিন্তু যে সকল ধনবান লোক অজ্ঞ, তারা বেঁচে থাকে স্রেফ যৌনলালসা মেটাতে এবং তাদের চালচলন বনের জন্তু-জানোয়ারের মতো; সর্বক্ষেত্রে এমনই দেখা যায় : এবং তাদেরকে নিন্দা করা যায়, কারণ ধনদৌলত ও অবসরের মতো নেয়ামত পেয়েও তারা কোনো কাজে লাগাতে পারে নাই।

আমরা যখন কোনো বই পড়ি, তখন অন্য এক মানুষ আমাদের হয়ে চিন্তা করে দেন : আমরা কেবল তার মস্তিষ্কজাত চিন্তার পুনরাবৃত্তি করি। বাচ্চাকাচ্চারা যেমন নতুন লিখতে শুরু করার সময় শিক্ষকের লিখে দেওয়া অক্ষরের ওপর হাত ঘোরায়, বই পড়ার ব্যাপারটা এমনই— আমাদের চিন্তাটা আগেই একজন করে দিয়েছে। এই কারণেই দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আমরা যদি কোনো বই হাতে নিই, তখন কেমন নির্ভার বোধ হয়। বই পড়ার সময় আমাদের মস্তিষ্ক অন্যের চিন্তার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই কারণে একজন পাঠক যদি দিনের প্রায় পুরো অংশ বই পাঠে ব্যয় করে, অবসর বা এক বই শেষে অন্য বই ধরার মধ্যবর্তী সময় কোনো চিন্তা-ফিকির ছাড়াই কাটান, তিনি ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র চিন্তার শক্তি হারিয়ে ফেলেন; যেভাবে সবসময় গাড়িতে চলাচল করা ব্যক্তি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এমন পরিণতি বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের বেলায় হয়েছে যে, তারা পড়ে পড়ে আরও নির্বোধে পরিণত হয়েছে। কেননা অবসর পেলেই বই পড়লে, মানে অন্য কিছু না করে কেবল পড়ে গেলে, মস্তিষ্কে সারাদিন অক্লান্ত গতরখাটা শ্রমিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে, অচল হয়ে যায়। শ্রমিক বেচারাও তো অন্তত আপন খেয়াল-ভাবনায় কিছু সময় কাটায়, কিন্তু আমাদের পাঠকেরা তাও পায় না। চালু মেশিনে স্প্রিং যেমন কখনোই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, অন্য ব্যক্তির চিন্তা অনবরত চেপে বসতে থাকলে মনেরও তেমন পরিণতি ঘটে। অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাবারও যেমন মানুষকে অসুস্থ করে দেয়, মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত খাদ্যদানও তেমনই স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তিকে মেরে ফেলে। আপনি যতই পড়েন না কেন, অল্প কিছু কথাই আপনার মনে থাকবে। মন একখানা স্লেটের মতো, নতুন কিছু লিখলে পুরনো লেখা মুছতে হয়, বসে বসে জাবর কাটার সময় নেই। মানে, আপনার যদি বইয়ের লেখাজোখা হজম করতেই হয়, একখানা উপায়ও কেবল আছে— যা পড়বেন, নিজের চিন্তা-ফিকিরের সাথে মিশিয়ে তাকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করবেন। নয়তো যা পড়েছেন, মন থেকে শেকড়সুদ্ধ সব গায়েব হয়ে যাবে। মস্তিষ্কের খাবার শরীরের খাবারের মতোই, যা খাবেন বড়জোর তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ শরীরে থাকে, বাকি সব মলমূত্রের সাথে বেরিয়ে যায়।

এতসব কথার মানে এই— কাগজে লেখা চিন্তা সমুদ্রে বালির ওপর পায়ের ছাপের মতো : আপনি পথিকের পায়ের নিশানা দেখতে পাবেন, কিন্তু ওই লোক কী কী দেখেছে তা দেখতে হলে আপনার পথিকের চক্ষু অধিকার করতে হবে। 

লেখকের বাকচাতুর্য, কল্পনাশক্তি, উপমা-চিত্রায়ণ-দক্ষতা, দৃঢ়তা, তিক্ততা, বীরত্ব, ঔদার্য, প্রকাশদক্ষতা বা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, অভাবনীয় প্রতিতুলনা, অল্প কথায় অনেক ভাব প্রকাশ বা সহজ-সরল উপস্থাপন— এ ধরনের যত গুণই থাকুক না কেন, এমন কোনো তেলেসমাতি উপায় নাই যে আপনি বই পড়ে লেখকের সেসব গুণ আত্মস্থ করতে পারবেন। কিন্তু এই গুণগুলি যদি আগে থেকেই আমাদের মধ্যে থাকে, বই পড়ে আমরা হয়তো সেসবকে সচেতন মনে জাগিয়ে তুলতে পারি; আমরা শিখতে পারি গুণগুলিকে স্থান-কাল ভেদে ব্যবহারের কৌশল; আমাদের মতি গতি খুঁজে পায়, সাহসী হয়ে ওঠে, তুলনার মাধ্যমে আমরা সেইগুলিকে আরও শাণিত করতে পারি, সেগুলিকে জায়গামতো প্রয়োগ ঘটাতে পারি; আর যখন লক্ষ্যে পৌঁছাই, আমরা মনে করি সত্যিকারভাবে এই গুণগুলির অধিকারী। কেবলমাত্র এই পদ্ধতিতে বই পড়া ফায়দা দেয় যে, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত নেয়ামত আমরা কাজে লাগাতে পারি। আর এই নেয়ামত প্রকৃতি আমাদের জন্মের সময়ই দিয়ে রেখেছেন, আমরা খালি ব্যবহার করা শিখি নাই। এসব ছাড়া বই কতগুলো শীতল, মরাধরা নিয়মনীতি আর ভাসা-ভাসা অনুকরণ ব্যতীত কিছুই শেখায় না।

আমি এখানে ধড়িবাজির একটি কৌশল আপনাদের বলি, স্বীকার করতেই হয় বহু পেশাদার সাহিত্যিক, ফরমায়েশি লেখক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতারা এই কৌশল ব্যবহার করে সফল হয়েছে। মানসম্মত কাজ ও সময়-সংস্কৃতির প্রকৃত বয়ান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তারা পুরো ফ্যাশন জগতটাকে মূল তন্ত্রী বানাতে সফল হয়েছে, তারা মানুষজনকে ‘ইদানিংকালের লেখাজোখা’ এবং একই জিনিস পড়ার কালচার গড়ে তুলেছে। যেমন, নতুন বই; এবং তারা পরিচিত যে মহলগুলোতে বইকেন্দ্রিক আড্ডা হয়, খাওয়া-দাওয়া হয় চলে, সেখানে নির্দিষ্ট বইকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। এভাবেই অনেক মানহীন ও বাজে উপন্যাস (বিক্রি-বাট্টার মতলবে) প্রকাশকদের হাতে ‘না পড়লে জীবন বৃথা’ ক্যাটাগরির হয়ে ওঠে।

যেভাবে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ অতীতের জীবসকলকে স্তরে স্তরে ধারণ করে থাকে, লাইব্রেরির সারি সারি বইয়ের তাকও অতীতের সমুদয় ভুলভ্রান্তিকে সেভাবে সংরক্ষণ করে চলে। অতীতকালের জীবের মতো এই বইগুলোও নিজ নিজ সময়ে প্রাণপ্রাচুর্যময় ছিল, এবং ব্যাপক শোরগোল মাচিয়েছিল; কিন্তু এক্ষণে সেসব ঠাড় মারা আর জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। এখন তাতে কেবল জীবাশ্মবিজ্ঞানীর আগ্রহ।

হেরোডোটাসের ভাষ্যমতে, রাজা জেরেক্সেসের তার বিশাল সেনাবাহিনী দেখে চোখ অশ্রুতে ভিজে উঠেছিল, দুঃখপীড়িত কণ্ঠে বলেন— আজ থেকে একশ বছর পর এদের কেউ বেঁচে থাকবে না। তেমনই নতুন বইয়ের এক প্রমাণ সাইজের ক্যাটালগ দেখে কেউ হয়তো কেঁদে ফেলবে— আজ থেকে দশ বছর পরে এসব নামীদামি বইয়ের একটারও নাম শোনা যাবে না। 

সাহিত্য মানুষের জীবনের মতোই : আপনি যেভাবে কোনো ভালো জায়গায় বেড়াতে গেলে দেখেন মানুষ গিজগিজ করছে, গরমের দিনের মাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ, সব নোংরা ও কাদা-কাদা করে ফেলছে; বইয়ের জগতে ‘খারাপ বইয়ের’ ফিরিস্তিও এমন অগুনতি। সাহিত্যের এইসব আগাছা শস্য থেকে পুষ্টি শুষে নেয়, এবং ক্ষেত নষ্ট করে। 

মূল্যবান সময়, উপযুক্ত সম্মানী আর জনগণের মনোযোগ— যা প্রকৃতপক্ষে ভালো বই ও মহৎ উদ্দেশ্যময় শ্রমসাধনার প্রাপ্য, এসব ‘খারাপ বই’ সেসবের জায়গা দখল করে নেয়: এসব কেবল অর্থ উপার্জন বা বাজার ধরার মতলবে লেখা হয়। তাই এসব কেবল অন্তঃসারশূন্য নয়; এসব খুব সুন্দর-সুন্দর কথার মোড়কে পাঠককে বিপথগামী করে। আজকালকার জমানায় নব্বই পার্সেন্ট বইয়ের লক্ষ্য জনসাধারণের পকেট থেকে কয়েকটা পয়সা বের করা ছাড়া অন্য কিছু না; এবং এই লক্ষ্য সাধনে লেখক, প্রকাশক, রিভিউ লেখক, ও সমালোচকেরা সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

আমি এখানে ধড়িবাজির একটি কৌশল আপনাদের বলি, স্বীকার করতেই হয় বহু পেশাদার সাহিত্যিক, ফরমায়েশি লেখক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতারা এই কৌশল ব্যবহার করে সফল হয়েছে। মানসম্মত কাজ ও সময়-সংস্কৃতির প্রকৃত বয়ান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তারা পুরো ফ্যাশন জগতটাকে মূল তন্ত্রী বানাতে সফল হয়েছে, তারা মানুষজনকে ‘ইদানিংকালের লেখাজোখা’ এবং একই জিনিস পড়ার কালচার গড়ে তুলেছে। যেমন, নতুন বই; এবং তারা পরিচিত যে মহলগুলোতে বইকেন্দ্রিক আড্ডা হয়, খাওয়া-দাওয়া হয় চলে, সেখানে নির্দিষ্ট বইকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে। এভাবেই অনেক মানহীন ও বাজে উপন্যাস (বিক্রি-বাট্টার মতলবে) প্রকাশকদের হাতে ‘না পড়লে জীবন বৃথা’ ক্যাটাগরির হয়ে ওঠে। এই ধরনের ধড়িবাজদের খপ্পরে পড়ে যাওয়া পাঠকশ্রেণির জন্যে দুঃখ ছাড়া আর কী করা যায়— যারা সবসময় অত্যন্ত সাধারণ মানের লেখকদের সর্বশেষ কাজগুলি পড়তে বাধ্য হয়, যেসব বই শুধুমাত্র অর্থের জন্য লেখা, এবং যার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এবং এই ধড়িবাজির কারণে পাঠকশ্রেণি সর্বকালের সর্বজনীন লেখকদের উচ্চমানের বইগুলোর কেবল নাম জেনেই সন্তুষ্ট থাকে। সাহিত্য পত্রিকাগুলোও পাঠকদের ছিনতাই করে নিজ মহলে ভেড়াবার কলকারখানা। যদি প্রকৃতঅর্থেই সভ্য-সংস্কৃতিবান হতে হয়, তাহলে সমসময়ের চটকদার বইয়ের স্থলে প্রকৃত সাহিত্যের মূল্যায়নে নিজেকে নিবেদিত করা উচিৎ।

কোনো বই শুধুমাত্র এই কারণে হাতে না নেওয়া যে বইটি খুব প্রায় সবাই পড়ে; যেমন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পুস্তিকা, সস্তা উপন্যাস, সারহীন কবিতা, বা বিতর্ক সৃষ্টি করে পরিচিতি পাওয়া বই— যেগুলো প্রকাশের বছরেই বেশ কয়েকটি সংস্করণ বের হয়ে যায়— এই ধরনের বই পড়া থেকে বিরত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভেবে দেখুন, যিনি বোকাদের জন্য লেখেন, তিনি সবসময় একটি বড়সড় পাঠকগোষ্ঠী সম্পর্কে নিশ্চিত থাকেন। তাই বই পড়ার জন্য আপনার সময় সীমিত করার বিষয়ে সতর্ক হোন। এবং এই সময়টাকে একচ্ছত্রভাবে সেই সব বইয়ের ক্ষেত্রে লাগান, সর্বকালের সেরা মানবগণ যেই কাজগুলিতে জান কোরবান দিয়েছেন, যারা কাজ করেছেন কেবল মানুষের কল্যাণে, যারা লিখেছেন জনতার কণ্ঠস্বরে জনতার উন্নয়নে। এই মহাপুরুষেরা সত্যিই জ্ঞানী এবং সুপথ নির্দেশক। 

এমনিতে আপনি কখনোই মানহীন সাহিত্য খুব কম পড়তে পারবেন না, (কারণ এই ধরনের সাহিত্য খুবই মুখরোচক) আবার ভালো সাহিত্য খুব বেশি পড়তে পারবেন না। খারাপ বই বুদ্ধিবৃত্তিক বিষ; তারা মন এ মননশীলতাকে ধ্বংস করে ফেলে। তাই কখনোই খারাপ বই পড়বেন না, কারণ জীবন সংক্ষিপ্ত এবং এই ধরনের বই পড়ে সময় নষ্টের কোনো প্রয়োজন নাই।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই