চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

তাড়িওয়ালা যা দেখতো


তাড়িওয়ালা যা দেখতো

মূল: বেন ওকরি

অনুবাদ: মাহীন হক

[বেন ওকরি নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫মার্চ ১৯৫৯ সালে। বেন ওকরি 1991 সালে বুকার পুরস্কার সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার জিতেছেন। ওকরি উত্তর-আধুনিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান আফ্রিকান লেখক হিসাবে সুপরিচিত। ফিকশনের ক্ষেত্রে নিজের লেখনশৈলীকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন - এক ধরণের স্বপ্ন যুক্তি  অনুসরণ করে তার ফিকশন এবং প্রায়শই এক ধরণের দার্শনিক হেয়ালীতে ভরা তার ফিকশন।]

এই পৃথিবীতে কোনো এক কালে বাস করতো এক অসাধারণ তাড়িয়ালা। সে তালগাছ বেয়ে উঠতে যত ভালোবাসতো ততই ভালোবাসতো তালের রস জমাতে। এক রাতে সে স্বপ্ন দেখলো সে তালগাছ বাইতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। এই স্বপ্ন দেখার পর থেকে তার মন এতই অশান্ত হয়ে উঠলো যে সে সেই গভীর রাতেই তার বন্ধু টাবাস্কোর কাছে চলে গেলো, সে ছিল এক প্রখ্যাত কবিরাজ। কিন্তু সে রাতে টাবাস্কো এতটাই ব্যস্ত ছিল যে তাড়িয়ালার কথায় বিশেষ মনোযোগ দিতে পারলো না। তার এতগুলো স্ত্রী'র চাহিদার ভারে ত্যক্ত হয়ে কবিরাজ মহাশয় গোলমরিচ চাবাচ্ছিলেন আর তালের তাড়িতে গলা ভেজাচ্ছিলেন। তাড়িয়ালা চলে যাওয়ার সময় কবিরাজ তাকে একপাশে টেনে এনে কোনো হেতু ছাড়াই বলে উঠলো:

"আমি এক শিকারীকে চিনতাম যে একদিন শিকারের সময় এক অদ্ভুত হরিণ দেখতে পেলো। সে হরিণটার পিছু নিলো যতক্ষণ না হরিণটা একটা পিপড়ের ঢিবির সামনে থামলো। তাকে অবাক করে দিয়ে তারপর হরিণটা একটা মহিলায় পরিণত হয়ে গায়েব হয়ে গেলো। সেই শিকারী ওই মহিলার ফিরে আসার আশায় অনেকক্ষণ ওই ঢিবির পাশে বসে রইলো। অপেক্ষা করতে করতে সে ঘুমিয়ে গেলো আর ঘুম ভেঙে দেখলো পুরো জমিন লাল পানিতে ভরা। উপরে তাকিয়ে সে দেখলো তাকে ঘিরে নয়টি আত্মা দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে পাগল হয়ে যায়। তার চিকিৎসার জন্য তার মাথায় ঢোকার পর আমার তিন সপ্তাহ লেগেছিলো নিজের সেরে উঠতে। তার পাগলামির কিছুটা আমার মধ্যেও ঢুকে পড়ে। যদি আগামীকাল তুমি আমাকে তিনখানা কচ্ছপ ও বড় এক কাদি কোলা বাদাম এনে দিতে পারো, আমি তোমার স্বপ্নের ব্যাপারে কিছু করতে পারি। কিন্তু আজ রাতে আমি খুবই ব্যস্ত।"  

তাড়িয়ালা রাজি হলো, আর হতাশ মনে ঘরে ফিরে এসে পুরো এক হাঁড়ি তাড়ি একাই গিলে ফেললো। ঘুম আসতে আসতে তার স্বপ্নের কথা সে ভুলেও গিয়েছিলো। 

সকালবেলা সে তার দড়ি আর যাদুর পোশন জড়ো করলো, সাইকেলের সাথে তিনখানা হাঁড়ি বেঁধে নিয়ে জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হলো দিনের কাজ শুরু করতে। পেডেল মেরে বেশকিছু দূর যেতে না যেতে একটা সাইনবোর্ড তার চোখে পড়লো: ডেল্টা তেল কম্পানি: খননকার্য চলছে, সীমালঙ্ঘনকারীরা সাবধান। তাড়িয়ালা কোনোকিছু না বুঝেই সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরেকটু সামনে এগোতেই তার চোখে পড়লো একটা অদ্ভূত তালগাছের ঝাড়। মাকড়সার জালের ঘন আস্তরণ পেরিয়ে সে তালগাছগুলোর কাছে পৌঁছলো। তাদের লালচে-সবুজ বাকলের প্রবল ঘ্রাণে তার নেশা ধরে গেলো। সাথে সাথে সে তার যাদুর পোশন একটা গাছের গুড়িতে বাঁধলো, তারপর দড়ি বের করে বাইতে শুরু করে দিলো। দুই পা দিয়ে গাছটাকে আঁকড়ে ধরে দড়িটাকে উপরে মেরে মেরে দ্রুতবেগে সে গাছের উপরে উঠে গেলো। তারপর হঠাৎ তার বুকে ব্যথা শুরু হলো। ভোরের সূর্যের তেরছা নজর তাকে অন্ধ করে দিলো। তার চোখে সোনালী আলো ঠাসঠাস করে ফাটতে লাগলো আর ঠিক তখনই, গাছের ডালপালাগুলোও তার থেকে হাত সরিয়ে নিলো। তিরিশ বছরে এই প্রথমবার সে গাছ থেকে পড়ে গেলো। 

জ্ঞান ফিরলে পর অবাক হয়ে সে টের পেলো তার শরীরে কোনো ব্যথা নেই। উলটো তার মনে হচ্ছিলো পড়ে গিয়ে তার শরীরটা আরো ভালো লাগছে। এমনকি তার অনেক হাল্কা আর ফুরফুরে বোধ হচ্ছিলো। ঝিকিমিকি মাকড়সার জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিজের অজান্তেই কোনদিকে যে সে চলে গেলো। জোনাকিপোকারা সাই সাই করে তার নাকে ও কানে বিঁধে গিয়ে আবার চোখ দিয়ে বের হয়ে গেলো, তাদের আলো একটুও ক্ষীণ হলো না। অনেকক্ষণ এরকম হাঁটলো সে। তারপর তার চোখে পড়লো আরেকটা সাইনবোর্ড: ডেল্টা তেল কম্পানি। সীমালঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দেয়া হবে। চারিপাশে তার মাটির টিলা, কবর, একটামাত্র তালগাছ আর ম্যানগ্রোভ শিকড়ের জ্বলজ্বলে শিকড়। একটা গাছের শরীরে সে পথ চেনার জন্য চিহ্ন এঁকে দিলো। সাথে সাথে দাগটা পচন ধরে একটা ভয়াবহ ক্ষত হয়ে গেলো। এই পাক খাওয়া শিকড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের ক্ষতের সাদা রক্তের জ্বালায় গাছের শিকড় তার গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরলো। মাটিতে আঁকড়ে ধরে তাকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করলো। পরে সে হাসতে শুরু করলে আবার তাকে ছেড়ে দিলো।   

অবশেষে সে একটা নদীর পাড়ে এসে পৌঁছলো, যার জল ছিল আঠালো ও অনড়। নদীর ঠিক পাশেই ছিল একটা সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গের কোণে তিনখানা কচ্ছপ ঝিমুতে ঝিমুতে তাকে দেখছিলো। তাদের মধ্যে একটা কচ্ছপ দেখতে ছিল টাবাস্কোর মত। তাড়িয়ালা কি জানি বলতেই যাচ্ছিলো কি ঠিক তখন সুড়ঙ্গ হতে একটা রঙচঙে সাপ বের হয়ে তার পাশ দিয়ে সুরসুর করে নদীতে চলে গেলো। সাপটা নদীতে নামার সাথে সাথে পানির রঙ বদলে স্বচ্ছ আর উজ্জ্বল হয়ে গেলো। সাপটার চামড়া গোলাপি আগুনে জ্বলছিলো। তাড়িয়ালা দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো, ঠিক তখন তার পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো:  

"পেছনে ফিরো না।"

তাড়িয়ালা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কচ্ছপ তিনটা কাচের মতন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। যে কচ্ছপটার চেহারা টাবাস্কোর মত ছিল, সে তাড়িয়ালার দিকে ফিরে পেশাব করে দিলো। কচ্ছপটা বেশ মজাই পাচ্ছিলো মনে হয়। তার চোখেমুখে এক পৈশাচিক আনন্দের ছাপ। তাড়িয়ালা হেসে দিলো আর সাথে সাথে তার মাথায় পেছন থেকে ভারি কিজানি একটা লাগলো। আস্তে করে সে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কিছুই নেই। সে আবার হাসতে শুরু করলো আর এবার আরো জোরে বাড়ি লাগলো। সে টের পেলো তার অস্তিত্বের সারবস্তু গলে গলে যাচ্ছে। এই নীরবতায় নদীটা যেন ফুলেফেপে উঠলো। 

"আমি কোথায়?" জিজ্ঞেস করলো তাড়িয়ালা। 

তারপর আরো এক নীরবতা। সাপখানা, ঝিকমিক করতে করতে আবার নদী থেকে বের হয়ে এলো। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাপটা মাথা তুলে তার দিকে একদলা থুথু মেরে গেলো। তারপর সে ওই সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলো, সূর্যের বহু রঙে জ্বলজ্বল করছিলো তার শরীর। তাড়িয়ালার শরীরে তখন কাঁপুনি ধরে গেলো। কাঁপুনি থামলো পরে সারা শরীরে এক অদ্ভূত প্রশান্তি ছড়িয়ে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে সে বুঝলো সে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সে বুঝে উঠতে পারলো না তার শরীর নাকি মগজ তার থেকে বের হয়ে গেছে। 

"কোথায় আমি?"  

কণ্ঠটা কোনো উত্তর দিলো না। তারপর সে জানি কার চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো। ঘুমাতেও পারছিলো না সে, কারণ কারা যেন তার উপরে কী সব বলছিলো, তার ব্যাপারেই, যেন সে ওখানে নেই।  

এই দুনিয়ায় সূর্য ডোবে না, ওঠেও না। সূর্য এখানে একমাত্র একটা অটল চক্ষু। সন্ধ্যাবেলা সূর্যটা একটা বিশাল স্ফটিকের রূপ নিতো। ভোরবেলা সে জ্বলজ্বল করে জ্বলতো। তাড়িয়ালাকে কখনোই চোখ বুজতে দেয়া হতো না। সারাদিন ঘুরেফিরে সে যখন সুড়ঙ্গটার পাশে শুয়ে শুয়ে তালগাছের দিবাস্বপ্ন দেখতো, একটা বিকট গন্ধের প্রাণী এসে তার চোখে মাকড়সার জাল এঁটে দিয়ে যেতো। তার চোখ ভীষণ জ্বালাপোড়া করতো। তাড়িয়ালা যখন চোখ খোলা রেখেই ঘুমানোর চেষ্টা করতো, সে দেখতো তার চিরচেনা জগৎ লাল লাল আলোয় ঘূর্ণির মত ঘুরছে। সে দেখতো মহিলারা দূরবর্তী বাজারে দরদামরত, তাদের পিছে পিছে অশ্রুত স্বর। সে দেখতো পৃথিবীর সাইনবোর্ডগুলো ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছে। সে দেখতো তেলের কম্পানির কর্মচারীরা জঙ্গলটা সাফ করে দিচ্ছে। খিদা পেলে পর কোনোএক প্রাণী, যাকে সে দেখতে পেতো না, এসে তাকে গিরগিটির মাংস, পোকামাকড় আর গাছের বাকল মিশিয়ে কিছু একটা খাইয়ে দিয়ে যেতো। তৃষ্ণা পেলে সেই প্রাণী তাকে লাউ-জাতীয় কিছু একটার সবুজ রস খাইয়ে দিতো। আর রাতের বেলা আরো এক প্রাণী, যার গা থেকে পচা পদ্মের গন্ধ বেরুতো, এসে তার শরীরে উঠে বসতো, তার সাথে সঙ্গম করতো, তারপর তাদের যাপিত রাত্রির উদ্ভট ডিমগুলো তার কাছে রেখে চলে যেতো। 

তারপর একদিন সে সাহস করে ডিমগুলো গুণলো। সাতটা ডিম ছিল। সে চিৎকার করে উঠলো। নদীটা ফুলে উঠলো৷ সুড়ঙ্গ হতে সাপটা মাথা উঁচু করে উঁকি দিলো আর সূর্যের গলা হতে শোনা গেলো মরণের অট্টহাসি। সেই হাসি খুঁজে বের করলো তাকে, ঝাপিয়ে পড়লো তার উপর, ঝাকুনি দিয়ে তার মাথায় বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে চলে গেলো।   

সেই রাতে সে ছুটে পালালো। তার সাথে সাথে ছুটলো সবকিছু। কিছুক্ষণ বাদে সে থামলো। পুরো জায়গাটাকে গালি দিলো কিছুক্ষণ, গালি দিলো এখানের বিচ্ছিরি বাসিন্দাদের, এর অনড় দৃশ্যগুলোকে। পালাতে না পেরে সে ইচ্ছেমত গালি দিতে লাগলো। বদলে সে পেলো মাথায় দু-চারটে বাড়ি। অতঃপর, ডিমগুলোর ভিতরের আঁচড়াআঁচড়ির বিকট শব্দের যন্ত্রণায় সে বিরক্ত হয়ে গেলো, যেন এই ভয়াল আকৃতি ভেদ করে জন্ম নেয়ার জন্য হাতড়াচ্ছে বিকট কোনো প্রাণ। এর থেকে সে ধৈর্যের পাঠ নিলো। সে শিখে গেলো আকাশ দেখতে, আর লক্ষ্য করলো এগুলো তার মাতাল অবস্থার আকাশের মতই দেখতে। সে ডিমগুলোর ভেতর বাড়ন্ত প্রাণের গোঙানির শব্দ কানে না নিতে শিখে গেলো। সে আরো শিখলো সে যখন শান্ত থাকে তখন তার চারপাশের সবকিছুও শান্ত হয়ে থাকে।

আর তারপর, আরো এক কণ্ঠ তার কাছে এসে বললো: 

"তোমার পৃথিবীর সবকিছুর অসংখ্য প্রতিরূপ রয়েছে জগতে। এমন কোনো আকৃতি নেই, পাগলামি নেই, আনন্দ বা বিপ্লব নেই যার ছায়া অন্য কোথাও নেই। আমি তোমাকে এমনসব গল্প শোনাতে পারি যে তুমি পাগল হয়ে যাবে। তোমরা মানুষেরা কত ঢিমে–নিজেদেরই দুই হাজার বছর পেছনে হাঁটো তোমরা।"

কণ্ঠটা দ্রুতই মিলিয়ে গেলো। 

তারপর আরেকটা কণ্ঠ এলো:

"তুমি দুইদিন ধরে মৃত। এবার ওঠো।"

একটা প্রাণী এসে আবার তার চোখে মাকড়সার জাল এঁটে দিয়ে গেলো। তার চোখ আবার জ্বালাপোড়া শুরু হলে সে দেখতে পেলো পৃথিবীর যুদ্ধগুলো এখনও থামেনি। যেসব বোমা অজানা কারণে ফাটেনি, তারা খামারের কোণে লুকিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ফেটে উঠতো। আর যারা ভাবতো আসল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তাদের উপর বোমা ফেটে তাদের পেট চালানোর যুদ্ধ হতে মুক্তি দিতো। সে দেখলো মেরামতরত সেতুগুলো ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সে দেখলো জঙ্গল আর মশাদের বিল, নামহীন খাঁড়ি, মাত্রাছাড়া পাহাড়, সবকিছু ভেদ করে চলে গেছে রাজপথ। দেখলো সেসব পথের মুখে কঙ্কালের সারি, নির্বোধ দুর্ঘটনার শিকার তারা। সে দেখলো কুকুরের দল কিভাবে মানুষের পিছে পিছে যায় রাত্রির ঝোপঝাড়মাখা পথ ধরে। পথ হতে কুকুরগুলো একে একে গায়েব হয়ে গেলে তাদের প্রেত এসে নিঃসঙ্গ অসহায় পথচারীদের গিলে গিলে খায়। 

তারপর সে আবার দেখলো কম্পানিওয়ালাদের জঙ্গল সাফ করে তেলের ব্যর্থ খোঁজ। দেখলো জঙ্গল হতে প্রেতগুলোকে তাড়ানোর জন্য ধরে নিয়ে আসা ওঝাদের কাণ্ড। তারা এমনকি বৃষ্টির পথরোধ ও সূর্যাস্ত ঠেকানোরও চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এর কোনোটাই কাজে না দিলে কম্পানিটা এক প্রবাসী লোককে ভাড়া করলো গত যুদ্ধের বাকি থাকা বোমাগুলো অ্যারোপ্লেনে করে নিয়ে এই জমিটা উড়িয়ে দিতে। তাড়িয়ালা দেখলো সেই প্রবাসী লোক পুরো জঙ্গল জুড়ে ডাইনামাইট পুঁতে দিচ্ছে। বিস্ফোরণের পর তাড়িয়ালা দেখলো সবুজ ধোঁয়ার ঘন পর্দায় সব ঢেকে আছে। ধোঁয়া কেটে গেলে পর দেখা গেলো জমিন ফুঁড়ে তেলের ফোয়ারা আর মৃত পশুদের হাড়-গোড় ছিটকে বেরিয়ে আসছে। শেষমেষ জায়গাটা ছেড়ে সবাই চলে গেলো। ওখানে পরে রণক্ষেত্রে রক্তের মত পদ্মফুল ফুটেছিলো।

তাড়িয়ালা দেখলো মানুষ মারা যাচ্ছে গুলির আঘাতে, গোপন ক্রসফায়ারে, সশস্ত্র ছিনতাইয়ে। সে খেয়াল করলো যারা গুলির আঘাতে মারা যায় সেসব বুলেটের গায়ে তাদের নাম লেখা থাকে। চোখের জ্বালাপোড়া বন্ধ হলে পর সে আকাশের তামাটে মেঘের নিচে হাঁটতে লাগলো। সে খেয়াল করলো আশেপাশে কোনো পাখি নেই। আহত তালগাছে মাকড়সার জাল ধিকিধিকি কাঁপে।

আর তারপর একদিন, প্রাচীন সব বীরদের কথা মনে করে তার মন উদ্দীপনায় জ্বলে উঠলো। সে ভাবলো ওই সুড়ঙ্গটার ভিতরে একটা অভিযান চালাবে। ওই অদ্ভূত পরিমণ্ডলে সে দেখলো বহুরঙা সাপটা সাজিমাটির মত পেঁচিয়ে বসে আছে। সে দেখলো সবুজ জলের বুদ্বুদে সাঁতরে বেড়াচ্ছে কুমির। সে দেখলো এক বৃদ্ধ উলটো করে বাইবেল পড়তে বসা অবস্থাতেই মরে আছে। মনে হচ্ছিলো সবকিছুতে আগুন লেগে আছে, কিন্তু কোথাও কোনো ধোঁয়া নেই। চিটচিটে তেলের ঘন ঘন ফোটা দেয়ালের গা বেয়ে নামছিলো। কোনোকিছু না পুড়িয়ে সবখানে গোলাপি আগুন জ্বলছিলো। সে তার পিছে একটা আওয়াজ শুনতে পেলো। সে ঘুরে তাকাতেই একটা প্রাণী তার হাতে বিশ্রী কিছু খাবারের একটা প্লেট ধরিয়ে দিলো। প্রাণীটা তারপর ইশারায় তাকে ওটা খেতে বললো। বহুরঙা সাপটা সাজিমাটির আকার হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তাড়িয়ালা যখন খাচ্ছিলো সাপটা তখন তার কাছে এসে ফালতু চুটকি শোনাতে শুরু করলো। সাপটা তাকে বললো কিভাবে সাগরের ওইপারের শান্ত পশ্চিমা শহরগুলোতে কালোদের ঝুলিয়ে মারা হয়, আরো বলে শোনালো কিভাবে কোনো আওয়াজ ছাড়া একটা বাচ্চার শরীরের চামড়া ছিলিয়ে নেয়া যায়। হাসতে হাসতে বললো এসব সাপটা। সাপটা এতটাই হাস্যকর দেখতে ছিল যে, তাড়িয়ালাও হাসতে শুরু করে দিলো। সাথে সাথে তার মাথার উপরে ঠাসঠাস করে ক'খানা তীক্ষ্ণ চাবুকের বাড়ি পড়লো, আর তারপর অজ্ঞান হয়ে সে যেন বহু যুগ ওভাবেই পড়ে রইলো।   

তারপর জ্ঞান ফিরলে পরে সে পথ চিনে চিনে ওখান থেকে বের হয়ে এলো। উলটো করে বাইবেল পড়তে পড়তে মরে যাওয়া লোকটার সামনে দিয়ে আরেকবার যাওয়ার সময় ও খেয়াল করলো লোকটা দেখতে হুবহু ওর মত। তাড়াতাড়ি সে সুড়ঙ্গটা থেকে বের হয়ে এলো। 

তার অধীরতা এবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। সে জমিনের পাথর গোণা শুরু করে দিলো। মাকড়সার জাল, সূর্যের রঙসমূহ, নদীর জোয়ার-ভাটা, সব গুণতে লাগলো সে। বাতাসের ঝাপ্টাও সে গুণে রাখলো। সে নিজেকে গল্প বলে শোনাতে শুরু করলো। কিন্তু সে খেয়াল করলো সে নিজেকে যে গল্পই বলুক না কেন, তার ধ্বংসাত্মক অংশগুলো ওই মাথায় বাড়ি দিয়ে কেটে দেয়া হতো। সে মাথার বাড়িগুলোও গুণে রাখা শুরু করলো। তার অভ্যাস হয়ে গেছিলো। 

তারপরে আবার তার কাছে কণ্ঠটা এলো। এবার তাকে আগের চেয়েও অনেক হিংস্র লাগছিলো। কণ্ঠটা বললো: 

"তোমার কি এখানে ভালো লাগে?"

"না।"

তাড়িয়ালা ভেবেছিলো এবারও তার মাথায় একটা বাড়ি পড়বে। কিন্তু কিছুই হলো না। 

"তুমি কি চলে যেতে চাও?"

"হ্যাঁ।"

"তোমাকে কী আটকে রেখেছে?"

"আমি জানিনা কীভাবে যাব।"

কণ্ঠটা চুপ করে গেলো।

আরেকটা কণ্ঠ বলে উঠলো:

"তুমি তিন দিন ধরে মৃত।"

আর এই তাড়িয়ালা, আকাশ ও জমিন যার কাছে ধরা দিয়েছিলো বিবিধ ভঙ্গিমায়, যিনি জানতেন বিশুদ্ধ তাড়ির রহস্য, তিনি এইমাত্র জেনে গেলেন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কোনোকিছু না ভেবে সে শুনতে লাগলো।  

"যদি তুমি চলে যেতে চাও," কণ্ঠটা বললো, "আমাদের তোমাকে পিটিয়ে ভাগাতে হবে।"

"কেন?"

"কারণ তোমরা মানুষেরা শুধুই ব্যথার মর্ম বোঝো।" 

"একদমই না।"

তারপর এলো আরো একটা শব্দবিরতি। সে বাড়ির অপেক্ষা করলো। এবার এলোও। বাতাসে ছিন্ন মাকড়সার জালের মত তার চিন্তাগুলো দিকবিদিকে ভেসে গেলো। সূর্যের বেগুনি পর্যায়ের নিচে তাড়িয়ালা ওরকমই, নিথর দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘ বিরতির পর কণ্ঠটা আবার বললো:

"ওই বাড়ি খেয়ে তোমার চিন্তাগুলো উড়ে গেছে। তার বদলে অন্য কিছু চিন্তা শুনবে?  

"হ্যাঁ।" 

একটা গলাখাকাড়ি দিয়ে কণ্ঠটা শুরু করলো:

"এমনকি জীবনের ভালো জিনিসগুলোও একসময় বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এখানে তিনরকমের শব্দ আছে, দুইরকমের ছায়া, প্রতিটি ফাটা খুলির জন্য একটি করে লাউ, আর খুব বেশি উঁচুতে বেয়ে ওঠে যারা তাদের প্রত্যেকের জন্য সাতটি করে সুড়ঙ্গ। প্রতিটি অনুভূতির মধ্যে এখানে রয়েছে ঝাঁজালো তরল, এমন আগুন রয়েছে যাতে কিছুই পোড়ে না, শুধু রক্তমাংস লবণের মত গলে যায়। বড় মুখ ক্রমাগত ছোট মাথা গিলে খায়। যাকিছু আমরা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেই তা বাতাস আবার আমাদেরই দিকে ফিরিয়ে আনে। নিজের আগুনে পোড়ার বহু পথ রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট শব্দ শুনতে পেলে বোঝা যায় বিপদ আসন্ন। তোমার চিন্তারা কিছুই না, স্রেফ তোমার নিজের মগজের বিপন্ন অঞ্চলে তোমার যাতায়াতের পদধ্বনি। 

"ধন্যবাদ," বললো তাড়িয়ালা। 

কণ্ঠটা চলে গেলো। তাড়িয়ালা ঘুমিয়ে পড়লো। 

ঘুম ভেঙে সে দেখলো ওই তিনখানা কচ্ছপ সুড়ঙ্গের মুখে আবারও ঝিমুচ্ছে। টাবাস্কোর চেহারাওয়ালা কচ্ছপটা পশুর হাড়ের ফ্রেমের একটা চশমা আর গলায় স্টেথেস্কোপ লাগিয়ে বসে ছিল। কচ্ছপগুলো একটা কোলা বাদাম ভাঙলো, তারপর নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলো, এবং কোনো বিষয় ছাড়াই পণ্ডিতদের মত আলোচনা শুরু করে দিলো। সুড়ঙ্গ হতে বহুরঙা সাপটা বের হয়ে নদীর দিকে এগোলো। কচ্ছপগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে একটু থামলো। তাড়িয়ালা সাপটার উপলের মত চোখ দু'টো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো।  

"আজ রাতে ছয়টা চাঁদ উঠেছে," বলে উঠলো টাবাস্কোর মুখওয়ালা কচ্ছপটা। 

"হ্যাঁ, আজ রাতে ছয়টা চাঁদ উঠেছে," সহমত জানালো বাকি কচ্ছপেরা। 

সাপখানা তখন মাথা উঁচু করলো, তার চোখ জ্বলজ্বল করে আছে তারকাদের দিকে, বললো:

"আজ রাতে সাতটা চাঁদ উঠেছে।" 

কচ্ছপগুলো চুপ করে রইলো। সাপটা নদীর দিকে এগিয়ে গেলো। টাবাস্কোর মত দেখতে কচ্ছপটা একটা নুড়িপাথর উঠিয়ে সাপটার গায়ে ছুড়ে মারলো। বাকি কচ্ছপগুলো মজা পেয়ে হেসে দিলো।

"আজকের রাতে একটিও সাপ নেই," টাবাস্কোর মত দেখতে কচ্ছপটা বললো।

এটা যেন কোনো ইশারা ছিল, শোনার সাথে সাথে কচ্ছপগুলো সাপটার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। টাবাস্কো কচ্ছপটা সাপের ঘাড় ধরে স্টেথেস্কোপটা গলায় পেঁচিয়ে টিপে ধরেছিলো। বাকি কচ্ছপগুলো সাপটার মাথায় পাথর মারতে লাগলো। সাপটা লেজ দিয়ে একটা মোচড় মেরে উঠলো। টাবাস্কো আর সাপটা গড়িয়ে সুড়ঙ্গটার মধ্যে পড়ে গেলো। নিচ থেকে অনেক আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর টাবাস্কো কচ্ছপ তার চশমা আর স্টেথেস্কোপ ছাড়াই উঠে এলো। তারপর সে বাকি কচ্ছপদের সাথে গিয়ে বসলো। তারা আরো একটা কোলা বাদাম ভাঙলো। তারপর টাবাস্কো কচ্ছপ একটা পাইপ সাজানো শুরু করলো। তামাকের বদলে সে গোলমরিচ ঢুকালো পাইপে। পাইপটা ধরিয়ে সে তাড়িয়ালাকে ইশারায় কাছে ডাকলো। তাড়িয়ালা গিয়ে সুড়ঙ্গের মুখে কচ্ছপগুলোর সাথে গিয়ে বসলো। টাবাস্কো কচ্ছপ তাড়িয়ালার মুখে ঘন কালো সুরসুরি ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বললো:

"তুমি ছয়দিন ধরে মৃত।" 

তাড়িয়ালা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। কচ্ছপেরা আবার গম্ভীরভাবে আকাশের তারাদের নিয়ে আলাপে ডুবে গেলো।

কিছুক্ষণ পর ওই ধোঁয়ার প্রভাবে তাড়িয়ালা এক পরিচিত দুনিয়ায় ভেসে গেলো। তার নাকে হঠাৎ সুরসুরি লাগা শুরু হলো। শৈশবের একটা মুহূর্তে ভেসে গেলো সে, যখন তার মা তাকে কোলে করে মুখোশোৎসবে নিয়ে গেছিলো। সেইদিন খুবই গরম পড়েছিলো। মুখোশ পরে নাচতে নাচতে লোকেরা দ্রুত পিছে চলে গেলো, চারিপাশে রক্তের মত লাল ধোঁয়া সব ঢেকে দিয়েছিলো যাতে সাধারণ মরমানুষেরা তাদের এই চমৎকার রীতি দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। সেইদিন সারাটাদিন তার নাকে আগুন লেগে ছিল। আর সেই রাতে সে স্বপ্নে দেখেছিলো সকল প্রকার ভৌতিক প্রাণীরা পাল্লা দিচ্ছিলো কে কতক্ষণ নিজের নাক মুখে লাগিয়ে রাখতে পারে। এই স্বপ্নটার ভেতর দিয়েও সে আরেকবার গেলো। স্বপ্নের ওই ভৌতিক প্রাণীদের মধ্যে ছিল সেই বিখ্যাত কামার, যে পানি দিয়ে লোহা বানাতে পারতো; আরো ছিল সেই কুখ্যাত কচ্ছপ, যে সকল জটিল পরিস্থিতি সামলাতো তার সহজ পাগলামি দিয়ে; এবং ছিল ওঝারা, যাদের কাছে কোনো রহস্যের উত্তর ছিল না। তাদের এই পাল্লার মাঝে তার মা এসে এক প্লেট গুড়ামরিচ ছড়িয়ে দিয়ে এদের সবাইকে ভাগিয়ে দিলো। এতে তার নাকের সমস্যা আরো বাড়লো। 

এই পরিচিত দুনিয়ায় ভাসতে ভাসতে তার উপর সেই কণ্ঠটা চেপে বসলো। আরেকটা কণ্ঠ বললো:

"দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওঠো।"

তার উপর একের পর এক অদৃশ্য আঘাত পড়তে লাগলো। সূর্যের সবচাইতে অস্বাভাবিক পর্যায় চলছিলো তখন, যখন সে বেগুনি হতে চোখের মণির মত কালো হয়ে গেলো। আঘাতগুলো থামলে পরে তাড়িয়ালা তার ভেতর অনেকক্ষণ ধরে জমতে থাকা প্রবল একটা হাঁচি দিয়ে বাঁচলো। তার হাঁচির চোটে অতিকায় ডিমগুলো ফেটে গেলো, সাপটা তার উপলের মত চোখ হারালো, কণ্ঠগুলো ছিটকে গিয়ে মশাদের একাগ্র বার্তালাপে মিলিয়ে গেলো। সুড়ঙ্গের মুখ ফেটে সবুজ তরল বের হয়ে সাপ, সাইনবোর্ড, কচ্ছপ সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়িয়ালা চারপাশে তাকালো। একটা নীল-নীল মেঘ তার চোখের সামনে দিয়ে গেলো। কবিরাজ টাবাস্কো তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কটু ধূপচি ঘোরাচ্ছিলো, তার ধোঁয়ার গন্ধ ছিল সবচেয়ে বাজে। যেইমাত্র তাদের চোখাচোখি হলো, কবিরাজ টাবাস্কো খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠে তার মন্দিরের সাজিমাটির মূর্তির উপর দেবতাদের উদ্দেশ্যে একটুখানি সুরা ঢেলে দিলো। মূর্তিটার দু'টো সবুজ কাচের চোখ। মন্দিরের ঠিক নিচে একটা সবুজ বেসিনে দু'টো কচ্ছপ রাখা। 

"আমি কোথায়?" জিজ্ঞেস করলো তাড়িয়ালা।

"দুঃখিত আমি তোমার স্বপ্নের প্রতি প্রথম থেকে নজর দেইনি," উত্তর দিলো কবিরাজ।

"কিন্তু আমি কোথায়?"

"তুমি একটা তালগাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলে আর তুমি সাতদিন ধরে মৃত। আজ সকালে তোমাকে কবর দিতে যাচ্ছিলাম আমরা। আমি এই পুরোটা সময় তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। এই কাজের জন্য তোমার থেকে আমি কোনো পয়সা নেবো না, বরং আমিই তোমাকে কিছু দিতে চাই। কারণ কবিরাজ হিসেবে আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় এত চমৎকার ঘটনা আমি কোনোদিন দেখিনি, এবং এত চমৎকার আলাপও আমার কারো সাথে হয়নি।"


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই