চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ভিনদেশি ভাষা



ভিনদেশি ভাষা

মূল : মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান

তর্জমা : মওলবি আশরাফ


প্রয়োজন প্রচেষ্টা ও মেহনত

জোসেফ কনরাড ১৮৫৭ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বেরদিচিও শহরে [1] জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই পিতাকে হারান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ পাননি, জীবনের প্রথমদিকে তিনি নাবিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জাহাজে করে দেশ-বিদেশে যেতেন, শেষমেশ ১৮৮৬ সালে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই থিতু হন।

ব্রিটেনে অবস্থানকালীন তিনি ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। মেহনত করতে করতে এক পর্যায়ে ইংরেজিকে কেবল আয়ত্ত্বই আনেননি, বরং ইংরেজিকে নতুন এক রূপ দেন। বলা হয় জীবদ্দশায় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা সাহিত্যিকদের তালিকায় তার অবস্থান ছিল টমাস হার্ডির পরপরই। তার রচিত গ্রন্থ লর্ড জিম-এর ভূমিকায় লেখা হয়—

He made his name as a stylist in English although he was unable to speak a word of language before he was nineteen.

‘তিনি ইংরেজি ভাষায় নতুন গদ্যশৈলী প্রণয়ন করেছিলেন, অথচ জীবনের প্রথম ১৯ বৎসর তিনি একটি ইংরেজি শব্দও বলতে পারতেন না।’

জোসেফ কনরাডের ২৪টির বেশি ইংরেজি বই আছে, এর বেশিরভাগই গল্প ও উপন্যাস। ইংরেজি তার মাতৃভাষা নয়, তারপরেও তার ইংরেজি বই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। জনৈক ইংরেজিভাষী আমাকে বলেন, কলেজে তাকে তার ইংরেজি শিক্ষক জোসেফ কনরাডের বই পড়ার পরামর্শ দেন, কারণ তার ইংরেজি খুব প্রাঞ্জল।

এটা একটা উদাহরণ, যেখান থেকে আন্দাজ করা যায় মেহনতের ফলে কত কী-ই না করা যায়। মেহনতের ফলে সব সম্ভব। আপনি গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন। আপনি ইংরেজি ভাষার মানুষ না হয়েও ওই ভাষার সাহিত্যিক হতে পারেন। আপনি মানুষের চোখে গুরুত্বপূর্ণ না হয়েও এমন কিছু লিখতে পারেন যে মানুষ আপনার লেখা পড়তে বাধ্য হবে।


নিজেই নিজের শিক্ষক হোন

এক মুসলিম ছাত্রী ইংরেজিতে খুব দুর্বল ছিল। তার পরিবার খুবই ধার্মিক, সেখানে ইংরেজি চর্চার কোনো পরিবেশ ছিল না। একারণে তিনি এমএ-তে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। কিন্তু তার খুব ইচ্ছা ইংরেজিতে চোস্ত হবেন, এবং এই ভাষায় লেখালেখি করবেন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একজন ভালো শিক্ষকের, কিন্তু পরিবারের সামনে একথা তোলাই অসম্ভব, তারা কোনোমতেই আলাদা গৃহশিক্ষক রেখে পড়ার অনুমতি দিবে না। 

কথায় আছে, সকল পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো না কোনো পথ খোলা থাকে। শর্ত একটাই, পথ বের করার তীব্র বাসনা থাকতে হবে। ওই মেয়ে ইংরেজিতে লেখালেখি করার উপায়-উপকরণ খুঁজছিলেন। এরই মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি বই তার হাতের নাগালে আসে। সেখানে লেখা ছিল : যদি আপনি মাতৃভাষার মতো ইংরেজি লিখতে চান, তাহলে প্রথমে কোনো ইংরেজিভাষীর লেখা একটি বই খুলুন। তারপর একটি অধ্যায় আপনি নিজ ভাষায় অনুবাদ করুন। এবার বইটি একপাশে রেখে দিয়ে সেই অনূদিত অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করুন। এরপর বই খুলে মিলিয়ে দেখুন মূল বইয়ের সাথে আপনার ইংরেজি কতটুকু মিল রাখে। এভাবে প্রতিদিন অনুশীলন চালিয়ে যান। আশা করি খুব দ্রুতই আপনি ইংরেজিভাষীর মতো ইংরেজি লিখতে পারবেন।

তিনি এই অংশটুকু পড়ে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এরপর রুটিন করে অনুশীলন চালিয়ে যান। ইংরেজি পত্রিকা কিংবা বই, যা-ই সামনে পেতেন, প্রতিদিন কিছু অংশ মাতৃভাষায় অনুবাদ করতেন, তারপর অনূদিত অংশ আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন। দুই অনুবাদে পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করে সংশোধনের চেষ্টা করতেন। এভাবে প্রায় দুই বৎসর পরিশ্রমের পর তার হাত একদম পাকা হয়ে যায়। তার ইংরেজি এত চোস্ত হয় যে তার লিখিত প্রবন্ধ নামী নামী ইংরেজি ম্যাগাজিনে ছাপতে শুরু করে। তার ভাই এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কাজ শুরু করেছিলেন, সেখানে ইংরেজিতে লেখালেখির কিছু ব্যাপার ছিল। মেয়েটি পুরো দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। এমনকি তার লেখার জাদুতে বিদেশিদের সাথে চুক্তি করা সহজ হয়ে যায়। 

উল্লিখিত শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষার ওপর যেই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে, যেকেনো ভাষার ওপরই এই এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব। সর্বক্ষেত্রেই আমি মনে করি সাফল্যের দেখে মিলবে।

আমাদের দুনিয়ার এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানে যেকোনো পদ্ধতিতেই সফল হওয়া সম্ভব। সফল হওয়ার পথ একম ও অদ্বিতীয়ম নয়, বরং এখানে হাজার হাজার পথ আছে। এক পথ বন্ধ হলেও অন্য পথ খোলা। একারণে পৃথিবীতে একমাত্র হিম্মতহারা লোকেরাই ব্যর্থ হয়, আর বুদ্ধিমান মানুষ ব্যর্থ হলেও সেই ব্যর্থতা থেকেও নতুন কোনো পথ খুঁজে বের করেন।


ভুল করুন, ভুল থেকে শিখুন

আহমদ ও ইকবাল একই শহরে বসবাস করতেন। আহমদ ছিলেন বিএ পাশ, আর ইকবাল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। একবার ইকবাল কোনো এক সরকারি অফিসে গিয়েছিলেন, ঘটনাক্রমে আহমদও সেখানে ছিলেন। আহমদ খেয়াল করে দেখলেন ইকবাল অনর্গল ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। অফিস থেকে বের হওয়ার পর আহমদ ইকবালকে বললেন, ‘তুমি একেবারে উলটাপালটা ইংরেজি বলছিলে, আমি তো জীবনেও এমন ভুলভাল বকার সাহস করব না।’ ইকবাল একথা শুনে মোটেও লজ্জা পেলেন না, বরং আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, ‘ভুল করছি যেন ভুল থেকে শিখতে পারি।’

ইকবাল এরপরে বললেন, ‘তুমি যদিও উচ্চশিক্ষিত, আর আমি ইশকুলের দেউড়ি পাড়ি দিতে পারিনি, তবু দেখো একদিন আমি বিশুদ্ধ ইংরেজি বলতে পারব, অন্যদিকে তুমি কিছুই পারবে না।’

এই ঘটনার পর বিশ বৎসর পার হয়ে গেছে। ইকবাল নিজের কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করেছেন, ইংরেজিতে তিনি এতই স্মার্ট যে তার কথায় এখন ভুল ধরা সম্ভব না। ওদিকে আহমদ ঠিক সেই অবস্থানেই আছেন, বিশ বছর আগে যেখানে ছিলেন। ইকবালের এই চ্যালেঞ্জ তাকে সৌভাগ্যবান ও সফল ব্যবসায়ী বানিয়ে তোলে। আগে শহরে তার ছোট্ট একটা দোকান ছিল, আর এখন তিনি বিশাল কারখানার মালিক। 

ইকবালের এই প্রচেষ্টা কেবল ভাষা শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয়, জীবনের সবকিছুর সাথেই এর সম্পর্ক। বর্তমান পৃথিবীতে এমন লোকই শুধু সফলকাম হন যিনি সুযোগকে কাজে লাগান, যিনি ভয়ডর ছাড়া কেবল সামনে এগিয়ে যান, যিনি বিপদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েই কদম ফেলেন। ভুল করতে করতেই মানুষ সঠিক কাজ করে। যিনি ভুল করতে ভয় পান,  তিনি কখনো সফল হতে পারবেন না। কারণ মঞ্জিলে মাকসুদের পথ কখনোই সরলরৈখিক নয়, এখানে পথ হারিয়েই আপনি পথ খুঁজে পাবেন।

সূত্র : রাযে হায়াত

[1]  Berdychiv—পরবর্তীতে পোল্যান্ড ও বর্তমানে ইউক্রেনের অংশ।


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই