চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ইসলাম ও বিজ্ঞান



ইসলাম ও বিজ্ঞান

মূল : মাওলানা ওহিদুদ্দিন খান
তর্জমা : মওলবি আশরাফ


বিজ্ঞানমনস্ক এক ভদ্রলোকের সাথে কথা হচ্ছিল, যিনি সায়েন্সের ওপর ডিগ্রি নিয়েছেন পাশাপাশি ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। কিন্তু তিনি আল্লাহ ও ধর্মে বিশ্বাস রাখতেন না। কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘ইসলামকে যদি গোটা মানবেতিহাস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে মানবজাতির ইতিহাসে কোনো কমতি বা অপূর্ণতা থাকবে কী?’ 

আমি বললাম, ‘সেই অপূর্ণতা থাকবে, ইসলাম আসার আগে মানবজাতির ইতিহাসে যা ছিল।’

পৃথিবীতে মানবজতি হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। কিন্তু জানা ইতিহাসে মানবজাতি এমন পর্যায়ে কোনোকালেই পৌঁছাতে পারেনি, ইসলামের পরে যেখানে পৌঁছেছে। এর কারণ কী? উত্তর খুবই সহজ। ইসলামের আগে প্রতিটি যুগে মানবজতির ওপর শিরক ও পৌত্তলিকতা বিজয়ী ছিল। এই শিরকই বিশ্বপ্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রতিবন্ধক ছিল। কেননা শিরকি ধারণায় প্রাকৃতিক বস্তুগুলো ছিল পূজনীয়। আর বিজ্ঞানের চর্চা তখনই হওয়া সম্ভব যখন পদার্থ ও প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা হয়।

একজন পৌত্তলিক চাঁদকে দেবতা মনে করে, তাই সে চাঁদে পা রাখার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সে নদীর স্রোতকে ঈশ্বরের অংশ মনে করে, এইজন্য স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ভাবনাও তার মনে আসতে পারে না। জানা ইতিহাসে একমাত্র ইসলামই শিরককে পরাজিত করে আল্লাহর একত্বকে বিজয়ী করেছে। অন্যকথায়, ইসলামই প্রথম মানবজাতিকে এই ধারণা দেয় যে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই খালেক (সৃষ্টিকর্তা), বাকি সবকিছু তার মাখলুক (সৃষ্টি)। এইভাবে ইসলাম বিশ্বপ্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এবং এই কারণেই বর্তমানের এইসব উন্নতি-অগ্রগতি অস্তিত্বে এসেছে, প্রকৃতিকে জয় করার বদৌলতেই মানবজাতি এসব হাতের নাগালে পেয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো— প্রাচীনকালে বিজ্ঞান চর্চা গতিশীল না হওয়ার কারণ ছিল শিরক, আর বর্তমানে বিজ্ঞান গতিশীল হওয়ার মূল কারণ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস।

নিঃসন্দেহে ইসলাম পৃথিবীকে বিজ্ঞান দিতে আসেনি। আবার একথাতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি ইসলাম না আসত, তাহলে মানবজতির ওপর আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বার বন্ধ থাকত, যেভাবে পূর্ববর্তী জাতির সামনে বন্ধ ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা, গবেষণা ও উন্নতির এই ধারাবাহিকতার পেছনে যে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের ভূমিকা আছে, একথা আর্নল্ড টয়েনবিও (১৮৮৯-১৯৭৫) স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন।

ইসলামি বিপ্লব থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম

তৌহিদের বুনিয়াদের ওপর চিন্তার বিপ্লব আসে, এর প্রমাণ হলো মানুষ বিশ্বপ্রকৃতিকে এ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল যে, সেটা নিছক প্রকৃতি বা জড়বস্তু। আর মানবজাতির বস্তুকে জানার এবং তাকে নিজের কাজে লাগানোর অধিকার রয়েছে। এই কাজ সর্বপ্রথম উমাইয়া যুগে (৬৬১-৭৫০) দামেশকে শুরু হয়। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা রসায়ন শাস্ত্রের সাহায্যে রুপা দিয়ে স্বর্ণ তৈরি করত। সর্বপ্রথম খালেদ বিন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া রসায়ন শাস্ত্রকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আব্বাসীয় যুগে এই শাস্ত্র আরও উন্নতি লাভ করে এবং স্পেন ও সিসিলি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেসময় মুসলমানরা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চায় পৃথিবীর সকল জাতি থেকে এগিয়ে ছিল। ওই সময়ের ইউরোপকে খোদ ইউরোপের ঐতিহাসিকরাই অন্ধকার যুগ (Dark Ages) বলেন। কিন্তু সেই অন্ধকার যুগ কেবল ইউরোপের জন্যই ছিল, মুসলিম বিশ্বের জন্য নয়। ওয়ার্ল্ড বুক অফ এনসাইক্লোপিডিয়ায় অন্ধকার যুগের (Dark Ages) শিরোনামে লেখা আছে :

The term dark ages cannot be applied to the splendid Arab culture which spread over North Africa and into Spain.

অন্ধকার যুগের সংজ্ঞা গৌরবময় আরব সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, যা তৎকালীন উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনেও বিস্তৃত ছিল।

শিরক কিভাবে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, বিষয়টাকে স্পষ্ট করতে এখানে তার একটি উদাহরণ পেশ করছি। প্রাচীন গ্রিসে সূর্যের আবর্তনের প্রশ্নে দুইটি মতামত পাওয়া যায়। অ্যারিস্টার্কাসের মত ছিল পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। অপরদিকে টলেমির মত ছিল সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। প্রথম মত অনুযায়ী পৃথিবী গোলাকার ছিল। আর দ্বিতীয় মত অনুযায়ী পৃথিবী ছিল চ্যাপ্টা। কনসট্যানটাইন (২৭২-৩৩৭)  খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর যখন তারা ইউরোপে বিজয় লাভ করল। তখন তারা টলেমির মতকে (খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস হিসাবে) গ্রহণ করল, আর ভিন্নমতকে শক্তহাতে দমন করল। এর কারণ ছিল খুবই আশ্চর্যজনক— খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে হজরত ঈসা (আ) ঈশ্বরের অংশ, তো এই বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবী ঈশ্বরের জন্মভূমি হওয়ায় পূতপবিত্র, আর যে জিনিস ঈশ্বরের জন্মভূমি, তা কখনোই কারও অধীনস্ত (Satellite) হতে পারে না। পৃথিবীকে এরকম পবিত্র জ্ঞান করার কারণে এই বিষয়ে তারা কখনো বাড়তি চিন্তা-ফিকির করার দুঃসাহস দেখায়নি।

পৌত্তলিক ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মাঝে বিরোধের বিশদ বর্ণনার জন্য ড্রেপার (১৮১১-১৮৮২) রচিত গ্রন্থ Conflict between Science and Religion (‘ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মাঝে বিরোধ’)-এ চোখ বুলানো যেতে পারে।

আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের শাসনামলে (৭৮৬-৮৩৩) বাইতুল হিকমাহ[1] প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সবধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান আরবিতে অনুবাদ করা হয়। মুসলমানরা যখন আকিদা-বিশ্বাসের আপত্তি থেকে মুক্ত হয়ে দুটো মতই (সূর্য কেন্দ্র না পৃথিবী কেন্দ্র) পর্যবেক্ষণ করল, তখন তাদের কাছে প্রথম মতটিই অধিক বাস্তব ও যুক্তিযুক্ত মনে হলো। খলিফা আল মামুন নিজেও একজন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি এ বিষয়ের গুরুত্ব অনুভব করলেন। তিনি ভূগোলবিদদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবীকে গোলাকার ধরে এর ব্যাস (Circumference) জানতে, এবং এ-কাজের জন্য খোলা প্রান্তরে ভূ-গোলক (Terrestrial Degree) স্থাপন করে পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও গভীরতা পরিমাপ করতে। ওই সময় মুসলমানদের কাছে মাপার জন্য উন্নত যন্ত্র ছিল না, শুধু কোয়াডর‍্যান্ট অ্যাস্ট্রোল্যাব, সূর্যঘড়ি আর সাধারণ গ্লোব ছিল। এই ধরনের সাধারণ কিছু জিনিস নিয়ে তারা চেষ্টা শুরু করে। এই উদ্দেশ্যে সিরিয়ার পালমাইরার (Palmyra) প্রশস্ত ভূমিকে নির্বাচন করে। তারা একটি জায়গায় উত্তর মেরুর উচ্চতার সাথে একটি কোণ স্থাপন করে উত্তর দিকে জেরিব (অঞ্চল) থেকে মাপতে শুরু করে, ৫৬ ২/৩ মাইল উত্তর দিকে অগ্রসর হলে উত্তর মেরুর উচ্চতার কোণে এক ডিগ্রি দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। এর থেকে বোঝা গেল ভূপৃষ্টের ওপর এক ডিগ্রির দুরত্ব যেহেতু ৫৬ ২/৩ মাইল হয়, সেহেতু পৃথিবীর ব্যাস ২০ হাজার মাইলের চেয়ে বেশি হওয়া উচিৎ, কেননা প্রত্যেক বিন্দুতে সমস্ত কোণের সমষ্টি ৩৬০ ডিগ্রি হয়। এবং ৩৬০ কে ৫৬ ২/৩ এর মধ্যে গুণ করলে ২০,৪০১ মাইল দূরত্ব পাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার ফুরাতের উত্তরে কুফার একটি খালি মাঠে এই পরীক্ষা চালানো হয়, আবারও একই ফলাফল আসে। এই পরিমাপটি বিস্ময়করভাবে সঠিক ছিল। কেননা বর্তমানে সঠিক পরিমাপ অনুযায়ী মধ্যরেখা থেকে জমিনের ব্যাস ২৫ হাজার মাইল। আল মামুনের জ্যোতির্বিদগণ পৃথিবীর ওপর অঙ্কিত একটি কৌণিক রেখার দৈর্ঘ্য মাপতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভৌগোলিক দূরত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে এটি ছিল সত্যিই চমকপ্রদ সাফল্য। পৃথিবী গোলাকার এই অনুমানের ভিত্তিতে তার পরিধি ও আয়তন নির্ণয় করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। পালমাইরার কাছে ফুরাত নদীর উত্তরে সিন্সার নামে একটি সমভূমিতে তারা এই রৈখিক কোণের মাপ নিয়েছিলেন। মধ্যরেখা পর্যন্ত অঙ্কিত এই কৌণিক রেখার দৈর্ঘ্য ছিল ৫৬ আরবীয় মাইল। এটি ছিল নিঃসন্দেহে নির্ভুল পরিমাপ। এবং ওই জায়গায় কৌণিক রেখার প্রকৃত  দৈর্ঘ্যের চেয়ে তা ছিল ২,৮৭৭ ফুট বেশি। এর ফলে পৃথিবীর পরিধি ও ব্যাসের পরিমাপ হবে যথাক্রমে ২০,৪০০ মাইল ও ৬,৫০০ মাইল।

মধ্যযুগে মুসলমানদের বিজ্ঞানে উন্নতির বিষয়ে প্রফেসর ফিলিপ হিট্টি তার হিস্টরি অফ অ্যারাবস বইতে বিস্তারিত লিখে গেছেন।

বিজ্ঞান থেকে মুসলিমদের আলাদাকরণ

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি, উন্নতি অব্যাহত ছিল। এরই মাঝে মুসলমানদের পরস্পর মতবিরোধের কারণে আরবীয় খেলাফত ভেঙ্গে যায়, এবং ইসলামের পতাকা (১৫১৭-১৯২২) ওসমানি তুর্কিরা শক্তহাতে ধারণ করে। এভাবেই খ্রিষ্টীয় ষোল শতকে মুসলিমবিশ্বের রাজনৈতিক কেন্দ্র আরব থেকে সরে তুর্কির দিকে চলে যায়। এখান থেকেই সূচিত হয় ইতিহাসে নতুন বিপ্লব, যা ইতিহাসের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়।

ইতিহাসের অদ্ভূত ট্রাজেডি হলো এক ব্যক্তি যদি কোনো না কোনো উপায়ে উপকারী প্রমাণিত হয়, সে আবার অন্যকোনো দিক দিয়ে বড় মসিবত হয়ে দাঁড়ায়। তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো উমাইয়া খলিফা সুলাইমান বিন আবদুল মালিক। তার একটি মহৎ কাজ হলো, তিনি ওমর বিন আবদুল আজিজকে তার পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে খোলাফায়ে রাশেদার তালিকায় পঞ্চম খলিফা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। কিন্তু ঐতিহাসিকরা তার ভয়ানক কিছু ভুলের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি তার সময়ের অনেক জগদ্বিখ্যাত সেনানায়কদের হত্যা করেছেন, ফলে এশিয়া ও আফ্রিকাতে ইসলামের অগ্রগতি থেমে যায়।

ওসমানি তুর্কিরাও এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। তুর্কিরা ঠিক সেই সময় ইসলামের পতাকা শক্তহাতে ধারণ করেছিল, যখন দুর্বল হাতে পৌঁছে তা পুনরায় ভুলুন্ঠিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। তারা কয়েক শ বৎসর পর্যন্ত ইসলামকে হেফাজতের জন্য ইউরোপীয় খ্রিষ্টশক্তির মোকাবেলায় শক্ত প্রাচীর হয়ে ছিল। এই দিক বিবেচনায় তাদের এই সুবিশাল খেদমত কখনোই ভুলবার নয়। কিন্তু এ তুর্কিরাই মুসলিমবিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং তারা চেয়েছিল এসব ইউরোপের দিকে ফিরে যাক। তুর্কিরা অত্যন্ত সাহসী জাতি, কিন্তু তাদের মূর্খতাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বিজ্ঞান ও গবেষণার গুরুত্ব কেবল বুঝতেই পারেনি এমন নয়, বরং তারা একে নিজেদের রাজনৈতিক হুমকি জ্ঞান করেছিল। তাদের ধারণা ছিল জ্ঞান বেড়ে গেলে প্রজাদের মাঝে আনুগত্য কমে যাবে এবং তাদের বশ রাখা কঠিন হয়ে যাবে। একারণে তারা জ্ঞানের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখেনি। যখন মুসলিমদের রাজনৈতিক কেন্দ্র পরিবর্তিত হলো, তখন যারা বাগদাদ ও অন্যান্য অঞ্চলে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিল, তারা তৎকালীন তুরস্কের রাজধানী আসতানায় একত্রিত হলো। আব্বাসী খলিফারা তাদের সীমাহীন কদর করত। তারা তাদের ওপর দিনার দিরহামের বৃষ্টি বর্ষণ করত। কিন্তু তুর্কিরা নিজেদের জন্য বিপদ মনে করে তাদের ঘৃণা করতে থাকে। তুর্কিরা তাদের উৎসাহ উদ্দিপনা এমনভাবে নষ্ট করে দেয় যে, তারা তুরস্কে নিজেদের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখতে পেল। সুতরাং তারা তুরস্ক ছেড়ে ইতালি ও ফ্রান্সের দিকে যেতে শুরু করল। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণার কাজ এভাবেই মুসলিমবিশ্ব থেকে বের হয়ে ইউরোপের  হাতে চলে গেল। তুর্কিরা কিভাবে জ্ঞান ও জ্ঞানীদের উৎসাহ উদ্দিপনা ভেঙে দিয়েছে, তার ভয়ানক বর্ণনা সিরিয়ান ঐতিহাসিক মুহাম্মদ কুর্দ আলি (১৮৭৬-১৯৫৩) তার  তারিখ আল হাদারা আল আরাবিয়্যার-তে উল্লেখ করেছেন।

পশ্চিমাবিশ্বে এসকল মুসলিম বিজ্ঞানীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়। ক্রুসেড যুদ্ধে (১০৯৫-১২৭১) মুসলমানদের মোকাবেলায় ইউরোপের পরাজয় একারণে হয়েছিল যে, মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের চেয়ে অগ্রগামী ছিল। সেই যুদ্ধে শুরুর দিকে রোমান বাহিনী গ্রিক ফায়ার (Greek Fire) ব্যবহার করে। ফলে মুসলমানদের অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ‘গ্রিক ফায়ার’ বড় আকারের পিচকারির মতো দেখতে একধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যার মধ্যে বারুদের রাসায়নিক বিক্রিয়া ভরে শত্রুর অবস্থানস্থলে নিক্ষেপ করা হতো। মুসলিম বিজ্ঞানীরা তার প্রতিরক্ষায় নতুন ক্ষেপণাস্ত্র আবিষ্কার করে, যার মধ্যে খনিজ তেল ব্যবহার হতো। সেটা অনেক দূর পর্যন্ত নিক্ষেপ করা যেত, এবং এর তাণ্ডবও ছিল গ্রিক ফায়ারের চেয়ে কয়েকগুণ। খ্রিষ্টানরা শক্তির দিক দিয়ে মুসলমানদের মোকাবেলায় নিজেদের জড়তাকে দূর করার জন্য উদগ্রীব ছিল। এখন যেহেতু মুসলিমবিশ্বের বিজ্ঞানীরা ইউরোপে এসে উপনীত হয়েছে, তাই তারা সাদরে অভ্যর্থনা জানালো এবং যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করল। ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাজ দ্বিগুণ গতিতে এগুতে লাগলো, ইতোপূর্বে যে পরিবেশ মুসলিমবিশ্বে ছিল। খ্রিষ্টীয় ষোল শতক থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় তিন শ বছর কঠিন শ্রম ও চেষ্টা-সাধনার ফলে অবশেষে সেই বিপ্লব সংগঠিত হয়, ইতিহাসে যাকে বলা হয় বিজ্ঞান ও শিল্পের বিপ্লব।

ইউরোপীয় বিজ্ঞানের উন্নতিতে মুসলমানদের অবদান বিষয়ে আরও জানতে রবার্ট ব্রিফল্টের The Making of Humanity (1919) গ্রন্থটি পড়া যেতে পারে।

ষোল শতক পর্যন্ত মুসলমানরা গুরুর আসনে সমাসীন ছিল, কিন্তু পরবর্তী শতকগুলোতে ইউরোপীয়রা যে উন্নতি সাধন করে, সেটা মুসলমানদেরকে শিষ্যের অবস্থানে নামিয়ে দেয়। এভাবেই বৈপ্লবিক কাজগুলো মুসলমানদের বেহাত হয়ে যায়, মুসলমানরা নিজেদের হাতে গড়া পৃথিবীতে অন্য জাতির পিছনে পড়ে যায়। এরপরেও ইউরোপের গবেষণা থেকে উপকৃত হয়ে উন্নতি করার সুযোগ ছিল, তাহলে  সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারত— যেমনটা মুসলমানদের মোকাবেলায় পশ্চিমাদের বেলায় হয়েছে। মুসলমানদের জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তো পশ্চিমারা এগিয়ে গিয়েছিল, এখন চাইলেই মুসলমানরা পারত ইউরোপীয় জ্ঞান নিয়ে নিজেদেরকে আরও এগিয়ে নিতে। কিন্তু এখানে দুইটি বিশেষ কারণ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ফলে ইতিহাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেষমেশ তা মুখ থুবড়ে পড়ে।

বিজ্ঞান প্রশ্নে বর্তমান মুসলিমদের উদাসীনতা

(এক) কয়েক শ বছর বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকার পর ইউরোপীয়দের মাধ্যমে যখন মুসলমানদের কাছে আবার বিজ্ঞান এলো, তখন সেটা শুধুমাত্র জ্ঞান হিসেবে আসেনি, বরং সেটা জাতীয়তাবাদ ও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের রূপে আসে। মুসলমানদের কাছে এই বিজ্ঞান তারাই ফিরিয়ে এনেছিল যারা কিনা তাদের মহত্ব, বড়ত্ব ও নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল, এবং সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিষয়ের ওপর আক্রমণ করেছিল। এই পরিস্থিতে মুসলমানরা ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পশ্চিমাদের রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখার মতো বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেনি। বরং তারা দুটো বিষয়কেই, মানে পশ্চিমা রাজনীতি ও বিজ্ঞানকে এক চোখেই দেখেছিল। তারা যেভাবে আগ্রাসী পশ্চিমাদের শত্রু ভেবেছিল, ঠিক সেভাবে পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানকেও তা থেকে আলাদা করতে পারেনি। যখন অন্যান্য জাতি পশ্চিমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করছিল, তখন মুসলমানরা শত্রুর জিনিস মনে করে তার থেকে পলায়ন করতে থাকে। ফলে বর্তমানে মুসলমানরা নেতৃত্ব দিবে দূরের কথা, বরং তারা অন্যান্য জাতি থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অন্তত এক শতাব্দী পিছিয়ে আছে।

(দুই) সবচেয়ে বড় এই ক্ষতি হয়েছে যে, দীর্ঘ ঔদাসীন্যের পর মুসলমানদের মাঝে যারা জ্ঞানের প্রচার-প্রসারের জন্য উদ্যোগী হয়েছিল, তারা এই কাজের জন্য একদমই উপযুক্ত ছিল না। তারা সঠিক কাজটিই ভুল পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছিল। ফলে মুসলমানদের মাঝে তাদের সেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি, আদতে যা হওয়া উচিৎ ছিল।

উদাহারণ হিসাবে বলা যায় : আধুনিক জ্ঞানের গুরুত্ব প্রমাণ করার জন্য কোরআন হাদিসের যেখানে ‘ইলম’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, তারা এর উদ্দেশ্য বানায় কলেজ ও ইউনির্ভাসিটিতে পড়ানো সেক্যুলার জ্ঞান। এটা ছিল একটা সঠিক বিষয়কে প্রমাণের জন্য ভুল দলিলের উপস্থাপন। কেননা বাস্তবতা হলো কোরআন হাদিসে যে ইলমের কথা বলা হয়েছে, সেটা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইলমে দীন তথা ধর্মীয় জ্ঞান, সেক্যুলার বা ইহজাগতিক জ্ঞান নয়। নিঃসন্দেহে এসব জ্ঞান অর্জন করাও মুসলমানদের জন্য জরুরি। কিন্তু এসব জ্ঞানের গুরুত্ব কোরআনের শক্তি অর্জনের আয়াত দিয়ে প্রমাণিত হয়, ইলম অর্জনের আয়াত দিয়ে নয়। কোরআনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা সেই শক্তি অর্জন করো যার দ্বারা তোমাদের প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় মজবুত হয়ে দাঁড়াতে পারো। বর্তমানে সায়েন্স সেই স্থানেই রয়েছে। এই জন্য মুসলমানদের বিজ্ঞানে পারদর্শী হওয়া আবশ্যক। বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন ছাড়া মুসলমানরা শক্তিধর হতে পারবে না, সুরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে এমনই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।[২] বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে কোরআনের এই হুকুম বাস্তবায়ন করা ও এসকল জ্ঞান শেখা জরুরি। এবং সেটাকে ইসলাম ও মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগানোও আবশ্যক।

মুসলমানদের ধার্মিক শ্রেণি পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কঠোর বিরোধী হয়ে যাওয়ার কারণেই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশা। طلب العلم فريضة على كل مسلم (প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ) হাদিসের উদ্দেশ্য ধর্মীয় আলেমদের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন করা। আধুনিক শিক্ষিতরা যখন এই ধরনের আয়াত এবং হাদিস দিয়ে বর্তমান জমানার পার্থিব জ্ঞান উদ্দেশ্য করেন, আলেমদের কাছে তখন এই বিষয়টি ইসলামের অবমাননা মনে হয়। কাজেই তারা এর বিরোধী হয়ে যান। আধুনিক শিক্ষিতরা নিশ্চিত ভুলের ওপর ছিলেন, কিন্তু ধর্মীয় আলেমদের থেকেও একই ভুল হয় যে, তারা উদ্দেশ্য ও দলিল উপস্থাপনকে আলাদা করে দেখতে পারেননি। যদি তারা এমনটি করতেন, তাহলে তাদের উপলব্ধ হতো যে, আধুনিক শিক্ষিতরা আয়াতের ভাবার্থ তুলে যেই জ্ঞানের গুরুত্বকে ভুলভাবে প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন, সেটা ওই আয়াতে প্রমাণিত না হলেও কোরআনের অন্য আয়াত দিয়ে ঠিকই প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল দলিল উপস্থাপনের পদ্ধতি সংশোধন করা, উদ্দেশ্যকে মোটেও বাতিল করা নয়। 

ইসলামে বিজ্ঞানের গুরুত্ব

ইসলামে বিজ্ঞানের গুরুত্বের নানাবিধ কারণ রয়েছে। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো।

(ক) বিজ্ঞান হলো বস্তুজগত নিয়ে গবেষণা করা। কোরআনে মুমিনের এই গুণের কথাই বলা হয়েছে যে, (يتفكرون في خلق السماوات والارض) অর্থাৎ মুমিন আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ফিকির করে। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯১) এই হিসাবে একজন বিজ্ঞানী ঠিক সেই কাজটিই করে যা মূলত একজন মুমিনের কাজ। যদিও উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞানীর কাজ শুধু গবেষণার জন্য হয়, আর মুমিনের কাজ হয় শিক্ষার জন্য। বিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনা শুধু পার্থিব জগতে সফলতার জন্য হয়। আর মুমিনের জ্ঞানসাধনা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। বিজ্ঞানী নতুন কিছু আবিষ্কার করেই তুষ্ট। আর মুমিন ঈমান বৃদ্ধির ওপর তৃপ্ত।

দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য উভয়ের চিন্তা-ফিকির ও গবেষণার মধ্যে বড় ব্যবধান সৃষ্টি করে। তার ফলাফল এই হয় যে, বিজ্ঞানী বস্তুর সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে ছেড়ে শুধু বস্তুর গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করা পর্যন্ত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে। একজন বিজ্ঞানীকে এমনটি করতে হয়, কারণ সে শুধু যুক্তি দিয়ে বিশ্বকে দেখতে চায়। আর মানুষের মস্তিষ্ক কেবল পর্যবেক্ষণযোগ্য বস্তুই দেখতে পায়। এই জন্য বিশ্বজগতের পর্যবেক্ষণযোগ্য বস্তু পর্যন্ত তাদের চিন্তাভাবনা ও গবেষণা সীমিত রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু মুমিন নিজের যুক্তির সাথে নবুওয়তের পথপ্রদর্শন ও দিকনির্দেশনাও মেনে নেয়। এ কারণে সে বস্তুর বৈশিষ্ট্য ছেড়ে বস্তু সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা পর্যন্ত নিজের চিন্তা-ফিকিরকে টেনে নিয়ে যায়। সে সৃষ্টিকে তার স্রষ্টার সাথে মিলিয়ে দেখে। এই পার্থক্যই মুমিনের বিশ্বজগত পর্যবেক্ষণের মধ্যে বহুমাত্রিক গুণ তৈরি করে। তার কাছে সমস্ত বিশ্বজগত আল্লাহ তাআলার কুদরতের নিদর্শন। বিশ্বজগতের এই বৈচিত্র্যের সে আল্লাহকে পায়, যেই আল্লাহর প্রতি সে পয়গম্বরের মধ্যস্থতায় ঈমান এনেছে।  

(খ) কোরআনে বিশ্বজগত সম্পর্কীয় বিষয়গুলোকে দলিল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। কেমন যেন কোরআনে যেকথা সূক্ষ্মভাবে বলা হয়েছে, বিশ্বজগত সেকথার বাস্তব প্রমাণ। এই দিক থেকে গোটা বিজ্ঞান কোরআনের ইলমে কালাম। কেননা বিজ্ঞান কোনো বিজ্ঞানীর নিজের আবিষ্কৃত জ্ঞানের নাম নয়। বরং সেটা আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট বিশ্বজগতে চলমান নিয়মনীতির নাম। সেই নিয়মাবলির যেই অংশ বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে পেরেছে, সেটা আল্লাহ তাআলার কুদরতের এক ঝলক। সেটা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনের মধ্য থেকে এক নিদর্শন, যা মানুষ রপ্ত করতে পারে। একজন বিজ্ঞানীর জন্য বিজ্ঞান শুধুমাত্র জ্ঞান, বেশি থেকে বেশি দুনিয়ায় সুখ-শান্তির উপাদান। কিন্তু মুমিনের জন্য বিজ্ঞান একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র, যার থেকে সে দীন প্রচারে সহযোগিতা নেয়, এবং নিজের কথাকে যুক্তির মাধ্যমে মানুষের সামনে পেশ করে। 

(গ) বিজ্ঞানের তৃতীয় দিক ইসলামি দৃষ্টিতে সেটাই যা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ বিজ্ঞান বর্তমান সময়ে শক্তি সামর্থের অবস্থান রাখে। এই জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর জন্য আবশ্যক হলো তারা বিজ্ঞানের শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করবে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন তারা বিজ্ঞান গবেষণা ও অর্জনের জন্য অগ্রসর হবে। এমনকি তারা এক্ষেত্রে নেতৃত্বের মর্যাদা অর্জন করবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে মুসলিম নেতাদের এই ধারণা ছিল যে, ভিনদেশি রাজনৈতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তির নামই বিজয়। তারা রাজনৈতিক মুক্তিকে ইসলামের অগ্রগতি ও উন্নতি মনে করেছিল। কিন্তু অসংখ্য কোরবানি বিনিময়ে মুসলিম দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পরও দেখা গেল তারা আজও ওই সকল অমুসলিম রাষ্ট্রের হাতে বন্দি যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের অগ্রগামী। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তাদের বর্তমান বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিতে পারেনি। কেননা সাধারণ ঘড়ি থেকে শুরু করে যুদ্ধের সরঞ্জাম পর্যন্ত সবকিছুতেই তারা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তবতা হলো, বর্তমানে সবকিছু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং যে জাতি এ সকল বিষয়ে পিছিয়ে থাকবে, তারা প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় প্রথম সারিতে স্থান পাবে না।

শেষ কথা

দিল্লির যন্তর মন্তর রোড দিয়ে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত ভবনে চোখে পড়ে, যেই ভবনটির নামও যন্তর মন্তর। এই নামেই রাস্তার নাম রাখা হয়। যন্তর মন্তর মূলত অতীতের একটি মানমন্দির, যা আঠারো শতকের প্রথমার্ধে জয়পুরের রাজা, রাজা জয় সিং নির্মাণ করেছিলেন। রাজা জয় সিংয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ভারতের এই রাজপুত রাজা নিজ আগ্রহে শুধু জয়পুরে মানমন্দির নির্মাণ করেননি, বরং দিল্লি, মথুরা, বেনারস, এবং উজ্জয়নেও মানমন্দির নির্মাণ করেছেন। দিল্লির যন্তর মন্তর ভবন আজও রাজা জয় সিংয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সেই মানমন্দিরগুলোর মাধ্যমে সে সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্র ও চাঁদের গতি পরিমাপ করত। এর মাধ্যমে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করত। নক্ষত্র ও পৃথিবীর দূরত্ব পরিমাপ করত। রাতে চাঁদের আলো ও দিনে সূর্যের আলোর মাধ্যমে সময়ের পরিমাপ করত। ভবনের জানালা, দরজা ও দেয়ালের ছিদ্রে বৎসরের পুরো ক্যালেন্ডার নিজে নিজেই বিন্যস্ত হয়ে থাকত। মধ্যযুগে সারা দুনিয়ার মানুষজন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নির্মাণশৈলীতে মুসলমানদের অনুকরণ করত, তো মহারাজা জয় সিংয়ের এই মানমন্দিরও ছিল আব্বাসীয় যুগের মানমন্দিরের অনুকরণে। এই মানমন্দিরটি ঠিক সেভাবেই নির্মাণ করা হয়েছিল, যেভাবে খলিফা মামুনুর রশিদ একহাজার বছর পূর্বে নির্মাণ করেছিলেন।

অতীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদেরই নেতৃত্ব ছিল। পুরা দুনিয়ায় তাদেরই মত, পথ, দর্শনের অনুকরণ করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের উদাসীনতার কারণে নেতৃত্বের এই আসন পশ্চিমারা দখল করে নেয়। তিন শ বৎসর আগেও যদি কেউ জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য মানমন্দির নির্মাণ করতে চাইত, সে বাগদাদেরই অনুসরণ করত। অথচ আজ যদি কোনো দেশে মানমন্দির নির্মাণ করা হয়, তাহলে তার ডিজাইন ও সরঞ্জাম পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এটাই সেই অবস্থান যেখানে মুসলমানদের সম্মান ও নেতৃত্বের সফর শেষ হয়েছে, আর এখান থেকেই মুসলমানরা পুনরায় নিজেদের সফর শুরু করতে পারে।


টীকা :

[১] বাইতুল হিকমাহ ছিল আব্বাসীয় আমলে ইরাকের বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত একটি গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান] এটিকে ইসলামি স্বর্ণযুগের একটি প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইতুল হিকমাহ খলিফা হারুনুর রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পুত্র আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) এর সময় তা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছায়। জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য আল মামুন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। ৯ম থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত পারসিয়ান ও খ্রিষ্টানসহ[২] অসংখ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এই গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। আরবিতে গ্রন্থ অনুবাদ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি পণ্ডিতরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখেন।

[২] তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সুসজ্জিত অশ্ব প্রস্তুত রাখ, এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে সন্ত্রস্ত করবে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ জানেন। আর আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে, তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অত্যাচার করা হবে না। (সুরা আনফাল, আয়াত ৬০)


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই