চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

দেওবন্দি চিন্তায় শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক



দেওবন্দি চিন্তায় শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক 

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ 


দেওবন্দি চিন্তায় 'শিয়া সুন্নি সম্পর্ক' নিয়ে গভীর আলাপের আগে এর রুপ , প্রকৃতি ও ধরন নিয়ে বিবেচনা অত্যন্ত তাৎপর্য-পূর্ণ। কারণ, এছাড়া দিনশ্যাষে অনেক আলাপের ইতি-টা পষ্ট হয় না। বিশৃঙ্খলার বাইরে সমাধানের কোন পথ সরলরেখায় আবিষ্কার করা যায় না। এজন্য দেওবন্দি চিন্তায় শিয়া সুন্নি সম্পর্কের দুটি ক্ষেত্র -ধর্মীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক-  স্পষ্ট করতে চাই ; উভয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিধি ও প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করতে চাই। 

ক - শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের আকিদাগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক :   

দেওবন্দি চিন্তায় শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক নিয়ে পাঠ ও পর্যালোচনার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। দেওবন্দি চিন্তার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব যিনি - শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী -তাকে মুসনাদুল হিন্দ হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি নিজেও শিয়া মতাদর্শকে কাউন্টার করেছেন। তার ছেলে শাহ আব্দুল আজিজ রহ. লিখেছেন 'তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া'। উভয় কিতাব সেই সময়ের পটভূমিতে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

আব্দুল্লাহ নওশাহরাভি বলেন যে, ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী রহ. এর 'কাশফুল খফা আন খিলাফাতিল খুলাফা'র মাধ্যমে শিয়া মতাদর্শের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে। আর শাহ আব্দুল আজিজের তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া লেখার পর শিয়া মতাদর্শের গোপনীয়তা আরও বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এই দু'টি কিতাব থেকে ব্যাপকভাবে মানুষ উপকৃত হয়েছে। এর ব্যাপকতার সামান্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিরোধীদের পাঠ ও প্রতিক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টি দিলে। শুধুমাত্র 'তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া' গ্রন্থের রদে প্রায় বিশটির মতো গ্রন্থ শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে। 

পরবর্তীতে হাকিমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহি . লিখেছেন 'শহিদ কারবালা আওর ইয়েযিদ'। 'শহিদ কারবালা' নামে আরেকটি কিতাব আছে মুফতি শফি রহ. এর নামে। মাওলানা মানজুর নুমানী লিখেছেন 'ইরানি ইনকিলাব ইমাম খোমেনি আওর শিইয়্যাত'। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে, বিভিন্ন কিতাবে ওলামায়ে দেওবন্দ 'শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক' নিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনা করেছেন। 

দেওবন্দি চিন্তায় শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক নিয়ে যত আলাপ ও পর্যালোচনা গড়ে উঠেছে, তার প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - শিয়াদের ব্যাপারে সামগ্রিক বা মুতলাক ভাবে কোন ফায়সালা তারা দেন নি। সকলেই নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস ও মূলনীতির আলোকে ফতোয়া দিতেন। যেমন, তাহরিফে কুরআন, শাইখাইনকে পথভ্রষ্ট বলা ,ইমামদেরকে খোদার স্থানে আসীন করা , নবি ও ফেরেশতাদের থেকেও ইমামদেরকে মর্যাদাসম্পন্ন মনে করা। ইত্যাদি বিশ্বাস যেসব শিয়ারা লালন করে, তারা নিশ্চিত কাফের। অন্যথায়, যদি এসব আকিদাতে বিশ্বাস না রাখে , তাদেরকে গোমরাহ তো বলা হবে,  কিন্তু , তাদের কুফুরির ব্যাপারে দেওবন্দি আলেমগন সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। 

১ . 

এক্ষেত্রে আমরা শাহ আব্দুল আযীয রহ. এর ' তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া' তে দেখি যে, তিনি শিয়াদেরকে বিভিন্ন শ্রেণী ও দলে বিভক্ত করছেন। মোটাদাগে তিনি চারটি দলের আলোচনা এনেছেন - 

প্রথমত, ঐ সকল শিয়া, যারা আলি রা .এর সময়ে ছিলেন। তাকে সঙ্গ দিয়েছেন, উপযুক্ত মর্যাদা তাকে দিয়েছেন। ফিতনার কালে বিভিন্ন যুদ্ধে আলি রা . এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। আবার কেউ কেউ বিপরীতে অবস্থান নিলেও , আলি রা. ও আহলে বাইতের প্রতি তাদের ভালোবাসা ছিল। এদের মধ্যে আছেন - তালহা , জুবায়ের ও উম্মুল মু'মিনিন আয়েশা রা . প্রমুখ সাহাবী। ৩৭ হিজরি পর্যন্ত সময়ে তাদের উপস্থিতি ছিল। এদেরকে 'মুখলিছিন' শিয়া বলে উল্লেখ করেছেন শাহ আব্দুল আযীয রহ.। 

দ্বিতীয়ত, তিনি আরেক ধরনের শিয়াদের কথা উল্লেখ করেছেন - যাদের তিনি 'তাফদিলিইয়্যা' বলে নামকরণ করেছেন। তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - তারা আলি রা. কে অন্যান্য সাহাবীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিতেন। কিন্তু, কোন সাহাবীকে কাফের আখ্যা দেওয়া তো দূরের কথা, কাউকে গালমন্দ পর্যন্ত করেন নি। আবুল আসআদ দুয়ালি ছিলেন তাদের একজন ; যাকে নাহুর আবিষ্কারক বলা হয়। আরো ছিলেন আবু সাঈদ ইয়াহইয়া, সালেম ইবনে হাফসা প্রমুখ আলেমগন। তাদের সূচনা হয়েছিল শিয়া মুখলিছিনদের দুই বছর পর। তবে বলা হয় যে, আলি রা . জীবিত থাকতেই বুঝতে পেরেছিলেন , তাকে কেউ কেউ শাইখাইনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে। তখন তিনি বলে ছিলেন , "যদি আমি শুনি কেউ আমাকে শাইখাইনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে, আমি তাকে অপবাদের শাস্তি দেব" তথা : চল্লিশটি বেত্রাঘাত করবো। 

তৃতীয়ত , 'সাবাইয়্যা' শিয়া - যারা আমীরে মুআবিয়া রাযি . এর সময়ে আব্দুল্লাহ বিন সাবার উস্কানিতে তৈরি হয়েছিল। এরা সাহাবীদের গালমন্দ করতো। পরবর্তীতে প্রথম প্রকারের লোকদেরকে 'শিয়া' নামে ডাকা হতো না, এই তৃতীয় শ্রেণী থেকে পৃথক করার জন্য। এবং তারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ নামে পরিচিতি লাভ করেন। কিছু কিছু ইতিহাসবিদের বর্ণনায় যখন দেখা যায় যে, তারা গ্রহণযোগ্য লোকদেরকে শিয়া বলতেছেন - যেমন , ওয়াকিদি- তখন বুঝতে হবে , এখানে শিয়া শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য প্রথম প্রকারের শিয়া।  

চতুর্থত, যে শ্রেণীর শিয়ারা 'গুলাত'দের অন্তর্ভুক্ত। তারা সবচে কট্টর। তাদের কোন কোন দল আলি রাযি . এর উলূহিয়্যাহ পর্যন্ত দাবি করেছে (নাউযুবিল্লাহ)। এদের সংখ্যা স্বল্প হলেও আব্দুল আযীয রহ. এদেরকে ২৪ টি দলে বিভক্ত করেছেন। এই চব্বিশ দলের মধ্যে 'ইমামিয়্যাহ' হচ্ছে প্রসিদ্ধ একটি দল - যাদের আবার উনচল্লিশটি উপদল আছে শাহ সাহেবের বিশ্লেষণ অনুযায়ী। এর মধ্যে প্রধান একটি দল হলো 'ইসনা আশারিয়া' - সাধারণভাবে যখন ইমামিয়া বলা হয়, তাদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়। তারা বারো ইমামে বিশ্বাস করে, এবং শেষ ইমামকে অন্তর্হিত বলে ধারণা করে থাকে। [১]

২ .

আশরাফ আলী থানভী রহ. বলেন , 

অনেকগুলো কুফুরি আকিদা শিয়া মতাদর্শের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ নিজেকে 'শিয়া মতবাদের' প্রতি সম্পৃক্ত করে ,শিয়া বলে পরিচয় দেয়, তখন প্রকারান্তরে যেন সে এইসব আকিদা মেনে নিল। তখন তাকে কাফের বলাতে আর কোন বাধা থাকে না। যদি এইসব আকিদাগত মাসআলা শিয়া ঘরানার লোকদের মধ্যে মতভেদপূর্ণ হতো , তবুও তাদেরকে কাফের বলার সুযোগ ছিল। কিন্তু, দেখা যায় যে, শিয়াদের মধ্যে অল্প কয়েকজন শুধু এসব আকিদায় দ্বিমত পোষণ করেছে। এবং তাদের এই দ্বিমত জমহুর শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট অ-গ্রহনযোগ্য। সুতরাং, শিয়াদের ক্ষেত্রে 'তাকফির'টাই মূলকথা হিসেবে বিবেচিত হবে।

তবে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যদি সুস্পষ্ট ভাবে বলে যে , 'আমি এসব কুফরি আকিদায় বিশ্বাস করি না' তাকে কাফের বলা হবে না। অথবা কোন দল যদি নিজেদেরকে শিয়া পরিচয় ছাড়া অন্য কোন ইমামের পরিচয়ে পরিচিত করে , যেই ইমামের মাঝে কুফুরি আকিদা নেই , তখন সেই দলকে তাকফির করা হবে না। [২]

অনেকেই আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলতে চায় যে , তিনি মুতলাক বা সামগ্রিক ভাবে তাকফির ফতোয়ার প্রবক্তা ছিলেন। তারা সম্ভবত থানবী রহ. এর উদ্ধৃতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। কারণ, তিনি শুধুমাত্র 'আকছারিইয়্যাত' বা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে একটি মৌলিক সুত্র দেখিয়েছেন। যা আদতে শিয়া মতাদর্শের সাধারণ প্রবনতা। পাশাপাশি শিয়া মতাদর্শের যারা সংখ্যালঘু -কুফুরি আকিদায় বিশ্বাসী না- তাদের জন্যেও থানবী রহ. এখানে স্পেস রেখেছেন। এবং কেউ যদি তার আকিদা-বিশ্বাসের স্বচ্ছতা  প্রকাশ করে , তার ক্ষেত্রে তাকফির প্রযোজ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন। উনার অবস্থানকে মুলত 'তাকফির বিল ওসফ' হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। 

 ৩ .  

মুফতি শফি রহ. 'জাওয়াহিরুল ফিকহ' গ্রন্থে যেখানে শিয়াদের নিয়ে আলোচনা করেছেন , সেখানে তিনিও মুতলাক তাকফিরের পক্ষে ছিলেন না। তিনি সেখানে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন শিয়াদেরকে -

প্রথমত, যাদের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানা যাবে যে , তারা কুফুরি আকিদা লালন করে , তাদের কাফের হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। 

দ্বিতীয়ত, যাদের ব্যাপারে অবহিত হওয়া যাবে যে , তারা 'জরুরিয়াতে দ্বীন' তথা : দ্বীনের আবশ্যিক মৌলিক বিষয়াদিকে অস্বীকার করে না, তাদেরকে সর্বসম্মতিক্রমে মুসলিম আখ্যায়িত করা হবে। কিন্তু, তারা তাদের ভ্রান্ত চিন্তধারার জন্য গোমরাহ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে তাদের সাথে লেনদেনের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে। 

তৃতীয়ত,  শিয়াদের মধ্যে যাদের ব্যাপারে সংশয় থাকবে। যাদের আকিদার ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে না, তাদের ক্ষেত্রে -কুফর ও ইসলাম - কোনটারই বিধান আসবে না। এবং তাদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবে। মুফতি শফি রহ. তার এই অবস্থানের পক্ষে আশরাফ আলী থানভী রহ. এর 'ইমদাদুল ফতোয়া'র সপ্তম খন্ডের আহলে কিতাব ও খুনসা তথা: হিজরার বর্ণনা সংক্রান্ত আলোচনাকে মেছাল হিসেবে নিয়েছেন। 

মুফতি শফি রহ. ইমদাদুল ফতোয়া থেকে চয়ন করে বলতেছেন যে , যদি কোন নির্দিষ্ট লোক বা দলের কুফুরির ব্যাপারে সংশয় তৈরি হয় ; সেই সংশয় আলেমদের মতানৈক্যের কারণে হোক বা উসুলের নিপুনতার জন্যে অথবা আলামতের দ্বিমূখীতার কারণে হোক - সে ক্ষেত্রে সবচে নিরাপদ পন্থা হলো , তাদের ক্ষেত্রে কুফর বা ইসলাম - কোনটারই বিধান আরোপিত না করা। তাদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। 

তবে যদি তাদের কুফুরি আকিদার ব্যাপারে তাহকিক করার সুযোগ থাকে , তাহলে তাহকিকের পর যা প্রমাণিত হবে , সে হিসেবে হুকুম জারি হবে। আর যদি তাহকিকের সক্ষমতা না থাকে , তাহলে নিশ্চুপ থাকতে হবে। এবং তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা হবে। [৩]

৪ . 

মুশতাক আহমদ নামে এক লোক মুফতি তাকি উসমানী সাহেবকে প্রশ্ন করেন , মুতলাক ভাবে শিয়াদের কাফের হওয়ার ব্যাপারে। তার প্রশ্ন ছিল এমন যে, কিছুদিন আগে একটি সম্মিলিত ফতোয়া-পত্র বেরিয়েছিল, তাতে পাকিস্তান ও ভারতের বড় বড় আলেমগন শিয়াদের মুতলাক কুফুরির ব্যাপারে সাক্ষর করেছেন। কিন্তু, সেখানে আপনার সাক্ষর পাই নি। তাছাড়া আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছে যে, মুফতি রফি উসমানি শিয়াদের তাকফিরের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করবেন , দয়া করে। -ইতি আপনার প্রতি মুখলিস , মুশতাক আহমদ।

মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের জবাব - 

"যেই শিয়া কুরআন বিকৃতির কথা বলে, জিবরাইল আ. ওহি ভুল স্থানে নিয়ে গেছেন মনে করে, এবং আয়েশা রাযি .এর উপর অপবাদ আরোপ করে , তার কুফুরির ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু, এ কথা  মুহাক্কাক বা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত না যে, তাদের সবাই এসব আকিদাতে বিশ্বাস রাখে। আবার কাফি ও উসুলুল কাফিতে যতো কথা আছে , সেসবকে তারা সঠিক মনে করে না - এটিও মুহাক্কাক না। অথচ তাকফিরের ব্যাপারটা খুবই সংবেদনশীল। এজন্য অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। ধরে নিলাম , কেউ যদি তাকিয়া করেও থাকে , সেটা তার বাতেনি বিষয় ; সে তার ভিতরগত কুফুরির কারণে আল্লাহর কাছে কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু, ফতোয়া তো তার যাহির বা বাহ্যিকতার উপরেই নির্ভর করবে। এজন্যেই চোদ্দশত বছরের ইলমি ঐতিহ্যে জমহুর ওলামায়ে উম্মত মুতলাক বা সামগ্রিক ভাবে ফতোয়া দেওয়ার পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু আকিদা উল্লেখ করতেন। এবং বলতেন , যদি এসব আকিদা কোন শিয়ার মধ্যে পাওয়া যায়, সে কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে। এই পন্থাই ছিল দেওবন্দি চিন্তার অধিকাংশ আলেমদের মধ্যে। এজন্য দারুল উলূম করাচিতে মুফতি শফি রহ. থেকে নিয়ে আকাবিরদের ধারা এমনি ছিল। মুতলাকভাবে শিয়াদের কাফের বলা হতো না। বরং সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। এর অর্থ এই নয় যে, তারা গোমরাহ না। বরং যাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলা হচ্ছে, তারাও গোমরাহ , পথভ্রষ্ট। [৪] 

৫ . 

জামিআ বিন্নূর টাউনের দারুল ইফতা থেকে প্রকাশিত একটি ফতোয়া হুবহু তুলে ধরছি এখানে -

"যে শিয়া কুফুরি আকিদা ধারণ করে, যেমন - প্রচলিত কুরআনকে বিকৃত মনে করা , জিবরাইল আ . ওহি ভুল স্থানে নিয়ে গেছেন মনে করা , আলি রা. এর উলূহিয়্যাহ দাবি করা , আয়েশা রাযি . কে অপবাদ দেওয়ার মতো আকিদা-বিশ্বাস যারা লালন করে , তাদের কুফুরের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। 

আর যদি কোন শিয়া এইসব আকিদা পোষণ না করে। বরং এসব থেকে নিজের মুক্ততা যাহির করে , তাদেরকে কাফের বলা যাবে না। এজন্য জমহুর আলেমগন শিয়াদেরকে মুতলাক বা সামগ্রিক ভাবে কাফের বলা থেকে বিরত থাকতেন। 

তবে যারা এসব বিশ্বাস থেকে মুক্ত, তারাও আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তারাও পথভ্রষ্ট, ভ্রান্ত। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন। [৫]

হুবহু ফতোয়া দারুল উলূম দেওবন্দের 'দারুল ইফতা'র সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি ৮০৩ নং ফতোয়া হিসেবে একটি বিবরণ দেওয়া আছে - সেখানেও নির্দিষ্ট আকিদার ভিত্তিতে কাফের বলা হয়েছে। 

তবে হ্যাঁ!  দেওবন্দি কিছু কিছু আলেমগনের ফতোয়া থেকে মুতলাক কুফুরির ব্যাপারে ইশারা পাওয়া যায়। সেসব অবশ্য দেওবন্দিদের মৌলিক চিন্তা না।  তবে তাদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এটা তাদের নিজস্ব তাহকিক বা পর্যবেক্ষণ। এই ভিন্নতার কারণ হলো - ওলামায়ে দেওবন্দ সাধারণত যুগের চাহিদা, নানাবিধ হেকমত ও নিজস্ব ইলমি যাওক থেকে কোন একটা মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সুতরাং, বলা যায় যে, দেওবন্দি চিন্তায় শিয়াদেরকে মুতলাকভাবে কাফের বলা হয় না। বরং নির্দিষ্ট কুফুরি আকিদার উপস্থিতির শর্তে তাকফির করা হবে। 

যারা মুতলাক তাকফিরের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন , তাদের ক্ষেত্রেও পরিবেশ-পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সরফরাজ খান সফদরের রহ. অবস্থান ও তার মূল্যায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে 'জাইশে সাহাবা' শিয়াদের তাকফিরের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতো। তারা শিয়াদের ব্যাপারে মুতলাকভাবে কুফুরির কথা বলতো। 

১৯৯২ ঈ. সনে পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেম  মাওলানা সরফরাজ খান সফদর রহ. 'সিপাহে সাহাবা'-র নেতৃত্বশীলদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, যার বিবরণ নিচে তুলে দিলাম - 

“ইরানের তাগুতী অনুশাসনের  মদদপুষ্ট রাফিজিয়্যাতের পাকিস্তানে প্রবেশের  পথ বন্ধ করার যে কাজটি 'সিপাহে সাহাবা' করেছে ,  তা শুধু সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজই না বরং দ্বীনী দিক থেকে ফরজে কিফায়াহ ছিল। আল্লাহ আপনাদের পবিত্র এ প্রচেষ্টাকে সফল করুন , এর প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিন।

মনকষ্ট না হলে ,কয়েকটি জরুরি বিষয় উপস্থাপন  করার সাহস করছি -

১. যুবকদের যেই মানসিকতা  আপনারা গড়ে  দেন বা দিবেন, তারা তাই আত্মস্থ করবে। কেননা,  তাদের অধিকাংশের দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান নেই, আকাবিরদেরকেও তারা দেখেনি। আপনারা তাদের যা বলবেন, তাকেই তারা শেষকথা হিসেবে বিবেচনা করবে। দেহ-মন উজাড় করে দিবে তার পেছনে। 

২. তরুণরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে ; উচ্ছাসের কারণে তারা অনেক কিছু বলে ফেলে , করে বসে। কঠোরতা দিয়ে কখনও সমস্যার সমাধান হয় না। শক্তি প্রয়োগ করে  কোন ব্যক্তি ও মতাদর্শকে বিলুপ্ত করা যায় না।... এজন্য  নিবেদন করছি যে, যুবকদেরকে বলে কয়ে কঠোরতা থেকে বিরত রাখুন। রাফেজীদের কুফর নিয়ে সন্দেহ নেই ঠিক , কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে 'কাফের' লেখা , শ্লোগান দেওয়ার  দ্বারা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হবে। বাস্তবতা খুবই স্পষ্ট। বোঝানোর কিছু নেই।

৩. সম্ভবত, কিছু আবেগী ও জযবার অধিকারী ও পাতলা চিন্তার লোক আমার এ লেখার থেকে অর্থ খুঁজে বের করবে যে , 'আমি বিক্রি হয়ে গেছি , দমে গেছি'। এমনটা মোটেও যথার্থ হবে না। আল্লাহর রহমতে ,  এই গুনাহগার তারুণ্যে ও  ভীষণ দারিদ্রে যেমন বিক্রি হইনি বা দমিনি, এখন আশি বছরের বার্ধক্যে, জীবনসন্ধ্যায় কবরের কাছে পৌঁছে কিভাবে বিক্রি হবো বা দমে যাবো!"

চিঠিতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন ; সেসব জাইশে সাহাবার গঠনতন্ত্র ও অন্যান্য প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। 

এক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক দিক মাথায় রাখলে বিচার-বিশ্লেষণে ভারসাম্য আসে , তা হলো - 

ক .  শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস অনেকটা ধোঁকা, প্রতারণা ও মেকির ভেতরে আচ্ছন্ন থাকা ইতিহাস। বিশেষত, শিয়া মতাদর্শের নেতৃত্বে থাকা লোকেরা 'সুন্নি' প্রশ্নে কখনও সরলতা ও স্বচ্ছতার পরিচয় দেয় নি। যখন রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য শিয়ারা প্রতারণার আশ্রয় নিতো , তখন দেওবন্দি চিন্তার আলেমগন তাদের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। আবার যখন শিয়াদের নমনীয়তা দেখা গেছে, সুন্নিদের ঐক্যের প্রবনতা থেকে তখন তারা অবস্থানগত দিক থেকে শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন। এই কারণে কখনও কখনও, কোন কোন আলেমের মধ্যে কঠোরতার নীতি দেখা গেছে, আবার কেউ কেউ শিথিল ছিলেন। দুটি অবস্থান-ই ছিল নিজস্ব পরিবেশ-পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিতে যেয়ে।

খ .  শিয়াদের তাকফিরের কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে ; এসব কারণ কোন শিয়া ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পাওয়া গেলেই তাকে তাকফির করা হবে। নতুবা করা যাবে না। সুতরাং, শিয়াদের কুফুরির ব্যাপারে দেওবন্দি চিন্তার আলেমদের প্রধান কাজ ছিল 'তাহকিক' বা পর্যবেক্ষণ। যার তাহকিক বা পর্যবেক্ষণে যেই চিত্র ধরা পড়েছে, সেই অনুপাতে তিনি ফতোয়া দিয়েছেন। কারো কারো পর্যবেক্ষণে শিয়াদের এমন বিশ্বাস যখন ধরা পড়েছে, তিনি তখন তাকফির করেছেন। আবার অনেকের পর্যবেক্ষণে শিয়াদের এমন বিশ্বাস ধরা পড়ে নি -তাকিয়ার কারণে অথবা বাস্তবেই- ফলে তিনি মুতলাক তাকফির করেন নি। 

গ. উপমহাদেশে শিয়াদের ব্যাপারে হাজির থাকা দৃষ্টিভঙ্গি গুলার মধ্যে সবচে কঠোর অবস্থান 'সিপাহে সাহাবা'র। যেখানে অপরাপর ইসলামিক স্কলাররা শিয়াদেরকে ব্যাপক হারে তাকফির করেন না , বরং শর্তের সাথে যুক্ত করে তাকফির করেন (এমন এমন চিন্তা থাকলে কাফের হবে , নতুবা হবে না এই টাইপের)। 

এখানে সিপাহে সাহাবা কিছুটা ব্যাতিক্রম। তাদের অধিকাংশই শিয়াদের মুতলাকভাবে তাকফির করে। 'মুতলাক' মানে হচ্ছে, বিশ্বে যারাই শিয়া নামে পরিচিত , তারাই কাফের। এই টাইপের ফতোয়ার ফিকহি ভিত্তির চেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে এর 'রাজনৈতিক ভিত্তি'। ফতোয়ার সাথে রাজনীতির সংযোগ থাকে। যেমন ধরেন, আপনার সাথে আমার রাজনৈতিক চিন্তার মিল নাই , সো আপনি অমুক তমুক। এইটারে মু'তায আল খতিবরা বলছে 'রাজনৈতিক তাকফির'। শিয়াদের ব্যাপারে ফতোয়া দিতে যেয়ে 'জি হা দি মুভমেন্টের লোকজন কিছুটা হলেও রাজনীতির শিকার হয়েছেন। ইরাকে আবু মুসআব যারকাবি 'দা ওলা' প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমেরিকার পাশাপাশি শিয়াদের পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ ছিল মোটামুটি। আবার তা ন যিম আল কায়েদার সাথেও প্রথমকালে (২০০৩) দাওলার বিশেষ সংযোগ ছিল , ইরাকে কায়েদার শাখা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল আইএসএস। কিন্তু  পরবর্তীতে বিন লাদেনের সঙ্গে যারকাবির  মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব হয়ে যায় বিশেষত শিয়া ইস্যুতে।  আবার গ্লোবাল জি হা দি মুভমেন্টে কাঠামোগত একটা নীতি আছে, শত্রুতার সীমা-পরিসীমা এবং নীতি নির্ধারণ সংশ্লিষ্ট ; সেখানে দুই ধরনের শত্রুকে চিহ্নিত করা হয়েছে -- প্রথমত, নিকটতম শত্রু (আলআদুউল করীব)। দ্বিতীয়ত, দূরবর্তী শত্রু (বাঈদ)। দূরবর্তী শত্রু বলতে সাম্রাজ্যবাদী কুফুর শক্তিকে বুঝানো হয়, আর নিকটতম শত্রু বলতে দেশীয় গণতান্ত্রিক শাসন , শিয়া এবং সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট মুসলিমদেরকে বুঝানো হয়। এখানে কোন শত্রুকে আগে মোকাবিলা করা হবে, এটা নিয়ে কায়েদা আর দায়েশের মধ্যে স্ট্রাটেজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এক্ষেত্রে দায়েশের মত ছিল, আগে নিকটতম শত্রুকে মোকাবিলা করা হবে। এক্ষেত্রে দায়েশ (বর্ম) তাতাররুসের মাসআলাকে সুত্র ধরে ইবনে তাইমিয়াকে ফলো করে। আর এভাবেই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুবাদে, রাজনৈতিক তাকফিরের উপর সওয়ার হয়ে সবসময়ই আইএসপন্থীরা শিয়াদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিল। 

তো এইভাবে শিয়াদের ব্যাপারে 'রাজনৈতিক তাকফির' প্রবনতাটা জি হা দি ঘরানায় ব্যাপকতা পেয়েছে। সেখান থেকে উপমহাদেশের সিপাহে সা হা বা ব্যাতিক্রম না আরকি। 

খ - শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের রাজনৈতিক দিক : 

১৯৭৯ এর পূর্ব পর্যন্ত শিয়া মতাদর্শের রাজনৈতিক কোন অথরিটি ছিল না। রাষ্ট্রে তাদের কর্তৃত্ববাদী অবস্থান তখনও পোক্ত হয় নি। ইরানে তখন মার্কিন সেবাদাস ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসক রেযা শাহ পাহলভীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল; যা ছিল আড়াই হাজার বছরের পুরনো রাজতন্ত্র। রাষ্ট্র ও সমাজে শিয়া মতাদর্শের লোকজন থাকলেও, রাষ্ট্রে মতাদর্শের কোন প্রভাব ছিল না। ফলে শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক সমাজ ও সামাজিকতার চিরায়ত চিত্রকে ছাপিয়ে 'বিশ্ব ও ভূ-রাজনৈতিক' বলয়ে প্রবেশ করে নি তখনও। আশির দশকের শেষে যখন খোমেনির নেতৃত্বে ইরান বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্র কাঠামোতে দাখিল হয়, তখন 'শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক' নিয়ে আলাপটা গভীর ও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। 

তবে 'শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক' বিষয়ক আলাপে গতি সঞ্চারিত করেছে শিয়া মতাদর্শের ইমাম খোমেনি, ব্যাপক প্রচারণা-মূলক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে। খোমেনির প্রচারণার সময়ে উপমহাদেশের দেওবন্দি চিন্তা চেতনার বিশিষ্ট আলেম মানজুর নুমানী রহ. ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ। তিনি লিখেছেন, "বর্তমান যুগে প্রচারণা একটি অসাধারণ ও প্রভাবশালী শক্তি। যে কোন একটা মারাত্মক ভ্রান্ত বিষয়কেও সত্য রুপে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়ার অভূতপূর্ব ক্ষমতা রয়েছে প্রচারণার মধ্যে , যা আমাদের চোখের সামনে রয়েছে - বর্তমান ইরান সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালিত প্রচার অভিযান। ইরান সরকার তাদের বিভিন্ন দূতাবাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে অবিরাম প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে, ইমাম রুহুল্লাহ খোমেনি একজন খাঁটি মুসলমান এবং তার পরিচালিত ইরানি বিপ্লব একটি খাঁটি ইসলামি আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে তারা ইসলামি ঐক্য ও শিয়া-সুন্নি একতার প্রতিও আহ্বান জানাচ্ছে।" [৬]

এই প্রচারণার জন্য খোমেনি প্রচুর সেমিনার ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, বই পুস্তক রচনা সহ সংবাদপত্র , পত্র পত্রিকা ও সাময়িকীর ব্যবস্থা করেছিল। এবং এই কাজে অঢেল সম্পদ ব্যয় করেছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক নিয়ে আলাপটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। উপমহাদেশ ও দেওবন্দি চিন্তাধারাও এর বাইরে ছিল না। কারণ, খোমেনির প্রচারণার প্রভাব উপমহাদেশেও সমান্তরালভাবে বিস্তৃত ছিল। মনজুর নুমানী রহ. লিখেছেন, "১৯৮৪ সালের মার্চ মাসের শুরুতে মুরাদাবাদের এক লোক আমার নিকট আসলো। সে জানালো তাদের অঞ্চলেও নাকি ইরানি প্রচারপত্র পৌঁছেছে। [৭ ]

উপরে আমরা আলোচনা করে এসেছি যে, শিয়া-সুন্নি রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং মুসলিম ঐক্যের জন্য আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি কি পরিমান প্রচারণা চালিয়েছেন। এখানে এসব প্রচার প্রচারণার ব্যাপারে মোটাদাগের একটি প্রশ্ন হাযির হয় - এই প্রচার-মূখিতার পেছনে খোমেনির চিন্তা ও মানসিকতার স্বচ্ছতা কতটুকু?  কিংবা, সেই সময়ের বিপর্যস্ত বাস্তবতায় রুহুল্লাহ খোমেনির ঐক্যের আহ্বানকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে? 

দেওবন্দি চিন্তায় খোমেনির প্রচারণাকে দু'টি ভিন্নমূখি বাস্তবতাকে সামনে রেখে বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে  খোমেনির প্রচারণা-মূলক পদক্ষেপের দুটি ভিন্নমূখি মূল্যায়নও হাযির হয়েছে -

প্রথমত,

ব্যাপকভাবে তার ঐক্য প্রচেষ্টাকে কৃত্রিম , মেকি ও তাকিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এবং এই বিবেচনার যথেষ্ঠ কারণ ও যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয়। দেওবন্দি চিন্তার বিশিষ্ট চিন্তক আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেন , " বিগত বছরগুলোতে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি সাহেবের ইসলামি বিপ্লবের ডাক এবং পাহলভী রাজবংশের উৎখাত ও তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি তার দাওয়াতকে সার্বজনীন ও সর্বজনগ্রাহ্য করার লক্ষ্যে বহুকাল ধরে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা শিয়া-সুন্নি বিরোধ সম্পর্কিত ইতিহাসের বিতর্কিত পাতাটি খুলতে যাবেন না। সেই বিতর্কিত অধ্যায় বই থেকে মুছে ফেলতে না পারলেও তা খোলার দুঃসাহস করবেন না। এবং কোন রাজনৈতিক বা অবস্থানগত স্বার্থের কারণে ইমামিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস পরিত্যাগ করার ঘোষণা করতে না পারলেও , অন্তত সেসবের প্রচারণা থেকে বিরত থাকবেন। বরং সামরিক শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিক থেকে বিশ্ববিশ্রুত পাহলভী রাজবংশকে যিনি তার অনলবর্ষী বাগ্মীতা ও নির্ভীক নেতৃত্বের মাধ্যমে ধূলিধূসরিত করেছেন , এমন একজন বিরাট নেতার নিকট প্রত্যাশা ছিল যে , তিনি তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মুসলিম ঐক্যের জন্য স্বীয় চিন্তা-গবেষণার ভিত্তিতে জনসমক্ষে বলবেন - যে সমস্ত আকিদা-বিশ্বাস ইসলামের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হানে , বিশ্ববাসীর সামনে যা ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে , বিধর্মীদের দাওয়াত দেওয়ার পথে যেসব বিশ্বাস পাহাড়সম বাধা সৃষ্টি করে, সেসব অলীক বিশ্বাসের কোন প্রয়োজন নেই, নেই কোন অবকাশ। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা ,মুসলিম দেশসমূহের সংষ্কার এবং মুসলিম সমাজ থেকে ফেতনা ফাসাদ উচ্ছেদকল্পে অতীতের বিদ্ধেষ ভুলে নতুনভাবে পথ নির্মাণ করতে হবে আমাদের। ইসলামের অতীত ও বর্তমানের উজ্জ্বল প্রতিকৃতি জগতবাসীর সামনে উদ্ভাসিত হবে , পৃথিবীবাসী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে। 

কিন্তু, সকল আশা আকাঙ্খা ও ইশারা ইঙ্গিতকে ভূলুণ্ঠিত করে , তিনি শুধু ঐসব বিষয়েই লিখতে আরম্ভ করলেন, যেসব তার শিয়া মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করছিল। " [৮]

সুতরাং, একদিকে দেখা যাচ্ছে, রুহুল্লাহ খোমেনি পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছেন , নিজেদের স্বচ্ছতার ঘোষণা দিচ্ছেন, আর অন্যদিকে তিনি শিয়া মতাদর্শের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করছেন। পুরনো সেই ইমামিয়াতের আকিদা-বিশ্বাসকে নতুন মোড়কে মুদ্রিত করছেন। তার 'বেলায়েতুল ফকীহ' গ্রন্থে তিনি ইমামত ও ইমামগণকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, ঐশি মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন , নবি-রসুলদের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। (৫২ পৃ .)

তিনি ফারসি ভাষায় লিখিত তার 'কাশফুল আসরার' গ্রন্থে সাহাবায়ে কেরাম বিশেষত প্রথম তিন সাহাবীকে কটাক্ষ করেছেন। গালিগালাজ করেছেন।  

এখানে শিয়া মতাদর্শের ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির দ্বিচারিতা দুটি শক্তিশালী উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থাকে নির্দেশ করছে - 

১ . ইরান বিপ্লবকে 'বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের' ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করে শিয়া মতাদর্শের নেতৃত্বে গ্লোবাল খেলাফতের নকশা তৈরি করা। দেওবন্দি চিন্তার অনেকেই ইরান বিপ্লবকে এই চিত্রেই আবিষ্কার করেছিলেন। কারণ, ইরান বিপ্লবের তাত্ত্বিক ও রুহানি উপাদান হিসেবে ছিল 'ইমামতের' বিশ্বাস। মানজুর নুমানী লিখেছেন, "দীর্ঘ এ পাঠ থেকেই এ বিষয়টি সামনে এসেছে যে , শিয়া মতাদর্শ সম্পর্কে উত্তমরুপে অবগত না হয়ে ইমাম খোমেনি পরিচালিত ইরান বিপ্লবের স্বরুপ ও প্রকৃতি হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। কারণ, শিয়া মতাদর্শের মৌলিক বিশ্বাস ইমামত ও প্রতিক্ষীত মাহদীর 'গায়বাতে কুবরা'র আকিদাই এ বিপ্লবের মুল ভিত্তি। ৯ 

২ .  ইরান বিপ্লবের দিকে বিশ্ব মুসলিমদের নজর ফেরানোর জন্য 'তাকিয়া' অবলম্বন করা। তাকিয়া হচ্ছে শিয়া মতাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস ও কর্মপন্থা - বিশেষ প্রয়োজনে বা বিপদের মুখে নিজস্ব বিশ্বাস ও মাযহাবকে গোপন করার নির্দেশ রয়েছে এতে। শিয়া মতাদর্শের গ্রন্থাদি ও তাদের ইমামদের বাণীতে এর নাম হচ্ছে 'কিতমান' : গোপন করা ,প্রকাশ না করা। আর তাকিয়া শব্দের অর্থ হল, কথা ও কর্ম দ্বারা আসল স্বরুপ ও বাস্তব ঘটনার বিপরীত প্রকাশ করা এবং অন্যদের ধোঁকায় পতিত করা।  শিয়া-সুন্নি ঐক্যের যে ডাক খোমেনির মুখে বারুদের মতো বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল , দেওবন্দি চিন্তার অনেকেই একে তাকিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। মনজুর নুমানী লিখেছেন , "এক্ষেত্রে আমি এ সত্য প্রকাশও সমীচীন মনে করি যে , শিয়া মতাদর্শ সম্পর্কে আমাদের সুন্নি আলেমদের অজ্ঞতার একটি বিশেষ কারণ আছে। তা হচ্ছে, শিয়া মতাদর্শে নিজস্ব দ্বীন ও মাযহাবকে গোপন করার অত্যন্ত জোরালো নির্দেশ আছে। আমি যতদূর জেনেছি এবং পাঠ করেছি - বিশ্বের সকল ধর্ম ও মতাদর্শের মধ্যে কেবলমাত্র শিয়া মতাদর্শের এটি একটি বিরল বৈশিষ্ট্য।" [১০]

কিন্তু, উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট খোমেনি একজন খাঁটি ও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিল। অনেক বুদ্ধিজীবি লোকজন ভাবতে আরম্ভ করলো যে, বর্তমানে ইরানে একটি ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ রাষ্ট্রের কর্ণধার হলেন ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। বিশেষত, নব্য শিক্ষিত যুবকশ্রেণী ইরানের ধর্মীয় সাধু ও তাত্ত্বিক লোকদেরকে পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করলো। তখন মনজুর নুমানী রহ. বিচলিত ও চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে,  অশীতিপর বার্ধক্যে বসেও শত শত পৃষ্ঠা পাঠ করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি যে শিয়া মতাদর্শের একজন কট্টর সমর্থক, তা দেখানোর প্রয়াস পান। তিনি খোমেনির নিজের লেখা রচনাবলী থেকে তুলে ধরেছেন তার বিশ্বাসগুলো - ইমামত , উসমান রা . এর ব্যাপারে কটুক্তি , মুতআ , ইমামদের নবিদের মতো নিষ্পাপ হওয়ার বিশ্বাস, তাহরিফে কুরআন ও অন্তর্হিত ইমামের প্রতি বিশ্বাস - এই সব কিছুর প্রতি খোমেনির বিশ্বাস ছিল। এবং এসব বিশ্বাসকে প্রচার প্রচারণার জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, খোমেনির ঐক্য প্রচেষ্টাকে রাজনৈতিক সত্য হিসেবে বিবেচনা করার ঘটনাও ঘটেছে। হাফেজ্জী হুজুর সহ কেউ কেউ খোমেনির প্রচারণার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন , তার ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, ইরান বিপ্লবের সেমিনারে উপস্থিত হয়েছেন। শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক নিয়ে নতুনভাবে ভাবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এবং হাফেজ্জী হুজুর নিজেই সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্য ইরানে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাফেজ্জী হুজুরের এই প্রচেষ্টাকে প্রাসঙ্গিক মনে করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এবং সে প্রাসঙ্গিকতা নানা দিক থেকে তাৎপর্য-পূর্ণ ছিল - 

ক . পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো রেযা শাহ পাহলভীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। পশ্চিমের জন্য যাবতীয় অপকর্মের সুযোগ অবারিত ছিল এই রাজতন্ত্রে। ইরান বিপ্লবের বীজ যখন অঙ্কুরিত হওয়া শুরু করে, একটি ধর্মতান্ত্রিক শক্তি -তা যেমনি হোক- ইরানে ক্ষমতাশালী হবে, পশ্চিমা শক্তি কোনভাবেই তা কামনা করে নি। কারণ,পশ্চিমা বিশ্ব চার্চের মধ্যযুগীয় বর্বরতা থেকে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, দ্বিতীয়বার সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে তারা নারাজ। ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের কোন ধরনের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতা তাদের ছিল না। ফলে ইরান বিপ্লবের পর পশ্চিমা বিশ্বের মাথা ব্যথা ছিল শুধু 'খোমেনি ও সদ্য সফল হওয়া বিপ্লব' নিয়ে। 

বিপ্লব পরবর্তী ইরান নিয়ে পশ্চিমে নানামূখী আয়োজন আরম্ভ হয়েছিল - বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা , ম্যাগাজিন ও সিনেমার প্রধান প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল 'বিপ্লব পরবর্তী ইরান'। ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে মধ্যযুগের থিওক্রেসি হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার প্রবনতা শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে "the stroning of suraya" নামে একটি সিনেমা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। তাতে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ককে কতো কঠিন ও কঠোর ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এবং ইরান সেই মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বর অধ্যায়ের নতুন  সূচনা করতে চাচ্ছে। সুতরাং, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র বিরোধী পশ্চিমা প্রচারণা অনেকটা ধর্ম , ধর্মীয় রাজনীতি এবং ধর্মের পুনরুত্থানে ক্রিয়াশীল যেকোন আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছিল। আর সেই অবস্থান থেকে খোমেনির ঐক্য প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার যৌক্তিকতা ছিল বটে।

খ .  ইরান বিপ্লবকে সফল করার ক্ষেত্রে খোমেনি ও ধর্মীয় সমাজের সাথে সাথে বামপন্থীদের ভূমিকাও ছিল। বিশেষত, মস্কোপন্থী মার্কসবাদীরা আলি শরিয়তির চিন্তা দ্বারা দারুণ ভাবে প্রভাবিত ছিল। আলি শরিয়তি ইরান বিপ্লবকে 'মার্ক্সীয় পরিভাষার' মোড়কে বামপন্থীদেরকে গলাধঃকরণ করিয়েছিলেন। আলি শরিয়তি মার্কসবাদের 'বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত' এর নতুন ভার্সন বের করেন 'আলাভি ও শাফাবি শিয়া' - এসব তত্ত্বে দারুণ ভাবে প্রভাবিত হয়ে,  ইরান বিপ্লবে বামপন্থার লোকেরাও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু, বিপ্লবের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা যখন খোমেনির হাতে চলে গেল। এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেল , বামপন্থীদের তখন স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল। এবং পশ্চিমাদের সাথে তারাও ইরান বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করলো। ফলে ইরান ও খোমেনি রাজনৈতিকভাবে এক ঘরে হয়ে পড়েছিল। এবং ইরানের অর্থনীতিতে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছিল।  

৩ .  ইরান যখন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছিল, তখন খোমেনির কাছে শিয়া-সুন্নি ঐক্য অত্যন্ত জরুরি হিসেবে হাযির হয়েছিল। কিন্তু, শিয়া-সুন্নি ঐক্যের পথে তখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া 'ইরাক-ইরান' যুদ্ধ। কারণ, এতে ইরানের বিপক্ষে ইরাকের সমর্থক হিসেবে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সুন্নি রাষ্ট্র। 

এই অবস্থান থেকে হাফেজ্জী হুজুর খোমেনির ঐক্যের আহ্বানকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে গণ্য করাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এছাড়াও এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যেহেতু ভূ-রাজনৈতিক সংকট থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, শিয়া-সুন্নি মতাদর্শের কোন বিবাদ ছিল না। তাই এখানে রাজনৈতিক ঐক্যকে জরুরি এবং প্রাসঙ্গিক মনে করেন হাফেজ্জী হুজুর। এবং তিনি ইরাক-ইরান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য মধ্যপ্রাচ্যে সফর করেন। আর এ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যে মতাদর্শিক না , তার কারণ হলো, সাদ্দাম হোসেন নিজেও পাক্কা ধার্মিক ছিলেন না। ফলে সহজেই এ যুদ্ধকে মতাদর্শিক হিসেবে চালানো যাবে না। সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপারে বার্থ পার্টির সদস্য এবং জাতীয়তাবাদী নেতা হওয়ার একটা গুঞ্জন আছে। 

ইরান , খোমেনি ও শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক বিষয়ক হাফেজ্জী হুজুরের অবস্থান সাধারণত 'মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর' সফরনামা থেকে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি দিক বিবেচনা করা জরুরি -

ক . ইরানে হাফেজ্জী হুজুরের সফর ছিল নিছক রাজনৈতিক ঐক্যের লক্ষ্যে ; এখানে ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ঐক্য প্রচেষ্টা ছিল না যে , শিয়াদেরকে সুন্নি বানিয়ে ফেলা হবে। বরং সফরের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ঐক্য, বিশেষত, ইরাক-ইরান যুদ্ধের অবসান ঘটানো। সুতরাং, এখানে  শিয়া মতাদর্শ সম্পর্কে জমহুরদের চিরায়ত চিন্তার বাইরে তিনি ছিলেন না। 

খ .  এই সফরনামা লিখেছেন 'মরহুম আখতার ফারুক' সাহেব। তিনি বইয়ের ভূমিকায় অত্যন্ত সরলতার সাথে ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি সফরনামা হাফেজ্জী হুজুরকে পড়ে শোনাতে পারেন নি ; এটি বইয়ের নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্যতম একটি দুর্বল দিক। তবে তিনি অন্যান্য সফর সঙ্গিদের শুনিয়েছেন। শুরুতে তিনি লিখেছেন, "ইচ্ছে ছিল হুজুর ও তার অন্যান্য সফর সঙ্গিদের বইটি আগাগোড়া শুনিয়ে ছাপতে দেব। কিন্তু, একদিকে হেদায়েত ও তাবলিগের মাসগুলোতে তাদের দেশব্যাপী সফরের ব্যস্ততা। অন্যদিকে প্রকাশকের বই বিক্রির মৌসুমের তাড়াহুড়োর কারণে তা আর সম্ভব হয়ে উঠল না। তথাপি , পয়লা দুই ফর্মা মাওলানা ওবাইদুল হক , মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ও মাওলানা হামিদুল্লা সাহেবদেরকে শুনিয়ে তাদের থেকে বেশকিছু মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি। তারপর সেই পরামর্শের আলোকে বইটি দাড় করাতে চেয়েছি। [১১]

মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর সফরনামাতে যেই চিত্র দেখা যায় , 

এক . ইরানে যাওয়ার পর, শিয়াদের সাথে বৈঠক হয়েছে হাফেজ্জী হুজুর ও তাঁর সঙ্গীদের। সেখানে শিয়া-সুন্নির ধর্মতাত্ত্বিক দিক নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়েছিল গাজিয়ান কাউন্সিলের সদস্যদের কাছে, তখন তারা স্বাভাবিক জবাব দিয়েছিল। কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন, আয়াতুল্লাহ খাযায়ী , আয়াতুল্লাহ মানেঈ , আয়াতুল্লাহ জান্নাতী  এবং আয়াতুল্লাহ মাহদাবী কানী প্রমূখ। সফরনামার সেই জায়গা এখানে উদ্ধৃত করছি। আখতার ফারুক সাহেব লিখেছেন - "এবারে আমরা শিয়া-সুন্নির আকিদাগত পার্থক্যের দিকটা তুলে ধরলাম। বিশেষত, তিন খলিফাকে গালমন্দ পাড়ার ও রাসুলুল্লাহর সা . চাইতে আলিকে মর্যাদা দেওয়ার প্রসঙ্গটি তুললাম। তারা বললেন , রাসুলুল্লাহর চাইতে যারা আলিকে বেশি মর্যাদা দেয় , আমরা তাদেরকে কাফের বলি। এ কারণেই আমরা বাহাইদের কাফের ঘোষণা করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। শুনতে পেলাম বাংলাদেশে নাকি তারা স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা বানিজ্য করে যাচ্ছে। আশা করি আপনারা তাদেরকে তাড়িয়ে দেবেন।" ১২

ইরানের শিয়াদের ফিকহের মাযহাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তখন তার বলেছে " ইরানি শিয়াদের চৌদ্দ আনাই জাফরী ফেকাহর অনুসারী। জাফরী ফেকাহের উদ্গাতা হলেন শিয়াদের বারো ইমামের অন্যতম ইমাম জা'ফর সাদিক রহ . । তিনি ছিলেন আবু হানিফা রহ . এর উস্তাদ। উস্তাদ শাগরেদের সম্পর্ক এতো গভীর ছিল যে , সমসাময়িক কালে তিনি শিয়া ভক্ত বলে মশহুর ছিলেন। [১৩]

দুই . তাছাড়া ইরানের ভেতরগত পরিবেশ সুন্নি মুসলিমদের জন্য কতোটা অন্তরঙ্গ , এই বাস্তবতা উঠে আসার দরকার ছিল। ইরান সফরে তারা একজন সুন্নি আলেমের দেখা পেয়েছিলেন , যিনি এক সময় 'দারুল উলূম করাচিতে' পড়ালেখা করেছেন। এই সুবাদে তারা তাকে ইরানের ভিতরগত বাস্তবতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তখন তার মুখে যেই বাস্তবতা উঠে এসেছে, তা আখতার ফারুক সাহেব লিখেছেন, "তারপর বললেন, শাহের আমলে এদেশে সুন্নি বলে পরিচয় দেবার সাহস ছিল না কারো। তেহরানের কোন মসজিদে প্রবেশাধিকার ছিল না কোন সুন্নির। নেতৃত্ব কর্তৃত্ব, চাকরি বাকরি, ব্যবসা বানিজ্য কোথাও সুন্নির কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এমনি ঘোর দুর্দিনে এলো বিপ্লবের ডাক। শাহের বিরুদ্ধে বিপ্লবের শ্লোগান উঠলো 'শিয়া-সুন্নি ভাই ভাই'। তাই শিয়া-সুন্নি হাতে হাত মিলিয়ে শাহকে উৎখাত করলো। ফলে তাদের (সুন্নিদের) অস্তিত্বই শুধু স্বীকৃত হলো না , স্বীকৃত হলো তাদের সব শাসনতান্ত্রিক অধিকারও। সুন্নির মাযহাবী স্বাধীনতা ঘোষিত হলো। [১৪]

উঠে আসা এইসব বাস্তবতার আলোকে ঐক্য প্রচেষ্টায় হাফেজ্জী হুজুরের সক্রিয়তাকে নেতিবাচক চোখে দেখার সুযোগ থাকে না। বইটির পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা যেহেতু শুধুমাত্র ইরানি নেতাকর্মী দের মৌখিক ভাষ্য ও ক্ষেত্র বিশেষে কিছু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা থেকে নেওয়া হয়েছে , তাই উক্ত সফরনামার চিত্র শিয়া মতাদর্শের সামগ্রিক বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করবে কি না , সে প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনাও কম জরুরি নয়।

তথ্যসূত্র : 

১. তুহফায়ে ইসনা আশারিয়া, আব্দুল আযীয,পৃ . ২৯

২.  ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ৪/৫৮৪-৫৮৬, দারুল উলুম করাচী থেকে প্রকাশিত।

৩ .  জাওয়াহিরুল ফিকহ, ১/ ১৮১- ১৮২ পৃ. 

৪. ফতোয়ায়ে উসমানী, ১ম খন্ড ৪৪-৪৫ পৃ .

৫.  দারুল ইফতা, জামিআ বিন্নূর টাউন , ১৪৩৯০১ নং ফতোয়া।

৬ . ইরানি ইনকিলাব ইমাম খোমেনি আওর শিইয়্যাত , মানজুর নুমানী, পৃ . ১

৭ .  প্রাগুক্ত, পৃ . ১

৮ . ভূমিকা, আলি মিয়া নদভী,  ইরানি ইনকিলাব , পৃ . 

৯ . ইরানি ইনকিলাব, পৃ. ২

১০ .  প্রাগুক্ত, পৃ. ৩

১১ . মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর, ভূমিকা আখতার ফারুক।

১২ . মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর, ২৮ পৃ . 

১৩  . প্রাগুক্ত, ২৯ পৃ. 

১৪ . প্রাগুক্ত, ৩৪ পৃ . 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই