চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

জাদুর শহর

জাদুর শহর

মিলু হাসান



হাসমত  ঘামাচ্ছেন। বাহিরে বৃষ্টি, বাসার ভিতর  ফ্যান ছাড়া। তবুও দরদর করে ঘামাচ্ছেন৷ বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু টেনশনে ঘুম আসতাছে না৷ বিভিন্ন স্টাইলে শোয়ার চেষ্টা করেই গেলেন। ফল হলো না৷ রাতের বেলা হাসমতের পানির তৃষ্ণা পাবেই। এবারও পেলো। উঠে গিয়ে খাবার টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢাললেন। গ্লাসটা হাতে  নিতেই হাসমতের হাত কাঁপাকাঁপি  শুরু হলো। মনে হচ্ছে হাতকে কেন্দ্র করে ভূকম্পন হচ্ছে।টেনশন তীব্র হলে হাসমতের হাত কাঁপতে থাকে। ঠোঁটের কাছে গ্লাস নেয়ার আগেই অর্ধেক পানি নিচে পড়ে গেলো-- কাঁপাকাঁপিতে। 

সেই পানিতে স্লিপ খেয়ে পড়ে গেলেন হাসমত। ভাঙ্গলো গ্লাস।হাসমত জিহ্বায় কামড় বসালেন। না জানি সোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও এসে গ্রামের ঝগড়াটে মহিলাদের মতোন একগাদা আজেবাজে কথা শোনায়া যাবে। হাসমত বাঁচছে। সোমার ঘুম ভাঙ্গেনি। টেনশন তাড়াতে হাসমতের কাছে বড় অসুধ সিগারেট। বাসায় সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে কালাকানুন জারি করছে সোমা। সিগারেটের গন্ধে নাকি ওর নাড়িভুড়ি উল্টায়া আসে। হাসমত তাই যাইই লুকায়াচুকায়া সিগারেট খায় সব ব্যালকোনিতে। ব্যালকোনিতে বসে সিগারেট টানছে হাসমত। বৃষ্টির ছিঁটা এসে লাগছে তার গায়। এতো তুমুলভাবে বৃষ্টি পড়ছে মনে হচ্ছে আজকে রাতেই ডুবে যাবে ঢাকা শহর।অথচ হেমন্ত কাল শুরু হয়ে গেছে। এদেশের আবহাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা নাই কখন কী হবে কেউ জানে না৷  

হাসমত সিগারেট খেয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। টিভি ছাড়ে। নিউজ১২ এ খবর চলছে। খবর দেখতে ভালো লাগে হাসমতের। দেশের খোঁজখবর রাখা যায়। তবে আজকাল নিউজ দেখে সে হতাশ। যেনবা টিভি চ্যানেলের ইচ্ছা মানুষকে উদ্ভট সব খবর দেখানো। যেমন গতকাল সে দেখতেছিলো পঞ্চগড়ের এক গ্রামে পেঁপে গাছে লেবু ধরছে সে নিউজ বেশ জোরেশোরে প্রচার করছে কয়েকটা চ্যানেল। তার আগের দিন দেখলো জয়া আহসান একদিনে চারটি ফজলী আম খেয়েছেন - সে নিউজ। তবে এখন হুট করে একটা  খবর দেখে হাসমত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। খবরে দেখছে হাসমতকে নিরাপত্তাকর্মীরা ধরে নিয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছে একের পর এক। নিরাপত্তাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনে প্রধান একেএম মফিউ খান তার জবাব দিছেন একের পর এক। এতটুক দেখার পর হাসমত টিভি বন্ধ করে নিজেকে চিমটি কাটতে থাকে। বাথরুমের আয়নায় নিজেরে চেহারা দেখে। এবং আশ্বস্ত হয় যে সেই হাসমত এবং সে ঘরেই আছে। তবুও নিজেকে নিয়ে কেমন জানি সে কনফিউজড হয়ে যায়। 

হাসমত টিভি বন্ধ করে বিছানায় যায়। সাড়ে পাঁচটা বাজে। দশটায় অফিস। ঘুমাবে কী ঘুমাবে না বুঝতে পারছে না। আবার ঘুমের কামড়ে হাসমত ধরাশায়ী। চোখ বুজে আসছে। ঘুমের অতল গহীনে হারিয়ে গেলো হাসমত। স্বপ্নের মধ্যে দেখছে কারা যেন তার ভাড়া ফ্লাটের দরজায় সজোরে লাথি মারছে আর দরজা খুলতে বলছে। সোমা দরজার ছোট গোল লুকিং গ্লাসে দেখছে একদল শাদা পোশাকের লোক। তারা দরজা ভেঙ্গে হাসমতকে এক হেঁচকা টানে ঘুম থেকে উঠালো। হাসমত ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠে বসে পড়লো। চিৎকার করলো৷  রান্নাঘরে রুটি বেলতেছিলো সোমা। চিৎকার শুনে দৌড়ে  এসে বললো - কী হইছে তোমার? পানি খাও। হাসমতের বিছানার পাশে সবসময় এক বোতল পানি থাকে। হাসমত বোতলের ক্যাপ খুলে ডগডগ করে পানি খেলো। সোমা তার ওড়না দিয়া হাসমতের কপালের ঘাম মুছে দিলো।

-অফিস যাবে না?

-যাবো তো। কয়টা বাজে।

-নয়টা দশ৷

-কী বলো৷ তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার দাও। আমি ফ্রেশ হইয়া আসতাছি। 

আজকে এক আচানক বিষয় ঘটলো। বিজয় স্মরণীতে কোনো জ্যাম হলো না। কী যে এক ভয়াবহ খুশি হলো হাসমত৷ সে যখন এসএসসির পরীক্ষায় বোর্ড স্ট্যাণ্ড করছিলো তখন সে এরকম খুশি হয়েছিলো। তাও মেলা আগের কথা৷ কারওয়ান বাজার আসতেই বাস খালি হলো। সে ভিতরে গিয়া দাঁড়ানোর সুযোগ পেলো। তার মতোন আরো অনেকে দাঁড়ায়া আছে। সবার মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। কোল্ডওয়ার। কীভাবে একটা সিট খালি হলে অন্য সকলকে ফাঁকি দিয়া হুট করে বসে পড়বে। সে যুদ্ধে হাসমত হারলো। 

হাসমত তড়িঘড়ি করে গোসল করে নাস্তা সেরে বাসার নিচে নামে। নেমে সে অবাক হয়। রাস্তা তো বঙ্গোপসাগর হয়ে আছে-- সারারাতের বৃষ্টিতে। হাসমত আশেপাশে কোনো রিকশা দেখতাছে না। এদিকে অফিসেও লেট হয়ে যাচ্ছে। কী যে করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর সে  দেখলো দুটো ডিঙি নৌকা আসছে। বিশ টাকা রিকশা ভাড়া নৌকাতে হয়ে গেছে পঞ্চাশ। হাসমত নৌকায় উঠলো। এতো ভাববার টাইম নাই। নিরুপায়। অফিস আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে।ডিঙি নৌকা এক নড়বড়ে বস্তু। যে কোনো লোক উঠলেই এক কাত হয়ে ডুবুডুবু হয়ে যায়। মানে অল্পের জন্য ডুবলো না টাইপ। যতক্ষণ না অবধি সবাই ভারসাম্য বজায় রেখে বসছে। হাসমত উঠার পরও একই ঘটনা ঘটলো৷ কেমন জানি জাদু জাদু লাগছে তার কাছে৷ গতকাল এ রাস্তা দিয়া রিকশা চলেছে। এখন চলছে নৌকা। মাঝির চেহারা চিনতে পারলো হাসমত৷ পরিচিত রিকশাওয়ালা। প্রশ্ন কইরা জানতে পারলো এ বুদ্ধি রিকশার মহাজনের৷ কোমর পানি সমান রাস্তায় রিকশা চালানো যেমন কষ্টকর তেমনি পানিতে রিকশা চালাইলে অটো রিকশার ইঞ্জিনে ডিস্টার্ব মারে৷ তাই রিকশার মহাজন পাঁচটা ডিঙি নৌকা আগেই কিনে রাখছে। বৃষ্টি নামালে রিকশাওয়ালারা এটা চালাবে৷ যাত্রীও বেশি বসতে পারবে, ভাড়াও বেশি। লাভের উপর লাভ। 

কিছুদূর আসতেই হাসমত এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখলো। উপরের কারেন্টের তার ছিঁড়ে এক মাঝির গায়ে পড়েছে। কারেন্টের শক খেয়ে নৌকার উপর সে মরে আছে। তার চোখ উল্টানো, মুখ খোলা, আকাশের দিকে চাওয়া, চেহারা অচিহ্নিত, কারেন্টের শকে বডি পুড়ে গেছে৷ কোনোরকমে হাসমতের নৌকার মাঝি সে জায়গাটা পার হলো। সবাই এক পলক অবাক হয়ে আবার স্বাভাবিক হলো। যেনবা কিছুই ঘটেনি। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে হাসমতের মনে হলো গত সপ্তাহে তাদের পাশের ফ্লাটের রবিন ভাইয়ের বারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে ম্যানহোলের গর্তে পড়ে মারা গেছে। রাস্তায় কনস্ট্রাকশন কাজ চলতেছিলো৷ পুরো রাস্তা খুঁড়ে পানির লাইন, গ্যাসের লাইন থেকে ধরে সব খোদাই করা হচ্ছিলো৷ খানাখন্দে ভরা। একটু অসতর্ক হলেই বিশাল গর্তে পড়ে যাবে তার নিচে ময়লা পানি আর সারা দুনিয়ার সব গার্বেজ। মেয়েটা গর্তে পড়ে গেছিলো পা ফসকায়া, সাঁতার জানতো না। রাস্তায় তখন কেউ ছিলো না।মেয়েটার কথা মনে হলেই হাসমতের শুধু একটা কথাই মনে পড়ে। সিঁড়ি দিয়া উঠতে নামতে মেয়েটা সুন্দর করে সালাম দিতো। তারপর বলতো কেমন আছেন আঙ্কেল? 

যাই হোক সকলের গন্তব্য স্থলে যাওয়াই মঞ্জিলে মাকসুদ। অবশেষে হাসমত বাস স্ট্যাণ্ডে এসে পৌঁছলো। 

হাসমত জানপরান হাতে নিয়া একটা লোকাল বাসে উঠে। আর একটু হলে সে পড়ে গিয়া মরতো। গেটের কাছে এক পা রেখে এক হাতে ধরে সে অফিস যাচ্ছে। চল্লিশ মিনিট পরে একটা বাস আসছে৷ বৃষ্টির দিনে বাসগুলি কই যেন উধাও হয়ে যায়। এ বাসে না উঠতে পারলে আবার কখন যে বাস আসবে কে জানে। নিরুপায়। উঠতেই হলো। আজকে এক আচানক বিষয় ঘটলো। বিজয় স্মরণীতে কোনো জ্যাম হলো না। কী যে এক ভয়াবহ খুশি হলো হাসমত৷ সে যখন এসএসসির পরীক্ষায় বোর্ড স্ট্যাণ্ড করছিলো তখন সে এরকম খুশি হয়েছিলো। তাও মেলা আগের কথা৷ কারওয়ান বাজার আসতেই বাস খালি হলো। সে ভিতরে গিয়া দাঁড়ানোর সুযোগ পেলো। তার মতোন আরো অনেকে দাঁড়ায়া আছে। সবার মধ্যে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। কোল্ডওয়ার। কীভাবে একটা সিট খালি হলে অন্য সকলকে ফাঁকি দিয়া হুট করে বসে পড়বে। সে যুদ্ধে হাসমত হারলো। সে যে সিটের পাশে দাঁড়াইছে সে সিট খালি হলে সে যখন বসতে যাবে পিছন থেকে একজন তাকে হালকা ধাক্কা দিয়া আগে আগে বসে পড়লো। 

সে রাগী রাগী চেহারায় লোকটার দিকে তাকালো, সে দেখলো  সুটবুট পরা ভদ্রলোক চেহারার গোছের অথচ বদমাশ। লোকটার দিকে রাগী রাগী লুক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। তার এ হাসা দেখে মনে হলো সে মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতি বাবরকে হারিয়ে রাজসিংহাসন দখল করেছে৷ হাসমত কিছু বলতে গিয়াও বললো না। এসব লোকের সঙ্গে কথা বলাও তার কাছে কথা-সময়ের অপচয় মনে হলো। হাসমত শাহবাগ এসে বসার সুযোগ পেলো৷ তখন নামলো আবারও বৃষ্টি। লোকাল বাস কাবেরীর ছাদ খোলা। ওই ফাঁক দিয়া বৃষ্টি পড়তাছে। ছাদের ঢাকনা নাই। আর ওই বৃষ্টির মধ্যে এক পিচ্চি মেয়ে নাচতে নাচতে ভিজছে। কারো কারো কাছে দৃশ্যটা সুন্দরই লাগছে। সুন্দর দৃশ্য অসুন্দর হতে সময় লাগলো না। হুট করে ব্রেক কষায় পিচ্চি মেয়েটা বাসের দরজার কাছাকাছি গিয়া পড়লো। বারি খেয়ে মাথাটা টোম হয়ে গেছে। ভাগ্যিস দরজায় হেল্পপার দাঁড়ানো ছিলো। না হলে বাসের বাহিরেই চলে যেতো। পিচ্চি মেয়েটির বাপমা এ ঘটনায় হতবাক হয়ে গেলো। মেয়েটি গগনবিদারী চিৎকার করা শুরু করলো পুরো বাসে। চারোপাশের গাড়ির হর্ণ বিবিধ শব্দের আওয়াজে সে কান্না কারো হৃদয় স্পর্শ করলো না। মেয়েটির বাবা আর মা ছাড়া আর কেউ বাপের ড্রাইভারকে কিছু বললো না। বাকিরা নিশ্চুপ। 

এক বুড়ো লোক তো বলেই ফেললো- দোষ তো আপনাগো। বাসে কি বৃষ্টির মইধ্যে নাচ দেয়ার জায়গা। বুড়া লোকের কথা শুনে হাসমত খেপে গেলো। কথাকাটাকাটি থেকে যেন হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যাবে যাবে ভাব। এদিকে হাসমত যেখানে বসছে জানালার পাশে, সে জানালার কাচ ভাঙ্গা। বৃষ্টির পানিতে তার শার্টের এক পাশ ভিজে গেছে। হাসমত যে উঠে দাঁড়াবো সে ইচ্ছা আর হলো না। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়ায়া থেকে আবার দাঁড়াতে ইচ্ছা করতাছে না। মন চাইতাছে বাস মালিককে খুঁজে বের করে হাসমত এক বেলা জুতাপেটা করে৷ সে ইচ্ছাটা সে গিলে ফেললো। এর মধ্যে ঘটলো আরেক কাণ্ড। এক লোক ২ টাকা ভাড়া কম দেয়ায় হেল্পপার তার লগে বাজে বিহেভ করলো। এ দোষ যে হেল্পারের এরকম না। দোষটা যাত্রী ও হেল্পারের ইগোর। যাত্রী অবশেষে নত স্বীকার করলো তার কাছে ২ টাকা কম আছে। এ নত স্বীকারের পর হেল্পার যেন ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ান থেকে ফেরত এসে আবার ক্রিজে নেমে ছক্কা হাঁকালো৷: ২ টাকা নাই আবার মুরোদ চোদাস, মাদারচোদ। বাসে উঠছোছ কেন তুই। এ ঘটনা ঘটলো যখন হাসমত বাস থেকে নেমে যাবে মৎস্য ভবনে। হেল্পপারকে হাসমত বাস থেকে নেমে যাবার পথে  ডেকে ২ টাকা দিয়া সজোরে একটা ঘুষি দিলো মুখে। হেল্পার হাসমতের  মুখে দিলো একটা ঘুষি। ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে হাসমতের। আর বাস চলে যাচ্ছে সামনের রাস্তায়। 

হাসমত অফিসের দিকে হাঁটছে। মৎস্য ভবন থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। শিল্পকলা একাডেমির রাস্তার সামনে কিছু কিছু জায়গায় খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। সেই খানাখন্দে জমে আছে বৃষ্টির পানি। কালো রঙের ভিআইপি বেশের একটা গাড়ি সাঁ সাঁ করে যাওয়ার পথে হাসমতের শাদা শার্টে কাদা ছিটিয়ে গেলো। হাসমত ইংরাজি বাংলা মিলায়া কয়েকটা মারাত্মক বিচ্ছিরি গালি দিলো এবং সাহস থাকলে গাড়িটা থামা এটাও বললো। একটু আগে যে বৃষ্টি হয়েছে তা বুঝার উপায় নাই৷ এখন কাঠফাটা রোদ। যে পানিমিশ্রিত কাদা তার গায়ে লাগলো তাতে তার মনে হলো উত্তপ্ত  গরম পানি গায়ে পড়ছে। গাড়িটা হালকা করে সামনে থেমে কালো গাড়ির গ্লাস থেকে একজন বন্দুকবাহী লোক হাসমতকে কষে থাপ্পড় দিয়া গাড়িতে উঠে চলে গেলো। হাসমত হতভম্ব হয়ে দাঁড়ায়া রইলো। কী ঘটলো তা বুঝে উঠতে পারলো না। তার আগেই গাড়ি শিল্পকলার মোড় দিয়া বাঁক নিলো৷ আর হাসমত রাস্তাতেই দাঁড়ায়া থাকলো। একটু পর হাসমতের সম্বিৎ ফিরে এলো রিকশার টুনটুন আওয়াজে। রিকশাওয়ালা তারে বললো- বয়রা লোকজন কোথায় থেইকা যে এ শহরে আসে। 

হাসমত অফিসের গেট পার হয়। দারোয়ান তাকে সালাম দিলো না। হাসমত অবাকই হয়। গত আট বছর ধরে চাকরি করছে হাসমত এ অফিসে৷ দারোয়ান  তাকে দেখলেই হাসিমুখে একটা সালাম দেয়, জিজ্ঞাসা করে কেমন আছেন স্যার? পরিবারের হগলে ভালা তো? হাসমতের কেমন জানি লাগলো বিষয়টা৷ 

সিঁড়ি দিয়া উঠার পথে পিয়ন আজমত তাকে বললো- হাসমত তোরে বড় স্যার ডাকে। 

হাসমত আকাশ থেকে পড়লো, আজমত তাকে কখনো তুইতোকারি করে না। আপনি ছাড়া আর স্যার ছাড়া সে কথাই বলে না। সে আজমত তাকে তুইতোকারি করছে। কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে তার মনে হচ্ছে। চেনা অফিস তার কাছে অচেনা ঠেকছে। হাসমত বড় স্যার ড.আবুল খায়ের মহিউদ্দিনের রুমে গেলো

-স্যার আসতে পারি। 

-আসুন, হাসমত সাহেব। 

-মন্ত্রণালয় থেকে আপনার জন্য জরুরি একটা নোটিশ আসছে। নেন এটা। আপনার আজকে আর অফিস করতে হবে না , বাসায় চলে যান, রেস্ট করেন। 

হাসমত কী বলবে বুঝতে পারছে না। খামটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে হাসমত অফিস ত্যাগ করলো। 

হাসমত অফিস থেকে বের হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে আছে সেই মধ্য দুপুর থেকে। হাসমত খামটা বের করলো৷ ৷ নোটিশে যা লেখা তার সামারি এই হাসমতকে চাকরি থেকে বরখাস্ত  করা হয়েছে৷ কারণ হচ্ছে গতরাত ১১:৫৭ মিনিটে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের বিধিমালা অমান্য করে কর্তৃপক্ষদ্রোহী অপরাধ করেছে। তার মনে পড়তে থাকলো গতকাল রাতের কথা। হাসমত গতকাল রাতে ফেসবুকে একটা স্টেস্টাস দিয়েছিলো এক বাক্যের- কিছু লোক এতো তেল মারে সেজন্য বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। স্টেস্টাসটিতে রিয়েকশন পড়ছে ১৮৭ টা। কমেন্ট ৩০ টা। শেয়ার পাঁচটা। আহামরি কিছু না। হাসমত আসলে এ স্টেস্টাসে দুভাবে ধরাশায়ী হইছে। 

এক, হাসমতের তেলমারা বড় পদের কলিগরা ভাবছে তাদেরকে হাসমত স্যাটায়ার করে এ স্টেস্টাস দিছে। দুই, কর্তৃপক্ষ ভাবছে তেলের দাম যে বেশি এটা সে একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে লেখলো কীভাবে। এটা একটা বড় অপরাধ। হাসমতের মাথা ঝিমঝিম করছে। সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটা বেঞ্চে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে বসে দেখে তার পকেটের মোবাইল, মানিব্যাগ উধাও। 

হাসমত শাহবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তার বুক পকেটে নোটিশের চিঠি ছাড়া কিছুই নেই। নিরুপায় হয়ে সে হাঁটা ধরছে৷ ভাড়া নাই এছাড়া আর কী উপায়। হাসমত হাঁটতে হাঁটছে ভাবছে কালকে রাতের স্টেস্টাসটা কেটে দিলেই ভালো হতো।কেন যে কেটে দিলাম না। হাসমত হাঁটছে আর মাগরিবের আজান হচ্ছে। চারোদিক তার জীবনের মতোন অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আবার বৃষ্টি নামলো। হাসমত ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলো। বুকপকেটে তার নোটিশটা ভিজে যাচ্ছে৷ ভিজছে তার শার্ট, প্যান্ট আর সমস্ত শরীর। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তার যে কোথাও আশ্রয় নেয়া দরকার সে দিকটা তোয়াক্কাই করছে না সে। হাঁটতে হাঁটতে হাসমত যখন শ্যাওড়াপাড়া ওভারব্রীজ পার হয়ে এবার থেকে ওপারে যাবে তখন সে আবার ছিনতাইয়ের স্বীকার হলো। বৃষ্টির দিন তেমন লোকজন নেই রাস্তাঘাটে৷ ছিনতাইকারীরা তার কাছে একটা খাম ছাড়া কিছু পেলো না। তারা ভেবেছিলো  খামে হয়তো টাকা আছে৷ তার সামনে খামটি খুলে দেখে কাগজ। তাই তাদের একজন রাগে তাকে ছুরি দিয়া ঘাঁই মারতে গেলে হাসমত হাত দিয়া ধরে ;তারপর তারা কেটে পড়ে। হাসমত বাসার দিকে হাঁটছে। তার হাত থেকে যেমন ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে ঠিক তেমনি রক্ত ঝরছে তার হৃদয় থেকেও। সে রক্ত কেউ দেখছে না। হাত কাটার রক্ত হৃদয় কাটার রক্তের কাছে কোনো অংশেই কম না। হাসমত বাসায় গিয়ে সোমাকে কী বলবে তা ভাবছে৷ তার মাথা কাজ করছে না। কেমন জানি ব্লাক হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে যদি তাকে আর কখনো বাসায় যেতে না হতো - বড়ই ভালো হতো। 

আজকে আবার  চাঁদ উঠেছে।  খাবলা খাবলা কালো-শাদা মেঘের ঘুরাঘুরিতে চাঁদের চেহারা এই দেখা যায়, আবার এই নাই; মনে হচ্ছে ঘরের কোণ থেকে একজন সুন্দরী এই  উঁকি দিছে আবার এই মুখ আড়ালে লুকাচ্ছে। মোল্লা রোডের মোড় থেকে চার-পাঁচজন শাদা পোশাকের লোককে আসতে দেখা যাচ্ছে। তারা তড়িৎ গতিতে এগুচ্ছে৷ তাদের চেহারা আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট। তারা মোড় পার হতেই মোড়ের ন্যাড়া কুত্তাগুলি ঘেউঘেউ করে উঠলো। মোড়ের ন্যাড়া কুত্তার দল অচেনা কাউকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে সারা মহল্লা মাথায় তুলবে। মৃদু বাতাসে একটা পলিথিন উড়ে পায়ের সামনে পড়লে সামনে থাকা একজন পলিথিনটাকে কিক মারলো; মনে হচ্ছে পলিথিন না ফুটবল। একজনের হাতে সিগারেটের আগুন, এতটুক বোঝার বাহিরে আর কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কিন্তু তারা হাসমতের কাছে আসার পরই ঘটে গেল অদ্ভুত জাদুময় ঘটনাটা- উধাও হয়ে গেলো হাসমত। 

সোমা প্রতিদিনই দরজার সামনে টুল নিয়ে বসে থাকে সন্ধ্যা সাতটা থেকে। এই বুঝি অফিসফেরত হাসমত আসবে আর কলিংবেল বাজালেই সে দরজা খুলে দেবে। কিছু কিছু অপেক্ষার ভার উহূদ পাহাড়ের চে বেশি ভারী। সেরকম একটা ভার বুকে নিয়ে সোমা অপেক্ষা করে। সোমার অপেক্ষার পালা কবে ফুরাবে আদৌ ফুরাবে কী না কোনোদিন কেউ জানে না। প্লিজ কেউ যদি হাসমতের কোনো খোঁজখবর জানেন সোমাকে খবরটা দিয়েন৷ 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই