চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

স্কুল



[এই গল্পটা Donald Barthelme-র ‘The School’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটা নেয়া হয় তার ‘সিক্সটি স্টোরিজ’ সংকলন থেকে যার বেশিরভাগ গল্প আগে দ্যা নিউ ইয়র্কারে ছাপা হইছিলো। বার্থলমেকে বেশিরভাগ ক্রিটিক পোস্টমডার্নিস্ট হিসেবে ক্লাসিফাই করেন। তিনি ফর্ম নিয়া প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী  তিনি হেমিংওয়ের স্টাইলে লেখা শুরু করেন কিন্তু ওগুলা তার বিচ্ছিরি লাগে। তার ভালো লাগে বেকেটের লেখা; আর তাই বেকেট যেমন লেখে অনেকটা জয়েসের বিপরীতে, উনার লিখতে হয় বেকেটের বিপরীতে। সেইখান থেকেই আমরা পাই উনার স্টাইলের বহুল আলোচিত ‘ফ্র্যাগমেন্টেশন’। স্কুল গল্পটা মনোলোগে লেখা। উনি কনশাসনেস নিয়া কাজ করছেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন এক্সপ্রেশন নিয়া। এই গল্পের ন্যারেটর ক্লোজ এবং কিছুটা লজ্জ্বিত। আমার মতে এই গল্পে হঠাৎ কইরা বাচ্চাদের বড় বড় দার্শনিক প্রশ্ন করা অ্যাবসার্ড। যেই অ্যাবসার্ডকে উনি আনছেন হঠাৎ ফর্মাল ল্যাঙ্গুয়েজে আনার মধ্যে দিয়া। মুড ও টেকনিকগত বিষয় অনুবাদে ধরার চেষ্টা করা হইছে।]

স্কুল 

মূলঃ ডোনাল্ড বার্থলমে

অনুবাদঃ মাসিয়াত জাহিন

তো, আমরা সব বাচ্চাদের দিয়ে গাছ লাগাইতেছিলাম, কারণ, আমরা ভাবছিলাম এটা তাদের শিক্ষার একটা অংশ; মানে বোঝেনই তো– মূলতন্ত্র নিয়ে জানা, দায়িত্বের বোধ, জিনিসপাতির যত্ন নেয়া, ব্যক্তিগতভাবে জিম্মেদার হওয়া ইত্যাদি। বুঝতেছেনই কি বলতেছি। তারপর গাছগুলা সব মারা গেল। ওগুলা ছিল কমলা গাছ। আমি জানিনা তারা কেন মারা গেছিলো, তারা জাস্ট মইরা গেল। মনে হয় মাটিতে কোন গণ্ডগোল ছিল বা নার্সারি থেকে যা আনছিলাম তা ভালো ছিল না। আমরা এটা নিয়ে অভিযোগ করছিলাম। তো আমাদের বাচ্চা ছিল তিরিশটা, যাদের নিজস্ব তিরিশটা চারা ছিল, আর আমরা এখন পাইলাম এই মরা তিরিশটা গাছ। একগাদা বাচ্চা খয়েরি রঙের মরা ডালের দিকে তাকায় আছে, দৃশ্যটা প্যাড়াদায়ক। 

এই ঘটনাটা এত বেশি বাজে হইতোনা যদিনা তার মাত্র সপ্তাহদুয়েক আগে সাপগুলা সব মারা না যাইতো। কিন্তু আমি মনে করি সাপগুলা- মানে সাপগুলার এই পরিণতি হইছিলো কারণ ধর্মঘটের কারণে বয়লার চারদিন বন্ধ ছিল, আর এইটা ব্যাখ্যাযোগ্য। এটা এমন কিছু যেটা আপনি বাচ্চাদেরকে বুঝায়ে বলতে পারবেন যে ধর্মঘটের কারণে হইছে। মানে কোন বাপমাই নিশ্চয় তাদের বাচ্চাদের পিকেট লাইন ক্রস করতে দিতো না আর তারা জানতো একটা স্ট্রাইক চলতেছে, আর এটা কি বোঝায়। তাই আবার যখন সব শুরু হইলো আর আমরা সাপগুলা মৃত পাইলাম, তারা খুব একটা ধাক্কা খায়নাই।

ভেষজ বাগানের ক্ষেত্রে মনে হয় অতিরিক্ত পানি দেয়া হইছিলো, অন্তত এখন তারা জানে বেশি পানি দেয়া ভাল না। বাচ্চাগুলা ভেষজ বাগান নিয়া খুবই বিবেকবান ছিল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভবত– যখন আমরা দেখতেছিলাম না, কিছু বেশি পানি ঢাইলা দিতো। অথবা– আমি মানে ভাবতে পছন্দ করিনা কেউ আমাদের সাথে এই নাশকতা চালাইছে, কিন্তু এটা আমাদের মনে আসছিলো। সম্ভবত আমরা এভাবে ভাবতেছিলাম কারণ এর আগে জার্বিলগুলা মারা গেলো, আর সাদা ইঁদুর, এরপর স্যালামান্ডার… যাক এখন তবুও তারা জানে এগুলারে প্লাস্টিক ব্যাগে নিয়া ঘুরতে হয়না। 

অবশ্যই আমরা ভাবছিলাম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছটা মারা যাবে, সেটাতে কেউই অবাক হয়নাই। এই জিনিসগুলা; আপনি তাদের দিকে বাঁকা কইরা তাকাবেন, আর তাতেই তারা পেট উল্টায় মইরা থাকবে। কিন্তু ওই সময় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ নিয়া শিক্ষা দেয়া সম্ভব ছিল না, প্রতিবছর হয়, দ্রুততার মধ্যে এই ঘটনাটা পার হয়ে যায়। 

তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “ওরা সবাই কই গেছে? গাছগুলা, স্যালামান্ডার, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, এডগার, আব্বা আম্মারা, ম্যাথু আর টনি, কই গেছে?” আমি বললাম, “আমি জানিনা, আমি জানিনা।” ওরা বললো, “কে জানে?” আমি বললাম, “কেউ জানেনা।” তারপর তারা বললো, “এটা কি মৃত্যু যা মানুষের জীবনকে অর্থ দেয়?” আমি বললাম, “না, এটা জীবন যেটা জীবনকে অর্থ দেয়।” তারপর তারা বললো, “কিন্তু মৃত্যুকে কি ভাবা হয়না সেই অপরিহার্য সত্য, যার মাধ্যমে প্রতিদিনের সাধারত্ব নিজেকে অতিক্রম করে আগায়ে যায় এমন দিকে—”

আমাদের আসলে কোন কুকুরের বাচ্চাও থাকার কথা ছিল না। 

আমাদের কোন কুকুরছানা থাকার কথা ছিলোনা; কিন্তু এটা ছিল এমন একটা বাচ্চা যেটা মার্ডকের মেয়ে গ্রিস্টিডিদের ট্রাকের নিচে কুড়ায় পাইছিলো। তার ভয় ছিল ড্রাইভার ডেলিভারি শেষ করার পর ট্রাক এটার উপর দিয়া চালায় দিবে। তাই এটা সে তার ব্যাগে ভইরা স্কুলে নিয়া আসলো। তো আমাদের তখন ছিল এই কুকুরের বাচ্চা। যখনই আমি এটাকে দেখছিলাম, আমি ভাবছিলাম, হায়রে খোদা! এটা নিশ্চয় শুধু দুই সপ্তাহ বাঁচবে আর তারপর.. আর আসলেই এটাই হইছিলো। এটার আসলে ক্লাসরুমেই থাকার কথা ছিলোনা, এসব নিয়া কি জানি নিয়ম আছে, কিন্তু আপনি তাদেরকে বলতে পারেন না তারা একটা কুকুরের বাচ্চা রাখতে পারবেনা যখন কুকুরের বাচ্চাটা ইতিমধ্যে সেখানে আছে। একদম তাদের সামনে, ফ্লোরের উপর, ইয়াপ ইয়াপ ইয়াপিং। তারা এটার নাম দিছিলো এডগার– এডগার, তারা এটারে আমার নামে নাম দিছিলো। তারা অনেক মজা পাইতো, এটার পিছে ছোটাছুটি করতে আর চিল্লাইতো, “এইযে এডগার! সোনা এডগার!” তারপর তারা কি যে হাসতো! তারা এই রহস্যময়তা পছন্দ করতো। আমি নিজেই পছন্দ করতাম। আমার বাচ্চামি করতে কোন সমস্যা নাই। তারা সাপ্লাইয়ের ঘরে ওর জন্য একটা ছোট্ট বাসা বানাইছিলো। আমি জানিনা সে কেমনে মারা গেছে। কুকুরদের ভাইরাল জ্বর বা কিছুতে। এটার হয়তো বাঁচার কোন সম্ভাবনাই ছিলোনা। আমি বাচ্চারা আসার আগে ওকে তার ঘর থেকে বের করছিলাম। আমি প্রতিদিন ওই কামরা চেক করতাম। আমি জানতাম কি হইতে যাইতেছে। আমি ওকে কাস্টডিয়ানের কাছে দিয়ে দিছিলাম। 

তারপর সেই এতিম কোরিয়ান বাচ্চা যাকে আমাদের ক্লাস এডপ্ট করছিলো ‘শিশুদের সাহায্য কর’ প্রোগ্রামের আওতায়। সব বাচ্চারা প্রতি মাসে ২৫ সেন্ট করে আনতো, এটা ছিল পরিকল্পনা আরকি। এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছিল, বাচ্চাটার নাম ছিল কিম আর আমরা হয়তো তাকে এডপ্ট করতে বেশি দেরি করে ফেলছিলাম বা এমন কিছু। তার মৃত্যুর কারণ চিঠিতে লেখা হয়নাই, তারা আমাদের সাজেস্ট করছিলো আমরা যাতে অন্য একটা বাচ্চা এডপ্ট করি এবং কিছু ইন্টারেস্টিং কেইস ও পাঠাইছিলো। কিন্তু আমাদের আর ওই বুকের পাটা ছিল না। বাচ্চারা জিনিসটা খুব বাজেভাবে নিছিলো, ওরা ভাবা শুরু করছিলো (যদিও ওরা আমাকে কেউ কিছু বলেনাই) হয়তো এই স্কুলের কোন সমস্যা আছে। কিন্তু আমি মনে করিনা এই স্কুলের আলাদাভাবে কোন সমস্যা আছে। আমি এর চেয়ে ভালোও দেখছি, খারাপও দেখছি। এটা ছিল একটা দুর্ভাগ্যের সিরিজ। যেমন, আমাদের একটা বিশাল সংখ্যক অভিভাবক মারা গেছিলো। মনে হয় দুইটা হার্ট এটাক, দুইটা সুইসাইড, একজন পানিতে ডুবে, চারজন একসাথে একটা কার এক্সিডেন্টে মারা গেছিলো। একটা ছিল স্ট্রোক। আর নানা-নানী-দাদা-দাদীদের সাধারণভাবে বড় একটা মৃত্যুহার তো আছেই। হয়তো এই বছর সেটা আরো বড় ছিল। এরপর অবশেষে সেই ট্র্যাজেডি। 

ট্র্যাজেডিটা হইছিলো যখন ম্যাথু উইন আর টনি ম্যাভ্রোগর্ডো নতুন ফেডারেল অফিস বিল্ডিং এর পাশে খেলতেছিলো, ওইখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলতেছিলো। গর্তের পাশে বড় কাঠের বিমগুলা একসাথে রাখা ছিল। এটা নিয়ে একটা কোর্ট কেইস আসতেছে, ওদের বাপ মা বলতেছে বিমগুলা ভালোমত জড়ো করে রাখা ছিলোনা। আমি জানিনা কি সত্য কি সত্য না। এই বছরটা অদ্ভুত। 

আমি বিলি ব্র্যান্টের বাপের কথা বলতে ভুলে গেছি। সেই লোক মারা গেছিলো ভয়ংকরভাবে, ছুরির আঘাতে, বাড়িতে ঢুকে পড়া অপরিচিত লোকটার সাথে কুস্তি করতে করতে। 

একদিন আমরা ক্লাসে একটা আলোচনা করলাম। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “ওরা সবাই কই গেছে? গাছগুলা, স্যালামান্ডার, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, এডগার, আব্বা আম্মারা, ম্যাথু আর টনি, কই গেছে?” আমি বললাম, “আমি জানিনা, আমি জানিনা।” ওরা বললো, “কে জানে?” আমি বললাম, “কেউ জানেনা।” তারপর তারা বললো, “এটা কি মৃত্যু যা মানুষের জীবনকে অর্থ দেয়?” আমি বললাম, “না, এটা জীবন যেটা জীবনকে অর্থ দেয়।” তারপর তারা বললো, “কিন্তু মৃত্যুকে কি ভাবা হয়না সেই অপরিহার্য সত্য, যার মাধ্যমে প্রতিদিনের সাধারত্ব নিজেকে অতিক্রম করে আগায়ে যায় এমন দিকে—”

আমি বললাম, “হ্যা, হয়তো।”

তারা বললো, “আমরা এটা পছন্দ করতেছি না।”

আমি বললাম, “যুক্তিযুক্ত।”

তারা বললো, “এটা জঘন্য বাজে!”

আমি বললাম, “হ্যা।”

তারা বললো, “আপনি কি এখন হেলেনকে (আমাদের সহকারী শিক্ষক) চু্মু খাবেন, আদর করবেন যাতে আমরা দেখতে পারি এটা কিভাবে করা হয়? আমরা জানি আপনি হেলেনকে পছন্দ করেন।”

আমি হেলেনকে পছন্দ করি কিন্তু আমি বললাম যে আমি করব না।

“আমরা এই ব্যাপারে এত শুনছি, কিন্তু কখনো দেখিনাই।”

আমি বললাম আমার চাকরি চলে যাবে আর এটা কখনোই, অথবা প্রায় কখনো, দেখানোর জন্য করা হয়না। হেলেন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

তারা বলছিলো, “প্লিজ প্লিজ হেলেনকে আদর করুন। আমাদের কোন অর্থপূর্ণ জিনিস দেখা দরকার। আমরা ভীত।”

আমি তাদেরকে বলছিলাম তাদের ভয় পাওয়া উচিত না (যদিও আমিও প্রায়ই পাই) এবং সবজায়গায় অর্থ ছড়া‍য় আছে। হেলেন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তাকে ভ্রুর উপর কয়েকবার চুমা খেলাম। আমরা একজন আরেকজনকে ধরে থাকলাম। বাচ্চারা খুশি হচ্ছিলো। তারপর দরজায় টোকা পড়লো, আমি দরজা খুললাম আর নতুন জার্বিলটা ঢুকলো। বাচ্চারা তীব্রভাবে উল্লাস করছিলো।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই